কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কিতাবুল ইলম: জ্ঞান অর্জনের স্বরূপ (মিন্নাতুল বারী-৫ম পর্ব)

[যে হাদীছের ব্যাখ্যা চলছে:

حَدَّثَنَا أَبُو النُّعْمَانِ عَارِمُ بْنُ الفَضْلِ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو عَوَانَةَ، عَنْ أَبِي بِشْرٍ، عَنْ يُوسُفَ بْنِ مَاهَكَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو، قَالَ: تَخَلَّفَ عَنَّا النَّبِيُّ فِي سَفْرَةٍ سَافَرْنَاهَا فَأَدْرَكَنَا - وَقَدْ أَرْهَقَتْنَا الصَّلاَةُ - وَنَحْنُ نَتَوَضَّأُ، فَجَعَلْنَا نَمْسَحُ عَلَى أَرْجُلِنَا، فَنَادَى بِأَعْلَى صَوْتِهِ: «وَيْلٌ لِلْأَعْقَابِ مِنَ النَّارِ» مَرَّتَيْنِ أَوْ ثَلاَثًا.

৬০. ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমাকে আবুন নু‘মান আরেম ইবনে ফাযল হাদীছ শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাকে আবূ আওয়ানা হাদীছ শুনিয়েছেন, তিনি আবূ বিশর থেকে, তিনি ইউসুফ ইবনে মাহাক থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর থেকে, তিনি বলেন, এক সফরে আমাদের সাথে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিছনে থেকে আসছিলেন। পরে তিনি আমাদের কাছে পৌঁছালেন। তখন ছালাতের সময় হয়ে গিয়েছিল এবং আমরা ওযূ করছিলাম। আমরা (তাড়াহুড়ো করে) আমাদের পায়ে হাত বুলিয়ে নিচ্ছিলাম (ভালোমতো ধুচ্ছিলাম না)। তখন তিনি উচ্চৈঃস্বরে বললেন, দুঃখ (বা ধ্বংস) হোক! সেই গোড়ালিগুলো জাহান্নামের আগুনে!তিনি এটি দুই বা তিনবার বললেন।]

শব্দ ও বাক্য বিশ্লেষণ:

১. أَرْهَقَتْنَا الصَّلاَةُ

শাব্দিক বিশ্লেষণ:

أرهق - আরবী ক্রিয়া, যার মূল অর্থ হলো বোঝা চাপিয়ে দেওয়া, ঢেকে ফেলা, অতি নিকটে চলে আসা বা পেয়ে বসা।

বাক্যের ব্যাখ্যা:

أَرْهَقَتْنَا الصَّلاَةُ - ছালাত আমাদের ওপর এসে পড়েছিল বা ছালাত আমাদেরকে প্রায় ধরে ফেলেছিল।

এখানে الصلاة শব্দটি ফায়েল (কর্তা)। অর্থাৎ ছালাত নিজেই সময়ের দিক থেকে এতটা কাছে চলে এসেছিল যে, পূর্ববর্তী ছালাত পড়ার সময় সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

হাদীছটির অন্য শব্দ:

হাদীছটি এভাবেও এসেছে- وَقَدْ أَرْهَقْنَا الصَّلاَةَ অর্থাৎ, আমরা ছালাতকে ধরে ফেলেছিলাম অর্থাৎ আমরা পরবর্তী ছালাতের সময়ের এত কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম যে, দেরি করে ফেলছিলাম।

সারকথা: এটি এমন এক অবস্থা বুঝায়, যেখানে দুটি ছালাতের মাঝে সময় এতটাই সংকীর্ণ ছিল যে, একটির সময় আরেকটিকে প্রায় ঢেকে ফেলছিল। মূল বক্তব্য হলো- ছালাত আদায়ের ক্ষেত্রে সময়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য।

২. وَيْلٌ لِلْأَعْقَابِ

শব্দ বিশ্লেষণ:

ويلٌ - একটি মাছদার (Verbal Noun/ক্রিয়ামূল)। কিন্তু এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট ক্রিয়া নেই। এর অর্থ ধ্বংস, দুর্ভোগ, শাস্তি। এটি জাহান্নামের একটি ভয়াবহ উপত্যকার নাম হিসেবেও হাদীছ ও তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে। কুরআনে অনেকবার এসেছে, যেমন- فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّينَ অর্থাৎ ধ্বংস তাদের জন্য, যারা ছালাতে গাফেল।

أعقاب - শব্দটি عقب -এর বহুবচন। শব্দটির অর্থ গোড়ালি বা পায়ের পেছনের অংশ। মানুষ যখন স্পোর্টস জুতা পায়ে দেয়, তখন পায়ের পিছনের অংশ ঢাকার জন্য জুতার যতটুকু জায়গা ব্যবহার করা হয়, সেই জায়গাকেই আকিব বলা হয়। তথা গোড়ালিসহ পায়ের গোছার দিকে আরও একটু উপর পর্যন্ত জায়গাকেই আকিব বলা হয়।

