কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

অহির বাস্তবতা বিশ্লেষণ (১১তম পর্ব)

(মিন্নাতুল বারী- ১৮তম পর্ব)

হাদীছ নং : ৪

حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو عَوَانَةَ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ أَبِي عَائِشَةَ، قَالَ: حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ جُبَيْرٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ فِي قَوْلِهِ تَعَالَى: {لاَ تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ} [القيامة : 16] قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعَالِجُ مِنَ التَّنْزِيلِ شِدَّةً، وَكَانَ مِمَّا يُحَرِّكُ شَفَتَيْهِ - فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: فَأَنَا أُحَرِّكُهُمَا لَكُمْ كَمَا كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُحَرِّكُهُمَا، وَقَالَ سَعِيدٌ: أَنَا أُحَرِّكُهُمَا كَمَا رَأَيْتُ ابْنَ عَبَّاسٍ يُحَرِّكُهُمَا، فَحَرَّكَ شَفَتَيْهِ - فَأَنْزَلَ اللَّهُ تَعَالَى: {لاَ تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ} [ القيامة : 17] قَالَ: جَمْعُهُ لَكَ فِي صَدْرِكَ وَتَقْرَأَهُ: {فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ} [ القيامة : 18] قَالَ: فَاسْتَمِعْ لَهُ وَأَنْصِتْ: {ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ} [ القيامة : 19] ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا أَنْ تَقْرَأَهُ، فَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعْدَ ذَلِكَ إِذَا أَتَاهُ جِبْرِيلُ اسْتَمَعَ فَإِذَا انْطَلَقَ جِبْرِيلُ قَرَأَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَمَا قَرَأَهُ.

অনুবাদ :

মহান আল্লাহর বাণী, ‘তাড়াতাড়ি অহি আয়ত্ত করার জন্য আপনার জিহ্বা দ্রুত নাড়াবেন না’ (আল-ক্বিয়ামাহ, ৭৫/১৬)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহি নাযিলের সময় তা আয়ত্ত করতে বেশ কষ্ট স্বীকার করতেন এবং এজন্য তিনি তাঁর ঠোঁট (দ্রুত) নাড়াতেন। ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি তোমাদেরকে ঠিক সেভাবে ঠোঁট নেড়ে দেখাচ্ছি, যেভাবে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঠোঁট নাড়াতেন’।

সাঈদ রহিমাহুল্লাহও তাঁর ছাত্রদের বললেন, আমি তোমাদেরকে ঠিক সেভাবে আমার ঠোঁট নেড়ে দেখাচ্ছি, যেভাবে আমি ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা-কে তাঁর ঠোঁট নাড়াতে দেখেছি। অতঃপর তিনি তাঁর ঠোঁট নেড়ে দেখান। ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন, ‘তাড়াতাড়ি অহি আয়ত্ত করার জন্য আপনার জিহ্বা দ্রুত নাড়াবেন না’। এর সংগ্রহ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই’ (আল-ক্বিয়ামাহ, ৭৫/১৬-১৮)

ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এর অর্থ হলো আপনার অন্তরে তা সংরক্ষণ করা এবং আপনার দ্বারা তা পাঠ করানো। আল্লাহর বাণী, ‘সুতরাং যখন আমি তা পাঠ করি, তখন আপনি সে পাঠের অনুসরণ করুন’ (আল-ক্বিয়ামাহ, ৭৫/১৯)। ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, অর্থাৎ মনোযোগ সহকারে শুনুন এবং চুপ থাকুন। আল্লাহর বাণী, ‘এরপর আপনার কাছে তা ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব আমারই’ (আল-ক্বিয়ামাহ, ৭৫/১৯)। অর্থাৎ অতঃপর আপনাকে পাঠ করানোর দায়িত্বও আমারই। এরপর যখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিবরীল আলাইহিস সালাম আসতেন, তখন তিনি মনোযোগ সহকারে কেবল শুনতেন এবং জিবরীল আলাইহিস সালাম চলে গেলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঠিক সেভাবে পড়তেন, যেভাবে জিবরীল আলাইহিস সালাম পড়েছিলেন’।

অধ্যায়ের সাথে সামঞ্জস্য :

