কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কুরবানীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: গুরুত্ব ও মর্যাদা

post title will place here

যিলহজ্জ মাস হলো হিজরী সনের দ্বাদশ মাস এবং সর্বশেষ মাস। এ মাসেই রয়েছে বিত্তবানদের ওপর ফরয হজ্জ এবং মানব ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ঘটনা তথা আপন সন্তানকে কুরবানী করার ইতিহাস।

কুরবানীকে আরবী ভাষায় ‘উযহিয়্যাহ’ বলা হয়। এর অর্থ হলো ওই পশু, যা কুরবানীর দিন যবেহ করা হয়। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু যবেহ করাই কুরবানী। ঈদুল আযহা মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। দেখতে দেখতেই কুরবানীর ঈদ আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়ছে। ইসলামে কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর কুরবানী করা তাকিদপূর্ণ সুন্নাহ। উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ভেড়া ও ছাগল দ্বারা কুরবানী করতে হবে। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার কমপক্ষে এক বছর পূর্ণ হতে হবে; গরু-মহিষের দুই বছর পূর্ণ হতে হবে; উটের পাঁচ বছর পূর্ণ হতে হবে।[1] এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন- হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নেই। তদ্রূপ হাঁস-মুরগি বা কোনো পাখি দ্বারাও কুরবানী জায়েয নেই।[2] যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে পালিত হয় এ উৎসব। কুরবানী শব্দটির অর্থ নৈকট্য অর্জন করা। মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টি ও মানবকল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করাই মূলত ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদের তাৎপর্য। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-কে কুরবানী করার প্রস্তুতি নিয়ে অনন্য ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। আল্লাহর নির্দেশেই তিনি ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-কে কুরবানী দিতে উদ্যত হয়েছিলেন মক্কার মরু প্রান্তরে। মহান আল্লাহ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সংকল্পের দৃঢ়তা দেখে তাঁর কুরবানী কবুল করেন এবং ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর স্থলে একটি দুম্বা কুরবানী মঞ্জুর করেন। এরই সূত্র ধরে গোটা মুসলিম জাহানে আজও চলে আসছে কুরবানীর এই ধারা। এর ভেতর দিয়ে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের দিকে অগ্রসর হয় মুসলিম জাতি। কুরবানী মুসলিম উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। পশু কুরবানীর মাধ্যমে গরীব-দুঃখী ও পাড়া-প্রতিবেশীর আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বার্থত্যাগ, আত্মত্যাগ ও সম্পদত্যাগই হলো কুরবানী। কুরবানী শুধু একটি আনন্দ-উৎসব নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা ও দর্শন।

ঈদুল আযহা আত্মত্যাগের প্রেরণায় উজ্জীবিত এক অনন্য আনন্দ উৎসব। যে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণ মূর্ত হয় মানুষের জীবনে, তার জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হলো এই কুরবানী। পশু কুরবানীর ভেতর দিয়ে মানুষের ভেতরে থাকা পশুশক্তি, কাম-ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুকে ত্যাগ করতে হয়। তাই শুধু পশু নয়, প্রয়োজন পশুত্বের কুরবানী। কুরবানীদাতা শুধু পশুর গলায় ছুরি চালান না; তিনি তার সব কুপ্রবৃত্তির ওপরও ছুরি চালিয়ে তাকে নির্মূল করেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর নির্দেশ দিয়েছি। আল্লাহ তাদের রূযী হিসেবে যেসব গৃহপালিত পশু দিয়েছেন, তার উপর তারা যেন (যবেহ করার সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে’ (আল-হাজ্জ, ২২/৩৪)

কুরবানীর ঈদ পালনের মাধ্যমে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ আল্লাহর প্রিয় বান্দা, নবী ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমাস সালাম-এর অতুলনীয় আনুগত্য এবং মহান ত্যাগের পুণ্যময় স্মৃতি বহন করে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর পশু কুরবানী করে থাকে। মহান আল্লাহ কুরআনে কারীমে নির্দেশ দিচ্ছেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘অতএব, আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন’ (আল-কাউছার, ১০৮/২)

কুরবানীর মাধ্যমে মুসলিমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জানমাল থেকে শুরু করে সবকিছুই কুরবানী করতে প্রস্তুত—এই জানান দেন। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তাঁর পুরো পরিবারের নজিরবিহীন কুরবানীর ইতিহাস মানুষকে যে ত্যাগের শিক্ষা দেয়, তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মুমিন তার সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকে।

নবী ইবরাহীম, তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাঈল আলাইহিমাস সালাম এবং মা হাজেরার আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশগুলো আল্লাহ তাআলা হজ্জের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে স্বপ্নে দেখালেন, তিনি তাঁর পুত্রকে যবেহ করছেন (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১০২)। যেভাবে ‘কুরবানী’ কবিতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,

“এই দিনই ‘মিনা’-ময়দানে
পুত্র-স্নেহের গর্দানে
ছুরি হেনে ‘খুন ক্ষরিয়ে নে’
রেখেছে আব্বা ইবরাহীম সে আপনা রুদ্র পণ!
ছি ছি! কেঁপোনা ক্ষুদ্র মন!
আজ জল্লাদ নয়, প্রহ্লাদ-সম মোল্লা খুন-বদন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন।”

পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে আল্লাহ বললেন, ‘হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছ’। প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন দুম্বা বা ছাগল যবেহ করলেন? এর উত্তর হলো, যদি সেদিন এই ঘটনা না ঘটত, তাহলে পরবর্তীতে এভাবে মানুষ কুরবানী চলমান থাকত। অতএব, আল্লাহ মানবজাতিকে শিক্ষা দিলেন, মানুষ যবেহ করার জিনিস নয়; যবেহ যদি করতে হয়, তাহলে পশু যবেহ করো।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়, মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা একবার অসুস্থ হলে তাঁর দাদা ১০০ উট যবেহ করেছিলেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, পশু যবেহ করা মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রচলন করেননি; বরং পূর্ব থেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু যবেহ করা হতো। পশু কুরবানীর আরো একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে মূসা আলাইহিস সালাম-এর জাতিকে আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন,وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَذْبَحُوا بَقَرَةً ‘আর স্মরণ করো, যখন মূসা তাঁর ক্বওমকে বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা একটি গাভী যবেহ করবে’ (আল-বাক্বারা, ২/৬৭)

গরু তোমাদের উপকারার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে, যেন তোমরা এর দুধ পান করতে পার, গোশত খেতে পার এবং এর মাধ্যমে অন্যান্য উপকার সাধন করতে পার। হাদীছে এসেছে, পশু যবেহ আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের অন্যতম একটি মাধ্যম। তবে তা ঐ ব্যক্তির জন্য, যে নিষ্ঠার সাথে কেবল আল্লাহ তাআলার ভালোবাসায়, তাঁর ইবাদতের উদ্দেশ্যে ঈমান সহকারে পশু যবেহ করে। এমন কুরবানীকে আরবীতে ‘নুসুক’ বলা হয়েছে, যার আরেকটি অর্থ অনুগত। আসলে আল্লাহ মানুষের অন্তর দেখেন, কে কোন উদ্দেশ্যে কুরবানী করছে, তা তিনি ভালো করেই জানেন। কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘শহীদী-ঈদ’ কবিতায় বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন—

‘মনের পশুরে করো জবাই

পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।’

আল্লাহর নামে পশু কুরবানী করে তা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার মানে দান নয়; তা ত্যাগ। তাই তো কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘শহীদী-ঈদ’ কবিতায় আরও লিখেছেন—

‘চাহি নাকো গাভী দুম্বা উট,

কতটুকু দান? ও দান ঝুট।

চাই কোরবানী, চাই না দান।’

আমাদের পুণ্যকর্মগুলোর মূল উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি, তাহলে তিনি হয়তো আমাদের আমল গ্রহণ করবেন। আল্লাহ যাদের সামর্থ্য দিয়েছেন, তারা ইচ্ছা করলে কুরবানী ঈদের বাজেটের একটি অংশ গরীবদের জন্য ব্যয় করতে পারেন। আমরা যদি এই ঈদে সম্মিলিতভাবে দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াই, তাহলে অনেক পরিবারকে আমরা ঈদ আনন্দে অন্তর্ভুক্ত করতে পারব। কেননা গরীব-অসহায়দের সাহায্য করাই ইসলামের শিক্ষা আর এর মাধ্যমেই আল্লাহ বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হন। আল্লাহপ্রেমিক বান্দারা ঘরে বসেই তাঁর বান্দাদের কষ্ট দূর করার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। যারা তাঁর বান্দার কষ্টের সময় সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাঁর বন্ধু বানিয়ে নেন। কুরবানীর ফযীলত লিখে সমাপ্ত করা অসম্ভব। তাই সমস্ত মুসলিম জাতির প্রতি আবেদন, যদি আপনাদের কুরবানী করার ক্ষমতা থাকে, তাহলে নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতকে অনুসরণ করে কুরবানী করুন।

পরিশেষে বলতে চাই, কুরবানী হলো ইসলামের এক মহান নিদর্শন। কুরআনের সূরা আল-কাউছারে প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করতে ও কুরবানী করতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক হাদীছে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ وَجَدَ سَعَةً وَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারেকাছেও না আসে’।[3] নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার নির্দেশ দিয়ে আরও বলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِى كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَةً ‘হে লোক সকল! প্রত্যেক পরিবারের ওপর প্রতি বছর কুরবানী দেওয়া অপরিহার্য’।[4]

উল্লিখিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কুরবানী করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের যারা সামর্থ্যবান রয়েছেন, তাদের সকলকে সাধ্য অনুযায়ী কুরবানী করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

 চিকিৎসক, কলামিষ্ট ও গবেষক; প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।


[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৯৬৩।

[2]. আল ফিক্বহুল মুয়াসসার, পৃ. ১৮৯।

[3]. দারাকুত্বনী, হা/৩৫।

[4]. আবূ দাঊদ, হা/২৭৮৮, হাসান।

Magazine