(খ) বৈবাহিকসূত্রে স্থায়ী মাহরাম নারীগণের বিবরণ :
কোনো পুরুষ বিয়ে করলে বিয়ে করার কারণে তার জন্য কয়েক শ্রেণির নারী চিরতরে হারাম হয়ে যায়। তাদেরকে বৈবাহিকসূত্রে স্থায়ী মাহরাম নারী বলা হয়। বৈবাহিকসূত্রে স্থায়ী মাহরাম নারীগণ কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে। যথা—
প্রথম প্রকার:স্ত্রীর জন্মগ্রহণ সম্বন্ধীয় বা বংশ সম্বন্ধীয় মাহরাম নারী
(১) শাশুড়ি: কোনো পুরুষ ব্যক্তির স্ত্রীর জন্মগ্রহণ সম্বন্ধীয় বা বংশ সম্বন্ধীয় মাহরাম নারী হচ্ছেন তার স্ত্রীর মা (শাশুড়ি), স্ত্রীর মায়ের মা (নানী শাশুড়ি), স্ত্রীর পিতার মা (দাদী শাশুড়ি)— এভাবে যতই উপরে যাক না কেন। অন্যভাবে বলা যায়— স্ত্রীর মা, স্ত্রীর নানী, স্ত্রীর দাদী ও তাদের ঊর্ধ্বতন নারীগণ হচ্ছেন কোনো পুরুষের স্ত্রীর জন্মগ্রহণ সম্পর্কিত মাহরাম। এ শ্রেণি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَأُمَّهَاتُ نِسَائِكُمْ ‘আর (তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে) তোমাদের স্ত্রীর মাতাগণকে (শাশুড়িগণকে)’ (আন-নিসা, ৪/২৩)। এ আয়াতাংশে ‘তোমাদের স্ত্রীর মাতাগণ’ বলতে উপরে বর্ণিত সকল নারী উদ্দেশ্য।[1]
জ্ঞাতব্য, শাশুড়ি, নানী শাশুড়ি, দাদী শাশুড়ির সাথে চিরতরে বিয়ে বন্ধন হারাম হওয়ার জন্য শাশুড়ির মেয়ে অর্থাৎ ব্যক্তির স্ত্রীর সাথে সহবাস হওয়া শর্ত নয়; বরং কেবল বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হলেই তারা হারাম হয়ে যাবেন। অতএব, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাহলে ঐ নারীর মা, দাদী শাশুড়ি, নানী শাশুড়ি ও তাদের ঊর্ধ্বতন নারীগণ ঐ পুরুষের জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যাবে— যদিও ঐ নারীর সাথে ঐ পুরুষের সহবাস না হয়। সেজন্য, বিয়ের পরপরই যদি কেউ তার স্ত্রীকে তালাক দেয় অথবা স্ত্রী মারা যায় এবং তাদের মধ্যে সহবাস না হয়ে থাকে, তথাপিও শাশুড়ি, নানী শাশুড়ি, দাদী শাশুড়ি ঐ ব্যক্তির জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যাবে।[2]
দ্বিতীয় প্রকার:যে স্ত্রীর সাথে সহবাস হয়েছে, তার জন্মদান সম্বন্ধীয় মাহরাম নারী
(২) স্ত্রীর মেয়ে: অর্থাৎ স্ত্রীর অন্য স্বামীর বা অন্য ঘরের মেয়ে, যে স্ত্রীর সাথে বর্তমান স্বামীর সহবাস হয়েছে। এমনটা হলে অর্থাৎ স্ত্রীর সাথে সহবাস হলে স্ত্রীর অন্য স্বামীর বা অন্য ঘরের মেয়ে এই স্বামীর জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যাবে।[3] শুধু স্ত্রীর অন্য ঘরের মেয়ে নয়, বরং মেয়ের মেয়ে, ছেলের মেয়ে, তাদের মেয়ে— এভাবে যতই নিচে যাক না কেনো সবাই হারাম হয়ে যাবে।[4] মহান আল্লাহ বলেন,وَرَبَائِبُكُمُ اللَّاتِي فِي حُجُورِكُمْ مِنْ نِسَائِكُمُ اللَّاتِي دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَإِنْ لَمْ تَكُونُوا دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ ‘(তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে) তোমরা যেসব স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়েছো, সেসব স্ত্রীর অপর স্বামী থেকে যেসব কন্যা তোমাদের কোলে রয়েছে তাদেরকে। আর যদি তোমরা তাদের সাথে মিলিত না হয়ে থাকো, তবে তোমাদের উপর কোনো পাপ নেই’ (আন-নিসা, ৪/২৩)।
