জনগণের প্রতি শাসকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য:[1]
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুসলিম শাসকের কাঁধে গুরুত্বপূর্ণ বহু দায়িত্ব অর্পিত হয়। দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধান শাসকশ্রেণির দায়িত্বের মূল বিষয়। এতদুভয়ের নিরাপত্তা রক্ষায় তাদেরকে সামাজিক, সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বহু গুরু দায়িত্ব পালন করতে হয়। নিচে এসব দায়িত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো:
১. সামাজিক দায়িত্ব: ইসলাম ও মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা সরকারের সামাজিক দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। যেসব বিষয় সামাজিক দায়িত্বের আওতাভুক্ত:
ক. দ্বীনের হেফাযত: দ্বীনের হেফাযত মুসলিম সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি আসবে, সেটি হচ্ছে দ্বীনের মূলনীতিসমূহ সংরক্ষণ ও নির্ভেজাল আক্বীদা লালন। সরকারকে একদিকে যেমন দ্বীনের আক্বীদা, আমল, আখলাক, হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে, তেমনি দ্বীনের ব্যাপারে যাবতীয় ভ্রান্ত আক্বীদা-আমলকে দূরীভূত করতে হবে।
খ. বিচারকার্য পরিচালনা: বিবাদমান দুই পক্ষের মধ্যে ইনছাফের সাথে বিচার-ফয়সালা করে দেওয়া সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, যাতে যালেম আর সীমালঙ্ঘন করতে না পারে এবং মাযলূম ধীরে ধীরে আরো দুর্বল না হয়ে যায়। সেজন্য, সরকারকে যোগ্য ও ন্যায়পরায়ণ বিচারক নিয়োগ দিতে হবে এবং বিচারকার্য তদারকি করতে হবে। তবে, অন্যায়ভাবে বিচারকার্যে হস্তক্ষেপ করার অধিকার সরকারের নেই। অনুরূপভাবে শরী‘আত পরিপন্থি কোনো ফয়সালা বিচারক দিতে পারবেন না।
গ. হুদূদ বা দণ্ডবিধি বাস্তবায়ন: হুদূদ শব্দটি আরবী। এটি হাদ্দুন-এর বহুবচন। শরী‘আত নির্ধারিত শাস্তিকে হাদ্দ বলে, যা আল্লাহ বা বান্দার হক্ব হিসেবে ওয়াজিব হয়।[2] যেসব অপরাধে শরী‘আত হাদ্দের বিধান প্রণয়ন করেছে, সেগুলো হলো- যেনা, যেনার অপবাদ, চুরি, নেশা করা, ত্রাস সৃষ্টি করা, ইসলাম ত্যাগ করা ও চরমপন্থা অবলম্বন করা। সুতরাং এসব অপরাধে কেউ জড়িয়ে পড়লে সরকার তার ক্ষেত্রে ইসলামের দণ্ডবিধি কার্যকর করবে। এতে সমাজে অপরাধ একেবারেই কমে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَآ أُولِي الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ ‘আর হে বিবেকবান লোকেরা! ক্বিছাছের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে, আশা করা যায় তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করবে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৭৯)। তবে মনে রাখতে হবে, এসব দণ্ডবিধি কার্যকর করার অধিকার শুধু সরকারের। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পরস্পর দণ্ডবিধি কার্যকর করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে না।
ঘ. নিজে উত্তম আদর্শ হওয়া: সরকারকে আদর্শবান হতে হবে। চরিত্র, আমল-আখলাকে জনগণের জন্য মডেল হতে হবে। সরকার ভালো হলে জনগণও ভালো হতে সচেষ্ট হবে। পক্ষান্তরে সরকার এর বিপরীতটা হলে জনগণও সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করবে। উমার ইবনুল খাত্ত্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর শাসনামলে তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ দুনিয়াবিমুখ হতে শিখেছিলেন। উমাইয়া শাসক ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালিক রাহিমাহুল্লাহ-এর শাসনামলে তার দেখাদেখি মানুষ মসজিদ নির্মাণের প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। ইতিহাসে এমন উদাহরণের অভাব নেই।
ঙ. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ: এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দ্বীনকে রক্ষা করতে হলে এর বিকল্প নেই। দেশ রক্ষায়ও এর ভূমিকা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হওয়া উচিত, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, ভালো কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম’ (আলে ইমরান,৩/১০৪)। অতএব, সরকার এমন কিছু লোক নিয়োগ দিবে, যারা এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করবেন।
