চলমান বিশ্বে টিনএজদের[1] নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র মারাত্মক শোচনীয় ও করুণ। ধর্মবোধ, নৈতিকতার বন্ধন ছিন্ন করে পাশ্চাত্য সভ্যতার ছোবল ও তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ ছাড়াও মাদকাসক্তি আজকের শিশু-কিশোরদের ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের কিনারে। ফলে জাতির আগামী দিনের রূপকার আজ চরম অবক্ষয়ের সম্মুখীন। টিনএজ সমস্যায় নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র মোটাদাগে স্পষ্ট। যাদের চরিত্র হওয়ার কথা ছিল মহৎ, উন্নত ও আদর্শময়। তাদের হওয়ার কথা সমাজসংস্কারের রূপকার, জাতির পরবর্তী প্রজন্মের আইডল। অথচ তারাই মিথ্যা, সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ, মাদকদ্রব্য, অশ্লীলতা ও খুনখারাবি ইত্যাদি অনৈতিক কাজকর্ম লিপ্ত। এমন এক সংকটময় বিপজ্জনক পরিস্থিতির স্বীকার টিনএজদের হওয়ার কারণ কী এবং এর থেকে উত্তরণের পথ ও পন্থা কী হতে পারে? বক্ষ্যমান প্রবন্ধে সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াস পাব।
টিনএজদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ ও প্রতিকার :
(১) পারিবারিক সুশিক্ষার অভাব : আজকের কথিত আধুনিকমনা অধিকাংশ পরিবারের মারাত্মক সমস্যা হলো সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত না করা। বড় বড় নামিদামি প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর জন্য সন্তানকে প্রাইভেট, কোচিং করানো হচ্ছে। তাদেরকে বিভিন্ন মাধ্যমে মোটিভেট ও টেক-কেয়ার করা হচ্ছে। অথচ স্বার্থক ও সমৃদ্ধ জাতির কাণ্ডারী হিসেবে সন্তানদের মানসিকতা গঠনের পাশাপাশি তাদের আধ্যাত্মিক উন্নয়নে অবদান রাখার ঘাটতি আধুনিক অভিভাবকদের মাঝে লক্ষণীয়। সুশিক্ষার বুনিয়াদি শক্তিই হলো পরিবার। প্রতিষ্ঠান মূলত বিল্ডিং বা দালানকোঠার ন্যায়। আর শিক্ষাজীবনের যাত্রা শুরু হয় পরিবার থেকেই। তাই পরিবার যদি সন্তানের আদর্শিক ও নৈতিক শিক্ষার বুনিয়াদি ভিত্তি গঠন না করে, তবে সে সমাজ বা রাষ্ট্র কখনোই উন্নত শিক্ষা ও আধুনিক চিকিৎসা কোনো ক্ষেত্রে কোনোই অবদান রাখতে পারবে না। কেননা জাতি গঠনের ভিত্তি তথা সুশিক্ষা সেখানে অনুপস্থিত ছিল। তাই সন্তানকে সুশিক্ষা তথা ধর্মীয় শিক্ষার চেতনা শিশু বয়সেই সৃষ্টি করতে হবে। এভাবে যত দিন যাবে, সন্তান আদর্শবান হওয়ার বদলে বেয়াদব ও অসভ্য হবে। তাই একজন সন্তানের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হলো তার পরিবার তথা একজন আদর্শ মা। এজন্য সন্তানকে শিক্ষিত করতে চাইলে অবশ্যই একজন শিক্ষিত মা প্রয়োজন। খাদ্য-পানীয়র চেয়েও একজন শিক্ষিত মা একটা আদর্শ পরিবারের জন্য অতীব জরুরী। কেননা ধর্মবোধ সৃষ্টি হয় পরিবার থেকেই। আর নৈতিকতাও সৃষ্টি হয় ধর্মবোধের চেতনা থেকে। তাই আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সুশিক্ষা তথা ধর্মীয় শিক্ষা আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের মূলভিত্তি। এর গুরুত্ব বোঝাতে Stanly Hall বলেন, ‘If you teach their the three ‘Rs’ Reading, Writing and Arithmetic and don't teach the fourth ‘R’ Religion they are sure to become fifth ‘R’ Rascal’. অর্থাৎ ‘যদি তুমি তাদেরকে (টিনএজদের) তিনটি ‘আর’ তথা পড়া, লেখা ও গণিত বিদ্যা শিক্ষা দাও এবং চতুর্থ ‘আর’ (ধর্ম) শিক্ষা না দাও তাহলে অবশ্যই