আয়াতে رَبَائِبُ শব্দটি رَبِيْبَةٌ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ কোনো ব্যক্তির স্ত্রীর অন্য পক্ষের মেয়ে। অর্থাৎ ইতোপূর্বে স্ত্রীর অন্য কোথাও বিয়ে হয়েছিল এবং সেখানে তিনি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। তারপর সেই স্ত্রীর স্বামী মারা যায় বা তাকে তালাক দিয়ে দেয়। তারপর বর্তমান স্বামী তাকে বিয়ে করে। এখন, স্ত্রীর আগের ঘরের মেয়েটিকে বর্তমান স্বামীর رَبِيْبَةٌ বলা হয়ে থাকে।[5]
উল্লেখ্য, স্ত্রীর আগের পক্ষের মেয়েটি বর্তমান স্বামীর উপর হারাম হওয়ার জন্য তাকে বর্তমান স্বামীর গৃহে লালিত-পালিত হওয়া শর্ত নয়। কুরআন মাজীদে, ٱلَّٰتِي فِي حُجُورِكُم ‘যেসব কন্যা তোমাদের কোলে রয়েছে’— কথাটি বলার কারণ হচ্ছে, সাধারণত তারা তাদের মায়ের সাথে মায়ের পরের স্বামীর বাড়ি তথা তাদের সৎবাবার বাড়ি চলে আসে এবং সেখানেই লালিত-পালিত হয়। এই হিসেবে কুরআন মাজীদে উল্লেখ করা হয়েছে; শর্ত হিসেবে নয়।[6]
মেয়ে ও তার মা কোনো পুরুষের উপর হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে সূত্র হচ্ছে,اَلْعَقْدُ عَلَى الْبَنَاتِ يُحَرِّمُ الْأُمَّهَاتِ وَالدُّخُوْلُ بِالْأُمَّهَاتِ يُحَرِّمُ الْبَنَاتِ ‘মেয়ের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হলেই তার মা হারাম হয়ে যায় আর (অন্য পুরুষের ঔরসজাত) মেয়ের মায়ের সাথে বিবাহোত্তর সহবাস করলেই মেয়ে হারাম হয়ে যায়।[7]
তৃতীয় প্রকার: কোনোপুরুষের সন্তানাদির স্ত্রী
(৩) পুরুষের সন্তানাদির স্ত্রী: এখানে কোনো পুরুষের সন্তানাদি বলতে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী প্রমুখ উদ্দেশ্য। অতএব,কোনো পুরুষের সন্তানাদির স্ত্রী বলতে ছেলের স্ত্রী (পুত্রবধূ), ছেলের ছেলের স্ত্রী (নাতবৌ), মেয়ের ছেলের স্ত্রী (নাতবৌ)— এভাবে যত নিচে যাক সবাই উদ্দেশ্য। এই শ্রেণির নারী হারাম হওয়া প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, وَحَلَائِلُ أَبْنَائِكُمُ الَّذِينَ مِنْ أَصْلَابِكُمْ ‘(তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে) তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রীদেরকে’ (আন-নিসা, ৪/২৩)।
অতএব, কোনো পুরুষের ছেলের স্ত্রী (পুত্রবধূ), ছেলের ছেলের স্ত্রী (নাতবৌ), মেয়ের ছেলের স্ত্রী (নাতবৌ) এবং এভাবে যত নিচে যাক, তাদের সকলের স্ত্রী ঐ পুরুষের জন্য চিরতরে হারাম। কেবল বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হলেই তারা হারাম হয়ে যায়; এক্ষেত্রে সহবাস শর্ত নয়। সেজন্য, সহবাসের পূর্বেই যদি ছেলে ও নাতি তাদের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয় বা তারা মারা যাওয়ার কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে অথবা অন্য কোনো কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে, তাহলে তাদের স্ত্রীর কেউ ঐ পুরুষের জন্য বৈধ নয়।[8]
