আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আমাদের জীবন হতে হবে উদ্দেশ্যমূলক এবং মহৎ। তিনি বলেন,اِنْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالًا وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ‘তোমরা হালকা বা ভারী হয়ে অভিযানে বের হয়ে পড়ো এবং তোমাদের সম্পদ ও প্রাণ দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করো’ (আত-তওবা, ৯/৪১)।
এই আয়াত নির্দেশ করে যে, আমাদের প্রচেষ্টা কখনো হালকা বা তুচ্ছ হওয়ার নয়; বরং আমাদের শক্তি, সময় ও সম্পদ সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগাতে হবে। বিখ্যাত মুফাসসির যেমন ইবনে কাছীর, কুরতুবী ও সা‘দীর মতে, ‘হালকা-ভারী’ অর্থ- মানুষ যেকোনো অবস্থায় থাকুক না কেন, দ্বীনের কাজে সজাগ ও উদ্যমী হতে হবে। তরুণ কিংবা বৃদ্ধ, ধনী কিংবা গরীব, সুস্থ কিংবা অসুস্থ, সবাই দ্বীনের দায়িত্বে সমান। এই আয়াত আমাদের শেখায় যেকোনো পরিস্থিতিতেই অজুহাত ছাড়াই দাওয়াত ও দ্বীনের কাজে সক্রিয় থাকা আবশ্যক, শুধু সামান্য স্বার্থ বা সমর্থনের আশায় সীমাবদ্ধ থাকা যাবে না।
সক্ষমতা অনুযায়ী, যতক্ষণ শরীর ও মন সাহসী, হাত কর্মঠ এবং মুখে বল আছে, ততক্ষণ দ্বীনের কাজে অংশ নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই দায়িত্ব থেকে পালানো উচিত নয়। বড় স্বপ্ন থাকলে চেষ্টাও বড় হয়। মুআয ইবনে জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে সাব্যস্ত, রাসূলুল্লহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,فإذا سَأَلتُم اللهَ فاسأَلوه الفِردَوسَ ‘যখন তোমরা আল্লাহর কাছে কিছু চাইবে, তখন জান্নাতুল ফেরদাউস চাও’।[1] এই হাদীছ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ছোট স্বপ্ন নয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও মহৎ লক্ষ্যই আমাদের প্রেরণার উৎস হতে পারে। আবার হাসান ইবনে আলী ইবনে আবূ তালেব রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে সাব্যস্ত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يُحِبُّ مَعَالِيَ الْأُمُورِ، وَيَكْرَهُ سَفْسَافَهَا ‘আল্লাহ তাআলা উচ্চ মর্যাদার ও সম্মানজনক কাজগুলোকে ভালোবাসেন এবং তুচ্ছ কাজ অপছন্দ করেন’।[2] অনুরূপ আরও একটি হাদীছে জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে সাব্যস্ত। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ، وَيُحِبُّ مَعَالِيَ الْأُمُورِ، وَيَكْرَهُ سَفْسَافَهَا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। তিনি মহৎ ও উচ্চতর কাজগুলোকে পছন্দ করেন এবং তুচ্ছ ও নিচু মানসিকতার কাজগুলোকে অপছন্দ করেন’।[3]
উক্ত হাদীছগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহ মহৎ চিন্তা, উচ্চ আদর্শ ও সম্মানজনক কাজকে পছন্দ করেন। তিনি চান মানুষের জীবনেও সৌন্দর্য, পরিচ্ছন্নতা ও শালীনতা থাকুক। তুচ্ছ, অর্থহীন বা হীন কাজ যেমন অহেতুক তর্ক, সংকীর্ণ মনোভাব আল্লাহ অপছন্দ করেন। এজন্য মহৎ চরিত্র ও উৎকর্ষতা অর্জনে আমাদের সর্বদা চেষ্টা করতে হবে।
ইবনুল জাওযী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, যারা মানসিক সততা নিয়ে কাজ করে, তারা সর্বোচ্চ মর্যাদায় পৌঁছানোর চেষ্টা করে এবং তুচ্ছতায় সন্তুষ্টি ত্যাগ করে। ‘علو الهمة’ গ্রন্থে মুহাম্মাদ ইসমাঈল আল-মুক্বাদ্দাম উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবুল ফারাজ আল-জাওযী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, مَنْ أَعْمَلَ فِكْرَةَ الصَّافِي دَلَّهُ عَلَى طَلَبِ أَشْرَفِ المَقَامَاتِ وَنَهَاهُ عَنِ الرِّضَا بِالنَّقْصِ فِي كُلِّ حَالٍ ‘যে ব্যক্তি তার মনের সততা কাজে লাগায়, সেটা তাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা অর্জনের দিকে চালিত করে এবং কোনো অবস্থাতেই তুচ্ছতায় সন্তুষ্ট হতে দেয় না’।[4]
