কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইসলামে দলীলের প্রয়োজনীয়তা : ছূফী-সুন্নীর প্রেক্ষিতসহ

post title will place here

ইসলামই একমাত্র ইলাহী ধর্ম, যেখানে যত কিছুই পালন করা হোক না কেন তার সুস্পষ্ট দলীল ও প্রমাণ থাকতে হবে। কেননা মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন (আল-মায়েদা, /)। সুতরাং ইসলামে নতুন করে কোনো কিছু হ্রাস-বৃদ্ধি করা যাবে না। একই সাথে কেউ ইসলামে নতুন কিছুর অবতারণা করলে তাকে সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণাদি নিয়ে আসতে হবে। কেননা আল্লাহ নিজেই যেকোনো কাজের জন্য দলীল-প্রমাণাদি উপস্থাপনের আহ্বান করেছেন। যেমন কাফেররা ফেরেশতাদের আল্লাহর কন্যা সন্তান দাবি করলে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তাদের কাছে এর প্রমাণ চেয়েছেন এভাবে, أَمْ لَكُمْ سُلْطَانٌ مُبِينٌ ‘না কি তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট কোনো দলীল রয়েছে?’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১৫৬)। সুতরাং ইসলামে ঈমান, আমল, আক্বীদার ক্ষেত্রে অবশ্যই দলীল এবং সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে।

আজ ইসলাম বহুধারায় বিভক্ত। মুসলিমগণ হাজারো শাখা-উপশাখায় বিভক্ত। এতসব শাখা-উপশাখার মধ্যে কারা সঠিক ঈমান ও আক্বীদা পোষণ করে, তা যাচাই করা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। কেননা সবাই নিজেদের সঠিক এবং সত্য বলে দাবী করে। কিন্তু মুখের কথায় কখনোই কাউকে মান্য করা যাবে না। যেকোনো দলের বা গোষ্ঠীর ঈমান, আমলগুলো অবশ্যই দালীলিকভাবে প্রমাণিত হতে হবে। যারা সুস্পষ্ট দলীল ও প্রমাণ দিতে পারবে তাদের ঈমান, আক্বীদা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হবে।

অথচ আমাদের উপমহাদেশে বৃহৎ একটি ইসলামী গোষ্ঠী যারা নিজেদের সুন্নী বলে দাবী করে, তারা তাদের ঈমান ও আক্বীদায় এমন কিছু আমল করে যা সরাসরি কুরআন-সুন্নাহর বিরোধী। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহর বাইরে নিজেদের মনগড়া কথায় কখনোই ইসলাম পরিচালিত হয় না। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে কাফের-মুশরিকদের থেকে দলীল ও প্রমাণাদি চাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। 

বিশেষ করে মুশরিকরা যখন আল্লাহর সাথে অন্যান্য দেবদেবী, অলী-আউলিয়ার শরীক করে, তখন মহান আল্লাহ বলেন, أَمْ أَنْزَلْنَا عَلَيْهِمْ سُلْطَانًا فَهُوَ يَتَكَلَّمُ بِمَا كَانُوا بِهِ يُشْرِكُونَ ‘আমি কি তাদের কাছে এমন কোনো দলীল নাযিল করেছি, যা তারা যে শিরক করে, তার (পক্ষে) কথা বলে?’ (আর-রূম, ৩০/৩৫)

ছূফী-সুন্নীরা তাদের বিভিন্ন পীর, অলী-আউলিয়ার আল্লাহর সমকক্ষ করে গাউছুল আযম, গরীবে নেওয়াজ ইত্যাদি নামে ডাকে এবং তাদের কাছে সাহায্য চায়। যার কোনো প্রমাণ কুরআন-হাদীছের কোথাও নেই। সুতরাং এটা শিরক। কিন্তু দলীল ছাড়াই এ জাতীয় অসংখ্য শিরকী আক্বীদা তাদের মধ্যে রয়েছে, যা আল্লাহ কখনোই পছন্দ করেন না। কেননা আল্লাহ বলেন,الَّذِينَ يُجَادِلُونَ فِي آيَاتِ اللَّهِ بِغَيْرِ سُلْطَانٍ أَتَاهُمْ كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ وَعِنْدَ الَّذِينَ آمَنُوا ‘যারা নিজেদের কাছে আগত কোনো দলীল ছাড়াই আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে বিতর্ক করে, তা আল্লাহ ও মুমিনদের কাছে খুবই অসন্তোষজনক’ (আল-মুমিন, ৪০/৩৫)

