(জুন’২৩ সংখ্যায় প্রকাশিতের পর)
৪. ঈমানের শাখা-প্রশাখা :
ঈমানের অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এটাই প্রমাণ করে যে, ঈমান শব্দটি যখন আলাদাভাবে ব্যবহার করা হবে, তখন তা দ্বীনের সমস্ত বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করবে। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের শাখা-প্রশাখাগুলো সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত পরিসরে বর্ণনা করেছেন।
সংক্ষিপ্ত পরিসর হলো, যেমনটা আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীছে এসেছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ شُعْبَةً وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ وفي رواية الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ ‘ঈমানের শাখা ৭০টির চেয়েও বেশি, আর লজ্জাশরম ঈমানের একটি শাখা। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ঈমানের শাখা ৭০টিরও কিছু বেশি অথবা ৬০টির কিছু বেশি। এর সর্বোচ্চ শাখা হচ্ছে (আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই) একথা স্বীকার করা, আর এর সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। আর লজ্জা ঈমানের একটি বিশেষ শাখা’।[1]
ইমাম আবূ বকর আল-বায়হাক্বী ‘ঈমানের ৭৭টি শাখা-প্রশাখা উল্লেখ করেছেন’।[2] এই শাখা-প্রশাখাগুলো নিম্নে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আসছে :
(১) আল্লাহর প্রতি ঈমান।
(২) রাসূলগণের প্রতি ঈমান।
(৩) ফেরেশতাগণের প্রতি ঈমান।
(৪) কুরআনুল কারীম ও সমস্ত নাযিলকৃত কিতাবের প্রতি ঈমান।
(৫) আল্লাহর পক্ষ থেকে ভালো ও মন্দ তাক্বদীরের প্রতি ঈমান।
(৬) শেষ দিবসের প্রতি ঈমান।
(৭) মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান।
(৮) কবর থেকে পুনরুত্থানের পরে হাশরের মাঠে সকল মানুষকে একত্রিতকরণের প্রতি ঈমান।
(৯) ঈমান বা বিশ্বাস রাখা যে, মুমিনদের আবাস হবে জান্নাত এবং কাফেরদের আবাস হবে জাহান্নাম।
(১০) আল্লাহকে ভালোবাসার আবশ্যকতার প্রতি ঈমান।
(১১) আল্লাহকে ভয় করার আবশ্যকতার প্রতি ঈমান’।[3]
(১২) আল্লাহর নিকট থেকে আশা করার আবশ্যকতার প্রতি ঈমান।
(১৩) আল্লাহর নিকট ভরসা করার আবশ্যকতার প্রতি ঈমান।
(১৪) নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভালোবাসার আবশ্যকতার প্রতি ঈমান।
(১৫) কোনো বাড়াবাড়ি ছাড়াই নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সম্মান, মর্যাদা ও শ্রদ্ধা করার আবশ্যিকতার প্রতি ঈমান।
(১৬) দ্বীনের প্রতি ব্যক্তির ভালোবাসা এমনকি কুফরী করার চাইতে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া তার নিকট অধিক প্রিয় হবে।
(১৭) ইলম অন্বেষণ করা। তা হলো— প্রমাণাদি সহকারে আল্লাহকে, তাঁর দ্বীন ও নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানা।
(১৮) ইলম প্রচার করা ও মানুষকে তা শিক্ষা দেওয়া।
(১৯) কুরআনুল কারীমকে সম্মান করা, কুরআন শিক্ষা করা, শিক্ষা দেওয়া, তাঁর সীমারেখা ও বিধানাবলি রক্ষা করা, হালাল-হারাম জানা, তার ধারক-বাহককে সম্মান করা ও মুখস্থ করার মাধ্যমে’।[4]
(২০) পবিত্রতা অর্জন ও ওযূর যত্ন নেওয়া।
(২১) পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত যথারীতি আদায় করা।
(২২) যাকাত প্রদান করা।