উল্লেখ্য, আয়াতে ‘ঔরসজাত পুত্র’ কথাটি এজন্য বলা হয়েছে যে, যাতে পালক পুত্রের স্ত্রীকে কেউ এই হুকুমের আওতাভুক্ত না ধরে। তাই তো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালক পুত্র যায়েদ ইবনু হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু–এর স্ত্রীকে বিয়ে করেন।[9] যে বিয়ে সরাসরি আল্লাহ তাআলা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন (আল-আহযাব, ৩৩/৩৭)। অবশ্য পরবর্তীতে পালক পুত্র হিসেবে কাউকে গ্রহণ করার নিয়মটি নিষিদ্ধ হয়ে যায়।[10]
চতুর্থ প্রকার: কোনোপুরুষের পিতা ও পিতামহের স্ত্রী
(৪) কোনোপুরুষের পিতা ও দাদা-নানার স্ত্রী: পিতার স্ত্রী*, দাদার স্ত্রী, নানার স্ত্রী এবং এভাবে যত উপরে উঠুক না কেন তাদের সকলের স্ত্রী ছেলের জন্য বা নাতির জন্য চিরতরে হারাম। বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হলেই এসব স্ত্রী ছেলে ও নাতিদের উপর চিরদিনের জন্য হারাম হয়ে যায়; এক্ষেত্রে হারাম হওয়ার জন্য সহবাস হওয়া শর্ত নয়। বরং তালাক প্রদান, মারা যাওয়া বা অন্য যে কোনো বৈধ পদ্ধতিতে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটলেই বাবা ও দাদা-নানার সেসব স্ত্রীকে বিয়ে করা ছেলে ও নাতির উপর চিরদিনের জন্য হারাম।[11] মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন,وَلَا تَنْكِحُوا مَا نَكَحَ آبَاؤُكُمْ مِنَ النِّسَاءِ إِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَمَقْتًا وَسَاءَ سَبِيلًا ‘আর তোমরা বিবাহ করো না নারীদের মধ্য থেকে যাদেরকে তোমাদের পিতৃপুরুষগণ বিবাহ করেছেন। তবে পূর্বে যা সংঘটিত হয়ে (তা ক্ষমা করা হলো)। নিশ্চয় তা হলো অশ্লীলতা ও ঘৃণিত বিষয় এবং নিকৃষ্ট পথ’ (আন-নিসা, ৪/২২)।
বৈবাহিকসূত্রে স্থায়ী মাহরাম নারীগণের সংক্ষিপ্ত তালিকা:
(১) স্ত্রীর মা (শাশুড়ি), স্ত্রীর নানী-দাদী (নানী শাশুড়ি-দাদী শাশুড়ি) এবং এভাবে যত উপরে উঠতে পারে। শুধু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেই এ শ্রেণির নারী হারাম হয়ে যায়।
(২) ছেলের স্ত্রী (পুত্রবধূ), ছেলের ছেলের স্ত্রী (নাতবৌ), মেয়ের ছেলের স্ত্রী (নাতবৌ) এবং এভাবে যত নিচে যেতে পারে।
(৩) স্ত্রীর অন্য স্বামীর ঔরসজাত মেয়ে, তাদের মেয়ের মেয়ে, তাদের ছেলের মেয়ে এবং এভাবে যত নিচে যেতে পারে। তবে এ শ্রেণি হারাম হওয়ার জন্য শুধু তাদের মায়ের সাথে বিবাহ বন্ধন হওয়া যথেষ্ট নয়; বরং তাদের মায়ের সাথে অর্থাৎ ব্যক্তির স্ত্রীর সাথে বিবাহোত্তর সহবাস হওয়া শর্ত।
(৪) পিতার স্ত্রী, দাদা-নানার স্ত্রী। শুধু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেই এ শ্রেণির নারী হারাম হয়ে যায়।[12]