তারা পাঁচ নম্বর ‘আর’ বেয়াদব হবে’। পারিবারিক সুশিক্ষার অভাবে আজকের শিশু-কিশোরদের দ্বারা এমন কোনো অন্যায় নেই যা সংঘটিত হচ্ছে না। লাগামহীন জীবন চলার পথে তাদের ছেড়ে দিয়েছে আজকের আধুনিকমনা অধিকাংশ অভিভাবক। ফলে সমাজে শিক্ষিত সমাজ গঠনের জায়গায় এক অপদার্থ জাতি গঠন হওয়ার উপক্রম। তাই মানুষের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা যেমন মৌলিক অধিকার, ঠিক তেমনি একজন মানুষের জীবনে সুশিক্ষাও মৌলিক অধিকার। অতএব, প্রত্যেক পরিবারের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো সন্তানকে পারিবারিক সুশিক্ষা তথা ধর্মীয় শিক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাহলে একটা ভালো, কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি।
(২) অভিভাবকদের উদাসীনতা ও দায়িত্ব সচেতনতার অভাব : অভিভাবকদের উদাসীনতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতার অভাবে আজকের শিশু-কিশোরের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। তাদের জীবনও মারাত্মক দুর্বিষহ ও চরম বিকারগ্ৰস্ত। এই চলমান সমস্যার গোড়ায় পানি না ঢালা পর্যন্ত তথা অভিভাবকরা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন না হওয়া পর্যন্ত শিশু-কিশোরদের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করা মোটেও সম্ভব নয়। সন্তান কী করছে, কী পড়ছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে পড়ছে, কখন ঘুমাচ্ছে, কখন খাচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে যদি অভিভাবক খোঁজখবর না রাখেন, তবে সন্তানকে স্পষ্ট ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার দায় অভিভাবক এড়াতে পারবে- এমনটা আমার নিকট বোধগম্য নয়। এই ফেতনার যুগে যখন ঘরে রেখেই সন্তানকে ফেতনার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন তাকে ঘরের বাইরে কীভাবে তাকে ফেতনা থেকে মুক্ত রাখবেন? বিশেষ করে যখন আপনি তাকে ছেড়ে লাগামহীন একলা পথে দিয়েছেন! এজন্য অভিভাবকদের যথেষ্ট ভূমিকার প্রয়োজন। নইলে এ জাতিতে ‘ঐশী’-এর মতো আবারও নিকৃষ্ট সন্তানের জন্ম হবে। যারা সমাজের নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে যুগের পর যুগ থাকবে জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। অভিভাবক যদি তাদের দায়িত্বের গুরুত্ব না বুঝেন এবং এর প্রয়োজনীয়তা ও জবাবদিহিতার অনুভূতি তার মধ্যে সৃষ্টি না হয়, তবে তো একটি আমূল পরিবর্তনযোগ্য সমাজ কখনোই আশা করা যাবে না। নীতি-নৈতিকতার মূল্যবোধ সৃষ্টি করা অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। শুধু সন্তান জন্ম দিয়েই বাবা, মা হওয়া যায় কিন্তু উপযুক্ত অভিভাবক হওয়া যায় না। চতুষ্পদ জন্তুও সন্তান জন্ম দেয়। তাহলে এখানে মানুষ আর চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে পার্থক্য হলো মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতায়, যা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মৌলিকভাবে পার্থক্য সূচিত করে। সন্তানকে যেমনভাবে শাসন করতে হবে, ঠিক তেমনি আদর ও ভালোও বাসতে হবে। নচেৎ সন্তান নষ্ট হয়ে যাবে। অভিভাবকদের সন্তান গঠনে বড় ভূমিকা হলো সন্তানকে তার ঘুম থেকে শুরু করে টয়লেট পর্যন্ত সব বিষয়ে উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া। তাহলে সেও যেমনভাবে