(২৩) ফরয ও নফল ছিয়াম পালন করা।
(২৪) ই‘তিকাফ করা।
(২৫) হজ্জ করা’।[5]
(২৬) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।
(২৭) আল্লাহর রাস্তায় সীমানা পাহারা দেওয়া।
(২৮) শত্রুর বিপক্ষে অনড় থাকা এবং যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন না করা।
(২৯) ইমাম অথবা বিজয়ীদের প্রতিনিধির নিকট গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ দেওয়া।
(৩০) আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে গোলাম (দাস) আযাদ করা।
(৩১) পাপের কারণে আবশ্যক কাফফারাসমূহ। সেগুলো কুরআন ও হাদীছে বিদ্যমান চারটি— (ক) হত্যার কাফফারা, (খ) যিহারের (স্বামী স্ত্রীকে বলা তোমার পিঠ আমার মায়ের মতো) কাফফারা, (গ) শপথের কাফফারা এবং (ঘ) রামাযানের ছিয়াম রাখা অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করা।
(৩২) চুক্তিসমূহ পূর্ণ করা।
(৩৩) আল্লাহর নেয়ামতরাজি গোনা এবং এই নেয়ামতরাজির যে প্রশংসা আবশ্যক তার হিসাব করা।
(৩৪) অপ্রয়োজনীয় বিষয় হতে জিহ্বা সংযত রাখা।
(৩৫) আমানত সংরক্ষণ করা এবং তা মালিকের নিকট পৌঁছে দেওয়ার আবশ্যকতা।
(৩৬) মানুষ হত্যা করা ও তাঁর ক্ষতি করা হারাম।
(৩৭) অবৈধভাবে লজ্জাস্থান ব্যবহার করা হারাম এবং তা পবিত্র রাখা ওয়াজিব।
(৩৮) হারাম সম্পদ হতে হাত গুটিয়ে রাখা। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো, চুরি করা, ছিনতাই করা, ঘুস খাওয়া ও শারঈভাবে যা তার প্রাপ্য নয় তা খাওয়া হারাম’।[6]
(৩৯) খাদ্য ও পানীয়তে আল্লাহভীরুতা আবশ্যক এবং যা হালাল নয় তা থেকে বিরত থাকা।
(৪০) হারাম ও (মাকরূহ) অপছন্দনীয় পোশাক-পরিচ্ছদ ও থালা-বাসন পরিহার করা।
(৪১) শরীআতবিরোধী আনন্দ-বিনোদন ও খেল-তামাশা হারাম।
(৪২) মিতব্যয়ী হওয়া। আর অন্যায়ভাবে সম্পদ খাওয়া হারাম।
(৪৩) হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করা।
(৪৪) মানুষের মান-সম্মান অন্যের জন্য হারাম এবং তাতে পতিত না হওয়া আবশ্যক।
(৪৫) বিশুদ্ধ নিয়্যতে একমাত্র আল্লাহর জন্য আমল করা ও লৌকিকতা পরিহার করা।
(৪৬) ভালো কাজ নিয়ে খুশি হওয়া ও মন্দ কাজ নিয়ে বিষণ্ন হওয়া।
(৪৭) তওবাতুন নাছূহার মাধ্যমে সমস্ত পাপের চিকিৎসা/প্রতিরোধ করা।
(৪৮) কুরবানীসমূহ তথা আল্লাহর নৈকট্যমূলক উৎসর্গসমূহের সমষ্টি হলো, হজ্জ ও ঈদুল আযহার পশু যবেহ ও আক্বীক্বা করা’।[7]
(৪৯) শাসকদের আনুগত্য করা।
(৫০) জামাআত বা দল যার উপরে আছে তা আঁকড়ে ধরা।
(৫১) মানুষের মাঝে ন্যায়বিচার করা।
(৫২) সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা।
(৫৩) সৎ ও তাক্বওয়ার কাজে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করা।
(৫৪) লজ্জাশীলতা।
(৫৫) পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করা।
(৫৬) আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।
(৫৭) উত্তম চরিত্র।
(৫৮) ক্রীতদাস বা অধীনস্তদের সাথে সুন্দর আচরণ করা।
(৫৯) ক্রীতদাসের উপর মুনিবের অধিকার।
(৬০) পরিবার ও সন্তানসন্ততির অধিকার আদায় করা।
(৬১) দ্বীনদারদের নিকটবর্তী হওয়া এবং তাদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। সালাম প্রচার-প্রসার করা এবং মুছাফাহা করা।
(৬২) সালামের উত্তর দেওয়া।
(৬৩) অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া’।[8]