উক্ত হাদীছটি ‘অহির প্রারম্ভ’ নামক অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে অহির ইতিহাস, অহি আসার ধরন ইত্যাদি নিয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়ে গেছে। আলোচ্য হাদীছে অহি অবতীর্ণ হওয়ার প্রথম দিকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ আয়াত অবতীর্ণ করার মাধ্যমে সেই বিষয়টিকে সংশোধন করে দিয়েছেন। উক্ত আয়াত ও আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্ত কর্ম উভয়টিই অহি অবতীর্ণ হওয়ার প্রাথমিক অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং হাদীছের সাথে অধ্যায়ের কোনো বৈপরীত্য নেই।

সনদের সূক্ষ্মতা :

আলোচ্য হাদীছটিতে ঠোঁট নাড়ানো কর্মটি মুসালসাল তথা রাবী পরম্পরায় ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। মুসালসাল হাদীছকে কয়েকভাবে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন মুসালসাল হাদীছের সংজ্ঞায় আল্লামা সাখাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

(الْمُسَلْسَلُ) وَهُوَ لُغَةً: ‌اتِّصَالُ ‌الشَّيْءِ ‌بَعْضِهِ ‌بِبَعْضٍ، وَمِنْهُ سِلْسِلَةُ الْحَدِيدِ. وَ (مُسَلْسَلُ الْحَدِيثِ) ، وَهُوَ مِنْ صِفَاتِ الْإِسْنَادِ، (مَا تَوَارَدَا فِيهِ الرُّوَاةُ) لَهُ كُلُّهُمْ (وَاحِدًا فَوَاحِدَا حَالًا) ; أَيْ: عَلَى حَالٍ (لَهُمْ) ، وَذَلِكَ إِمَّا أَنْ يَكُونَ قَوْلِيًّا لَهُمْ. وَإِمَّا أَنْ يَكُونَ الْحَالُ فِعْلِيًّا.

 ‘মুসালসাস হাদীছ: মুসালসাল-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, একটি জিনিস আরেকটি জিনিসের সাথে যুক্ত হওয়া। এই অর্থেই লোহার জিঞ্জিরকে سلسلة الحديد বলা হয়ে থাকে। এটি সনদের বিশেষণের অন্তর্ভুক্ত। পারিভাষিক অর্থে, মুসালসালুল হাদীছ কয়েকভাবে হয়ে থাকে যেমন— সনদের বৈশিষ্ট্যে তথা সনদের প্রত্যেক রাবীর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট অবস্থার অবতারণা হয়। সেই নির্দিষ্ট অবস্থাটি ক্বওলী তথা বাক্য ও শব্দ বলার দিক থেকে হতে পারে। অথবা নির্দিষ্ট কাজের দিক থেকে হতে পারে। অথবা রাবীদের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে হতে পারে’।[1]

নির্দিষ্ট বাক্যের সাথে মুসালসাল হাদীছ : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা মুআয রযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন,إني أحبك فقل في دبر كل صلاة: اللهم أعني على ذكرك وشكرك ‘নিশ্চয় আমি তোমাকে ভালোবাসি। অতএব, তুমি প্রত্যেক ছালাতের শেষে বলো, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমাকে সহযোগিতা করুন আপনার যিকির ও শুকরিয়া আদায় করতে’।[2]

উক্ত হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে মুআয রযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেছেন আমি তোমাকে ভালোবাসি। এটি হাদীছের বাহিরের একটি অতিরিক্ত ব্যক্তিগত বাক্য ছিল। কিন্তু মুআয রযিয়াল্লাহু আনহু যখন এই হাদীছ তার ছাত্রকে শুনিয়েছেন, তখন তিনিও তাঁর ছাত্রকে বলেছেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি। অতএব, তুমি এই দু‘আ পড়বে। এভাবে সনদের প্রত্যেক রাবী তার ছাত্রকে হাদীছ বর্ণনা করার সময় বলেছেন ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। কাজেই এই হাদীছটিতে এই বাক্যটি রাবীগণ মুসালসাল বা ধারাবাহিকভাবে সবাই বর্ণনা করেছেন।

নির্দিষ্ট কাজের সাথে মুসালসাল ‍হাদীছ : আমাদের উল্লিখিত হাদীছটি নির্দিষ্ট কাজ তথা জিহ্বা নাড়ানোর দিক থেকে কর্মগত মুসালসাল হাদীছ। উক্ত হাদীছটি বর্ণনা করার সময় প্রত্যেক রাবী তার ছাত্রকে জিহ্বা নাড়িয়ে দেখিয়েছেন। এই রকম অনেক মুসালসাল হাদীছ আছে।