অর্থাৎ এইসব ছূফী-সুন্নীদের বিভিন্ন ভ্রান্ত আক্বীদা সম্পর্কে সুস্পষ্ট আয়াত দিয়ে প্রমাণ দেওয়ার পরও তারা তাদের অবস্থানে অনড় থাকে এবং তারা তাদের অবস্থান নিয়ে বিতর্ক করে কোনো প্রমাণ ছাড়াই। একইভাবে এইসব ছূফী-সুন্নীরা কুরআন-হাদীছের বাইরে নিজেদের পীর, অলী-আউলিয়াকে নানান উপাধিতে (গাউছুল আযম, গাউছ, কুতুব ইত্যাদি) ভূষিত করে, যার কোনো প্রমাণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আসেনি। যেমনভাবে প্রমাণিত ছিল না তৎকালীন আরবের মুশরিকদের বিভিন্ন দেব-দেবী তথা লাত, মানাত, উযযা প্রভৃতিকে আল্লাহর সাথে শরীক করার ক্ষেত্রে। এদেরকে মুশরিকরা পূজা করত, সাহায্য চাইত এবং আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী হিসেবে মানত। অথচ তাদের সম্পর্কেই আল্লাহ বলেন,إِنْ هِيَ إِلَّا أَسْمَاءٌ سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ এগুলো কেবল কতিপয় নামমাত্র, যে নামগুলো ‘তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষেরা রেখেছ। এ ব্যাপারে আল্লাহ কোনো দলীল-প্রমাণ নাযিল করেননি’ (আন-নাজম, ৫৩/২৩)

অর্থাৎ যাদের সম্পর্কে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো দলীল নেই, কিন্তু তারা তাদেরকে মানতে লাগল যেমন তাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের শিখিয়ে গেছে। যেমনটা হচ্ছে বর্তমান ছূফী-সুন্নীদের বেলায়। তারা তাদের বড় বড় বুজুর্গদের কাছ থেকে আন্দাজ ও অনুমানের ভিত্তিতে বিভিন্ন কবরবাসীকে নানান উপাধিতে ভূষিত করে পূজা-নযর-নেওয়াজ পেশ করে যাচ্ছে, যা সুস্পষ্ট গোমরাহী।

অথচ তারা সাধারণ মুসলিম যারা কুরআন হাদীছ জানে না, তাদেরকে বিভিন্ন উপায়ে বিভ্রান্ত করে এবং দাবী করে তাদের পীর, অলী-আউলিয়া ক্বিয়ামতের মাঠে সকল মুরীদের সুপারিশের মাধ্যমে ক্ষমা করিয়ে নিবে। অথচ সুপারিশ করার বিষয়টি সরাসরি আল্লাহর হাতে। আল্লাহ বলেন, مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ‘কে আছে এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া?’ (আল-বাক্বারা, ২/২৫৫)

অর্থাৎ আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে হলেও তাঁর অনুমতি লাগবে। তিনি যাকে যার জন্য অনুমতি দিবেন কেবল তিনিই তার জন্য সুপারিশ করতে পারবেন। সুতরাং নেককার ব্যক্তি অবশ্যই সুপারিশ করতে পারবে, তবে আল্লাহ তাকে যার জন্য অনুমতি দিবেন, তিনি কেবল তার ক্ষেত্রেই সুপারিশ করতে পারবেন। তাহলে যিনি দুনিয়ায় ঈমান আমলের ধারেকাছেও ছিল না, তাকে কীভাবে একজন নেককার ব্যক্তি সুপারিশ করতে পারেন কিংবা আল্লাহ সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন?