উপকৃত ও সাজানো গোছানো পরিপাটি জীবনের অধিকারী হতে পারবে, তেমনি সমাজে আদর্শ ও মডেল অভিভাবক হিসেবে সমাদৃত হওয়া যাবে। ফলে অন্য অভিভাবকদের আইডল হওয়ায় মুসলিম পরিবারের সন্তান যোগ্য, সৎ ও আদর্শ সমাজের রূপকার হতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। এজন্য অভিভাবকদের উদাসীনতার জায়গায় সচেতনতা, দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্ৰত করতে হবে। যতক্ষণ না অভিভাবকগণ দায়িত্ব সচেতন হবেন, ততক্ষণ টিনএজদের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করাও সম্ভব হবে না।
(৩) শিক্ষা সিলেবাসে সমস্যা : যেকোনো দেশের শিশুদের আগামীর দেশ গড়ার রূপকার, কাণ্ডারী করে গড়ে তুলতে চাইলে অবশ্যই টেকসই, দীর্ঘমেয়াদী বুনিয়াদী শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, নচেৎ জাতির সফলতা ও উন্নতির পথ রুদ্ধ হবে। সেই সাথে তাদের চারিত্রিক পদস্খলন অনিবার্য। এজন্য শিক্ষার সিলেবাস হতে হবে সমৃদ্ধ। নৈতিক শিক্ষা ছাড়াও এর অধ্যায় ও অনুচ্ছেদের কবিতা, ছড়া ও গল্প হবে শিক্ষণীয় ও আদর্শিক। ফলে শিশুমনেই উন্নত আদর্শ ও নৈতিকতা জাগ্ৰত হবে। মনে মনে সেই রকম হওয়ার বীজ সেই শিশুমনের গহীনে বদ্ধমূল হবে। যদি এমনভাবে শিক্ষা সিলেবাস ঢেলে সাজানো যায়, তবে আশু ফলাফল পাওয়া যাবে। অন্যথা শিক্ষা অর্জন হবে কিন্তু জাতীয় উন্নতি ও আদর্শ সমাজ গঠনের সাথে শিশু-কিশোরদের নৈতিক অবক্ষয়ের গায়ে একটুও আঁচড় পড়বে না। বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো আজকের শিক্ষা সিলেবাস নিয়ে। নেই কোনো নৈতিকতাবোধসম্পন্ন পড়া; বরং তার জায়গা দখল করেছে বিভিন্ন ছবি-মূর্তি আর শিক্ষার নামে আজগুবি ছড়া-কবিতা। এমনকি ঈমান বিনষ্টকারী কুফরী মতবাদে ভরপুর পাঠ্যবই। সবচেয়ে বেশি লজ্জা লাগে একজন মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর বিষয় তথা বয়ঃসন্ধিকাল, স্বপ্নদোষ, মেয়েদের মাসিকসহ অপ্রীতিকর বিষয়গুলোও ভরা ক্লাসে লাজ-শরমের পরোয়া না করে দিব্যি পড়ানো হচ্ছে আজকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তাহলে আপনিই বিবেচনা করুন কেন আজকের টিনএজদের হাতে অপরাধ সংঘটিত হবে না। এজন্য শিক্ষা সিলেবাস পরিবর্তন কাম্য। দেশ ও দশের কল্যাণে শিক্ষা সিলেবাসে পরিবর্তন আবশ্যক।
(৪) বিদেশি সংস্কৃতির আমদানি : বিদেশি সংস্কৃতির আমদানি যেকোনো দেশের জন্য উন্নতির অন্তরায়। দেশীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য একটা দেশের জন্য স্বনির্ভরতার প্রতীক ও পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সম্বল। দেশীয় সংস্কৃতির লালন ও প্রতিপালন একজন দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য; যদি সেটা শালীনতা বজায় রাখে, ধর্মের সীমানা অতিক্রম না করে। বাংলাদেশ সংস্কৃতিমনা একটি স্বাধীন দেশ। সংস্কৃতির উজ্জ্বল নেপথ্যের ধারক-বাহক মূলত এদেশের মানুষ বিশেষ করে শিক্ষার্থী; যারা ভবিষ্যতের রাহবার ও ধারক-বাহক। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তারা এদেশের সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুসরণ করেছে। ফলে সংস্কৃতি বলতে আজকের উদীয়মান টিনএজরা বিদেশি সংস্কৃতিকে বুঝে। বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো, বিদেশি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে এদেশের একশ্রেণির জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবী। বিদেশি সংস্কৃতি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি এবং অদূর ভবিষ্যতে সামনে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। যতদিন সমাজ বিদেশি সংস্কৃতিকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ না করবে, ততদিন পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতীয় জীবনে উন্নতি হবে না। এজন্য দেশীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য একান্তই জরুরী। বিদেশি সংস্কৃতির আমদানি মানেই দেশীয় সংস্কৃতিকে বিকলাঙ্গ ও অবমূল্যায়ন করা, নিজের জাতিসত্তাকে লাঞ্ছিত করা ও জাতীয় অস্তিত্বকে বিশ্ব মানচিত্রে সংকটাপন্ন করা। তাই বিদেশি সংস্কৃতি নয়; বরং দেশীয় সংস্কৃতিই আজকের শিশু-কিশোরদের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।
(৫) সহশিক্ষা : টিনএজদের আদর্শবান করে গড়ে তোলার জন্য ছেলেমেয়ে একসাথে পাঠদান নিষিদ্ধ করা খুবই জরুরী। নইলে সহশিক্ষার কুপ্রভাবে শিশু-কিশোরদের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করা মোটেও সম্ভব হবে না। কেননা পজিটিভ ও নেগেটিভ উভয়ে উভয়ের জন্য বিপজ্জনক। সহশিক্ষা শিশু-কিশোরদের অবৈধ যৌনাচারের পথকে খুলে দেয়, যার দরুন শিশু জীবন চলার পথে নৈতিক অবক্ষয়ের কবলে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান। শিশু-কিশোরদের নৈতিকতাকে নিষ্কলুষ রাখতে সকলের সম্মিলিত ভূমিকা প্রয়োজন। যদি এমনভাবে চলতেই থাকে, তবে জাতিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষমান থাকতে হবে। কেননা, আদর্শিক বিপর্যয় কখনোই কোনো দেশ ও জাতিকে অগ্ৰসর হতে দেয়নি। কারণ আদর্শ এমন এক গুণ, যা মানুষের জীবনকে পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করে। জীবনকে করে সৎ, সুন্দর ও সার্থক। সহশিক্ষার কুফল আজকে শিশু-কিশোর ও টিনেজদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর কেমন প্রভাব ফেলছে, তা সাময়িক রিপোর্ট ও পরিসংখ্যান থেকে সহজে অনুমিত হয়। পত্র-পত্রিকা খুললেই তাদের ক্রমবর্ধমান অপরাধপ্রবণতা চোখে পড়ে। ইউরোপ ও আমেরিকাসহ অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশগুলোর অবস্থা আরো করুণ, যা বলতেও লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। তাই জাতির এই সত্যকে এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই যে, শিশু-কিশোরের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হলো সহশিক্ষা। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা যখন একত্রিত হবে, তখন এই পন্থা দূর করা সম্ভব হবে- ইনশা-আল্লাহ। দৈনিক পত্র-পত্রিকায় অহরহ দেখা যায়, দুইজন মেয়ে এক ছেলেকে পাওয়ার জন্য ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত। বন্ধু বান্ধবীকে আর বান্ধবী বন্ধুকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করছে। ছেলেমেয়ের বিবাহবহির্ভূত অবাধ মেলামেশায় গর্ভধারণের রেকর্ড পত্রপত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকহারে লক্ষণীয়।
(৬) মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা : বর্তমান সময়ে মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা খুব সহজ হওয়ায় টিনএজসহ যে কেউ এই নিষিদ্ধ পথে পা বাড়াতে মোটেও পরোয়া করে না। সস্তা দামে কেনার সুযোগ থাকায় শয়তানী প্ররোচনার খপ্পরে পড়ে মাদকদ্রব্যের জ্বলন্ত খাদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাদীছে ‘মাদককে সকল পাপের মা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।[2]