নির্দিষ্ট বিশেষণের মুসালসাল হাদীছ : এই নির্দিষ্ট বিশেষণটি রাবীর নিজস্ব ‘বিশেষণ’ হতে পারে অথবা সনদের বিশেষ ‘বিশেষণ’ হতে পারে। রাবীর নিজস্ব ‘বিশেষণ’ যেমন— কোনো হাদীছের সকল রাবী ক্বারী বা সকল রাবী কুরআনের হাফেয বা সকল রাবীর বাড়ি নির্দিষ্ট এক শহরে বা সকল রাবী নির্দিষ্ট একটি গোত্রের হবে ইত্যাদি। আর সনদের বিশেষ বিশেষণ ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হওয়ার উদাহরণ হলো: যেমন এই হাদীছের সনদের সকল রাবী ‘হাদ্দাছানা’ শব্দ দিয়ে হাদীছ বর্ণনা করেন বা সকল রাবী ‘আখবারানা’ শব্দ দিয়ে হাদীছটি বর্ণনা করেন বা সকল রাবী ‘আন’ শব্দ দিয়ে হাদীছ বর্ণনা করেন ইত্যাদি।

রাবী পরিচিতি :

(১) মূসা ইবনু ইসমাঈল আত-তাবূযাকী :

নাম : মূসা ইবনু ইসমাঈল।

কুনিয়াত : আবূ সালামা।

নিসবাত : আল-বাছরী, আত-তাবূযাকী।

মৃত্যু : ২২৩ হিজরীতে।

শিক্ষকবৃন্দ : (১) জারীর ইবনু হাযেম (২) হিব্বান ইবনু ইয়াসার (৩) হাম্মাদ ইবনু সালামা (৪) হাম্মাদ ইবনু যায়েদ (৫) শু‘বা ইবনুল হাজ্জাজ (৬) আব্দু্ল্লাহ ইবনু দুকাইন (৭) আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (৮) সুলাইমান ইবনুল মুগীরা।

ছাত্রবৃন্দ : (১) ইমাম বুখারী (২) আবূ দাঊদ (৩) ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন (৪) ইয়াকূব ইবনু শায়বা (৫) ইয়াকূব ইবনু সুফিয়ান (৬) মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া আয-যুহলী (৭) ইবরাহীম ইবনু ইসহাক্ব আল-হারবী (৮) আহমাদ ইবনু মানছূর আর-রমাদী।

মন্তব্য : কুতুবে সিত্তাহর সকল ইমাম তার হাদীছ গ্রহণ করেছেন। তিনি একজন মযবূত রাবী। তার সাথে ইয়াহইয়া ইবনু মাঈনের একটি স্মৃতিময় ঘটনা রয়েছে। তিনি তার উস্তাদ হাম্মাম থেকে একটি হাদীছ শুনেছেন কিনা ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন এই ব্যাপারে শপথ করে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন, ‘যদি আমি হাদীছটি হাম্মাম থেকে না শুনে থাকি, তাহলে আমার স্ত্রী তিন তালাক!’[3]

(২) আবূ আওয়ানা ওযযাহ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-ইয়াশকুরী :

নাম : আল-ওযযাহ ইবনে আব্দুল্লাহ।

কুনিয়াত : আবূ আওয়ানা।

নিসবাত : কিন্দী, ইয়াশকুরী, বাছরী, অলার সম্পর্কে জুরজানী।

জন্ম : ১২২ হিজরীতে।

মৃত্যু : ১৭৫ বা মতান্তরে ১৭৬ হিজরীতে।

শিক্ষকবৃন্দ : (১) হাকাম ইবনু উতাইবা (২) হাম্মাদ ইবনু সালামা (৩) খালেদ ইবনু সালামা (৪) খালেদ ইবনু মিহরান (৫) সাঈদ ইবনু সিনান (৬) সাঈদ ইবনু মাসরূক (৭) সুলাইমান ইবনু মিহরান (৮) আতা ইবনু আবী রাবাহ।

ছাত্রবৃন্দ : (১) আহমাদ ইবনু ইসহাক্ব (২) হিব্বান ইবনু হেলাল (৩) হাজ্জাজ ইবনু ইবরাহীম (৪) হাফছ ইবনু উমার (৫) হাম্মাদ ইবনু উসামা (৬) সাঈদ ইবনু মানছূর (৭) সুলাইমান ইবনু হারব (৮) শু‘বা ইবনুল হাজ্জাজ।

