আমাদের জানা দরকার যে, সব রাগ খারাপ নয়। কখনো কখনো রাগ প্রশংসনীয় আর কখনো নিন্দনীয় হতে পারে। যদি আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাগ করা হয় এবং অন্যায় ও হারাম কাজ প্রতিরোধে রাগ করা হয়, তাহলে তা প্রশংসনীয়। বরং অন্যায় দেখে মনে রাগ সৃষ্টি হওয়া মজবুত ঈমানের আলামত। পক্ষান্তরে ব্যক্তিগত স্বার্থে বা দুনিয়াবী ছোটখাটো বিষয়ে রাগ করা নিন্দনীয়। রাগ করা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা মানুষকে বিচিত্ররূপে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের শরীরের রঙে যেমন ভিন্নতা রয়েছে, তেমনই তাদের স্বভাব-চরিত্রেও বিচিত্রতা স্পষ্ট। কেউ রাগী, আবার কেউ ধৈর্য ও সহনশীল। রাগ এক ধরনের আবেগ, যার বহিঃপ্রকাশ একেকজনের ক্ষেত্রে একেকভাবে হয়ে থাকে। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে রাগ ও রাগ নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কে জানব ইনশা-আল্লাহ।
ইসলামের দৃষ্টিতে রাগ: কোনো কারণবশত কোনো মানুষের রেগে যাওয়া বা রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো স্বাভাবিক হলেও অল্পতে রেগে যাওয়া মানবীয় ত্রুটি, যা ইসলামে নিন্দিত। ইসলাম রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছে। এমনকি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগ নিয়ন্ত্রণ করাকে প্রকৃত বীরত্ব বলে আখ্যা দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَا تَعُدُّونَ الصُّرَعَةَ فِيكُمْ قَالُوا الَّذِى لاَ يَصْرَعُهُ الرِّجَالُ قَالَ لاَ وَلَكِنَّهُ الَّذِى يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ ‘তোমাদের মাঝে কোন ব্যক্তিকে তোমরা বীর বলে গণ্য কর?’ ছাহাবীগণ বলেন, ‘যাকে লোকজন পরাভূত করতে পারে না’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না, বরং প্রকৃত বীর হলো সেই ব্যক্তি, যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখে’।[1] অন্য একটি হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগ করতে নিষেধ করেছেন। কারণ রাগ এমন একটি আবেগের বহিঃপ্রকাশ, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মানুষকে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় এবং মানুষ বড় ধরনের বিপদে পড়তে পারে। এ কারণে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ছাহাবীদের রাগ নিয়ন্ত্রণের তাগিদ দিতেন।
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ t أَنَّ رَجُلاً قَالَ لِلنَّبِىِّ ﷺ أَوْصِنِى قَالَ «لاَ تَغْضَبْ». فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ «لاَ تَغْضَبْ».
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে বললেন, ‘আপনি আমাকে উপদেশ দিন’। তিনি (নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘তুমি রাগ করো না’। লোকটি কয়েকবার তা বলেন, নবীজি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেকবারই বলেন, ‘রাগ করো না’।[2] তাই আমাদের উচিত রাগ সংবরণ করা। কারণ অতিরিক্ত রাগ শয়তানের পক্ষ থেকে আসে।
রাগ নিয়ন্ত্রণে করণীয়: রাগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে, যা আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন।
১. আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া: যখন অতিরিক্ত রাগ হবে, তখন আল্লাহ তাআলার নিকট বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাইতে (আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বনির রজীম বলতে) হবে।
عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ صُرَدَ قَالَ اسْتَبَّ رَجُلاَنِ عِنْدَ النَّبِىِّ ﷺ فَجَعَلَ أَحَدُهُمَا تَحْمَرُّ عَيْنَاهُ وَتَنْتَفِخُ أَوْدَاجُهُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ «إِنِّى لأَعْرِفُ كَلِمَةً لَوْ قَالَهَا هَذَا لَذَهَبَ عَنْهُ الَّذِى يَجِدُ أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ». فَقَالَ الرَّجُلُ هَلْ تَرَى بِى مِنْ جُنُونٍ.
