কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইসলামের প্রভাব (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

post title will place here

১১. আল্লাহর নামে শপথ/বক্তৃতা-বিবৃতিতে ইসলামের ব্যবহার : স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বভাবসুলভভাবে বক্তৃতা-বিবৃতিতে ‘খোদা (আল্লাহ) হাফেয, ইনশাআল্লাহ’ শব্দ ব্যবহার করতেন। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের নেতারা আল্লাহর নামে শপথ করে বক্তব্য-বিবৃতি দিতেন। ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৫১ জন জাতীয় পরিষদ এবং ২৬৮ জন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদ সদস্য ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নের সংকল্প ঘোষণা করে শপথ গ্রহণ করেন। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। আল্লাহর নামে শপথনামার শুরু হয়েছিল। আরবী ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’-এর হুবহু বাংলা তরজমাসহ হলফনামা শুরু হয়েছিল এভাবে— ‘আমরা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী দলীয় নব নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ শপথ গ্রহণ করিতেছি পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার নামে...’। আরো কিছু প্রতিজ্ঞা করে ‘আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’ বলে শপথনামার উপসংহার করা হয়েছিল।[1]

১২. কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শুরু : স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজনীতিবিদের অধিকাংশ কর্মসূচি কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হতো। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক সমাবেশ মাওলানা শেখ উবায়দুল্লাহ সাঈদ জালালাবাদীর কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল।[2] ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠানও সম্প্রচার শুরু হতো পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে। সেখানে যারা কুরআন তেলাওয়াত করতেন তাদের মধ্যে মো. মুজিবুর রহমান জিহাদী, মো. খায়রুল ইসলাম যশোরী, শেখ উবায়দুল্লাহ সাঈদ জালালাবাদী অন্যতম।[3]

দেশবাসী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কোনো অনুষ্ঠানে কখনো পবিত্র কুরআন ছাড়া অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ শোনেনি।

১৩. ইসলামী অনুষ্ঠান প্রচার এবং মুক্তিযু্দ্ধকে জিহাদ হিসেবে অভিহিত করা : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ইসলামী অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করা হতো। ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ এবং ‘ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ’ শিরোনামে কথিকা প্রচার করা হয়েছে। জুলাই, ১৯৭১ ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ কথিকায় বলা হয় ...বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে যে নৃশংস অন্যায় লীলা চলছে সেগুলো পরিপূর্ণভাবে ইসলামবিরোধী এবং আল্লাহ তাআলার শাশ্বত ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। ...বাংলাদেশের মুসলিম অত্যন্ত নিগূঢ়ভাবে ধর্মবিশ্বাসী এবং আল্লাহর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। এ সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে যারা অন্যায়ভাবে মারণ অস্ত্র ধারণ করেছে, আমি ইসলামের নামে তাদের বিরুদ্ধে অভিশাপ ঘোষণা করছি। আমাদের জয় হবেই, আমাদের জয় অপরিহার্য।[4]

‘ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ’ কথিকায় কুরআনের সূরা আত-তওবার ৭৩ ও ৭৪ নং আয়াত, সূরা আন-নিসার ৭৬ নং আয়াত, সূরা আল-বাক্বারার ১৫৪-১৫৫ নং আয়াত উল্লেখপূর্বক জিহাদের ফযীলত, গুরুত্বের উপর দীর্ঘ আলোচনা শেষে ধৈর্যধারণের আহ্বান জানানো হয়েছে— ‘...এই কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় অবশ্যই আমাদেরকে উর্ত্তীণ হতে হবে। আর সেজন্য প্রয়োজন হচ্ছে অসীম সহনশীলতা ও ধৈর্যের সাথে জিহাদ করে যাওয়া’।[5]

আবু রাহাত মো. হাবিবুর রহমান রচিত কথিকার তৃতীয় ও শেষ অংশে দুটি আয়াত ও একটি হাদীছ উল্লেখসহ বলা হয়েছিল, ‘ওরা আমাদের সাথে যে ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, তা হচ্ছে ন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ। কুরআনের দৃষ্টিতে ওরা শয়তানের বন্ধু ও দোযখী। অতএব, আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। ...অতএব, হে বাঙালি ভাই-বোনেরা, আসুন! আমরা অন্যায়কারী পশ্চিমা হানাদার পশু ও এদের পদলেহী দালাল কুকুরদের বিরুদ্ধে সার্বিক জিহাদ চালিয়ে আমরা আমাদের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হই। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। নাছরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন ক্বারীব’।[6]

১৪. কুরআন হাতে মুক্তিযুদ্ধের শপথ : ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য মৌলভী সৈয়দ আহমাদ-এর পরিচালনায় কুরআন মাজীদ হাতে নিয়ে মহান আল্লাহর নামে শপথও করেছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা’।[7]