মন্তব্য : তিনি ইয়াযীদ ইবনু আতার ক্রীতদাস ছিলেন। জুরজান থেকে বন্দী অবস্থায় আসেন। ইয়াযীদ ইবনু আতা তাকে ক্রয় করেন। অতঃপর তিনি তার কাছে দু’টি বিকল্প প্রস্তাব পেশ করেন। হয় আযাদ হয়ে যাও অথবা হাদীছ লিখো! তিনি হাদীছ লেখাকে পছন্দ করেন। এভাবে একজন ক্রীতদাস তার মুহাদ্দিছ মুনীবের নিকট হাদীছ শেখা শুরু করেন। যদিও পরবর্তীতে ইয়াযীদ ইবনু আতা এক পর্যায়ে তাকে কোনো শর্ত ছাড়াই আযাদ করে দেন।[4]

(৩) মূসা ইবনু আবী আয়েশা :

নাম : মূসা ইবনু আবী আয়েশা।

কুনিয়াত : আবুল হাসান।

নিসবাত : কূফী, অলার সম্পর্কে হামদানী।

শিক্ষকবৃন্দ : (১) সাঈদ ইবনু জুবায়ের (২) আমর ইবনু শু‘আইব (৩) মুজাহিদ (৪) গয়লান ইবনু জারীর (৫) আমর ইবনু হুরাইছ (৬) উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উতবা (৭) হাফছ ইবনু আবী হাফছ (৮) ইবরাহীম ইবনুল জাযযার।

ছাত্রবৃন্দ : (১) সুফিয়ান আছ-ছাওরী (২) সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা (৩) শারীক ইবনে আব্দুল্লাহ (৪) শু‘বা ইবনুল হাজ্জাজ (৫) আবূ আওয়ানা (৬) ইমরান ইবনু ইয়াহইয়া (৭) উবাইদা ইবনু হুমাইদ (৮) আছেম আল-জাহদারী।

মন্তব্য : কুতুবে সিত্তাহর সকলেই তার হাদীছ গ্রহণ করেছেন। অধিকাংশ মুহাদ্দিছ তাকে মযবূত বলেছেন।[5]

(৪) সাঈদ ইবনু জুবায়ের :

নাম : সাঈদ ইবনু জুবায়ের ইবনে হিশাম আল-আসাদী।

কুনিয়াত : আবূ আব্দিল্লাহ বা আবূ মুহাম্মাদ।

নিসবাত : কুফী, আসাদী।

মৃত্যু : ৯৫ হিজরীতে।

শিক্ষকবৃন্দ : (১) আনাস ইবনু মালেক (২) আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের (৩) আব্দুল্লাহ ইবনু উমার ইবনুল খাত্তাব (৪) আদী ইবনু হাতেম (৫) আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (৬) আবূ সাঈদ আল-খুদরী (৭) আবূ হুরায়রা (৮) আয়েশা।

ছাত্রবৃন্দ : (১) হাকাম ইবনু উতাইবা (২) বুকায়ের ইবনু শিহাব (৩) ছাবেত ইবনু আজলান (৪) হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান (৫) সিমাক ইবনু হারব (৬) উছমান ইবনু হাকীম (৭) আতা ইবনু দীনার (৮) আদী ইবনু ছাবেত।

মন্তব্য : একজন বিখ্যাত তাবেঈ ছিলেন। তাঁর ইমামাত ও জ্ঞান নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। অনেক ছাহাবী থেকে তিনি হাদীছ শ্রবণ করেছেন। হাজ্জাজ ইবনু ইউসুফ তাঁকে ৯৫ হিজরীতে হত্যা করেন। যদিও তাঁকে হত্যা করার পর হাজ্জাজ নিজেও বেশি দিন বাঁচেননি।[6]

(৫) আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস :

নাম : আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস ইবনু আব্দিল মুত্তালিব ইবনু হাশেম ইবনু আবদে মানাফ ইবনু কুছাই।

উপাধি : হাবরুল উম্মাহ বা উম্মাহর মহাপণ্ডিত।

কুনিয়াত : আবুল আব্বাস।

বংশ : হাশেমী, কুরাইশী।

জন্ম : হিজরতের ৩ বা ৪ বা ৫ বছর পূর্বে।

মৃত্যু : ৬৫ বা ৬৭ বা ৬৮ বা ৬৯ বা ৭০ বা মতান্তরে ৭৩ হিজরীতে।

শিক্ষকবৃন্দ : (১) বারা ইবনু আযেব (২) বেলাল ইবনু রাবাহ (৩) আসমা বিনতে উমাইস (৪) উবাই ইবনু কা‘ব (৫) যায়েদ ইবনু ছাবেত (৬) সা‘দ ইবনু উবাদা (৭) সাওদা বিনতে যাম‘আ (৮) আয়েশা বিনতে আবু বকর।

