কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

দুর্নীতির ভয়াবহতা

post title will place here

দুর্নীতি (Corruption) শব্দটি নেতিবাচক। এর বিপরীত শব্দ ‘সুনীতি’। দুর্নীতি শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো রীতি বা নীতিবিরুদ্ধ আচরণ, কুনীতি, অসদাচরণ ও নীতিহীনতা ইত্যাদি।দুর্নীতি দার্শনিকধর্মতাত্ত্বিকনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো আদর্শের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অসাধুতা বা বিচ্যুতিকে নির্দেশ করে। বৃহৎ পরিসরে ঘুষ প্রদান, সম্পত্তির আত্মসাৎ এবং সরকারি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করাও দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রীয় সম্পদের সাথে প্রতিটি নাগরিকের হক্ব বা অধিকার জড়িত রয়েছে। কাজেই যে লোক তা অন্যায়ভাবে নিজের কুক্ষিগত করলো, সে বস্তুত শত-সহস্র লোকের অধিকার হরণ করলো। যদি কোনো সময় তার মনে তা সংশোধন করার ইচ্ছা হয়, তখন সবাইকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া কিংবা সবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। একবার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার কাছে যা গনীমতের মাল রয়েছে, তা নিয়ে আসার জন্য বেলাল রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাধ্যমে তিনবার ঘোষণা করেন, তারপর তিনি গনীমতের মাল বণ্টন করে দেন। এরপর এক ব্যক্তি চুলের দড়ি নিয়ে আসেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন, তুমি কি বেলালের ঘোষণা শোনোনি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, শুনেছি। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন, তবে তুমি তখন নিয়ে আসোনি কেনো? তখন তিনি ওযর পেশ করলেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিনই তুমি এগুলো নিয়ে উপস্থিত হয়ো, আমি তোমার থেকে এসব কখনই গ্রহণ করব না’।[1] মসজিদ, মাদরাসা এবং ওয়াক্বফের মালের অবস্থাও একই রকম, যাতে হাজার হাজার মুসলিমদের চাঁদা বা দান অন্তর্ভুক্ত। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنِ اسْتَعْمَلْنَاهُ عَلَى عَمَلٍ فَرَزَقْنَاهُ رِزْقًا فَمَا أَخَذَ بَعْدَ ذَلِكَ فَهُوَ غُلُولٌ ‘আমি যাকে ভাতা দিয়ে কোনো কাজের দায়িত্ব প্রদান করেছি, সে যদি ভাতা ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করে তবে তা হবে আত্মসাৎ বা অসৎ উপায় অবলম্বন করা’।[2]

দুর্নীতির বিধান : শরীআতে এ ধরনের অপরাধ করা কাবীরা গুনাহ ও হারাম কাজের অন্তর্ভুক্ত। দুর্নীতির সম্পদ থেকে দান করলে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, বরং তা পরিত্যাজ্য হিসেবে গণ্য হবে।

দুর্নীতির কুফল : ১. দুর্নীতিকারীকে পরকালে ভয়াবহ শাস্তি প্রদান করা হবে। এমনকি ক্বিয়ামতের দিন সে তার আত্মসাৎকৃত সম্পদ পিঠে নিয়ে উপস্থিত হবে। ২. দুর্নীতিকারীর জন্য ইহকাল ও পরকালে অপমানজনক শাস্তি রয়েছে। ৩. দুর্নীতি দুর্নীতিবাজকে জান্নাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ৪. দুর্নীতি করা মুনাফিক্বের অন্যতম নিদর্শন।

দুর্নীতির প্রকার : ১. গনীমতের মালে দুর্নীতি করা, ২. যাকাতের মালে দুর্নীতি করা, ৩. জনসাধারণের মাল আত্মসাৎ করা, ৪. কর্মচারি নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি করা, ৫. জায়গা-জমি জবরদখলের মাধ্যমে দুর্নীতি করা প্রভৃতি।

দুর্নীতির কারণ :

(১) তাক্বওয়ার অভাব ও লজ্জা না থাকা : মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় ও লজ্জা না থাকার কারণে সে যে কোনো ধরনের খারাপ কাজ করতে দ্বিধা করে না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلاَمِ النُّبُوَّةِ الأُولَى إِذَا لَمْ تَسْتَحْيِ فَاصْنَعْ مَا شِئْتَ ‘অতীতের নবীগণের কাছ থেকে মানুষ একথা জানতে পেরেছে যে, যখন তোমার লজ্জা না থাকবে, তখন তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে’।[3]