১৫. মুক্তিযুদ্ধে আলেম ও ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জীবন দান : পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালে যে নিষ্ঠুর গণহত্যা চালায় তা থেকে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম এবং আলেম-ওলামারও রক্ষা পায়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বহু স্থানে মসজিদের মধ্যে প্রবেশ করে এবং মসজিদ থেকে ধরে নিয়ে মুছল্লীদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, মসজিদের প্রবিত্রতা নষ্ট করা হয়েছে। এর জ্বলন্ত প্রমাণ— নওগাঁ জেলার দামুরহাট থানার উত্তর-পূর্ব প্রান্তের শেষ গ্রাম পাগলা দেওয়ান। ‘৭১-এর ১৮ জুন পাগলা দেওয়ান গ্রামের কাছে প্রায় ৩৯ জন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২১শে নভেম্বর ঈদুল ফিত্বরের দিন বর্বর পাকিস্তানী সৈনিকরা মসজিদে ঢুকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এর বড় প্রমাণ ঢাকার পূর্বদিকের গোড়ান এলাকার পূর্বদিকে জাউলাপাড়া ছাপড়া মসজিদের সামনে ৮/১০ জন মুছল্লীকে গুলি করে হত্যা। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করায় মাওলানা হারুন-অর রশীদ ঢাকার সূত্রাপুরের লালকুঠির প্রাঙ্গণে সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। ১৯৭১-এর ২রা আষাঢ় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেবার অভিযোগে রসূলপুরের কাটানিশা গ্রামের হাজী আব্দুল গফুরকে (তার ভাই, ভাতিজা ও ভাগনেসহ) কুরআন তেলাওয়াতরত অবস্থায় হত্যা করেছিল পাকিস্তান বাহিনী। ১৯৭১ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তের কুমিল্লা শহরের নিকটবর্তী চান্দলা গ্রামের খোয়াজ আলী খলীফাকে ছালাতরত অবস্থায়, আব্দুল গফুর ও শহীদ মিয়াকে কুরআন তেলাওয়াতরত অবস্থায় হত্যা করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করার অপরোধে ২৫শে আগস্ট, ১৯৭১ এই অঞ্চলের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন চান্দলা গ্রামের পশ্চিম পাড়ার মাওলানা আব্দুল

লতিফ সাহেবকে পরিবারের পাঁচ সদস্যসহ হত্যা করা হয়। ২০ আগস্ট ১৯৭১ শুক্রবার আখাউড়ার গঙ্গাসাগরের নিকটবর্তী মান্দাইল মসজিদে জুমআর ছালাত পড়তে আসা মুছল্লীদেরকে টেনেহিঁচড়ে বের করে ৩৪ জনকে একসাথে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের ভাগ্যে জানাযা, দাফন কিছুই জোটেনি। এসব হতভাগ্য মানুষগুলোর পক্ষে সুপারিশ করার জন্য সেদিন মান্দাইল মসজিদের ইমাম মৌলভী বাশার মোল্লাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। ১৯৭১-এর জুলাই মাসে তদানীন্তন কিশোরগঞ্জ মহকুমার ভৈরব থানার মাদিকদী গ্রামের মধ্যপাড়া হাজী-বাড়ি মসজিদ, তরব আলী হাজী-বাড়ি মসজিদ, চান্দেরচর মসজিদ, তাতালচর মসজিদ ও মানিকদী মসজিদে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অভিযান চালায়। এই পাঁচ-পাঁচটি মসজিদে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে প্রায় ৪০ জন মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা। পাকিস্তানী ও তাদের দোসরদের নির্দেশ মতো মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে ওয়ায-মাহফিলে বক্তৃতা না করায় সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার নয়াগ্রাম মসজিদের ইমাম মাওলানা মকদ্দস আলীকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছাউনির কাছে বটগাছে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্দয় প্রহারে ১৯৭১-এর ২ সেপ্টেম্বর তিনি শাহাদাত বরণ করেন।[8]

শরীআতের দৃষ্টিতে ৬ দফার রচয়িতা সিলেটের কৃতি সন্তান লেখক, বুদ্ধিজীবী ডা. মাওলানা অলিউর রহমানকে স্বাধীনতার মাত্র কয়দিন আগে ১১ ডিসেম্বর ধরে নিয়ে যেয়ে হত্যা করে আল-বদর রাজাকাররা। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে প্রণীত বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় শহীদ মাওলানা অলিউর রহমানের নাম ছিল।[9] ‘৭১-এর এপ্রিলে জিরির মাদরাসায় হানাদারদের বোমার আঘাতে শহীদ আল্লামা দানেশ (চট্টগ্রাম লোহাগাড়া) এবং শহীদ মাওলানা মিজানুর রহমান (নাগেশ্বরী)-এর কথা কারো অজানা নয়’।[10]