যেহেতু মাদকদ্রব্য মানুষের মস্তিষ্ক লোপ করে, ফলে তার মাধ্যমে যেকোনো অন্যায় বা অপকর্ম সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই শরীআতে মাদকদ্রব্যের সেবন, পরিবেশন ও যে কোনোভাবে এতে জাড়িয়ে যাওয়ার শাস্তি সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। মাদকদ্রব্য যেমনভাবে ব্যক্তির উপর শারীরিক প্রভাব ফেলে, ঠিক তেমনি মানসিক, আর্থিকসহ বিভিন্ন স্তরে এর কুফল প্রভাবিত করে জীবনকে বরবাদ করে।
(৭) অসৎ সঙ্গ : সর্ব মহলে জ্ঞাত ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। সৎ সঙ্গ জীবন চলার পথে দ্বীপ্ত মশালের এক অনন্য সঙ্গী। যে সঙ্গ সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে পাশে থাকে সেটাই তো প্রকৃত সঙ্গ। সৎ সঙ্গ একে অপরের জন্য দু‘আ ও কল্যাণ কামনা করে। পাপের পথে চলতে নিষেধ করে। পুণ্যের পথে চলতে উৎসাহ ও উদ্দীপনা যোগায়। মালেক ইবনু দীনার রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে বন্ধুর কাছ থেকে কোনো উপকার পাওয়া যায় না, তার সঙ্গ ত্যাগ করো।[3] বিখ্যাত তাবেঈ বাকর ইবনু মুহাম্মাদ আল-আবিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমাকে দাঊদ আত-তাঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, হে বাকর! তুমি খারাপ মানুষ থেকে বেঁচে থাকো, যেভাবে তুমি হিংস্রপ্রাণী থেকে দূরে থাকো।[4] আব্দুল আযীয ইবনুল খাত্ত্বাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, একদিন মালেক ইবনু দীনার রাহিমাহুল্লাহ-এর কাছে একটি বিশাল ও ভয়ংকর কালো কুকুর বসে থাকতে দেখা গেল। এ দৃশ্য দেখে লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আবূ ইয়াহইয়া! আপনার পাশে যে কুকুর বসে আছে? তিনি বললেন, এটি খারাপ বন্ধু থেকে উত্তম।[5]
চিন্তা করুন! সালাফদের জীবন চলার গতি কেমন ছিল। অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য তাদের মিশন কেমন ছিল। সৎ সঙ্গ গ্ৰহণের জন্য তারা যেমন উদগ্ৰীব ছিলেন, ঠিক তেমনি অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ করে প্রয়োজনে একাকিত্ব বরণ করার জন্য সদা প্রস্তুত ছিলেন। তবুও অসৎ সঙ্গ গ্ৰহণ করতে পূর্ববর্তী সালাফগণ মোটেও রাজি ছিলেন না।
এটাই বাস্তবতা। এজন্য খাদ্য, পানীয় যেমন জরুরী, ঠিক তেমনি সৎ বন্ধু নির্বাচনে কোনো রকম শিথিলতা প্রদর্শন করা যাবে না। নচেৎ অসৎ বন্ধুর খপ্পরে পড়ে জীবন জাহান্নামের কিনারে পড়বে। তাই সচেতন অভিভাবকদের উচিত হবে, সন্তানকে সৎ বন্ধু নির্বাচনে সহযোগিতা করা এবং তাদেরকে অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ করার জন্য পরামর্শ দেওয়া আর এর পরিণাম ও ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করা। ফলে ছোট মগজে এই বিষয়টি দারুণ প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা যায়।