(২) দ্রুত ধনী হওয়ার লালসা : মহান আল্লাহ বলেন,أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ - حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ - كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ - ثُمَّ كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ - كَلَّا لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে, যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও। কখনো নয়, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। আবার বলছি, কখনো নয়, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। কখনো নয়, যদি তোমরা নিশ্চিতভাবে জানতে’ (আত-তাকাছুর, ১০২/১-৫)। রাসূল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি সবচেয়ে বেশি ভয় করি যে, তোমাদের জন্য দুনিয়ার বরকতসমূহ খুলে দেওয়া হবে’। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! দুনিয়ার বরকত কী? তিনি বললেন, ‘দুনিয়ার বরকত হলো দুনিয়ার চাকচিক্য’।[4]

(৩) লোভ ও তৃপ্তিহীনতা : মানুষের মধ্যে যদি সম্পদের অতৃপ্ত লোভ-লালসা থাকে, তাহলে সে দুর্নীতি করে সম্পদ উপার্জন করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। তখন হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করতে থাকে।

দুর্নীতির ক্ষেত্র :

(১) স্বজনপ্রীতি : নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি হলো কোনো কাজে

যোগ্য লোককে নিয়োগ না দিয়ে নিজের আত্মীয় বা নিজের পছন্দসই লোক হওয়ার কারণে অযোগ্য লোককে নিয়োগ দেওয়া।

(২) ঘুষ গ্রহণ : অবৈধ পন্থায় কোনো কাজ করে দেওয়ার জন্য ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ করা। ঘুষ আদান-প্রদান সম্পর্কে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الرَّاشِي وَالْمُرْتَشِي ‘ঘুষ গ্রহণকারী ও প্রদানকারী উভয়ের ওপর আল্লাহর লা‘নত বা অভিশাপ রয়েছে’।[5] আবূ উমামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ شَفَعَ لِأَخِيهِ بِشَفَاعَةٍ، فَأَهْدَى لَهُ هَدِيَّةً عَلَيْهَا فَقَبِلَهَا، فَقَدْ أَتَى بَابًا عَظِيمًا مِنْ أَبْوَابِ الرِّبَا ‘যে ব্যক্তি কারো জন্য সুপারিশ করল এবং সেই সুপারিশের প্রতিদানস্বরূপ তাকে কিছু উপহার দিল। যদি সে তা গ্রহণ করে তাহলে সে সূদের দরজাসমূহের একটি বড় দরজায় উপস্থিত হলো’।[6] আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতার উপর অভিসম্পাত করেছেন’।[7]

(৩) ক্ষমতার অপব্যবহার : জোরপূর্বক কোনো অবৈধ কাজ করাকে ক্ষমতার অপব্যবহার বলে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলিমদের কোনো বিষয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করে, অতঃপর তাদের ওপর কাউকে পক্ষালম্বন করে দায়িত্বশীল নিযুক্ত করে, তবে তার ওপর আল্লাহর লা‘নত। তার কাছ থেকে আল্লাহ ফরয-নফল কোনো নেক আমল গ্রহণ করবেন না। এমনকি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন’।[8]

(৪) সরকারি সম্পদ দখল করা : অন্যায়ভাবে সরকারের সম্পদ ভোগ করা। সরকারি সম্পদ কোনো ব্যক্তি মালিকানাধীন নয়; বরং তাতে রয়েছে সকলের অধিকার। তাই এ মাল অন্যায়ভাবে যে ভোগ করল, সে সকলের অধিকার নষ্ট করল। তাই এটি বড় গুনাহ। এতে দখলকারী পরকালে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফাআত তথা সুপারিশ পাবে না। তেমনিভাবে সে হবে জাহান্নামী।

দুনিয়াতে দুর্নীতিবাজের শাস্তির হুকুম বা বিধান : ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি সরকারি মাল থেকে কোনো কিছু আত্মসাৎ করে, অতঃপর তার কাছে তা পাওয়া যায়, তাহলে তার কাছ থেকে সেই সম্পদ গ্রহণ করা হবে এবং তাকে ভর্ৎসনা সহকারে শাস্তি দেওয়া হবে।