১৬. রনাঙ্গণে আলেমদের সরাসরি অংশগ্রহণ : মুক্তিযুদ্ধকালীন রণাঙ্গণে যেসব আলেম মুক্তিযোদ্ধা লড়াই করেছেন, জনমত তৈরি করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন স্বাধীনতাবিরোধীদের অত্যাচারে দেশ-বাড়ি ছেড়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন— চট্টলার বীর গেরিলা কমান্ডার মৌলভী সৈয়দ (বাঁশখালী), সেকশন কমান্ডার মাওলানা শামছুল হুদা (ভুরুঙ্গামারী), সিলেটের মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী (সাময়িক সনদপত্র নং ম-১১১০৮৮), মাওলানা মুখলেছুর রহমান (সনদ ক্রমিক নং ২০২০৬), সিলেটের মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, কুমিল্লার মাওলানা আব্দুর রহমান (সাময়িক সনদপত্র নং ম-৮৫২৫৯), মাওলানা খাইরুল ইসলাম যশোরী (সনদ ক্রমিক: ৩৫৫৯৪), কুমিল্লার মাওলানা আব্দুর রব, হাতিয়া দ্বীপের মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান, চট্টগ্রাম জিরির মাওলানা আব্দুস সোবহান, রাঙ্গুনিয়ার মাওলানা আবু ইসহাক, মাওলানা আবুল কালাম, চট্টগ্রামের মৌলভী আব্দুল মালেক, মৌলভী আব্দুস সোবহান, মাওলানা কাজী আবু ইউসুফ, চন্দ্রঘোনার মাওলানা দলিলুর রহমান, মাওলানা মতিউর রসূল, মাওলানা শরীফ (পটিয়া), মৌলভী মকছুদ আহমদ ভুঁইয়া (ছাগলনাইয়া), মৌলভী নুরুল আফসার, মাওলানা আব্দুল মতীন মজুমদার (চৌদ্দগ্রাম), নানু কারী, মাওলানা আব্দুল মতীন কাজী, মাওলানা মতিউল ইসলাম, মাওলানা মির্জা মো. নূরুল হক (ভুরুঙ্গামারী), মাওলানা আলিফুর রহমান (গঙ্গাচড়া), কারী আব্দুস সালাম সরকার (রংপুর), মাওলানা মুহাম্মাদ আলী (রংপুর), মাওলানা মাহতাব উদ্দীন (ভুরুঙ্গামারী), মাওলানা আমজাদ হোসেন (নাগেশ্বরী), মাওলানা কামারুজ্জামান (নরসিংসী), মাওলানা বশির উদ্দিন, মাওলানা বজলুর রহমান, হাফেয মহিউদ্দিন (এফ এফ নং ৯১১৯), মৌলভী মির্জা আব্দুল হামিদ (বুখাইনগর), মাওলানা লোকমান আহমেদ আমীমী, মাওলানা উসমান গণি (ফুলগাজি), মাওলানা নূরনগরী (নবীনগর), মাওলানা জহিরুল হক (কসবা), মাওলানা মোস্তফা আজাদ, মাওলানা শওকত আলী (শরীয়তপুর)।[11]

১৭. স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছে যেসব ইসলামী সংগঠন : এদের মধ্যে জাতীয় মুজাহিদ সংঘ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। জাতীয় মুজাহিদ সংঘ ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার আন্দোলন শুরু করেছিল। ৮ মার্চ, ১৯৭০ তারিখে মুজাহিদ সংঘ ঢাকার ভিকটেরিয়া পার্ক তথা বাহাদুর শাহ পার্কে একটি জনসভার আয়োজন করে দ্ব্যর্থহীনভাবে আলাদা হওয়ার তথা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান গঠন করার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করে। জাতীয় মুজাহিদ সংঘ কর্তৃক প্রকাশিত ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের রূপ’ নামে একটি পুস্তিকাও ১ জানুয়ারি, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ ছিল—

‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান- জিন্দাবাদ।

ইসলামী সাম্যবাদ- জিন্দাবাদ।

পশ্চিশ পাকিস্তানীদের দ্রব্য- বর্জন করুন।

পশ্চিমা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান- বয়কট করুন।

উর্দূ-ইংলিশ- ধ্বংস হউক।

পশ্চিম পাকিস্তানী সাম্রাজ্যবাদ- ধ্বংস হউক’।[12]

তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে কোনো পশ্চিম পাকিস্তানী পরিষদ সদস্য ঢাকায় আসলে তার ঠ্যাং ভেঙে ফেলা হবে বলে ভুট্টোর হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতী মাহমূদ ও তাঁর দলীয় আলেম সদস্যগণ এবং মাওলানা নূরানী যথারীতি ঢাকায় আসেন। শুধু তাই নয়, তারা তাদের এ দেশীয় অনুসারী আলেমদেরকে এ দেশের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে স্থানীয়ভাবে পলিসি নিধার্রণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ কারণে, জমিয়তপন্থী আলেমগণ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতার সাথে নিজেদের জড়াননি।[13]

১৮. ইসলামী দল ও ব্যক্তিদের সমর্থন : পাকিস্তানের ২৩ বছর এদেশের মানুষ ইসলামের নামে শুধু প্রতারিত হয়েছে। প্রতিটি ইসলামী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর যুলুম ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে ছিল। এসব ইসলামী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের পাকিস্তান সরকারের যুলুমরোধ কল্পে বঙ্গবন্ধুর সাথে একাত্মতা পোষণ করতেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় আলেমদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ এবং এর নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ সৃষ্টির পক্ষে ছিলেন। যেসব বরেণ্য ভারতীয় মুসলিম ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ সৃষ্টির পক্ষে কাজ করেছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন— শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহিমাহুল্লাহ-এর পুত্র ভারতীয় লোকসভার সদস্য মাওলানা সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী, কোলকাতা আলিয়া মাদরাসার হেড মাওলানা মুহাম্মাদ তাহের, করিমগঞ্জের এম.পি মাওলানা আব্দুল জলীল (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৭)। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আলেমদের কাজ করার বিষয়টি ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ স্বয়ং বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণে উঠে এসেছে এভাবে— ‘...এই উদ্দেশ্যেই আমরা মারকাজি জমিয়াতুল উলামায়ে ইসলামের মওলানা নূরানী, নওয়াব আকবর খান বুগতি, মওলানা গোলাম গউস হাজারভী ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মওলানা মুফতী মাহমূদ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতার সাথে বৈঠকে মিলিত হই’ (বাঙালির কণ্ঠ, (বঙ্গবন্ধু পরিষদ), পৃ. ২২৪)

১০৭০-৭১ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে বাংলাদেশের শতভাগ উলামায়ে কেরাম একমত ছিলেন (ড. তারেক মোহাম্মদ তওফীকুর রহমান, রাজনীতিতে আলিম সমাজের প্রভাব, (তৃতীয় সংস্করণ ২০১৮), পৃ. ৪৪)

উপসংহার : ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। এ যুদ্ধ ছিল যালেমের বিরুদ্ধে মাযলূমের যুদ্ধ। এটি কোনোভাবেই ইসলামের বিরুদ্ধে কাফেরদের কিংবা কাফেরদের বিরুদ্ধে ইসলামের যুদ্ধ ছিল না। ইসলামের শাশ্বত ন্যায়নীতি ও ইনছাফই ছিল এ যুদ্ধের মূল চেতনা। তাই মৌলিকভাবে ধর্মপ্রাণ আলেম সমাজ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেননি। তবে অনস্বীকার্য যে, আলেমদের মধ্যে একটা ক্ষুদ্র অংশ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, যেমন একটা অংশ যুদ্ধের পক্ষেও সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। সে কারণে ঢালাওভাবে ইসলামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী আখ্যা দেওয়া মহাসত্যের অপলাপ ছাড়া কিছুই নয়। বুদ্ধিমানের কাজ হলো প্রত্যেককে তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করা। প্রত্যেককে তার অবদানের জন্য পুরস্কৃত করা এবং কুকর্মের জন্য তিরস্কৃত করা। মহান আল্লাহ আমাদেরকে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত থেকে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

মো. হাসিম আলী

সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরী স্কুল এন্ড কলেজ, বগুড়া।


[1]. প্রাগুক্ত, ২/৬১২; আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, (পুনর্মুদ্রণ: জানুয়ারি ২০১৬), পৃ. ৫৪১-৫৪২।

[2]. আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, পৃ. ১৫৫।

[3]. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ৫/২৬।

[4]. প্রাগুক্ত, ৫/২৮১-২৮২।

[5]. প্রাগুক্ত, ৫/২৮২-২৮৫।

[6]. প্রাগুক্ত, ৫/২৮৪-২৮৫।

[7]. আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, পৃ. ২৩৮।

[8]. লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীরপ্রতীক), মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর কর্তৃক আলেম ও ধর্মপ্রাণ জনগণ হত্যা, (ইফা), পৃ. ১২-৫১।

[9]. আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, পৃ. ১৩৩, ১৪৪।

[10]. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৬, ৩০৭।

[11]. শাকের হোসাইন শিবলি, একাত্তরের চেপে রাখা ইতিহাস আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, (আল-এছহাক প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জুন ২০১৪)।

[12]. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ২/৫৯৮-৬১১।

[13]. আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, পৃ. ১৭৬।

Magazine