কবি আবূ তাইয়্যিব আল-মুতানাব্বী বলেন,
وَلَمْ أَرَ فِي عُيُوبِ النَّاسِ عَيْبًا *** كَنَقْصِ القَادِرِينَ عَلَى التَّمَامِ ‘মানুষের সবচেয়ে বড় ভুল হলো সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিপূর্ণতার জন্য চেষ্টা না করা’।[5]
ইবনুল জাওযী আরও উল্লেখ করেছেন যে, মানুষ যদিও আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে, তবুও শুধু মাটিতে থেকেই খুশি থাকা তার সীমাবদ্ধতারই লক্ষণ। যেমন নবুঅত এমন কিছু নয় যা পরিশ্রম করে অর্জন করা যায়। কিন্তু যদি সেটা সম্ভব হতো, তাহলে যারা পরিশ্রমে পিছিয়ে থাকে, তাদের ব্যর্থতা আরও স্পষ্ট হতো। যেহেতু নবুঅত এখন অর্জনের বাইরে, তাই মানুষের উচিত, জীবনের যেসব বড় অর্জন সম্ভব, তা অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। উঁচুতে ওঠার প্রেরণার জন্য ইবনুও জওযীর চোখে মানুষের পূর্ণতা ছিল অন্যতম একটা বিষয়। কয়েকটি বিষয়ে তার আলোচনা তুলে ধরা হলো।
১. বাহ্যিক সৌন্দর্য ও পরিচ্ছন্নতা: জন্মগত চেহারা হয়তো বদলানো যায় না, কিন্তু নিজের যত্ন নেওয়া জরুরী। শরীর, পোশাক ও চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়; এটি মনের ভেতরের শৃঙ্খলা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষারও একটি অংশ। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন ছিল এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ, যেখানে সৌন্দর্য ও পরিচ্ছন্নতার কোনো কমতি ছিল না। শরীআতও আমাদের পরিচ্ছন্ন থাকা এবং নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের কথা বলে।
২. আত্মসম্মান ও উচ্চ মনোভাব: নিজেকে ছোট বা তুচ্ছ ভাবা উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। কিছু ছূফী চিন্তাধারা মানুষকে নিজেদের ছোট ভাবতে শেখায়, যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার মতে, আত্মোপলব্ধি ও উচ্চ মনোবলই সাফল্যের চাবিকাঠি। নিচু মন কখনো বড় কিছু অর্জন করতে পারে না। তবে সেজন্য যেন মনে অহংকারে উদয় না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
৩. অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা: অন্যের ওপর নির্ভর করা নয়, বরং নিজের হাতে রোজগার করে স্বাবলম্বী হওয়ার ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছ, ‘উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম’। এর অর্থ হলো- অন্যের সাহায্য নেওয়ার চেয়ে নিজে উপার্জন করে দান করা অনেক বেশি সম্মানের।
৪. জ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি আগ্রহ: জ্ঞান অর্জনে অন্ধ অনুকরণ (তাক্বলীদ) ত্যাগ করতে হবে। প্রকৃত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি অন্যের দেখানো পথে না চলে বরং নিজের বুদ্ধি ও বিচার দিয়ে সর্বোচ্চ জ্ঞান ও মর্যাদা লাভের চেষ্টা করে। যারা শুধু অনুকরণ করে, তারা কখনোই সফলতার শিখরে পৌঁছতে পারে না।
৫. সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা: ইবনু জওযীর মতে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এমন হওয়া উচিত যে, কোনো মহৎ গুণ বা মর্যাদার কথা শুনলে নিজের মধ্যেও সেই গুণ অর্জনের আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। যেমন, যখন সে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বাণীটি শোনে, ‘আমার উম্মতের মধ্যে ৭০ হাজার ব্যক্তি বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে’, তখন তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা লাফিয়ে ওঠে, যেন সেও তাদের একজন হতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন, অলসতা পরিহার করে শ্রেষ্ঠদেরও ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। মনের এই তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনেকটা ফুটন্ত জলের মতো, যা ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলে।