চ. জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার: একটি জাগ্রত ইসলামী রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। মহান আল্লাহ ইলম অর্জনের প্রতি উৎসাহিত করে বলেন, اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ ‘পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (আল-আলাক্ব, ৯৬/১)। আর আল্লাহ আলেম-উলামার সম্মান বহুগুণ বৃদ্ধি করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,يَرْفَعِ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا مِنْكُمْ وَالَّذِيْنَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন’ (আল-মুজাদালাহ, ৫৮/১১)। এসব বক্তব্যে দ্বীনী জ্ঞানের বিশেষ গুরুত্ব ফুটে উঠলেও ইসলাম অন্যান্য উপকারী জ্ঞান অর্জনকেও উৎসাহিত করে। দেশের শান্তি-সমৃদ্ধিতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভূমিকা অসামান্য। সুতরাং সরকারের উপর এর পৃষ্ঠপোষকতা করা জরুরী। পক্ষান্তরে যেসব জ্ঞান দ্বীন ও দেশের জন্য ক্ষতিকর, সেগুলো নিষিদ্ধ করাও সরকারের দায়িত্ব।
ছ. জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন: রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম শাসকগণকে জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এবং তাদের উপর তাদের সাধ্যাতীত বোঝা চাপাতে নিষেধ করেছেন। তিনি এরশাদ করেছেন, اَللّٰهُمَّ، مَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِيْ شَيْئًا فَشَقَّ عَلَيْهِمْ، فَاشْقُقْ عَلَيْهِ، وَمَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِيْ شَيْئًا فَرَفَقَ بِهِمْ، فَارْفُقْ بِه ‘হে আল্লাহ! যে আমার উম্মতের কোনোরূপ কর্তৃত্বভার লাভ করে এবং তাদের প্রতি রূঢ় আচরণ করে, আপনি তার প্রতি রূঢ় হোন। আর যে আমার উম্মতের উপর কোনোরূপ কর্তৃত্বভার লাভ করে তাদের প্রতি নম্র আচরণ করে, আপনি তার প্রতি নম্র ও সদয় হোন’।[3] সুতরাং মুসলিম সরকারকে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।
জ. হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়া ও খেয়ানত বর্জন করা: জনগণের হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়া এবং তাদের সাথে খেয়ানত না করা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য। এক্ষেত্রে যদি সরকার সচেষ্ট হতে পারে, তাহলে সবাই সফলতার মুখ দেখতে পারবে। হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়া ও খেয়ানত বর্জন করা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অতএব, কেউ হিতাকাঙ্ক্ষী হলো না মানে সে খেয়ানত করল। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম শাসকগণকে জনগণের হিতাকাঙ্ক্ষী হতে এবং তাদের সাথে খেয়ানত না করতে আদেশ করেছেন। তিনি বলেন,مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيْهِ اللهُ رَعِيَّةً، يَمُوْتُ يَوْمَ يَمُوْتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِه، إِلَّا حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ ‘আল্লাহ যে বান্দাকে জনগণের দায়িত্ব দিয়েছেন, তার যদি তাদের সঙ্গে খেয়ানতকারীরূপে মৃত্যু হয়, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন’।[4] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,مَا مِنْ أَمِيْرٍ يَلِي أَمْرَ الْمُسْلِمِيْنَ، ثُمَّ لَا يَجْهَدُ لَهُمْ، وَيَنْصَحُ، إِلَّا لَمْ يَدْخُلْ مَعَهُمُ الْجَنَّةَ ‘মুসলিমদের দায়িত্বে নিযুক্ত কোনো শাসক যদি তাদের কল্যাণ কামনা না করে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বাত্মক প্রয়াস না চালায়, তাহলে সে তাদের সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’।[5] হাদীছ দু’টি থেকে জনগণের হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়া ও তাদের সাথে খেয়ানত বর্জনের গুরুত্ব স্পষ্ট বুঝা যায়। পক্ষান্তরে এর বিপরীত অবস্থার ভয়াবহ পরিণতির কথাও বুঝা যায়। সুতরাং শাসকশ্রেণিকে সাবধান হতে হবে।
