কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইসলামের দৃষ্টিতে বায়তুল মাক্বদিস: মর্যাদা, গুরুত্ব ও ফযীলত

post title will place here

ভূমিকা: বায়তুল মাক্বদিস ফিলিস্তীনের জেরুজালেমের পুরনো শহরে অবস্থিত। এটা মুসলিমদের প্রথম কিবলা। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি‘রাজের রাতে মক্কার হারাম থেকে আল-আক্বছা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা করেন। আর মি‘রাজের পূর্বে তিনি সকল নবীকে সঙ্গে নিয়ে নিজ ইমামতিতে ছালাত আদায় করেন। তবে মক্কা-মদীনার মতো এতে ‘হারাম’ তথা নিষিদ্ধ এলাকা নেই। ফিলিস্তীন বহু নবীর জন্মস্থান হওয়ার কারণে বহুপূর্ব থেকেই বায়তুল মাক্বদিস মুসলিশ, ইয়াহুদী ও খিষ্টানদের অতি আগ্রহের স্থান। বর্তমানে বায়তুল মাক্বদিসকে ঘিরে অভিশপ্ত ইয়াহুদী জাতি আবারো ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে আলোচনা সময়ের দাবি।

নামকরণের কারণ: আক্বছা অর্থ দূরবর্তী। যেহেতু এটি মসজিদুল হারাম থেকে দূরে অবস্থিত, তাই একে মসজিদুল আক্বছা বলা হয়।

বায়তুল মাক্কদিসের মর্যাদা: বায়তুল মাক্বদিসের মর্যাদা সম্পর্কে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

‘তিনি সেই পূত-পবিত্র সত্তা, যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি। তাকে আমার নিদর্শনাবলি দেখানোর জন্য, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (আল-ইসরা, ১৭/১)। বরকতের কারণ হতে পারে—

(১) এ অঞ্চলটি ইবরাহীম, লূত, ইয়াকুব, দাঊদ, সুলায়মান ও ঈসা আলাইহিমুস সালাম প্রমুখ অসংখ্য নবী-রাসূলের জন্মস্থান, বাসস্থান, কর্মস্থল ও মৃত্যুস্থান। মূসা আলাইহিস সালাম-এর মৃত্যুও এখানে হয়।

(২) এই এলাকাটি উর্বর, সুষম আবহাওয়া, গাছগাছালি, নদনদী, ঝরনা, প্রাচুর্য, ফলমূল, শস্য ও সর্বপ্রকার উদ্ভিদ ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ।[1] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,وَإِنَّهُ لَا يَقْرَبُ أَرْبَعَةَ مَسَاجِدَ: مَسْجِدَ الْحَرَامِ وَمَسْجِدَ الرَّسُولِ وَمَسْجِدَ الْمَقْدِسِ وَالطُّورِ ‘দাজ্জাল সমগ্র পৃথিবীতে বিচরণ করবে কিন্তু চারটি মসজিদের নিকটবর্তী হতে পারবে না— বায়তুল্লাহ, মসজিদে নববী, বায়তুল মাক্বদিস ও মসজিদে তূর’।[2]

