‘ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন’ বাক্যটি প্রায় সবার মুখ থেকেই শুনা যায়; আলেম হোক বা জাহেল। তাক্বদীর বা ভাগ্য শরীআতের অদৃশ্য স্পর্শকাতর বিষয়াবলির মাঝে অন্যতম। তাক্বদীর সম্পর্কে সঠিক বুঝ ও ধারণা না থাকার কারণে অনেক মুসলিম নামধারী মানুষও পথভ্রষ্ট হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে ইসলামে বিভিন্ন দল ও উপদলের। অনেক লোক তাক্বদীর অস্বীকারকারীদের রসব্যঞ্জক আলোচনায় প্রতারিত হয়ে বিপথগামী হয়েছে। তাদের কথা ও যুক্তি খুবই চমৎকার ও শ্রুতিমধুর; যার ফলশ্রুতিতেই মানুষ দিনে দিনে তাদের পিছনে ছুটছে। তাক্বদীর নামক পথটি খুবই সংকীর্ণ, পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত। অনেকেই এ পথে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছে। হ্যাঁ, তাক্বদীর খুবই পিচ্ছিল একটি পথ! পিচ্ছিল বলে হাঁটা যাবে না বিষয়টা এমন নয়; বরং খুব সতর্কতার সাথে হাঁটতে হবে। অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের তাক্বদীর সম্পর্কে জানার কৌতূহল জাগাটা স্বাভাবিক। কারণ জানলেই তো ঐ পিচ্ছিল পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব। পাঠকদের জ্ঞান পিপাসা নিবারণের লক্ষ্যে ও মুসলিম জাতিকে সঠিক দিশা দেওয়ার উদ্দেশ্যে নিজের অপ্রতুল জ্ঞান দিয়েই কিছু লিখার কথা অনুভব করছি। তাই কাল বিলম্ব না করে শুরু করা যাক তাক্বদীরের যাত্রা।
তাক্বদীর পরিচিতি :
অতি সংক্ষেপে যদি তাক্বদীর পরিচিতি তুলে ধরা হয়, তাহলে এভাবে বলা উচিত, ‘ভাগ্যের ভালো-মন্দের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ও সন্তুষ্ট থাকা’। অর্থাৎ পৃথিবীতে জীবনযাপন করার ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে যে সমস্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, বিপদাপদ আমাদের উপর আপতিত হয়, তার উপর সন্তুষ্ট থাকা ও হায়-হুতাশ না করা। ধৈর্যধারণ করা এবং এই বিপদ থেকে পুণ্যের আশা করা।
তাক্বদীরের প্রকারভেদ :
তাক্বদীরের প্রকারভেদ সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে অনেক মানুষ বিপদগামী হয়েছে। তাই নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো- তাক্বদীর দুই প্রকার। (১) মুবরাম (স্থায়ী) (২) মুআল্লাক্ব (ঝুলন্ত)। মুবরাম এমন তাক্বদীর যা কখনো পরিবর্তন হয় না; বান্দার জন্য যা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অনিবার্যভাবে ঘটবেই। যেমন- আপনি কোনো স্থানে মৃত্যুবরণ করবেন এটা পূর্ব থেকে নির্ধারিত। একটি হাদীছে নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,إِذَا قَضَى اللَّهُ لِعَبْدٍ أَنْ يَمُوتَ بِأَرْضٍ جَعَلَ لَهُ إِلَيْهَا حَاجَةً ‘আল্লাহ তাআলা যখন যে জায়গায় কারো মৃত্যু হওয়ার ফয়সালা করেন, তখন ঐ জায়াগায় গমনের উদ্দেশ্যে তার কোনো প্রয়োজন সৃষ্টি করে দেন’।[1] মুবরাম তাক্বদীরের উপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে ও পুণ্যের আশা করতে হবে। অহেতুক ও অযাচিত কথা বলা উচিত যাবে না। মুআল্লাক্ব হলো এমন তাক্বদীর, যা পরিবর্তন হয়। যেমন- আল্লাহ তাআলা কারো ভাগ্য নির্ধারণ করেন এভাবে, যদি আমার উমুক বান্দা উমুক স্থানে যায়, তাহলে গাড়ি এক্সিডেন্টে সে মৃত্যুবরণ করবে। হ্যাঁ, তবে সে যদি যাওয়ার আগে কোনো কিছু দান করে বা আমার কাছে হঠাৎ মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ চায়, তাহলে সে এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাবে। এ ধরনের তাক্বদীর সাধারণত শর্তযুক্ত থাকে। পবিত্র কুরআনে তাক্বদীরে মুআল্লাক্ব সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার সুস্পষ্ট বাণী রয়েছে,وَمَا يُعَمَّرُ مِنْ مُعَمَّرٍ وَلَا يُنْقَصُ مِنْ عُمُرِهِ إِلَّا فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ ‘কারো বয়স বৃদ্ধি বা হ্রাসকরণ সবই কিতাবে রয়েছে; আর এটা আল্লাহর কাছে অতি সহজ বিষয়’ (আল-ফাত্বির, ৩৫/১১)। এখানে দেখুন, কারো হায়াত যদি চূড়ান্তভাবে ৬০ বছর লেখা থাকে, তাহলে আবার তা বৃদ্ধি হবে কীভাবে? অথচ আল্লাহ বলছেন বয়স বৃদ্ধি পায়। বুঝা যাচ্ছে, এটা তাক্বদীরে মুবরাম নয়; বরং মুআল্লাক্ব। এ ব্যাপারটি আরো একটু সুস্পষ্ট হয় যামাখশারীর বক্তব্য দ্বারা। তিনি তাফসীরে কাশশাফে উল্লেখ করেছেন,
أَنَّهُ لاَ يَطُوْلُ عُمُرُ الْإِنْسًانِ وَلاَ يَقْصُرُ إِلاَّ فِيْ كِتَابٍ وَصُوْرَتُهُ أَنْ يُّكْتَبَ فِي اللَّوْحِ إِنْ لَمْ يَحُجَّ فُلاَنٌ أَوْ يَغْزُ فَعُمْرُهُ أَرْبَعُوْنَ سَنَةً ، وَإِنْ حَجَّ وَغَزَا فَعُمْرُهُ سِتِّوْنَ سَنَةً ، فَإِذَا جَمَعَ بَيْنَهُمَا فَبَلَغَ السِّتِّيْنَ ، وَإِذَا أَفْرَدَ أَحَدُهُمَا فَلَمْ يَتَجَاوَزْ بِهِ الْأَرْبَعِيْنَ فَقَدْ نُقِصَ مِنْ عُمُرِهِ الَّذِيْ هُوَ الْغَايَةُ وَهُوَ السِّتُّوْنَ وَذَكَرَ نَحْوَهُ فِيْ مَعَالِمِ التَّنْزِيْلِ
‘মানুষের বয়স বৃদ্ধি পাওয়া বা হ্রাস ঘটার উদাহরণটা হলো এমন, আল্লাহ তাআলা লাওহে মাহফূযে কারো ভাগ্য এভাবে লিখে রেখেছেন, যদি উমুক হজ্জব্রত পালন না করে ও যুদ্ধে না যায়, তাহলে তার বয়স হবে ৪০। আর যদি হজ্জব্রত পালন করে ও যুদ্ধে যায়, তাহলে তার বয়স হবে ৬০। এখানে ব্যক্তি দুটি শর্ত পূর্ণ করার কারণে তার বয়স হয়েছে ৬০। কিন্তু ব্যক্তি যদি একটি শর্ত পূরণ করে, তাহলে সে চূড়ান্ত বয়সে ৬০ বছর) পৌঁছতে পারবে না, বরং তার বয়স হবে ৪০; মাআলিমুত তানযীল গ্রন্থেও এ ধরনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।[2] অনেক মানুষ তাক্বদীরে মুআল্লাক্ব না জানার কারণে অহেতুক আল্লাহকে দোষারোপ করে থাকে, রোগ হলে অনেকে ভাগ্যের উপর নির্ভর করে বসে থাকে এবং বলে, ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। আরো বলে, আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছেন, তাই হবে। এ কথা বলে সে আর চেষ্টাই করে না। রোগ হলে সাধ্যানুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে, এটাই আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। তিনি বলেননি যে, ভাগ্যের উপর নির্ভর করে বসে থাকো। একটি হাদীছে আছে, ছাহাবায়ে কেরাম নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করেন, আমাদের রোগ হলে কি আমরা তাক্বদীরের উপর নির্ভর করে বসে থাকব, নাকি প্রতিষেধক গ্রহণ করব? প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রতিষেধক গ্রহণ করো; এটাও তাক্বদীরে রয়েছে’।[3] আমরা তো জানি না আমাদের তাক্বদীরে কী লেখা আছে, তাই তাক্বদীরের উপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না; বরং আমাদের সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করার পরও যদি সফলতা অর্জন করা সম্ভব না হয়, ঐ সময় মনে করতে হবে তাক্বদীরে আমার সফলতা নেই, তাই আমি সফল হতে পারিনি। তাই চেষ্টা না করে তাক্বদীরের উপর নির্ভর করে বসে থাকা অনুচিত।
তাক্বদীর কি পরিবর্তন হয়?