সেজন্য আমাদের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য বিষয় অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। এটি শুধু আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনের সব ক্ষেত্রেও। যেমন, নিজের স্বাস্থ্য, পেশাদারি দক্ষতা, জ্ঞান অর্জন বা সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রেও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে পারি।
ইমাম আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘পা মাটিতে রাখ, স্বপ্ন আকাশে দূরে’। অর্থাৎ, বাস্তবসম্মত জীবনযাপন করুন, কিন্তু আপনার লক্ষ্য হোক মহৎ। উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাড়া জীবন সংকীর্ণ হয় এবং ছোট স্বপ্নে সময় নষ্ট হয়। জীবনকে অর্থপূর্ণ করতে হলে স্বপ্ন বড় হতে হবে, উদ্দেশ্য মহৎ হতে হবে এবং প্রতিটি প্রচেষ্টা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা উচিত। তিনি বলছেন,
إِذا أَظمَأتَكَ أَكُفُّ الرِجالِ كَفَتكَ القَناعَةُ شبعاً وَريّا
فَكُن رَجُلاً رِجلُهُ في الثَرى وَهامَةُ هِمَّتِهِ في الثُرَيّا
أَبِيّاً لِنائِلِ ذي ثَروَةٍ تَراهُ لِما في يِدَيهِ أَبيّا
فَإِنَّ إِراقَةَ ماءَ الحَيا ةِ دونَ إِراقَةِ ماءِ المُحَيّا
‘যদি মানুষের হাতে পিপাসা জাগে,
তবে সন্তুষ্টি তৃষ্ণা-ক্ষুধা মেটাবে।
হও এমন মানুষ, পা মাটিতে থাকে,
তবু তোমার স্বপ্ন তারাদেরও ডাকে।
ধনীর দানেতে মাথা নত করো না,
ধনের টানে থেকো উদাস, গর্বে দৃঢ় না।
কারণ জীবনের সম্মান হারানো,
মুখের লজ্জার চেয়ে কঠিনতর জানো’।[6]
যদি অন্যের কাছে কিছু চাওয়ার কারণে তোমার মনে পিপাসা জাগে, তবে মনে রেখো, তোমার সন্তুষ্টিই তোমাকে তৃপ্ত করবে। এছাড়াও, আমাদের প্রাচীন উলামায়ে কেরামের হিকমতের অনুসরণ করলে দেখা যায়, ছোট স্বপ্নে মানুষ তার শক্তি অপচয় করে। কিন্তু যারা উচ্চ লক্ষ্য স্থাপন করে, তারা সর্বোচ্চ সক্ষমতা এবং কল্যাণমূলক কাজের দিকে এগোতে পারে। যেমন একজন ব্যবসায়ী বা শিক্ষার্থী যদি শুধু সামান্য সফলতার জন্য চেষ্টা করে, তার সম্ভাবনা সীমিত থাকে। কিন্তু যদি সে সর্বোচ্চ জ্ঞান, কল্যাণ বা ন্যায়ের জন্য প্রচেষ্টা চালায়, সে নিজেকে এবং সমাজকে উঁচু পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
আমরা এমন জীবনযাপন করতে চাই, যেখানে প্রতিটি প্রচেষ্টা অর্থবহ। স্বপ্নকে ছোট না করে বড় রাখুন, উদ্দেশ্যকে মহৎ করুন। এমন জীবন তৈরি করুন, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং সমাজের কল্যাণে পূর্ণ। আপনার সময়কে ব্যর্থতায় না কাটিয়ে, প্রতিটি মুহূর্তকে মহৎ উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করুন।
ছোট স্বপ্ন ও তুচ্ছ উদ্দেশ্য কখনও জীবনের প্রকৃত কল্যাণ আনতে পারে না। কুরআন, হাদীছ ও আলেমদের বাণী স্পষ্টভাবে শেখায়, স্বপ্ন বড়, উদ্দেশ্য মহৎ এবং প্রচেষ্টা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া উচিত। এটি আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে, আমাদের মনোবল ও সক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে আসে।
সুতরাং জীবনকে ছোট স্বপ্নে সীমাবদ্ধ না রেখে, দ্বীনের সেবা ও জাতির কল্যাণে উঁচু লক্ষ্য স্থাপন করাই প্রকৃত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি।
নির্বাহী সম্পাদক, ত্রৈমাসিক কিশলয়; শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. তিরমিযী, হা/২৫৩০।
[2]. আল-মুজামুল কাবীর, ৩/১৩১।
[3]. আল-মুজামুল আওসাত্ব, হা/৬৯০৬।
[4]. সিলসিলাতু উলূইল হিম্মাহ, ৩/৪।
[5]. শারহু মাআনি শে‘রিল মুতানাব্বি লি ইবনে ইফলিলী, দ্বিতীয় যাত্রা, ১/১৬৩।
[6]. সায়দুল আফকার ফিল আদাব ওয়াল আখলাক ওয়াল হিকাম ওয়াল আমছাল, লি হুসাইন ইবনে মুহাম্মাদ আল-মাহদী, ২/৩০১।
 
                             
                        
 
        
    