বাক্যের অর্থ:

‘গোড়ালির জন্য ধ্বংস’ অর্থাৎ যারা ওযূর সময় তাদের গোড়ালির অংশ ঠিকমতো ধৌত করে না, তাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তির হুমকি রয়েছে।

ফিক্বহী ব্যাখ্যা:

অধ্যায়ের সাথে হাদীছের সম্পর্ক: উক্ত হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদেরকে উঁচু আওয়াজে সতর্ক করেছেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উঁচু আওয়াজ প্রমাণ করে যে, শিক্ষা ক্ষেত্রে উঁচু আওয়াজ ব্যবহার করা যায়। আর এটিই উক্ত হাদীছের সাথে অধ্যায়ের সম্পর্ক।

এটি কোন সফরের ঘটনা?

উক্ত বর্ণনা অনুযায়ী ছাহাবীগণ কোন সফর থেকে ফিরছিলেন, তা সরাসরি উল্লেখ নেই। এই হাদীছেরই ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় স্পষ্ট এসেছে,رَجَعْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ مِنْ مَكَّةَ إِلَى الْمَدِينَةِ ‘আমরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে মক্কা থেকে মদীনায় ফিরে আসলাম’।[1] তথা সফরটি বিদায় হজ্জের সফর হতে পারে অথবা মক্কা বিজয়ের সফর অথবা হুদায়বিয়ার সফর হতে পারে। মহান আল্লাহ-ই অধিক অবগত।

বক্তব্যে উঁচু আওয়াজ-ই সুন্নাহ: উক্ত হাদীছ প্রমাণ করে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষার জন্য উঁচু আওয়াজ ব্যবহার করতেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাওয়াতী ও শিক্ষাদান পদ্ধতিতে ‌উঁচু আওয়াজে কথা বলা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তিনি শুধু কোমল ভাষায় নয়; বরং প্রয়োজন অনুযায়ী উঁচু কণ্ঠে, কখনো রাগ ও সতর্কতার সুরে বক্তব্য দিতেন, যাতে উপস্থিত ব্যক্তিরা গভীরভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করেন এবং মনোযোগের সঙ্গে শ্রবণ করেন।

এমন পদ্ধতির উদাহরণ ছহীহ হাদীছে বারবার পাওয়া যায়। বিশেষ করে খুবা ও জনসম্মুখে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সতর্কবাণী দেওয়ার সময় তিনি কণ্ঠস্বর দৃঢ়, উঁচু এবং গভীরভাবে প্রভাবসঞ্চারী হিসেবে উপস্থাপন করতেন।

হাদীছ: ১

জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,كانَ رَسُولُ اللهِ إِذَا خَطَبَ احْمَرَّتْ عَيْنَاهُ، وَعَلَا صَوْتُهُ، وَاشْتَدَّ غَضَبُهُ، حَتَّى كَأَنَّهُ مُنْذِرُ جَيْشٍ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খুৎবা দিতেন, তখন তাঁর দু’চোখ লাল হয়ে যেত, কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে যেত এবং ক্রোধ তীব্র হয়ে উঠত, এমনকি মনে হতো যেন তিনি কোনো সেনাবাহিনীর আগমন সম্পর্কে সতর্ক করছেন’।[2]

উক্ত বর্ণনা প্রমাণ করে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বক্তব্যে আবেগ, গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রদর্শনের জন্য কণ্ঠস্বর উঁচু করতেন, যাতে শ্রোতারা ভয়, সচেতনতা ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে।

হাদীছ: ২

নু‘মান ইবনু বাশীর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, سمعتُ رسولَ الله يخطبُ يقول أنذرْتُكم النارَ، أنذرْتُكم النارَ আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে খুৎবায় বলতে শুনেছি, ‘আমি তোমাদের জাহান্নাম সম্পর্কে সতর্ক করছি, আমি তোমাদের জাহান্নাম সম্পর্কে সতর্ক করছি’। তিনি আরও বলেন, এমনকি যদি কোনো ব্যক্তি বাজারেও থাকতেন, তবুও তিনি এই স্থান থেকে তাঁর আওয়াজ শুনতে পেতেন। আর বক্তব্যের তীব্রতায় তাঁর কাঁধে থাকা চাদর (খামীসাহ) তাঁর পায়ের কাছে পড়ে যায়।[3]

উক্ত হাদীছ থেকে বুঝা যায়, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে কথা বলতেন যেন তা দূর থেকেও শোনা যায়। তাঁর আওয়াজে এমন তীব্রতা ও আন্তরিকতা ছিল যে, তা শ্রোতার মনপ্রাণ কাঁপিয়ে দিত।