(৮) উলামায়ে কেরামের বক্তব্য ও তা‘লীম বিমুখতা : আমাদের আজকের সমাজের অধিকাংশ আধুনিক অভিভাবকগণ হরহামেশাই আলেম-উলামার সঙ্গে বাচ্চাদের সখ্যতা গড়তে মোটেও রাজি নন। তাদের বক্তব্য হলো, লেখনী পড়ার প্রতি তাদের কোনো উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে না। ফলে ধর্মীয় মূল্যবোধ, সম্মানবোধ ও ভক্তির পরিবর্তে বেয়াদবি, অশালীন আচরণ জায়গা দখল করছে। এমন অনেক অভিভাবক আছেন, যাদের সন্তান দিনরাত নেশার সাথে জড়িত ছিল, পরে কোনো আলেমের সংস্পর্শে এসে তার বিশাল পরিবর্তন হয়েছে। সে অবৈধ সম্পর্ক, জুয়া, নেশা বাদ দিয়েছে। সে এখন ইবাদত-বন্দেগী করে আর বাবা-মার সাথে ভদ্র মার্জিত ব্যবহার করে। কিন্তু আফসোস হয় ঐ অভিভাবকদের জন্য, যারা সন্তানের এমন দৃশ্য দেখে ভয় পায়। এই ভেবে যে, না জানি ছেলে আমার বিপথে যাচ্ছে বা জঙ্গি হচ্ছে! এমনকি ছেলের উপর নির্যাতন চালাতে কুণ্ঠাবোধ করে না। একবার ভাবুন! যেই ছেলে দুদিন আগে ছিল একটা অন্ধকার জগতে আর সেই ছেলে আলেমদের সংস্পর্শে এসে, তাদের বক্তব্য, লেখনী পড়ে এমন পরিবর্তন হচ্ছে; অথচ অভিভাবকগণ দৃশ্যপটের পরিবর্তন করছেন ভুল চিন্তা-ভাবনার খপ্পরে আটকা পড়ে। আলেমরাই একটি সৎ, নির্ভীক ও কর্মঠ জাতি গঠনের রূপকার। আলেমরাই একটি আদর্শবাদী সমাজ নির্মাণের কারিগর। দৈহিক, মানসিক সকল কল্যাণ সাধনে আলেমরাই অবদান রেখেছে, রাখছে এবং রাখবে- ইনশা-আল্লাহ। তাই অভিভাবকদের উচিত হবে, সন্তানদের বিজ্ঞ আলেমদের সাথে সখ্যতা তৈরিতে সুযোগ দেওয়া। তাদের লেখনী, বক্তব্যর সাথে পরিচিত করানো। ফলে এর মধ্য দিয়েই একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কামনা করা যেতে পারে।
(৯) সমাজসংস্কারের কাজে নিয়োজিত করার জন্য উৎসাহিত না করা : সমাজসংস্কারের জন্য সন্তানকে ছোট বয়স থেকেই উৎসাহ দিতে হবে, উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে হবে। নিজেও নিয়োজিত থাকবে, সাথে সন্তানকেও রাখবে। তাহলে এই সমাজসংস্কারের জন্য ছোট বয়সেই এমন বড় মন-মানসিকতার তৈরি হবে- ইনশা-আল্লাহ। সন্তানকে সবসময় ভালো, পরোপকারী ও কল্যাণকর কাজের প্রতি উৎসাহ জোগাতে হবে। সাথে করে নিয়ে এই সকল মহৎ কাজে শরীক হতে হবে। ফলে ছোট বয়সেই একটা শক্তিশালী অনুভূতি জাগ্ৰত হবে। মানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আপনি অনেক সময় যে দান করেন, আপনার দানের টাকাটা নিজে ফকিরকে না দিয়ে আপনার সন্তানের দ্বারা দিন। দেখবেন এই দানটা আপনার সন্তানের জন্য কত বড় উপকারী হিসেবে কাজ করবে, তা হয়তো আপনি অনুভবই করতে পারবেন না। এই ছোট্ট সামান্য কাজটি ছোট্ট শিশুমনে একটা দারুণ প্রভাব ফেলবে। বুঝতে শিখবে এভাবে ফকিরকে সাহায্য করতে হয়। এভাবে সমাজসংস্কারমূলক কাজ করতে হয়, দেশ ও দশের উন্নতি সাধন হয়, একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ হয়; এসকল কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার সাথে সাথে নিজ সন্তানকেও নিয়োজিত করলে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ পাওয়া যাবে ইনশা-আল্লাহ।
(১০) পর্নোগ্ৰাফিতে আসক্ত হওয়া : পর্নোগ্ৰাফি বলতে বুঝায় যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল বাক্য, সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নাচ, তা হতে পারে সিনেমা, নাটক, ছবি, কার্টুন ইত্যাদি। পর্নোগ্রাফি এতই সহজলভ্য হয়েছে যে, শিশু-কিশোররা খুব সহজেই এতে আসক্ত হচ্ছে। পর্নোগ্ৰাফির অবাধ অসক্তি জাতিকে নষ্ট ও অসভ্য করে তুলছে। অশ্লীলতা, নোংরামি, নির্লজ্জতার এক বিরাট স্রোতে ভেসে যেতে বসেছে আজকের টিনএজ সমাজ। যদি এই স্রোতকে এখনই বাধা দেওয়া না হয়, তবে টিনএজ সমাজকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। প্রযুক্তির