কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মুহাররম মাসের তাৎপর্য ও কারবালার ইতিহাস

post title will place here

ভূমিকা:

আরবী চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাস হলো মুহাররম মাস। হাদীছে এই মাসকে ‘আল্লাহর মাস’ বলে সম্মানিত করা হয়েছে আর এই মাসের ছিয়ামকে সর্বোত্তম নফল ছিয়াম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ ‘রামাযানের পরে সর্বোত্তম ছিয়াম হলো আল্লাহর মাস মুহাররমের ছিয়াম’।[1] আশূরা আরবী শব্দ, এর অর্থ হলো দশম।

আশূরায়ে মুহাররমে ছিয়াম পালনের তাৎপর্য:

এ দিনে মহান আল্লাহ মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সঙ্গী-সাথী বানূ ইসরাঈলকে ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার করেন এবং ফেরাউন ও তার সঙ্গীদেরকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মারেন। তাই ইয়াহূদীরাও এই মাসকে সম্মান করত এবং ছিয়াম পালন করত। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় এলেন, তখন দেখলেন ইয়াহূদীরা আশূরার দিনে ছিয়াম পালন করছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, مَا هَذَا الْيَوْمُ الَّذِي تَصُومُونَهُ؟ ‘এটা কী এমন দিন যে, তোমরা এ দিনে ছিয়াম রাখছ?’ ইয়াহূদীরা বলল,هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ أَنْجَى اللهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا فَنَحْنُ نَصُومُهُ ‘এ এক মহান দিন, যাতে আল্লাহ বানূ ইসরাঈলকে তাদের শত্রু (ফেরাউনের কবল) থেকে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। তাই মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে এই দিনে ছিয়াম পালন করেছিলেন’। এ কথা শুনে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ ‘মূসা আলাইহিস সালাম-এর ব্যাপারে তোমাদের চাইতে আমরা অধিক হক্বদার ও তাঁর অধিক নিকটবর্তী।’ সুতরাং তিনি ঐ দিনে ছিয়াম রাখলেন এবং অন্যকে ছিয়াম রাখার আদেশ দিলেন।[2] সালামা ইবনু আকওয়া রাহিমাহুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَ رَجُلًا يُنَادِي فِي النَّاسِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ إِنَّ مَنْ أَكَلَ فَلْيُتِمَّ أَوْ فَلْيَصُمْ وَمَنْ لَمْ يَأْكُلْ فَلاَ يَأْكُلْ ‘আশূরার দিন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে এ বলে লোকদের মধ্যে ঘোষণা দেওয়ার জন্য পাঠালেন যে, ‘যে ব্যক্তি খেয়ে ফেলেছে সে যেন পূর্ণ করে নেয়’ অথবা বলেছেন, ‘সে যেন ছওম রাখে আর যে এখনো খায়নি সে যেন আর না খায়’।[3]

ইয়াহূদীরা শুধু ১০ মুহাররম ছিয়াম পালন করে। তাই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لَئِنْ بَقِيتُ إِلَى قَابِلٍ لَأَصُومَنَّ التَّاسِعَ ‘যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তাহলে অবশ্যই (১০ মুহাররমের সাথে উক্ত মাসের) নবম তারিখেও ছিয়াম রাখব’।[4]

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আশূরার দিনে ছিয়াম রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে বলেন, أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ ‘আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তিনি বিগত এক বছরের গুনাহ মোচন করে দিবেন’।[5] ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَحَرَّى صِيَامَ يَوْمٍ فَضَّلَهُ عَلَى غَيْرِهِ إِلَّا هَذَا اليَوْمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَهَذَا الشَّهْرَ يَعْنِي شَهْرَ رَمَضَانَ ‘আমি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আশূরার ছিয়ামের ওপরে অন্য কোনো দিনের ছিয়ামকে প্রাধান্য দিতে দেখিনি এবং এ মাস তথা রামাযান মাস (এর ওপর অন্য কোনো মাসকে গুরুত্ব প্রদান করতেও দেখিনি)’।[6] আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত,كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَ بِصِيَامِ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ كَانَ مَنْ شَاءَ صَامَ وَمَنْ شَاءَ أَفْطَرَ ‘আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে আশূরার দিনে ছিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, পরে যখন রামাযানের ছিয়াম ফরয করা হলো, তখন যার ইচ্ছা ছিয়াম পালন করত আর যার ইচ্ছা করত না’।[7]

