‘রঙের লুটোপুটি আকাশের কাছে
অজানায় প্রতিদিন বাতাসে ওড়ে
স্মৃতির সারমর্ম ফেরি করে; অতঃপর
ঠোঁটের কোণায় মৃত্যুর মৌনতা
শিশিরে মুখরিত ঘাসের বুক
হামাগুড়ি দিয়ে সবুজ শহরে
লতাপাতায় অস্তগামী নির্জনতা।’
কবির কবিতা দিয়েই শুরু করছি আজকের লেখাটি। ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্য ও কল্যাণে আকৃষ্ট হয়ে বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামী শাসনব্যবস্থা ক্বায়েমের যে জোয়ার উঠে সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের মাটিতেও।
অষ্টম শতাব্দীতে স্পেনে ক্বায়েম হয় ইসলামী শাসন। মুসলিমদের নিরলস প্রচেষ্টায় স্পেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি লাভ করে।
দীর্ঘ ৮০০ বছর একটানা অব্যাহত থাকে এ উন্নতির ধারা। স্পেনের ৮০০ বছরের গৌরবময় মুসলিম শাসনের শেষ অধ্যায়। অর্থসম্পদ, বিত্ত-বৈভবের অঢেল জোয়ার তখন স্পেনে। মুসলিমরা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে ভুলে যায় কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা। নৈতিক অবক্ষয় ও অনৈক্য ধীরে ধীরে গ্রাস করে তাদের। এ দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে খ্রিষ্টানজগৎ। তারা মেতে ওঠে কুটিল ষড়যন্ত্রে।
সিদ্ধান্ত নেয়, স্পেনের মাটি থেকে মুসলিমদের উচ্ছেদ করতে হবে। এ চিন্তা নিয়েই পর্তুগীজ রাণী ইসাবেলা চরম মুসলিমবিদ্বেষী পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান সম্রাট ফার্ডিনান্ডকে বিয়ে করে। বিয়ের পরে দুজন মিলে নেতৃত্ব দেয় মুসলিম নিধনের। অন্যান্য খ্রিষ্টান রাজাও এগিয়ে আসে তাদের সহযোগিতায়। চক্রান্ত করে স্পেনের যুবরাজকে হাত করে নেয় তারা। এরপর শুরু হয় তাদের স্পেন থেকে মুসলিম নিধনের অভিযান।
হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে উল্লাস করতে করতে ছুটে আসে তারা শহরের দিকে। অবশেষে একদিন সম্মিলিত বাহিনী এসে পৌঁছে রাজধানী গ্রানাডায়।
একদিন টনক নড়ে মুসলিম বাহিনীর। তারা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মুসলিমদের গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতে দেখেই ভড়কে যায় সম্মিলিত খ্রিষ্টান বাহিনী। শহরের বাইরে দাঁড়িয়ে আল-হামরা মিনারের দিকে লোভাতুর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে রাজা ফার্ডিনান্ড ও রাণী ইসাবেলা।
কখনো সম্মুখযুদ্ধে মুসলিমদের পরাজিত করতে পারেনি বলে ধূর্ত ফার্ডিনান্ড পা বাড়ায় ভিন্নপথে। প্রথমেই গ্রানাডার আশপাশের সব শস্যখামার জ্বালিয়ে দেয়। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় শহরের খাদ্য সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র ভেগা উপত্যকা। দ্রুত দুর্ভিক্ষ নেমে আসে শহরে। বিপদ যখন প্রকট আকার ধারণ করল, তখন প্রতারক ফার্ডিনান্ড ঘোষণা করল, মুসলিমরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দিয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেয়, তবে তাদের বিনা রক্তপাতে মুক্তি দেওয়া হবে।
সেদিন ছিল ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা এপ্রিল। দুর্ভিক্ষতাড়িত গ্রানাডাবাসী অসহায় নারী ও মা‘ছূম বাচ্চাদের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে খ্রিষ্টানদের আশ্বাসে বিশ্বাস করে খুলে দেয় শহরের প্রধান ফটক। সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেয় আল্লাহর ঘর পবিত্র মসজিদে।
শহরে প্রবেশ করে খ্রিষ্টান বাহিনী মুসলিমদেরকে মসজিদের ভেতর আটকে রেখে প্রতিটি মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়। এরপর শহরের সমস্ত মসজিদে একযোগে আগুন লাগিয়ে বর্বর উল্লাসে মেতে ওঠে হায়েনারা। লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ, শিশু অসহায় আর্তনাদ করতে করতে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারায় মসজিদের ভেতর।
প্রজ্বলিত অগ্নিশিখায় দগ্ধ অসহায় মুসলিমদের আর্তচিৎকারে যখন গ্রানাডার আকাশ-বাতাস ভারী ও শোকাতুর করে তুললো তখন রাণী ইসাবেলা ক্রুর হাসি হেসে বলতে লাগল, “হায়! ‘এপ্রিলের বোকা’। শত্রুর আশ্বাসে কেউ বিশ্বাস করে?” সেই থেকে খ্রিষ্টানজগৎ প্রতিবছর পহেলা এপ্রিল আড়ম্বরের সাথে পালন করে আসছে ‘April Fool’ নামে এপ্রিলের বোকা উৎসব।
কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, আজও মুসলিমরা জানে না প্রতারক খ্রিষ্টানদের এই ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের ইতিকথা। প্রতিবছর পহেলা এপ্রিলে অজ্ঞতা ও অশিক্ষার কারণে পাশ্চাত্য দেশগুলোর অনুকরণে হাসি-তামাসায় মেতে ওঠে আমাদের দেশে অনেকে। যেমন— খালি খামের উপর ঠিকানা লিখে চিঠি পোস্ট করে, মিথ্যা টেলিফোন করে, মিথ্যা কথা বলে বিভিন্ন হয়রানিমূলক প্রতারণা করে। এটা নিতান্তই আত্মপ্রবঞ্চনা ও অজ্ঞতার পরিচয়।
অতএব, আসুন! এই বিয়োগান্তক নিষ্ঠুর ঘটনাবলির দিনটির কথা অনুধাবন করে তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করি এবং তুলে ধরি নতুন প্রজন্মের কাছে নির্মম ঘটনার সঠিক ও নির্ভুল তথ্য।
মহিউদ্দিন বিন জুবায়েদ
মুহিমনগর, চৈতনখিলা, শেরপুর।
তথ্যসূত্র :
১. নৈঃশব্দের নিঃসঙ্গ বয়ান, কাব্যগ্রন্থ।
২. ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতিকেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত লিফলেট।
৩. ইসলামিক ডায়রী, মোহাম্মদ নজরুল খান আল মারুফ।