তারপরও ছূফী-সুন্নীরা দাবী করে, তাদের পীরেরা তাদের মুরীদদের অবশ্যই শত হাজার গুনাহ থাকলেও পার করিয়ে নিবেন। যেমনটা বলে ইয়াহূদী-নাছারা। কুরআনে এসেছে, وَقَالُوا لَنْ يَدْخُلَ الْجَنَّةَ إِلَّا مَنْ كَانَ هُودًا أَوْ نَصَارَى تِلْكَ أَمَانِيُّهُمْ قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ ‘ওরা বলে, ইয়াহূদী অথবা নাছারা ব্যতীত কেউ জান্নাতে যাবে না। এটা ওদের মনের বাসনা। বলে দিন, তোমরা সত্যবাদী হলে প্রমাণ উপস্থিত করো’ (আল-বাক্বারা, ২/১১১)

এইসব ছূফী-সুন্নীরা বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় আল্লাহর পরিবর্তে সরাসরি তাদের পীর, আউলিয়াকে বিভিন্ন নামে ডাকে। একেকজন পীর, অলী একেক কাজের জন্য সমাদৃত। যেমন মক্কার মুশরেকরা তাদের বিভিন্ন দেব-দেবীকে নানান নামে ডেকে ইবাদত-বন্দেগী করত। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ ‘তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে নিছক কতগুলো নামের ইবাদত করছ, যাদের নামকরণ তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষেরা করেছ, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ প্রমাণ নাযিল করেননি’ (ইউসুফ, ১২/৪০)

সুতরাং মক্কার মুশরিকরা তাদের বাপ-দাদার অনুসরণে তৎকালীন অসংখ্য দেব-দেবীর যেমন বিভিন্ন নামে ডাকত, ঠিক তেমনি ছূফী-সুন্নীরাও তাদের বড় বড় বুজুর্গদের অনুসরণে বিভিন্ন পীর, অলী-আউলিয়াকে নানান নামে ডেকে তাদের ইবাদত-বন্দেগী করে। অথচ আল্লাহ মুশরিকদের যেমন কোনো দলীল অবতীর্ণ করেননি, ঠিক তেমননি ছূফী-সুন্নীদেরও কুরআন-হাদীছের কোনো দলীল নেই। তারা শুধু আন্দাজ ও অনুমা‌নের ভিত্তিতেই ইসলাম পালন করে, যেমনটা করত মক্কার মুশরিকরা। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلَّا تَخْرُصُونَ ‘আপনি বলুন, তোমাদের কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে, যা আমাদের কাছে পেশ করতে পারো। তোমরা শুধু আন্দাজের অনুসরণ করো এবং তোমরা শুধু অনুমান করে কথা বলো’ (আল-আনআম, ৬/১৪৮)

সুতরাং অনুমান দিয়ে কখনোই ইসলাম পালন করা যাবে না। আল্লাহ সৃষ্টির শুরু থেকেই বিভিন্ন দলীল ও প্রমাণের ভিত্তিতে যুগে যুগে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। কখনোই কোনো প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছু আল্লাহ গ্রহণ করেন না। এই সম্পর্কে আল্লাহ অসংখ্য আয়াত নাযিল করেছেন।

অতএব, ইসলামের নামে যেকোনো আমল করার আগে অবশ্যই তার স্বপক্ষে কুরআন-হাদীছের দলীল-প্রমাণ দিতে হবে। শুধু তাই নয় যেকোনো মুমিন, মুসলিম ইসলামের নামে যেকোনো আমল করার আগে অবশ্যই তা যাচাই-বাছাই করতে হবে। কেননা আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ ‘হে মুমিনগণ! কোনো ফাসেক্ব যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি না করে বসো! ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদের অনুতপ্ত হতে হয়’ (আল-হুজুরাত ৪৯/৬)

অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি দুনিয়াবী কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তা অবশ্যই যাচাই-বাছাই করে এর সত্যতা নিরূপণ করতে হবে, যাতে কোনো প্রকার বিপদের সম্মুখীন হতে না হয়। অতএব, যেখানে দুনিয়াবী বিষয় নিয়ে আল্লাহ সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন, সেখানে আখেরাতের বিষয় নিয়ে আমাদের কতটুকু সতর্ক হওয়া উচিত, তা বলাই বাহুল্য।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হলো যে, ইসলামে ঈমান, আমল, আক্বীদার ক্ষেত্রে অবশ্যই দলীল-প্রমাণাদির ভিত্তিতে তা পালন করতে হবে। অথচ ছূফী-সুন্নীদের ঈমান ও আক্বীদাসমূহের ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহর দালীলিক কোনো প্রমাণ নেই। সুতরাং তা কোনোমতেই পালন করা যাবে না। আল্লাহ আমাদের উপযুক্ত দলীল-প্রমাণাদিসহ সকল আমল করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

-সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী*

* পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম

Magazine