২. সামরিক দায়িত্ব: দেশের ভূখণ্ড ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জনগণের জান-মালের হেফাযত সরকারের সামরিক দায়িত্বের আওতায় পড়ে।
ক. দেশের নিরাপত্তা রক্ষা: অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় দিক থেকে সরকারকে দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করতে হবে। যাতে দেশের মধ্যকার বা বাইরের কেউ শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করতে না পারে, তার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে।
খ. সীমান্ত রক্ষা: দেশের সীমান্ত রক্ষা করা সরকারের গুরু দায়িত্ব। সে কারণে, সরকারকে সীমান্ত রক্ষার জন্য বিশেষ সশস্ত্র বাহিনী গঠন করতে হবে, তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র সরবরাহ করতে হবে, যাতে বহিঃশত্রু কর্তৃক দেশ আক্রান্ত না হয়। মহান আল্লাহ বলেন, وَأَعِدُّوْا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَّمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُوْنَ بِه عَدُوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِيْنَ مِنْ دُونِهِمْ لَا تَعْلَمُوْنَهُمُ اللهُ يَعْلَمُهُمْ ‘আর তাদেরকে মোকাবিলা করার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী সদা প্রস্তুত রাখবে, যদ্বারা তোমরা ভয় দেখাতে থাকবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে। আর তাদের ছাড়াও অন্যদেরকেও, যাদেরকে তোমরা জানো না, কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে জানেন’ (আল-আনফাল, ৮/৬০)।
গ. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিচালনা করা: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিচালনা করা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি সামরিক দায়িত্ব। সরকারের নেতৃত্বে জনগণের উপর আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা ফরয।
৩. রাজনৈতিক দায়িত্ব: দেশ ও জনগণ এবং সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত কোন নীতিতে চলবে— এগুলো সরকারের রাজনৈতিক দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। আরো যেসব দায়িত্ব রাজনৈতিক দায়িত্বের আওতায় পড়ে—
ক. ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা: ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে, ইসলামী আইন ও বিধিবিধান ক্বায়েম করা, যা দ্বীন ও রাষ্ট্রের মধ্যে অথবা দ্বীন ও রাজনীতির মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না। কেননা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন নবী ও রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন, তেমনি তিনি ছিলেন প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনাপতি। অনুরূপভাবে তার পরে তার খোলাফায়ে রাশেদূনও ঠিক তেমনই ছিলেন। বরং উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসনামলেও মুসলিম শাসকগণ দ্বীন ও রাজনীতি উভয়ের নেতৃত্ব দিতেন। অতএব, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণপূর্বক মুসলিম সরকারের উচিত, দ্বীন ও রাজনীতির মধ্যে বিভাজন না করা এবং দ্বীনকে মসজিদে বন্দী না করে ফেলা। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ هٰذِه أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوْنِ ‘নিশ্চয় তোমাদের এ জাতি তো একই জাতি। আর আমিই তোমাদের রব। অতএব, তোমরা আমার ইবাদত করো’ (আল-আম্বিয়া, ২১/৯২)।