যুগে যুগে বায়তুল মাক্কদিসের সংস্কার ও অবস্থা: বায়তুল মাক্বদিস সর্বপ্রথম নির্মিত হয় ফেরেশতা অথবা আদম আলাইহিস সালাম-এর কোনো এক সন্তানের মাধ্যমে কা‘বাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর। এরপর ইয়াকূব আলাইহিস সালাম স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে তা পুনঃনির্মাণ করেন। এর প্রায় ১ হাজার বছর পর দাঊদ আলাইহিস সালাম পুনঃনির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন এবং তদীয় পুত্র সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর হাতে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। অর্থাৎ দাঊদ আলাইহিস সালাম মূল নির্মাণ কাজ শেষ করলেও আনুসঙ্গিক কিছু কাজ তখনো বাকী থেকে যায়। তাই সুলায়মান আলাইহিস সালাম অবশিষ্ট কাজে হাত দেন। এই কাজগুলো অবাধ্যতাপ্রবণ জিনদের উপর ন্যস্ত ছিল। তারা তাঁর ভয়ে কাজ করত। এদিকে সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলো। তারা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারলে কাজ অসম্পূর্ণ রেখে পলায়ন করত। বিধায় সুলায়মান আলাইহিস সালাম মৃত্যুপ্রস্তুতি গ্রহণ করে কাচনির্মিত মেহরাবে প্রবেশ করেন যাতে বাহির থেকে ভেতরের সবকিছু দেখা যায়। তিনি নিয়মানুযায়ী ইবাদতের উদ্দেশ্যে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে গেলেন, যাতে রূহ বের হয়ে যাওয়ার পরও লাঠিতে ভর দিয়ে দেহ স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। আল্লাহর ইচ্ছায় সেটাই ঘটল। আল্লাহর নির্দেশে তাঁর দেহ লাঠিতে ভর করে এক বছর দাঁড়িয়ে থাকল। দেহ পচলও না, পড়লও না। জিন ভয়ে তাঁর কাছে যায়নি। ফলে তারা দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে কাজ শেষ করে ফেলল। কাজ সম্পন্ন হলে আল্লাহর আদেশে উইপোকার সাহায্যে লাঠি ভেঙে দেওয়া হয় এবং সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর লাশ মাটিতে পড়ে যায়। এ ঘটনা মহান আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন (সাবা, ৩৪/১৪)

প্রাক-ইসলাম যুগে ইয়াহূদীরা নবী ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম-কে হত্যা করলে নাছারারা তার প্রতিশোধ গ্রহণে বদ্ধপরিকর হয়। তারা ইরাকের বাবেল শহরের একজন অগ্নিউপাসক সম্রাট বুখতে নছরের সাথে মিলিত হয়ে ইয়াহূদীদের উপর আক্রমণ চালায়। তারা সেখানে হত্যা, লুণ্ঠন চালিয়ে তাওরাতের কপিসমূহ পুড়িয়ে দেয়, বায়তুল মাক্বদিসের অভ্যন্তরে ময়লা-আবর্জনা ও শূকর নিক্ষেপ করে এবং মসজিদের প্রাচীর ক্ষতবিক্ষত করে সমগ্র শহরটিকে জনমানবহীন করে দেয়। এতে ইয়াহূদীদের শক্তি খর্ব ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ পর্যন্ত বায়তুল মাক্বদিস এমনিভাবে পরিত্যক্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফতকালে যখন সিরিয়া ও ইরাক বিজিত হয়, তখন তাঁর নির্দেশক্রমে বায়তুল মাক্বদিস পুনঃনির্মিত হয়। এরপর দীর্ঘ সময় সমস্ত সিরিয়া ও বায়তুল মাক্বদিস মুসলিমদের অধিকারে থাকে। এই সময়ে বিভিন্ন মুসলিম বাদশার শাসনামলে আল-আক্বছা মসজিদটির সংস্কার সাধিত হয়। ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে খলীফা আব্দুল মালেক মসজিদ সম্প্রসারণ করেন এবং কুব্বাত আস-সাখরা (সোনালি গম্বুজওয়ালা স্থাপনা) নির্মাণ করেন। অতঃপর বায়তুল মাক্বদিস মুসলিমদের হস্তচ্যূত হয় এবং দীর্ঘ ৯০ বছর ইউরোপীয় নাছারাদের অধিকারে ছিল। অবশেষে হিজরী ষষ্ঠ শতকে সুলতান ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী ১১৮৭ সালে বায়তুল মাক্বদিস পুনরুদ্ধার করেন। ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্রুসেডার খ্রিষ্টানরা জেরুজালেম দখলের পর মসজিদটিকে প্রাসাদ এবং প্রাঙ্গণে থাকা কুব্বাতুছ ছখরা-কে গির্জা হিসাবে ব্যবহার করত। অতঃপর সুলতান ছালাহুদ্দীন আইয়ূবীর জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের পর একে মসজিদ হিসাবে ব্যবহার শুরু করেন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াহূদী কর্তৃক জেরুজালেম জবরদখলের পর ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর ইসরাঈলী পুলিশ এই প্রথম আল-আক্বছা মসজিদে প্রবেশ করে। বর্তমানে পুরনো শহরগুলো ইসরাঈলী বাহনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে মসজিদটি ফিলিস্তীনী নেতৃত্বাধীন ইসলামী ওয়াক্বফের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