কারবালার ইতিহাস:

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকালের ৫০ বছর পরে ৬১ হিজরীর মুহাররম মাসের ১০ তারিখে তাঁর প্রিয়তম নাতি হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু ইরাকের কারবালার প্রান্তরে শহীদ হন। এ ঘটনা মুসলিম উম্মতের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। তবে মুহাররম মাসের ফযীলতের সাথে এর কোনোই সম্পর্ক নেই।

ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ: ৬০ হিজরীতে ইরাকবাসীরা জানতে পারে যে, হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু ইয়াযীদের হাতে বায়আত করেননি। তাই তারা তার হাতে বায়আত করতে আগ্রহী হয়। এই জন্য তারা তাকে কূফায় আসার জন্য প্রায় ৫০০ চিঠি পাঠায়। বিষয়টি যাচাই করার জন্য তিনি তার চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকীলকে কূফায় প্রেরণ করেন। মুসলিম এসে জানতে পারেন যে, আসলেই তারা হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-কেই চাচ্ছে। অতএব, তিনি হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পক্ষে বায়আত নেওয়া শুরু করেন। এতে ২০ হাজার ইরাকবাসী হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পক্ষে বায়আত নেয়। অন্য দিকে সিরিয়ায় ইয়াযীদের নিকট উক্ত বায়আত গ্রহণের কথা পৌঁছা মাত্রই তিনি বাছরার গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার জন্য নির্দেশ দেন এবং বলেন, কূফাবাসী যেন হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ না করে। কিছু বর্ণনায় এসেছে যে, মুসলিম ইবনে আকীলের কিছু সমর্থক উবায়দুল্লাহর প্রাসাদ ঘেরাও করেন। গভর্নর এটা দেখে ইয়াযীদের সেনাবাহিনীর ভয়ভীতি দেখান। তাই ইয়াযীদের ধরপাকড় ও শাস্তির ভয়ে মুসলিমকে রেখে তারা পলায়ন করে। ফলে উবায়দুল্লাহ মুসলিমকে গ্রেফতার করে হত্যার আদেশ দেয়। কূফাবাসীদের এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানিয়ে মুসলিম দ্রুত হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে একটি পত্র প্রেরণ করে জানিয়ে দেন যে, হুসাইন! তুমি সবাইকে নিয়ে মদীনায় ফেরত যাও। কারণ তারা বায়আতের ব্যাপারে ওয়াদা রক্ষা করেনি। হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু মক্কা হতে কূফার উদ্দেশ্যে ৮ যিলহজ্জ তারিখে রওয়ানা দেন। যাত্রাপথে চিঠি হস্তগত হলে তিনি কূফার পথ পরিহার করে সিরিয়ায় ইয়াযীদের কাছে যাওয়ার জন্য বাসনা করেন। কিন্তু ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কারবালার ময়দানে তার গতিরোধ করে। তখন তিনি তাদের নিকট তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন— (১) তাকে ইয়াযীদের নিকট যেতে দেওয়া হোক, যাতে তিনি ইয়াযীদের হাতে বায়আত গ্রহণ করতে পারেন অথবা (২) তাকে মাদীনায় ফিরে যেতে সুযোগ দেওয়া হোক অথবা (৩) তাকে যেকোনো সীমান্তের দিকে যেতে দেওয়া হোক, যাতে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত সেখানে বসবাস করতে পারেন। কিন্তু তারা তার কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ করল না। পরিশেষে যা হবার তাই হলো। গুটিকয়েক লোক নিয়ে হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের সাথে যুদ্ধ করলেন। অবশেষে তিনিসহ সবাই কারবালা প্রান্তরে শহীদ হন। তাকে শহীদ করে ইয়াযীদের সৈন্য শাম্মার ইবনে যুল জাওশান।