দুর্নীতিবাজের পরকালীন শাস্তি : মহান আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَغُلَّ وَمَنْ يَغْلُلْ يَأْتِ بِمَا غَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ ‘আর কোনো নবীর জন্যে এটা সঙ্গত নয় যে, তিনি গনীমতের মাল আত্মসাৎ করবেন। আর যে ব্যক্তি গনীমতের মাল আত্মসাৎ করবে, সে যে গনীমতের মাল আত্মসাৎ করেছে তা নিয়ে ক্বিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে, অতঃপর প্রত্যেককে পরিপূর্ণভাবে তা-ই দেওয়া হবে, যা সে অর্জন করেছে এবং তাদের উপর আদৌ যুলুম করা হবে না’ (আলে ইমরান, ৩/১৬১)

কোনো নবী আলাইহিস সালাম-এর জন্য এটা সমীচীন নয় যে, তিনি কোনো গনীমতের মাল আত্মসাৎ করবেন। কারণ কোনো জিনিস গোপন করা বা আত্মসাৎ করা পাপের কাজ। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল নবী আলাইহিস সালামকে পাপমুক্ত রেখেছেন।

উক্ত আয়াত অবতীর্ণের পেক্ষাপট হলো, বদর যুদ্ধের পর যুদ্ধলব্ধ গনীমতের মালের মধ্যে থেকে একটি লাল চাদর পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন কোনো লোক বলল, হয়তো সেটি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়েছেন। এরই প্রেক্ষিতে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়।[9]

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিবার ও জিনিসপত্রের দায়িত্বে এক লোক ছিলো, তাকে ‘কারকারাহ’ বলা হতো, সে মারা গেলে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, هُوَ فِي النَّارِ فَذَهَبُوا يَنْظُرُونَ إِلَيْهِ فَوَجَدُوا عَبَاءَةً قَدْ غَلَّهَا ‘সে জাহান্নামী’। অতঃপর লোকজন তাকে দেখতে গিয়ে পায় যে, সে একটি আলখেল্লা চুরি করেছে।[10] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘(হে মানুষ সকল!) তোমাদের মধ্যে যাকে আমরা কোনো কাজে নিযুক্ত করি, অতঃপর সে যদি একটি সুঁই অথবা এর চেয়ে ছোট বা বড় কোনো কিছু আমাদের থেকে গোপন করে, তবে তা খেয়ানত হিসেবে গণ্য হবে এবং সে ক্বিয়ামতের দিন তা সাথে নিয়ে আসবে’।[11]

দুর্নীতি থেকে পরিত্রাণের উপায় : ১. অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি সৃষ্টি করা, ২. অল্পে তুষ্ট হওয়া, ৩. লোভ-লালসা থেকে বিরত থাকা, ৪. ইসলামী ও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করা এবং ৫. পরকালের জবাবদিহিতা ও শাস্তির ভয় অন্তরে জাগ্রত করা।

পরিশেষে বলবো, দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি। আমাদের চরিত্রকে নিষ্কলুষ রাখার জন্য দুর্নীতি পরিত্যাগ করতে হবে। যে জাতির মধ্যে দুর্নীতি যত কম, তারা তত বেশি সফল। সর্বোপরি ক্বিয়ামতের দিন আমরা যেন আল্লাহর দরবারে দুর্নীতিমুক্ত, সচ্চরিত্রবান হয়ে উপস্থিত হতে পারি, আল্লাহ তাআলা আমাদের সেই তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

মাহবূবুর রহমান মাদানী

শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৮৫৮।

[2]. আবূ দাঊদ, হা/২৯৪৩, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/৩৭৪৮।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৮৪।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪২৭।

[5]. ইবনু মাজাহ, হা/২৩১৩, হাদীছ ছহীহ।

[6]. আবূ দাঊদ, হা/৩৫৪১, হাসান।

[7]. আবূ দাঊদ, হা/৩৫৮০, হাদীছ ছহীহ; তিরমিযী, হা/১৩৩৭।

[8]. মুসতাদরাক হাকেম, হা/৭০২৪।

[9]. তিরমিযী, হা/৩০০৯; আবূ দাঊদ, হা/৩৯৭১।

[10]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০৭৪।

[11]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৩৩।

Magazine