বায়তুল মাক্বদিসে ছালাত আদায়ের ফযীলত: আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لاَ تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلَّا إِلَى ثَلاَثَةِ مَسَاجِدَ: المَسْجِدِ الحَرَامِ وَمَسْجِدِ الرَّسُولِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَسْجِدِ الأَقْصَى ‘তিনটি মসজিদ ব্যতীত কেউ অন্য কোনো স্থানে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সফর করা যাবে না— ১. মসজিদুল হারাম, ২. মসজিদে নববী এবং ৩. মসজিদুল আক্বছা’।[3] একদা আবূ যার রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন, বায়তুল মাক্বদিসে ছালাত আদায় করা উত্তম, না-কি মসজিদে নববীতে ছালাত আদায় করা উত্তম? তখন তিনি বললেন, صَلَاةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا أَفْضَلُ مِنْ أَرْبَعِ صَلَوَاتٍ فِيهِ ‘বায়তুল মাক্বদিসে ছালাত আদায়ের মর্যাদা আমার এই মসজিদে ছলাতের এক-চতুর্থাংশ’।[4] আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সুলায়মান আলাইহিস সালাম যখন বায়তুল মাক্বদিস তৈরির কাজ শেষ করেন, তখন তিনি আল্লাহর নিকট তিনটি বিষয়ে প্রার্থনা করেন— ১. সুবিচার, যা আল্লাহর হুকুমের অনুরূপ, ২. এমন রাজত্ব, যা তাঁর পরে কাউকে দেওয়া হবে না এবং ৩. যে ব্যক্তি বায়তুল মাক্বদিসে শুধু ছালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে আসবে, সে যেন তার গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে যায় সে দিনের মতো যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল সেরূপ। এরপর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘প্রথম দুটি তাঁকে দান করা হয়েছে এবং আশা করি তৃতীয়টিও তাঁকে দান করা হবে’।[5]

উপসংহার: বায়তুল মাক্বদিস ইসলামের ইতিহাস, বিশ্বাস ও ইবাদতের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি মুসলিমদের প্রথম কিবলা, মি‘রাজের গুরুত্বপূর্ণ স্তর এবং বহু নবীর স্মৃতিধন্য ভূমি। কুরআন ও হাদীছে এর ফযীলত ও মর্যাদা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। যুগে যুগে এই পবিত্র ভূমি বহুবার ধ্বংস-সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেলেও মুসলিমরা এর রূহানী মহিমা রক্ষা করে চলেছে। আজকের প্রেক্ষাপটে ইয়াহূদীদের অব্যাহত দখলদারিত্বের মুখে মুসলিম উম্মাহর উচিত—বায়তুল মাক্বদিসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও মুক্তির জন্য দু‘আ ও সচেতন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।

মাহবূবুর রহমান মাদানী

 শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. উক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।

[2]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/৩৭৫০৬; সিলসিলা ছহীহা, হা/২৯৩৪, এর রাবীগণ ‘ছিক্বাহ’।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৮৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৯৭।

[4]. শুআবুল ঈমান বায়হাকী, হা/৩৮৪৯ ‘ছহীহ সনদ’; মাওসু‘আতুল ই‘তিকাদ আলবানী, ২/২৫৩।

[5]. ইবনু মাজাহ, হা/১৪০৮।

Magazine