সাথে যুক্ত শিশু-কিশোর বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে। ইউজারদের চাহিদা অনুযায়ী প্রাপ্ত বিভিন্ন নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তারা এক ক্লিকেই অশ্লীলতার জগতে প্রবেশ করে। ফলে সেখান থেকে তাদের ফিরে আসা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। ড. ভূন বলেন, নিষ্পাপতার দিন শেষ। মানুষ এখন ইন্টারনেটে অনেক কিছু জানতে পারে। এটা হচ্ছে ঘরে হিরোইন রেখে বাচ্চাকে ছেড়ে দেওয়ার মতো।[6]
পর্নোগ্রাফির বিষাক্ত ছোবলে সকল পাপের পথ খুলে যায়। পর্নোগ্ৰাফির মরণ ছোবল থেকে এই জাতিকে মুক্ত করা খুবই জরুরী। যৌন সুড়সুড়ির ফলে তারা খুব সহজেই অশ্লীল কাজে জড়িয়ে পড়ে। এর নেশা খুব মারাত্মক, যা মাদকদ্রব্যের চেয়েও ভয়াবহ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের দোসররা অবৈধ সন্তান তৈরির কারখানা হিসেবে পর্নোগ্ৰাফির ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করে। আমেরিকার এক জরিপ বলছে, প্রতিবছর আমেরিকার স্কুলগুলোতে পর্নোগ্ৰাফিতে আসক্ত ২৮০০০ হাজারের বেশি ছাত্রী গর্ভবতী হচ্ছে। অন্য রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৪-১৬ বছর বয়সী ২৫২ শিক্ষার্থীর মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ অশ্লীল সিনেমা তথা পর্নো দেখে অবৈধ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে।
তবে একবার ভেবে দেখুন! পর্নোগ্ৰাফির চিত্র যদি এমন করুণ হয়, তবে জাতির নৈতিক অবক্ষয় কোথায় গিয়ে ঠেকবে! তাই জাতিকে এই অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে হলে দেশ-বিদেশের যত পর্ণ বা অশ্লীল সাইট আছে, তার সবই বন্ধ করতে হবে এবং শিশু-কিশোরদের অবাধ ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত তাদেরকে ইন্টারনেট ব্রাউজিং এর সুযোগ দেওয়া যাবে না।
পরিশেষে বলতে চাই, আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের জন্য যত পবিত্র ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে, তাদের জীবনযাত্রার মানও তত বেশি উন্নত ও পবিত্র হবে। অতএব, আমাদের অভিভাবকদের পবিত্র দায়িত্ব ও একমাত্র কর্তব্য হলো সব ধরনের নৈতিক অবক্ষয়, মানসিক বিপর্যয়, অশ্লীল পরিবেশ ও খারাপ চিন্তা-ভাবনা থেকে তাদেরকে রক্ষা করা এবং তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা, যাতে তাদের নিরাপদ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়; নচেৎ তাদের উদাসীনতাই একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট।
তাই সকলের উচিত এই ফেতনার গোলক ধাঁধায় না পড়ে শিশু-কিশোরদের নৈতিক অবক্ষয় রক্ষা করা। তাদেরকে আদর্শ নাগিরক হিসেবে গঠন করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে একটি সৎ, নির্ভীক, কর্মঠ জাতি গঠনের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মাযহারুল ইসলাম
অধ্যয়নরত, দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা দারুস সুন্নাহ, মিরপুর, ঢাকা।
[1]. ‘টিনএজ’ মানে উঠতি বয়সী। ১৩-১৯ বছর বয়সীদের টিনএজ বা টিনেজার বলা হয়।
[2]. ছহীহুল জামে‘ আছ-ছগীর, হা/৩৩৪৪, ‘হাসান’।
[3]. হিলইয়াতুল আউলিয়া, ২/৩৭২।
[4]. রওযাতুল উকালা, পৃ. ৮২ ।
[5]. প্রাগুক্ত।
[6]. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ এপ্রিল, ২০১৫, পৃ. ৮।