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের শুরুতেই মুত্তাক্বীদের একটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। আর সেটা হলো- না দেখে আল্লাহকে বিশ্বাস করা। কেউ যদি আল্লাহর প্রস্তুতকৃত ছায়াময় কষ্ট-ক্লেশমুক্ত জান্নাতের অধিবাসী হতে চায়, তাহলে আল্লাহকে না দেখে তাকে বিশ্বাস করতে হবে। এখন কেউ যদি জান্নাতে যেতে না চায়, তাহলে সে বিশ্বাস করবে না! তাক্বদীরের পুষ্পটি যেহেতু কাঁটাযুক্ত, সেহেতু এই পুষ্প স্পর্শ করবে না এবং পুষ্প আছে শুধু এ কথা বিশ্বাস করবে! শুধু শুধু অযথা ঘাঁটাঘাঁটি করা নিষ্ফল; বরং কখনো কখনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এজন্যই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদের তাক্বদীর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে নিষেধ করেন। যেমন- একটি হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَنَحْنُ نَتَنَازَعُ فِي الْقَدَرِ فَغَضِبَ حَتَّى احْمَرَّ وَجْهُهُ حَتَّى كَأَنَّمَا فُقِئَ فِي وَجْنَتَيْهِ الرُّمَّانُ فَقَالَ " أَبِهَذَا أُمِرْتُمْ أَمْ بِهَذَا أُرْسِلْتُ إِلَيْكُمْ إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حِينَ تَنَازَعُوا فِي هَذَا الأَمْرِ عَزَمْتُ عَلَيْكُمْ أَلاَّ تَتَنَازَعُوا فِيهِ
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো এক সময় আমাদের সামনে এসে দেখলেন যে, আমরা তাক্বদীর বিষয়ক তর্কে-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছি। তিনি ভীষণ রাগান্বিত হলেন, এতে তাঁর মুখমণ্ডল এমন লাল বর্ণ ধারণ করল যেন তাঁর দুই গালে ডালিম নিংড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর তিনি বললেন, ‘তোমরা কি এজন্য আদেশপ্রাপ্ত হয়েছ, না আমি তোমাদের প্রতি এটা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি? এ বিষয়ে তোমাদের পূর্ববর্তী জনগণেরা যখনই বাক-বিতণ্ডা করেছে, তখনই তারা ধ্বংস হয়েছে। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সাথে তোমাদেরকে বলছি, তোমরা এ বিষয়ে কখনো যেন বিতর্কে লিপ্ত না হও’।[6] শয়তান কখনো কখনো তাক্বদীরের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্তির মাঝে ফেলে, মনের মাঝে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। যার ফলশ্রুতিতে চলে আসে মনের অজান্তেই উদ্ভট প্রশ্ন।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
সাঈদুর রহমান
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. তিরমিযী, হা/২১৪৬; মিশকাত, হা/১১০।
[2]. তুহফাতুল আহওয়াযী, ৫/৬৪৩।
[3]. তিরমিযী, হা/২১৪৮।
[4]. তিরমিযী, হা/২১৩৯; সিলসিলা ছহীহা, হা/১৫৪; মিশকাত, হা/২২৩৩।
[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৪১৭; আবূ দাঊদ, হা/১৬৯৩।
[6]. তিরমিযী, হা/২১৩৩; মিশকাত, হা/৯৮।