বৈবাহিক সূত্রে বিশেষ এই নারীশ্রেণি হারাম হওয়ার পেছনে প্রজ্ঞা: বৈবাহিক বন্ধন বংশীয় বন্ধনের মতোই। একজন পুরুষ বিয়ের মাধ্যমে অন্য একটি পরিবার ও গোত্রের সদস্যের মতো হয়ে যায়। একজন মেয়েকে বিয়ে করলেই মেয়ের মা ঐ ব্যক্তির জন্য তার নিজের মায়ের মতো চিরতরে হারাম হয়ে যান। এমনকি ঐ ব্যক্তি সহবাসের আগেও যদি তার বউকে তালাক দিয়ে দেয়, তবুও বউয়ের মা অর্থাৎ শাশুড়ি চিরদিনের জন্য হারাম হিসেবে গণ্য হন। ফলে সে তার শাশুড়ির কাছে যেতে পারে, তার সাথে সফর করতে পারে ইত্যাদি। সেজন্য শাশুড়ির যেমন উচিত মেয়ের জামাইকে ছেলের মতো দেখা, তেমনি মেয়ের জামাইয়েরও উচিত শাশুড়িকে মায়ের মতো দেখা, মায়ের মতো তাকে সম্মান করা।
মোদ্দাকথা, বিয়ের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অন্য একটি পরিবার ও বংশের সদস্যের মতো হয়ে যায়। সে তাদের বিষয়কে নিজের বিষয়ের মতো মনে করে। সে তাদেরকে সহযোগিতা করে, তারাও তাকে সহযোগিতা করে।
বিয়ের মাধ্যমে খোঁজখবর রাখা ও সম্মান-মর্যাদার দিক থেকে স্ত্রীর মা তার জন্মদাতা মায়ের মতো হয়ে যান। তার স্ত্রীর অন্য পক্ষের মেয়ে আদর-স্নেহের দিক থেকে নিজের মেয়ের মতো হয়ে যায়। নিজের ছেলের স্ত্রী (বৌমা) নিজের ছেলের মতো হয়ে যায়, যাকে ছেলের মতো আদর-সোহাগ দেওয়া হয়। কোনো পুরুষের বাবার স্ত্রী তার আপন মায়ের মতো হয়ে যায়। এসব কারণে বৈবাহিক সূত্রের এ শ্রেণির নারীকে হারাম করা হয়েছে।[13]
(চলবে)
আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী
বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. দ্রষ্টব্য: তাফসীর বাগাবী, ২/১৯০।
[2]. মুহাম্মাদ সাঈদ রসলান, আল-মুহাররমাত মিনান নিসা, পৃ. ৪৩; বাকর মুহাম্মাদ ইবরাহীম, আল-মুহাররমাত মিনান নিসা, পৃ. ১১।
[3]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ২/২৫০।
[4]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ২/২৫২।
[5]. মুহাম্মাদ সাঈদ রসলান, আল-মুহাররমাত মিনান নিসা, পৃ. ৪৪।
[6]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ২/২৫১।
[7]. বাকর মুহাম্মাদ ইবরাহীম, আল-মুহাররমাত মিনান নিসা, পৃ. ১০-১১।
[8]. বাকর মুহাম্মাদ ইবরাহীম, আল-মুহাররমাত মিনান নিসা, পৃ. ১৪।
[9]. তাফসীর বাগাবী, ২/১৯১।
[10]. দ্রষ্টব্য: আহযাব, ৩৩/৫; ছহীহ বুখারী, হা/৩৫০৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৬১।
* এখানে পিতার স্ত্রী বলতে ব্যক্তির নিজ মা উদ্দেশ্য নয়। কারণ নিজ মা সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ ইতোমধ্যে গত হয়ে গেছে। বরং এখানে পিতার স্ত্রী বলতে অন্য স্ত্রী তথা ব্যক্তির সৎমা উদ্দেশ্য।
[11]. বাকর মুহাম্মাদ ইবরাহীম, আল-মুহাররমাত মিনান নিসা, পৃ. ১২।
[12]. মুহাম্মাদ সাঈদ রসলান, আল-মুহাররমাত মিনান নিসা, পৃ. ৪৬-৪৭।
[13]. মুহাম্মাদ সাঈদ রসলান, আল-মুহাররমাত মিনান নিসা, পৃ. ৪৮।