সুলায়মান ইবনু ছুরাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘দুই ব্যক্তি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে পরস্পরকে গালমন্দ করতে লাগলেন। তাদের একজনের চোখ লাল হতে থাকে ও ঘাড়ের রগ ফুলে যেতে থাকে। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি অবশ্যই এমন একটি বাক্য জানি, এ ব্যক্তি তা বললে তার রাগ চলে যাবে। তা হলো, অভিশপ্ত শয়তান থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইছি’। লোকটি বললেন, ‘আপনি কি আমার মাঝে পাগলভাব দেখছেন?’[3]
২. দাঁড়ানো থেকে বসে যাওয়া: দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কেউ যদি অতিরিক্ত রাগান্বিত হয়ে পড়ে, তাহলে তার উচিত হলো বসে পড়া। বসে পড়ার পরও যদি তার রাগ না কমে, তাহলে তাকে শুয়ে পড়তে হবে। কেউ যদি এই কাজ করতে পারে, তাহলে তার রাগ প্রশমিত হয়ে যাবে ইনশা-আল্লাহ। কারণ আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই আমাদেরকে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখিয়েছেন। আবূ যার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِذَا غَضِبَ أَحَدُكُمْ وَهُوَ قَائِمٌ فَلْيَجْلِسْ فَإِنْ ذَهَبَ عَنْهُ الْغَضَبُ وَإِلاَّ فَلْيَضْطَجِعْ ‘তোমাদের কারো যদি দাঁড়ানো অবস্থায় রাগের উদ্রেক হয়, তাহলে সে যেন বসে পড়ে। এতে যদি তার রাগ দূর হয় তো ভালো, অন্যথা সে যেন শুয়ে পড়ে’।[4]
৩. রাগের মুহূর্তে চুপ থাকা: রাগ হলে তা সংরবণ করার চেষ্টা করতে হবে। রাগের সময় চুপ হয়ে যেতে হবে। কারণ সেই সময় কথা বললে সেই কথা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ফলে তাতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে আর রাগবশত কথা বললে তা পরবর্তীতে আমাদের জীবনে ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসে। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেছেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,عَلِّمُوا وَيَسِّرُوا، عَلِّمُوا وَيَسِّرُوا - ثَلَاثَ مَرَّاتٍ - وَإِذَا غَضِبْتَ فَاسْكُتْ - مَرَّتَيْنِ - ‘তোমরা জ্ঞান দান করো এবং সহজতা আরোপ করো। তোমরা জ্ঞান দান করো এবং সহজতা আরোপ করো।’ তিনি একথা তিনবার বলেন। ‘তুমি ক্রোধান্বিত হলে নীরবতা অবলম্বন করো’। কথাটি তিনি দুইবার বলেন’।[5]
৪. দেহের হক্ব সঠিকভাবে আদায় করা: মানুষের শরীরের কিছু হক্ব রয়েছে, যে হক্বগুলো পরিপূর্ণভাবে আদায় না করলে মানুষের শরীর অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই আমাদের উচিত প্রয়োজনীয় ঘুম ও বিশ্রাম গ্রহণ করা, সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ না করা, অযথা উত্তেজিত না হওয়া। ক্রুদ্ধ ব্যক্তিদের ক্রোধের কারণ খুঁজতে গিয়ে অধিকাংশ ব্যক্তির মধ্যেই যে কারণগুলো পাওয়া গেছে, তা হলো অধিক পরিশ্রমের কাজ করা, ক্লান্তি, অনিদ্রা, ক্ষুধা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলোই অধিক রাগের পিছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমাকে রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে আব্দুল্লাহ! আমি এ সংবাদ পেয়েছি যে, তুমি প্রতিদিন ছিয়াম পালন কর এবং সারারাত ছালাত আদায় করে থাক’। আমি বললাম, ঠিক (শুনেছেন) হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, ‘এরূপ করবে না, (বরং মাঝে মাঝে) ছিয়াম পালন করো আবার ছিয়াম ছেড়েও দাও। (রাতে) ছালাত আদায় করো, আবার ঘুমাও। কেননা তোমার উপর তোমার শরীরের হক্ব আছে, তোমার চোখের হক্ব রয়েছে, তোমার উপর তোমার স্ত্রীর হক্ব আছে, তোমার মেহমানের হক্ব আছে। তোমার জন্য যথেষ্ট যে, তুমি প্রত্যেক মাসে তিন দিন ছিয়াম পালন করবে। কেননা প্রতিটি নেক আমলের পরিবর্তে তোমার জন্য রয়েছে ১০ গুণ নেকী। এভাবে সারা বছরের ছিয়াম হয়ে যায়’। আমি বললাম, আমি এর চেয়েও বেশি আমল করতে সক্ষম। তখন আমাকে আরও বেশি আমলের অনুমতি দেওয়া হলো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আরও বেশি শক্তি রাখি। তিনি বললেন, ‘তবে তুমি আল্লাহর নবী দাঊদ আলাইহিস সালাম-এর ছিয়াম পালন করো, এর থেকে বেশি করতে যেয়ো না’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নবী দাঊদ আলাইহিস সালাম-এর ছিয়াম কেমন? তিনি বললেন, ‘অর্ধেক বছর’। রাবী বলেন, আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বৃদ্ধ বয়সে বলতেন, আহ! আমি যদি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত রুখছত (সহজতর বিধান) কবুল করে নিতাম![6] অতএব, আমাদের উচিত, শরীরের হক্ব আদায় করে শরীরের যত্ন নেওয়া।
রাগ নিয়ন্ত্রণের পুরস্কার: রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তাতে রয়েছে প্রভূত উপকার। রাগ দমনকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন। আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনে বলেন,الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সময়ে ব্যয় করে, ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন’ (আলে ইমরান, ৩/১৩৪)। আল্লাহ তাআলা এখানে যারা রাগ সংবরণ করেন, তাদেরকে সৎকর্মশীল বলেছেন এবং তাদের প্রতি ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেছেন। সাহল ইবনু মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ كَظَمَ غَيْظًا وَهُوَ قَادِرٌ عَلَى أَنْ يُنْفِذَهُ دَعَاهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَى رُءُوسِ الْخَلاَئِقِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ اللَّهُ مِنَ الْحُورِ مَا شَاءَ ‘যে ব্যক্তি তার রাগ প্রয়োগে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সকল সৃষ্টিকুলের সামনে ডেকে নিবেন এবং তাকে হূরদের মধ্য থেকে তার পছন্দমতো যে কাউকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিবেন’।[7]
তাই আমাদের উচিত অতিরিক্ত ও খারাপ রাগ নিয়ন্ত্রণ করা এবং আল্লাহর প্রিয় পাত্রে পরিণত হওয়া। আমাদের রাগ হতে হবে শুধু আল্লাহর জন্য। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
সহকারী শিক্ষক (ধর্ম), মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয়, তানোর, রাজশাহী।
[1]. আবূ দাঊদ, হা/৪৭৭৯, হাদীছ ছহীহ।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১১৬।
[3]. আবূ দাঊদ, হা/৪৭৮১, হাদীছ ছহীহ।
[4]. আবূ দাঊদ, হা/৪৭৮২, হাদীছ ছহীহ।
[5]. আদাবুল মুফরাদ, হা/১৩২০।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৭৫।
[7]. আবূ দাঊদ, হা/৪৭৭৭, হাসান।