খ. পরামর্শভিত্তিক কাজ করা: পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। মহান আল্লাহ বলেন, وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ‘আর কাজ-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন’ (আলে ইমরান, ৩/১৫৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَأَمْرُهُمْ شُورٰى بَيْنَهُمْ ‘আর তাদের কার্যাবলি তাদের পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে’ (আশ-শূরা, ৪২/৩৮)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও অনেক বিষয়ে ছাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন। অনুরূপভাবে খোলাফায়ে রাশেদূন আবূ বকর, উমার, উছমান ও আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুমও পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করতেন। সুতরাং স্বেচ্ছাচারিতা না করে সরকারকে পরামর্শভিত্তিক কাজ করতে হবে।
গ. যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন: এটা সরকারের অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবে এমন আমানতদার ও শক্তিশালী দায়িত্বশীল নিয়োগ দেওয়া সরকারের কর্তব্য, যাতে তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْأَمِيْنُ ‘নিশ্চয় আপনি যাদেরকে মজুর নিযুক্ত করবেন, তাদের মধ্যে সে উত্তম, যে শক্তিশালী, আমানতদার’ (আল-ক্বছাছ, ২৮/২৬)। আবূ যার গিফারী রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব চাইলে তিনি তাকে বলেন,يَا أَبَا ذَرٍّ! إِنَّكَ ضَعِيْفٌ، وَإِنَّهَا أَمَانَةٌ، وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْيٌ وَنَدَامَةٌ، إِلَّا مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا، وَأَدَّى الَّذِيْ عَلَيْهِ فِيهَا ‘হে আবূ যার! তুমি একজন দুর্বল প্রকৃতির লোক, আর শাসনকার্য হলো একটি আমানত। নিশ্চয় তা হবে ক্বিয়ামতের দিন অপমান ও লাঞ্ছনা। তবে সে ব্যক্তি ব্যতীত, যে তা ন্যায়সংগতভাবে গ্রহণ করেছে এবং নিষ্ঠার সাথে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে’।[6] সুতরাং রাষ্ট্রনায়ককে যোগ্য দায়িত্বশীল নিয়োগ দিয়ে সবাই মিলে আমানতের সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,يَآ أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تَخُوْنُوا اللهَ وَالرَّسُوْلَ وَتَخُونُوآ أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহ ও রাসূলের সাথে খিয়ানত করো না। আর খিয়ানত করো না নিজেদের আমানতসমূহের’ (আল-আনফাল, ৮/২৭)।
ঘ. নিজে রাষ্ট্রীয় বিষয়াদির তত্ত্বাবধান: রাষ্ট্রনায়ককে অবশ্যই রাষ্ট্র ও জনগণের বিষয়াদি নিজে তত্ত্বাবধান করতে হবে। শুধু দায়িত্বশীলদের উপর নির্ভর করলে চলবে না। বরং দায়িত্বশীলদের দায়িত্বের তদারকিও সরকার প্রধানকে করতে হবে। কোনো অজুহাত দিয়েই এই দায়িত্বে অবহেলা করার সুযোগ নেই।
ঙ. জনগণের মধ্যে ইনছাফ প্রতিষ্ঠা: জনগণের মধ্যে ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করা সরকারের আরেকটি গুরু দায়িত্ব। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوْا بِالْعَدْلِ ‘আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে, তখন ইনছাফভিত্তিক ফয়সালা করবে’ (আন-নিসা, ৪/৫৮)। আয়াতটি রাজা-বাদশাহ সবার জন্য প্রযোজ্য। বেইনছাফী করলে তার জন্য ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। পক্ষান্তরে ন্যায়পরায়ণ শাসকের জন্য পরকালে রয়েছে বিশেষ ছায়া।[7]
৪. অর্থনৈতিক দায়িত্ব: কীভাবে সরকারি কোষাগার সমৃদ্ধ করা হবে, কোন নীতিতে এবং কোন কোন খাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়িত হবে, জনগণের জন্য জরুরী প্রয়োজনীয় কী কী জিনিসপত্র যোগান দেওয়া হবে ইত্যাদি সরকারের অর্থনৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
ক. রাষ্ট্রীয় তহবিল সমৃদ্ধ করা: অর্থ না থাকলে রাষ্ট্রযন্ত্র ঠিকমতো চলতে পারে না। সেজন্য সরকারকে রাষ্ট্রীয় তহবিল সমৃদ্ধির কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। তবে, তা যেন হয় বৈধ পন্থায়। যাকাত, ছাদাক্বা, ট্যাক্স, জিযিয়া এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য আয় রাষ্ট্রীয় তহবিলের বৈধ উৎস হতে পারে। যাকাত উত্তোলন ও নির্ধারিত খাতে বণ্টন মুসলিম সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব।