ছাত্রবৃন্দ : (১) ইবরাহীম ইবনু উক্ববা (২) ইবরাহীম ইবনু ইয়াযীদ (৩) আবূ সুফিয়ান (৪) আবূ ত্বলহা (৫) আনাস ইবনু মালেক (৬) আয়মান ইবনু ছাবেত (৭) ইসমাঈল ইবনু কাছীর (৮) আরকাম ইবনু শুরাহবিল।

পরিচিতি : তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় চাচা আব্বাসের ছেলে ছিলেন। তার মা উম্মুল ফাযল লুবাবা আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিজ বোন ছিলেন। তাঁর বাবা আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা আর তাঁর খালা আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রী। তথা পিতা ও মাতা উভয় দিক থেকে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটবর্তী ছিলেন। বস্তুত এই কারণেই আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে জ্ঞান অর্জন করা তাঁর জন্য সহজ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রী, তাঁর নিজ খালা হওয়ার সুবাদে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাড়ির অবস্থা সম্পর্কেও তাঁর ভালো জ্ঞান ছিল। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তার ইলমের জন্য দু‘আ করেছেন, যার বদৌলতে তিনি রঈসুল মুফাসসিরীন— মুফাসসিরকুল শিরোমণি, হাবরুল উম্মাহ— উম্মাহর মহাপণ্ডিত, ‍তুরজুমানুল কুরআন— কুরআনের মুখপাত্র প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হন।[7]

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর বর্ণিত হাদীছ সংখ্যা : আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে প্রায় ১৬৬০টি হাদীছ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব আলাইহ ৯৫টি এবং এককভাবে ছহীহুল বুখারীতে ১২০টি এবং ছহীহ মুসলিমে ৪৯টি হাদীছ।[8]

আল্লামা ইয়াহইয়া ইবনু আমিরী আল-ইয়ামানী রহিমাহুল্লাহ-এর গণনায় ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে মোট ২৩৪টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব আলাইহ ৭৫টি, ছহীহ বুখারীতে এককভাবে ১১০টি এবং ছহীহ মুসলিমে এককভাবে ৪৯টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[9]

আবাদিলায়ে আরবাআ‘ : হাফেয ইরাকী, ইমাম নববীসহ অনেকেই বলেছেন যে, ছাহাবীদের মধ্যে ২২০ ছাহাবীর নাম আব্দুল্লাহ ছিল।

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার, আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রযিয়াল্লাহু আনহুম- এই চার জনকে নবীন ছাহাবী, যারা কাছাকাছি বয়সী ছিলেন, দীর্ঘ দিন বেঁচে ছিলেন এবং মানুষ তাঁদের ইলমের মুখাপেক্ষী ছিলেন, তাঁদেরকে একত্রে আবাদিলা আরবাআ‘ বা চার আব্দুল্লাহ বলা হয়। উল্লেখ্য, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু আবাদিলার অন্তর্ভুক্ত নন। তিনি বয়সে এই চার জনের সমবয়সী না হওয়ায় তাকে এই চার জনের মধ্যে গণনা করা হয়নি।[10]

(চলবে)

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক

ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; এম. এ. (অধ্যয়নরত),
উলূমুল হাদীছ বিভাগ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।


[1]. ইমাম সাখাবী, ফাতহুল মুগীছ, ৪/৩৯।

[2]. হাফেয ইরাকী, শারহুত তাবছিরা ওয়াত তাযকিরা, ২/৯১।

[3]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১০/৩৬০-৩৬১; তাহযীবুল কামাল, ২৯/২৬।

[4]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৮/২১৮-২১৯; তাহযীবুল কামাল, ৩০/৪৪৮।

[5]. তাহযীবুল কামাল, ২৯/৯০-৯২।

[6]. তাহযীবুল কামাল, ১০/৩৬০-৩৭০; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৪/৩২০-৩৩০।

[7]. মা‘রেফাতুছ ছাহাবা, ৩/১৭০০; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৩/৩৩১-৩৬০।

[8]. তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত, ১/২৭৫।

[9]. আর-রিয়াদুল মুসতাত্ববাহ ফী জুমলাতি মান রওয়া ফিছ ছহীহাইনে মিনাছ ছাহাবা, পৃ. ২০৩।

[10]. আল্লামা যাইলাঈ হানাফী, নাছবুর রায়াহ, ৩/১২১।

Magazine