অষ্টম পরিচ্ছেদ : ইসলামী সমাজের সদস্যদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক
‘একজন মুসলিমের নিকট আল্লাহর জন্য, তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য এবং মুমিনদের জন্য মৈত্রী একটি সুদৃঢ় আক্বীদা ও প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি। তিনি কোনো দল, কোনো জমায়েত, কোনো স্বার্থ, কোনো লক্ষ্য বা কোনো পথের উপর ভিত্তি করে বন্ধুত্ব করতে পারেন না, যা কিনা মহান আল্লাহর নিম্নবর্ণিত বাণীর পরিপন্থী :﴿إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا﴾ ‘তোমাদের বন্ধু কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ’ (আল-মায়েদাহ, ৫/৫৫)।
অতএব, কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া মুসলিমদের এমন কোনো লিখিত চুক্তির বা সীলমারা কোনো অঙ্গীকারনামার বা কোনো মানহাজের দরকার নেই, যেখানে এই মূলনীতিটি উল্লিখিত থাকবে।
কোনো মুসলিমের জন্য এই অধিকার নেই যে, তিনি কোনো দল বা জমায়েতের উপর ভিত্তি করে মিত্রতা বা শত্রুতা পোষণ করবেন অথবা মনে করবেন যে, হক্ব তার দলের সূত্রেই আসে আর অন্যদের মধ্যে পাওয়া যায় বাতিল’।[1]
‘পার্থিব জীবনে মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারটিকে বিধানদাতা আল্লাহ দলবাজদের জন্য অবজ্ঞার পাত্র ও চারণক্ষেত্র হিসেবে ছেড়ে দেননি যে, আল্লাহ যে সম্পর্ক জোড়া দিতে বলেছেন, তা তারা ছিন্ন করবে’।[2]
অতএব, মযবূত সম্পর্ক মানেই হচ্ছে, ‘সর্বদা ইসলামী মানহাজ মেনে চলা, যা আল্লাহ বিধান হিসেবে দিয়েছেন এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর জীবদ্দশায় উত্তম নমুনা হিসেবে বাস্তবায়িত হয়েছে। এটাই মাপকাঠি। ভালো সম্পর্ক মানে ব্যক্তি, জামা‘আত, মাযহাব, দল বা শাসন মেনে চলার নাম নয়।
এই মাপকাঠি থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কারণে বা মুসলিমদের হাত থেকে এটিকে ছিনিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টার কারণেই ইসলামী জীবনাদর্শে নানা দোষত্রুটি ও রোগ-ব্যাধি ঢুকে পড়েছে। …এভাবেই মিথ্যা সম্পর্ক তৈরি হয়, যা কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য দাবি করা হয়। তৈরি হয় হাস্যকর ও ক্রন্দনোদ্দীপক সব ছুতো, যেগুলো তাদের কাজকর্ম ও ভুলভাল চালিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতকৃত; অথচ সেগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজের সাথে সাংঘর্ষিক।
এখান থেকেই শুরু হয় অধঃপতনের। কারণ তখন ইসলামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও মহান রবপ্রদত্ত মূল্যবোধের খেদমত না করে বরং সেগুলোকে নিজেদের খেদমতে ব্যবহার করা শুরু হয়। কবি যথার্থই বলেছেন (গদ্যানুবাদ), ‘আমি শীঘ্রই প্রচার করতে চাই যে, দলাদলি হারাম। হায়! আমাদের উম্মতের জন্য দুর্ভোগ যে, ইসলাম সংগঠনের খেদমত করছে’।
আর এ সময়েই ব্যক্তি বিশেষের উপর হুকুম-আহকামের প্রয়োগ শুরু হয়, নানা ছলচাতুরী মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়, এমনকি সেগুলো লিখিত আকারে তৈরি হয়ে যায়!
যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য তার ভাইদেরকে ভালোবাসে, তার এধারণা করা সমীচীন নয় যে, মানহাজ অনুসরণের দিকে আহ্বান এবং কোনো ব্যক্তি, প্রতীক ও লেবেলের অনুসরণ বর্জনের আহ্বান মানেই বিভক্তির দিকে ফিরে যাওয়া এবং কোনো ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাকে ওলটপালট করা!
মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ক এই মূলনীতি কিন্তু ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নয়। বরং তা মুসলিম সমাজের চলার পথকে পরিশুদ্ধ করার নাম, মানবজীবনে একনায়কতন্ত্রকে রদ করার নাম এবং ইসলাম মেনে চলার নাম, যার প্রতি মহান আল্লাহ দ্বীন হিসেবে সন্তুষ্ট এবং যে ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পেশ করেছেন’।[3]
‘মোদ্দাকথা, প্রকৃত যে সম্পর্ক বিভক্তকে যুক্ত করতে পারে, বিরোধপূর্ণকে জোড়া লাগাতে পারে, তা হচ্ছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর সম্পর্ক। এটি এমন একটি সম্পর্ক, যা গোটা ইসলামী সমাজকে একটি দেহে পরিণত করতে পারে; গোটা ইসলামী সমাজকে একটি ইমারতের মতো করে দিতে পারে, যার একাংশ অপরাংশের সাথে মযবূতভাবে গাঁথা। অতএব, এর বাইরে অন্য কোনো সম্পর্কের দিকে ডাকা কস্মিনকালেও বৈধ নয়’।[4]
এসবই ‘ইসলামের সৌন্দর্য হিসেবে ধর্তব্য। কারণ তা সামাজিক জীবনকে সুচারুরূপে সংগঠিত করেছে, মুমিনদেরকে ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বেঁধেছে, তাদের উপর পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পর্কের এমন অধিকার ধার্য করেছে, যা তাদের সামাজিক ঐক্যের নিশ্চয়তা দিতে পারে এবং মানবরচিত যাবতীয় দলীয় সম্পর্কের পথে অন্তরায় হতে পারে। এই সম্পর্ক ইসলাম এমনভাবে স্থাপন করেছে যে, এরপরে ইসলামের ছায়াতলে অন্য কোনো সম্পর্কের প্রয়োজন পড়বে না। মহান আল্লাহ এই সুদৃঢ় সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেন,﴿وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ﴾ ‘আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী পরস্পর পরস্পরের বন্ধু’ (আত-তাওবাহ, ৯/৭১)। তিনি আরো বলেন, ﴿إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ﴾ ‘কেবল মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১০)।
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ঈমানী সম্পর্কের প্রতি জোর দিয়েছেন, এর মর্যাদাকে উঁচু করে দেখিয়েছেন এবং এর উপর ভিত্তি করে যেসব অধিকার ও শিষ্টাচার বর্তায়, তার বিবরণ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,الْمُسْلِمُونَ تَتَكَافَأُ دِمَاؤُهُمْ، يَسْعَى بِذِمَّتِهِمْ أَدْنَاهُمْ، وَهُمْ يَدٌ عَلَى مَنْ سِوَاهُمْ ‘সকল মুসলিমের রক্ত সমান। একজন সাধারণ মুসলিমও যে কোনো ব্যক্তিকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলে তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা সকলের কর্তব্যে পরিণত হয়। তারা বিজাতীয় শত্রুর বিরুদ্ধে একটি হাতস্বরূপ (একতাবদ্ধ)’।[5] তিনি আরো বলেন,تَرَى المُؤْمِنِينَ فِي تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ، كَمَثَلِ الجَسَدِ، إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالحُمَّى ‘আপনি মুমিনগণকে তাদের পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে একটি দেহের মতো দেখবেন। যখন দেহের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন সারা শরীর এর কারণে রাত্রি জাগরণ ও জ্বরের মাধ্যমে ঐ ব্যথার অংশীদার হয়’।[6] তিনি আরো বলেন,الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا ‘একজন মুমিন অপর মুমিনের জন্য একটি ইমারতের মতো, যার একাংশ অপরাংশের সাথে মযবূতভাবে গাঁথা’।[7]
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের অধিকারের ব্যাপারে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন এবং ইসলাম তাদের পরস্পরের মধ্যে যে সম্পর্ক ও সহযোগিতা অপরিহার্য করেছে, সেগুলোর মধ্যে উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদীছগুলো কয়েকটি নমুনা মাত্র।
এই বন্ধুত্বই মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি।
এই সম্পর্ক বাস্তবায়ন করা মানেই হচ্ছে জামা‘আতবদ্ধ থাকা। আর এই সম্পর্ক থেকে সরে যাওয়া মানেই হচ্ছে ইসলামী ব্যবস্থাপনার গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং জাহেলী বিভেদের দিকে ফিরে যাওয়া, যা জাতি, গোত্র, ভাষা, মাতৃভূমি ইত্যাদির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। একারণে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন যে, জামা‘আত থেকে বের হওয়ার অর্থই হচ্ছে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং সেই অবস্থায় মৃত্যুবরণ মানেই জাহেলিয়্যাতের উপর মৃত্যুবরণ’।[8]
জামা‘আতবদ্ধ থাকার ব্যাপারে বর্ণিত সেই হাদীছগুলো কী কী?
জামা‘আত দ্বারা উদ্দেশ্যই-বা কী?
‘মুসলিমদের জামা‘আতসমূহ’ (جَمَاعَاتُ الْمُسْلِمِيْنَ) এবং ‘মুসলিমদের জামা‘আত’ (جَمَاعَةُ الْمُسْلِمِيْنَ)-এর মধ্যে কী পার্থক্য?
উভয়ের সূত্রগুলোই-বা কী?
(চলবে)
মূল : আলী ইবনে হাসান আল-হালাবী আল-আছারী
অনুবাদ : আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী
বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. আয়েয আল-ক্বরনী, আল-হারাকাতুল ইসলামিয়্যাহ আল-মু‘আছেরাহ, পৃ. ১০।
[2]. আত-ত্বলী‘আহ ফী বারাআতি আহলিস সুন্নাহ, পৃ. ১৫।
[3]. সালীম আল-হেলালী, হালাওয়াতুল ঈমান, পৃ. ৫২-৫৩।
[4]. আল্লামা মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতী, আযওয়াউল বায়ান, ৩/৪৪৭-৪৪৮ (ঈষৎ পরিমার্জিত)।
[5]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, হা/২৭৯৬৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হা/২৬৮৩; সুনানে আবূ দাঊদ, হা/২৭৫১, হাসান-ছহীহ।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০১১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮৬।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৮১, ২৪৪৬ ও ৬০২৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮৫।
[8]. আল-আহযাব আস-সিয়াসিয়্যাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ৪৩-৪৪ (সংক্ষেপিত)।