(৬৪) আহলুল ক্বেবলার (যারা মুসলিম দাবি করে এবং কা‘বার দিকে ক্বেবলামুখী হয়) কেউ মারা গেলে তার জানাযার ছালাত আদায় করা।
(৬৫) হাঁচিদাতার (الْحَمْدُ لِلهِ) ‘আল-হামদুল্লিাহ’ বলার জবাবে (يَرْحَمُكَ اللهِ) ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা।
(৬৬) কাফের ও ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের থেকে দূরে থাকা এবং তাদের উপর অনমনীয় হওয়া।
(৬৭) প্রতিবেশীকে সম্মান করা।
(৬৮) মেহমানকে সম্মান করা।
(৬৯) পাপিষ্ঠদের পাপ গোপন করা।
(৭০) বিপদাপদ ও আত্মা যে উপভোগ এবং কামনা-বাসনার প্রতি আগ্রহী হয় তার থেকে ধৈর্যধারণ করা।
(৭১) দুনিয়াবিমুখ হওয়া ও অল্প আশাবাদী হওয়া।
(৭২) আত্মসম্মানবোধ থাকা।
(৭৩) বাড়াবাড়ি করা থেকে দূরে থাকা।
(৭৪) দানশীলতা ও বদান্যতা থাকা।
(৭৫) ছোটদের স্নেহ ও বড়দের শ্রদ্ধা করা।
(৭৬) পরস্পরের মাঝে মীমাংসা করা।
(৭৭) ব্যক্তি তার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে এবং তার জন্য তাই অপছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য অপছন্দ করে এবং এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে, রাস্তা হতে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করা; হাদীছে যার দিকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে’।[9]
(চলবে)
মূল : ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহাফ আল-ক্বাহত্বানী রহিমাহুল্লাহ
অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
নারায়ণপুর, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর।
[1]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, শব্দ বিন্যাস মুসলিমের, ছহীহ বুখারী, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘ঈমানের বিষয়সমূহ’ অনুচ্ছেদ, ১/১০, হা/৯; ছহীহ মুসলিম, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘ঈমানের শাখা-প্রশাখার সংখ্যা, তার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন শাখার বর্ণনা, লজ্জা-শরমের ফযীলত এবং তা ঈমানের অঙ্গ হওয়ার বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ, ১/৬৩, হা/৩৫।
[2]. ঈমানের এই ৭৭টি শাখা-প্রশাখা তিনি সাত খণ্ডের মধ্যে উল্লেখ করেছেন এবং সেগুলো সনদসহ হাদীছের মাধ্যমে চমৎকার ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন।
[3]. ইমাম বায়হাক্বীর শুআবুল ঈমান গ্রন্থের ১ম খণ্ডে এই শাখা-প্রশাখাগুলো রয়েছে, ১/১০৩-৪৬৩।
[4]. ১২-১৯ নম্বর পর্যন্ত এই শাখাগুলো ইমাম বায়হাক্বীর শুআবুল ঈমান গ্রন্থের ২য় খণ্ডে রয়েছে, ২/৩-৫৪৮।
[5]. ২০-২৫ নম্বর পর্যন্ত এই শাখাগুলো ইমাম বায়হাক্বীর শুআবুল ঈমান গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে রয়েছে, ৩/৩-৪৯৪।
[6]. ২৬-৩৮ নম্বর পর্যন্ত এই শাখাগুলো ইমাম বায়হাক্বীর শুআবুল ঈমান গ্রন্থের ৪র্থ খণ্ডে রয়েছে, ৪/৩-৩৯৮।
[7]. ৩৯-৪৮ নম্বর পর্যন্ত এই শাখাগুলো ইমাম বায়হাক্বীর শুআবুল ঈমান গ্রন্থের ৫ম খণ্ডে রয়েছে, ৫/৩-৪৮৫।
[8]. ৩৯-৬৩ নম্বর পর্যন্ত এই শাখাগুলো ইমাম বায়হাক্বীর শুআবুল ঈমান গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডে রয়েছে, ৬/৩-৫৪৭।
[9]. ৬৩-৭৭ নম্বর পর্যন্ত এই শাখাগুলো ইমাম বায়হাক্বীর শুআবুল ঈমান গ্রন্থের ৭ম খণ্ডে রয়েছে, ৩/৩-৫৪০।