শিক্ষা:

(১) কূফাবাসী শীআদের বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি জানা গেল।

(২) ইয়াযীদ হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে হত্যা করার আদেশ দেননি।

(৩) ইয়াযীদের কয়েকজন সেনাবহিনীই হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হত্যার জন্য দায়ী।

(৪) হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে হত্যা করা যেমন অন্যায় ছিল; অনুরূপভাবে উমার, উছমান ও আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুম-কে হত্যা করাও মর্মান্তিক ছিল কিন্তু তাদের জন্য তো শীআরা ক্রন্দন ও মাতম করে না। কারণ হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রকৃত হত্যাকারী ছিল তারাই। এখন তারা মাতম ও শোক পালন করে শাক দিয়ে মাছ ঢাকছে। আল্লাহই অধিক অবগত!

কারবালার ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করার পরিণাম: এক শ্রেণির লোক ১০ মুহাররম হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর স্মরণে শোক মিছিল বের করে, মর্সিয়া ও শোকগাঁথা গায়, মাতম করে, বুক চাপড়ায়, ইমাম হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নকল কবর তৈরি করে মিছিল বের করে, মাতম করতে করতে শরীরের অংশ বিশেষ কেটে নিজেকে রক্তাক্ত করে। অনেকে ইয়াযীদ, মুআবিয়া, আমর ইবনুল ‘আছ রাযিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ ছাহাবীকে গালিগালাজ করে, যা ইসলামী শরীআতে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। অথচ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَطَمَ الخُدُودَ، وَشَقَّ الجُيُوبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الجَاهِلِيَّةِ ‘যে ব্যক্তি গালে আঘাত করে, কাপড় ছিঁড়ে এবং জাহিলিয়্যাতের ডাক ডাকে সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[8] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,النِّيَاحَةُ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ وَإِنَّ النَّائِحَةَ إِذَا مَاتَتْ وَلَمْ تَتُبْ قَطَعَ اللَّهُ لَهَا ثِيَابًا مِنْ قَطِرَانٍ وَدِرْعًا مِنْ لَهَبِ النَّارِ ‘মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা জাহিলিয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত। বিলাপকারী যদি তওবা না করে মারা যায়, তাকে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ আলকাতরার কাপড় প্রদান করবেন এবং অগ্নিশিখা দ্বারা নির্মিত বর্ম পরিধান করাবেন’।[9] তিনি আরও বলেছেন,لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِي فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيفَهُ ‘তোমরা আমার ছাহাবীদেরকে গালি দিয়ো না। আল্লাহর শপথ! তোমাদের কেউ উহুদ পাহাড় সমতুল্য স্বর্ণ ব্যয় করলেও তাদের একজনের এক মুষ্টি ও অর্ধ মুষ্টি পরিমাণ পৌঁছতে পারবে না’।[10]

উপসংহার:

পরিশেষে বলা যায় যে, মুহাররম মাস অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ একটি মাস। ফযীলতপূর্ণ অনেক ইবাদতের সমারোহ ঘটেছে এই মাসে। আর এই মাসে সংঘটিত কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যেন আমাদের জীবন পরিচালনা করতে পারি। আল্লাহ আমাদের জন্য বিষয়গুলো সহজ করে দিন- আমীন!

মাহবূবুর রহমান মাদানী

শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬৩; মিশকাত, হা/২০৩৯।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২০০৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭১৪।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯২৪।

[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৩৪।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬২।

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/২০০৬।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/২০০১।

[8]. ছহীহ বুখারী, হা/১২৯৪।

[9]. ইবনু মাজাহ, হা/১৫৮১, হাদীছ ছহীহ।

[10]. ছহীহ বুযখারী, হা/৩৬৭৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৪১।

Magazine