শিক্ষাদানে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলার হিকমাহ (প্রজ্ঞা):

১. মনোযোগ আকর্ষণ: মানুষ যখন আবেগতাড়িত হয়ে বা দৃঢ় কণ্ঠে কিছু বলে, তখন শ্রোতারা আরও মনোযোগী হয়।

২. ভয়ভীতি সঞ্চার: এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেমন-আখেরাত, জাহান্নাম, গুনাহ এসবের আলোচনায় কোমলতার চেয়ে দৃঢ়তা ও সতর্কতার সুর-ই অধিক কার্যকর।

৩. সত্য ও হক্ব প্রকাশ: উঁচু কণ্ঠ হক্ব কথা প্রচারে সাহসিকতার প্রতীক, যা দাওয়াতের মাঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পা মাসাহ করতে হবে নাকি ধৌত করতে হবে?

ওযূতে পা মাসাহ করা বা ধৌত করা নিয়ে ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই মতভেদ আছে। মতভেদটি তৈরি হয়েছে কুরআনের একটি আয়াতকে কেন্দ্র করে। কুরআনের আয়াতটি নিম্নরূপ:

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ

‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা ছালাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ও কনুই পর্যন্ত হাত ধুয়ে নাও এবং তোমাদের মাথা মাসাহ করো ও গোড়ালি পর্যন্ত পা ধৌত করে নাও’ (আল-মায়েদা, ৫/৬)

আলোচ্য আয়াতে পা ধোয়ার বিষয়টি মাথা মাসাহ করার সঙ্গে একত্রে উল্লেখ রয়েছে। এ কারণেই শীআদের মতে, এই আয়াত দ্বারা মাথার মতো পায়ের ওপরও মাসাহ করা প্রমাণিত হয়।

তবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত-এর সকল ইমামের মতে, পা ধোয়া আবশ্যক। এ কারণে তারা আয়াতের وأرجلكم শব্দটিকে আগের وجوهكم (মুখমণ্ডল) এবং أيديكم (হাত) ধোয়ার অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত করে পড়েন। এর সমর্থনে তাঁরা أرجلَكم শব্দে لام বর্ণে ‘যবর’ (فتح) দিয়ে পড়াকে গ্রহণ করেন, যা সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ কিরাআত হিসেবে বিবেচিত।

যদি এটি برءوسكم (মাথায় মাসাহ) অংশের সঙ্গে সংযুক্ত হতো, তাহলে আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী ‘لام’ বর্ণে ‘যের’ (كسر) হতো আর এই কারণে যারা পায়ে মাসাহ করার পক্ষে তারা তথা শীআরা أرجلِكم বলে ‘যের’ দিয়ে কিরাআত করেন।

তবে আমাদের আলোচ্য হাদীছটি এই মতবিরোধ নিরসনে যথেষ্ট প্রমাণ। এতে স্পষ্টভাবে পা ধোয়ার কথা বলা হয়েছে, যার কোনো বিকল্প নেই। ফলে আয়াতে যদি পায়ে মাসাহ করার অনুমানযোগ্য ইঙ্গিতও থাকে, তাহলেও এই হাদীছের স্পষ্ট নির্দেশনার ভিত্তিতে সেটিকে ‘মানসূখ’ (বাতিলকৃত) হিসেবে গণ্য করতে হবে। এটাই ইমাম ত্বহাবী রাহিমাহুল্লাহ-এর মত।

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ওযূর পূর্ণ বিবরণে যতগুলো ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, সবগুলোতেই পা ধোয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। আমরা ওযূর অধ্যায়ে তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব, ইনশা-আল্লাহ।

এই ঘটনায় ছাহাবীগণ মাসাহ করছিলেন নাকি ধৌত করছিলেন?

যারা আয়াতটি মানসূখ (বাতিলকৃত) বলে মত দিয়েছেন, তাদের মতে, উক্ত ঘটনায় ছাহাবীগণ শুরুতে পায়ের উপর মাসাহ করছিলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনার ফলে তারা পা ধোয়া শুরু করেন। ইমাম ত্বহাবী রাহিমাহুল্লাহ হাদীছে ব্যবহৃত নিম্নোক্ত শব্দ থেকে এই বক্তব্যের প্রমাণ গ্রহণ করেছেন, فَجَعَلْنَا نَمْسَحُ عَلَى أَرْجُلِنَا অর্থাৎ আমরা তখন পায়ে মাসাহ করতে শুরু করলাম।

তবে হাদীছের প্রেক্ষাপটে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শব্দচয়ন এবং ছাহাবীদের বর্ণনার ধরণ সবই প্রমাণ করে যে, তারা আসলে পা ধৌত করছিলেন; কিন্তু ধৌত করাটা ভালোভাবে হচ্ছিল না। কারণ যদি ধরে নেওয়া হয় যে, ঘটনাটি এমন সময়ে ঘটেছিল, যখন ছাহাবীগণ জানতেন না যে, পা ধৌত করতে হয় এবং তারা এটাও বিশ্বাস করতেন যে, পায়ে কেবল মাসাহ করাই যথেষ্ট; তাহলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনোই এভাবে কঠোর ভঙ্গিতে, জাহান্নামের হুমকি দিয়ে তাঁদের সতর্ক করতেন না। বরং তিনি প্রথমে শিষ্টাচারপূর্ণভাবে শিখিয়ে দিতেন যে, কীভাবে সঠিকভাবে ওযূ করতে হয়।

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কঠোর সতর্কবাণী এটাই প্রমাণ করে যে, ছাহাবীগণ শুরু থেকেই জানতেন, পা ধৌত করা ফরয; কিন্তু হয়তো সময়ের স্বল্পতার কারণে তাড়াহুড়োয় তারা পা ভালোভাবে ধৌত করছিলেন না, ফলে গোড়ালির অংশ শুকনো থেকে যাচ্ছিল। কারণ গোড়ালি পায়ের পিছনে থাকায় তা সহজে দেখা ও ধৌত করা যায় না।

তবে এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, হাদীছে ব্যবহৃত (نمسح على أرجلنا) ‘আমরা পায়ে মাসাহ করছিলাম’ এই বাক্যাংশের অর্থ কী হবে?

আসলে ‘মাসাহ’ শব্দটি মূলত ‘হাত বুলানো’ বা ‘স্পর্শ করা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। পা ধোয়ার ক্ষেত্রেও পানি প্রয়োগ করার সময় পায়ে হাত বুলাতে হয়, যাতে পানি সব জায়গায় ভালোভাবে পৌঁছে ওযূ পূর্ণ হয়। অতএব, এই হাদীছে ‘মাসাহ’ দ্বারা ‘পানি ছাড়া মাসাহ’ উদ্দেশ্য নয়; বরং এটার অর্থ এই যে, ছাহাবীগণ পানি দিয়ে পা ধোয়ার সময় তাড়াহুড়ো করছিলেন এবং গোড়ালি পর্যন্ত ভালোভাবে কচলিয়ে ধৌত করছিলেন না, হালকাভাবে পানির স্পর্শ করাচ্ছিলেন মাত্র। সেই হালকা স্পর্শ বা অপ্রতুল ধৌত করা বুঝাতেই এখানে ‘মাসাহ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

সারমর্ম ও শিক্ষা:

১. ওযূর সময় পা সম্পূর্ণভাবে ধৌত করা জরুরী: ওযূর সময় গোড়ালি বা পায়ের অংশ শুকনো রাখা মারাত্মক গাফলতি, যা জাহান্নামের শাস্তির কারণ হতে পারে।

২. ওযূর ক্ষেত্রে অবহেলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ: ওযূর সময় ভালোভাবে ধৌত করার প্রতি যত্নবান হওয়া জরুরী। শীতের কারণ, তাড়াহুড়ো বা অন্য কোনো কারণে অবহেলা করা উচিত নয়।

৩. শিক্ষার ক্ষেত্রেউলামায়ে কেরামের উচিত রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতো দৃঢ় হওয়া: রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো শিক্ষার জন্য জোরে ও সতর্কতামূলক ভঙ্গিতে কথা বলেছেন। আলেমদের জন্য তা অবশ্য অনুসরণীয়।

৪.ধমক দেওয়া ইসলামী শিক্ষার অংশ হতে পারে: যেখানে প্রয়োজন সেখানে কঠোর ভাষা ব্যবহার করা যায়, যদি উদ্দেশ্য সংশোধন হয়।

৫.সফর অবস্থাতেও ছালাতের গুরুত্ব কমে না: ছাহাবীগণ সফরে থেকেও ওযূ করে ছালাতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, এটি ছালাতের গুরুত্ব প্রমাণ করে।

৬.রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাওয়াহর আওয়াজ উঁচু ও শক্তিশালী ছিল: أعلى صوته (উঁচু আওয়াজে বলা) থেকে বোঝা যায়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর কণ্ঠস্বর জোরালো হতো।

৭. ছহীহ সুন্নাহর বিপরীতে আমল করা চলবে না: ছাহাবীগণ যখন ভুলভাবে পায়ে মাসাহ করছিলেন, তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে তা সংশোধন করেন।

৮. সংশোধনের ক্ষেত্রে দেরি নয়: ইসলাম তাৎক্ষণিকভাবে ভুল সংশোধনের নীতি শিক্ষা দেয়, যাতে তা ভুল অভ্যাসে পরিণত না হয়। প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনবার বলা যায়, যেমনটি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন।

(ইনশা-আল্লাহ চলবে)

* ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বিএ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।

[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪১।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৬৭।

[3]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৬৫৯।

Magazine