খ. মালের সুষ্ঠু বণ্টন: রাষ্ট্রীয় মালের সুষ্ঠু বণ্টন করা সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য ব্যয়ের খাত যথারীতি হিসাব করে সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মাল খরচ করতে হবে। কোনোভাবেই যেন মালের অপচয় ও অপব্যবহার না হয়— সেদিকে সরকারকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
গ. সামাজিক সম্প্রীতি ও সংহতি গড়ে তোলা: একটি রাষ্ট্রের শান্তির জন্য জনগণের পারস্পরিক সম্প্রীতি, সংহতি, সৌহার্দ, সাহায্য-সহযোগিতা, আন্তরিকতার অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَثَلُ الْمُؤْمِنِيْنَ فِيْ تَوَادِّهِمْ، وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكٰى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعٰى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمّٰى ‘মুমিনদের দৃষ্টান্ত তাদের পারস্পরিক সম্প্রীতি, দয়ার্দ্রতা ও সহমর্মিতার দিক দিয়ে একটি মানবদেহের মতো। যখন তার একটি অঙ্গ অসুস্থ হয়, তখন তার সমগ্র দেহ তাপ ও অনিদ্রা ডেকে আনে’।[8] সরকারকে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর এ দায়িত্ব পালনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে, সুষ্ঠু অর্থনৈতিক নীতিমালা।
ঘ. সমৃদ্ধি ও উন্নতির বিভিন্ন মাধ্যম সহজ করে দেওয়া: এখানে অনেক দায়িত্ব সরকারের কাঁধে চাপে। যেমন- জনগণের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা ও উপযুক্ত বাসস্থানের বিষয়টি সহজলভ্য করে দেওয়া, কৃষিকাজের জন্য সার্বিক সহযোগিতা করা, জনশক্তিকে কাজে লাগানো, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপাদন করা। যেগুলো কোনোভাবেই দেশে উৎপাদন সহজ নয়, সেগুলো আমদানি ও সরবরাহের পথ সুগম করা ইত্যাদি।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, বায়‘আত ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, যা ছাড়া মানুষের শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নতি, সমৃদ্ধি কোনো কিছুই সম্ভব নয়। বায়‘আত ছাড়া ইসলামের প্রয়োজনীয় বহু বিধিবিধান আমল ও বাস্তবায়নের বাইরে থেকে যাবে।
কিন্তু খুবই দুঃখজনক কথা হচ্ছে, ইসলামের যেসব বিষয়ের অপব্যাখ্যা হয়েছে, যেসব বিষয় নিয়ে সংশয় ও বিভ্রাট তৈরি হয়েছে, বায়‘আত সেসব বিষয়ের অন্যতম। সুতরাং এ নিয়ে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন।
সম্মানিত পাঠক! সংক্ষিপ্তাকারে এই হচ্ছে বায়‘আত সম্পর্কিত আলোচনা। আল্লাহর কসম! এর মাধ্যমে আমি কুরআন-হাদীছের বক্তব্য ও সালাফে ছালেহীনের বুঝের আলোকে বায়‘আতের সঠিক ও নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর প্রয়াস পেয়েছি। ইলমী আমানত হিসেবে তথ্যগুলো আমি উপস্থাপন করেছি। এর মাধ্যমে আমি কেবল আমাদের সংশোধন চেয়েছি। আমি চাই, আমাদের এ সম্পর্কিত ভুল ভাঙ্গুক। ভুলে ডুবে না থেকে ভুল থেকে ফিরে আসা প্রকৃত হকপন্থির বৈশিষ্ট্য। আমি মনে করি, আমাদের বাংলা ভাষায় নিরপেক্ষভাবে এ বিষয়ে আরও গবেষণা, লেখালেখি ও বক্তব্য হওয়া প্রয়োজন।
মহান রব্বুল আলামীন এই ক্ষুদ্র প্রয়াসটুকু কবুল করুন- আমীন!
আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী
বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. এ শিরোনামের অন্তর্গত তথ্যাবলি ড. আহমাদ মাহমূদ প্রণীত ‘আল-বায়‘আতু ফিল ইসলাম’ বইয়ের ২৯৯-৩১৪ পৃষ্ঠার আলোকে রচিত।
[2]. আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিইয়্যাতুল কুয়েতিইয়্যাহ, ১২/২৫৪-২৫৫, (ইসলাম ও ওয়াক্বফ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, কুয়েত, প্রকাশকাল: ১৪০৪-১৪২৭ হিজরী)।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৮|
[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪২।
[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪২।
[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৫।
[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৮০৬|
[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮৬।