কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ঈমানের আলো ও মুনাফেক্বীর অন্ধকার (শেষ পর্ব)

post title will place here

৪. নিফাক্বের পরিণাম ও ক্ষতিসমূহ :

নিফাক্বের কতগুলো ভয়াবহ পরিণাম ও ধ্বংসাত্মক ক্ষতি রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নে কিছু উল্লেখ করা হলো—

(১) বড় নিফাক্ব অন্তরে ভয় ও ভীতি সঞ্চার করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَحْذَرُ الْمُنَافِقُونَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُورَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِي قُلُوبِهِمْ قُلِ اسْتَهْزِئُوا إِنَّ اللَّهَ مُخْرِجٌ مَا تَحْذَرُونَ ‘মুনাফেক্বরা ভয় পায় তাদের মনের কথা প্রকাশ করে তাদের ব্যাপারে কোনো সূরা নাযিল হয়ে যায় নাকি। বলুন, ‘ঠাট্টা করতে থাকো, তোমরা যে ব্যাপারে ভয় পাও, আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিবেন’ (আত-তওবা, ৯/৬৪)

(২) বড় নিফাক্ব আল্লাহর লা‘নতকে আবশ্যক করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَعَدَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا هِيَ حَسْبُهُمْ وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُقِيمٌ ‘আল্লাহ মুনাফেক্ব পুরুষ, মুনাফেক্ব নারী ও কাফেরদেরকে জাহান্নামের আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাতে তারা চিরদিন থাকবে, এটি তাদের জন্য যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাদের লা‘নত (অভিশাপ) করেন এবং তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী শাস্তি’ (আত-তওবা, ৯/৬৮)। তিনি অন্যত্র বলেন,لَئِنْ لَمْ يَنْتَهِ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ وَالْمُرْجِفُونَ فِي الْمَدِينَةِ لَنُغْرِيَنَّكَ بِهِمْ ثُمَّ لَا يُجَاوِرُونَكَ فِيهَا إِلَّا قَلِيلًا - مَلْعُونِينَ أَيْنَمَا ثُقِفُوا أُخِذُوا وَقُتِّلُوا تَقْتِيلًا ‘যদি মুনাফেক্বরা এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, তারা ও শহরে মিথ্যা সংবাদ প্রচারকারীরা বিরত না হয়, তবে আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আপনাকে ক্ষমতাবান করে দিব। অতঃপর তারা সেখানে আপনার প্রতিবেশী হয়ে অল্প সময়ই থাকবে’ (আল-আহযাব, ৩৩/৬০-৬১)

(৩) বড় নিফাক্ব তৎসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম হতে বের করে দেয়। কেননা সে কুফর গোপন করে এবং ভালোটা প্রকাশ করে। বরং প্রকাশ্য কুফরের চাইতেও তা গুরুতর। আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا ‘নিশ্চয়ই মুনাফেক্বরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। আর আপনি কখনো তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী পাবেন না’ (আন-নিসা, ৪/১৪৫)

(৪) বড় নিফাক্বে লিপ্ত ব্যক্তি মারা গেলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। কেননা তা প্রকাশ্য কুফরের চাইতেও গুরুতর। বড় নিফাক্বে লিপ্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَظَلَمُوا لَمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ طَرِيقًا - إِلَّا طَرِيقَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا وَكَانَ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا ‘নিশ্চয়ই যারা কুফরী করেছে এবং যুলম করেছে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে কোনো পথ দেখাবেন না, জাহান্নামের পথ ছাড়া। তারা তাতে স্থায়ী হবে এবং তা আল্লাহর জন্য সহজ’ (আন-নিসা, ৪/১৬৮-১৬৯)

(৫) বড় নিফাক্ব ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম আবশ্যক করে এবং জান্নাত তার জন্য হারাম করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّ اللهَ جَامِعُ الْمُنَافِقِينَ وَالْكَافِرِينَ فِي جَهَنَّمَ جَمِيعًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুনাফেক্ব ও কাফেরদের সকলকে জাহান্নামে একত্রকারী’ (আন-নিসা, ৪/১৪০)

(৬) বড় নিফাক্ব ব্যক্তিকে জাহান্নামে চিরস্থায়ী করে। সুতরাং সে কখনো তা থেকে বের হবে না। আল্লাহ তাআলার বাণী,وَعَدَ اللهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا ‘আল্লাহ মুনাফেক্ব পুরুষ, মুনাফেক্ব নারী ও কাফেরদেরকে জাহান্নামের আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাতে তারা চিরদিন থাকবে’ (আত-তাওবা, ৯/৬৮)

(৭) বড় নিফাক্ব তৎসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আল্লাহ ভুলে যাওয়ার কারণ তৈরি করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُمْ مِنْ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنْكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْ نَسُوا اللهَ فَنَسِيَهُمْ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ‘মুনাফেক্ব পুরুষ ও মুনাফেক্ব নারীরা একে অপরের অংশ, তারা মন্দ কাজের আদেশ দেয় আর ভালো কাজ থেকে নিষেধ করে। তারা নিজেদের হাতগুলোকে সঙ্কুচিত করে রাখে। তারা আল্লাকে ভুলে গিয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই মুনাফেক্বরা হচ্ছে ফাসেক্ব (পাপাচারী)’ (আত-তাওবা, ৯/৬৭)

(৮) বড় নিফাক্ব সমস্ত আমলকে বরবাদ করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,قُلْ أَنْفِقُوا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا لَنْ يُتَقَبَّلَ مِنْكُمْ إِنَّكُمْ كُنْتُمْ قَوْمًا فَاسِقِينَ - وَمَا مَنَعَهُمْ أَنْ تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقَاتُهُمْ إِلَّا أَنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَبِرَسُولِهِ وَلَا يَأْتُونَ الصَّلَاةَ إِلَّا وَهُمْ كُسَالَى وَلَا يُنْفِقُونَ إِلَّا وَهُمْ كَارِهُونَ ‘বলুন, ‘তোমরা খুশি হয়ে দান কর অথবা বাধ্য হয়ে, তোমাদের থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না। নিশ্চয়ই তোমরা হচ্ছো ফাসেক্ব সম্প্রদায়। আর তাদের দান কবুল থেকে একমাত্র বাধা এই ছিল যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে। আর তারা ছালাতে আসে না; তবে অলস অবস্থায় ছাড়া এবং তারা দান করে না, তবে অপছন্দকারী অবস্থায় ছাড়া’ (আত-তওবা, ৯/৫৩-৫৪)

(৯) ক্বিয়ামতের দিনে বড় নিফাক্বের ব্যক্তিদের আলো আল্লাহ নিভিয়ে দিবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَوْمَ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ لِلَّذِينَ آمَنُوا انْظُرُونَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُورِكُمْ قِيلَ ارْجِعُوا وَرَاءَكُمْ فَالْتَمِسُوا نُورًا فَضُرِبَ بَيْنَهُمْ بِسُورٍ لَهُ بَابٌ بَاطِنُهُ فِيهِ الرَّحْمَةُ وَظَاهِرُهُ مِنْ قِبَلِهِ الْعَذَابُ ‘সেদিন মুনাফেক্ব পুরুষ ও মুনাফেক্ব নারীগণ ঈমানদারদের বলবে, ‘তোমরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করো, তোমাদের নূর (আলো) থেকে আমরা একটু নিয়ে নেই’, বলা হবে, ‘তোমরা তোমাদের পিছনে ফিরে যাও এবং নূরের (আলোর) সন্ধান করো,’ তারপর তাদের মাঝখানে একটি প্রাচীর স্থাপন করে দেওয়া হবে, যাতে একটি দরজা থাকবে। তার ভিতরভাগে থাকবে রহমত এবং তার বহির্ভাগে থাকবে শাস্তি’ (আল-হাদীদ, ৫৭/১৩)

(১০) বড় নিফাক্বে লিপ্ত ব্যক্তির মৃত্যুর সময় মুমিনদের দু‘আ ও জানাযার ছালাত হতে বড় নিফাক্ব বঞ্চিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِنْهُمْ مَاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَمَاتُوا وَهُمْ فَاسِقُونَ ‘আর তাদের মধ্যে যে মৃত্যুবরণ করেছে, তার জানাযা আপনি পড়বেন না এবং তার কবরের উপর দাঁড়াবেন না। নিশ্চয়ই তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে এবং তারা ফাসেক্ব অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে’ (আত-তাওবা, ৯/৮৪)

(১১) বড় নিফাক্ব দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তির কারণ তৈরি করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,فَلَا تُعْجِبْكَ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُمْ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ بِهَا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَتَزْهَقَ أَنْفُسُهُمْ وَهُمْ كَافِرُونَ ‘অতএব, আপনাকে যেন মুগ্ধ না করে তাদের ধনসম্পদ এবং সন্তানাদি, আল্লাহ এর দ্বারা কেবল তাদের শাস্তি দিতে চান দুনিয়ার জীবনে আর তাদের জান বের হবে কাফের অবস্থায়’ (আত-তাওবা, ৯/৫৫)

(১২) ব্যক্তি যখন বড় নিফাক্ব প্রকাশ করবে এবং ঘোষণা দিবে, তখন ইসলাম হতে সে বের হয়ে যাবে। তাই তার রক্ত ও সম্পদ হালাল হয়ে যাবে এবং মুরতাদের হুকুম-আহকাম তার উপর প্রয়োগ করা হবে। তবে শাসকের নিকট বাহ্যত তার তওবার গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। কারণ মুনাফেক্বরা সবসময় ইসলাম প্রকাশ করে’।[1] পক্ষান্তরে মুনাফেক্ব যখন তার নিফাক্ব ও কুফর গোপন রাখবে, তখন তার রক্ত ও সম্পদ সুরক্ষিত থাকবে। কারণ তারা ঈমান প্রকাশ করে। আর গোপন বিষয়গুলোর দেখাশুনা আল্লাহ করেন’।[2]

(১৩) বড় নিফাক্বে লিপ্ত ব্যক্তি যখন তার কুফর প্রকাশ করবে, তার মাঝে ও মুমিনদের মাঝে শত্রুতা পোষণ আবশ্যক হবে। সুতরাং মুমিনরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখবে না, যদিও সে অতি নিকটাত্মীয় হয়।

পক্ষান্তরে যখন সে তার কুফর প্রকাশ করবে না, তখন বাহ্যিক অবস্থা দেখে তার সাথে লেনদেন করা হবে। আর অন্তরের বিষয়সমূহ আল্লাহর দায়িত্ব।

(১৪) ছোট নিফাক্ব হলো আমলগত নিফাক্ব, যা ঈমান হ্রাস করে ও দুর্বল করে এবং ব্যক্তি আল্লাহর শাস্তির আশঙ্কায় থাকে।

(১৫) ছোট নিফাক্বে লিপ্ত ব্যক্তি একটা আশঙ্কার মধ্যে থাকে, যাতে এটা তাকে বড় নিফাক্বের দিকে না নিয়ে যায়।

আমরা আল্লাহর কাছে তাঁর ক্রোধ, ছোট ও বড় সকল প্রকার নিফাক্ব হতে আশ্রয় চাচ্ছি এবং দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষমা ও সুস্থতা কামনা করছি।

وصلى الله وسلم وبارك على عبده ورسوله نبينا محمد وعلى آله وأصحابه أجمعين

 মূল : ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনে ওয়াহাফ আল-ক্বাহত্বানী রাহিমাহুল্লাহ

অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন

নারায়ণপুর, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর।

[1]. ফাতাওয়া ইবনু তায়মিয়া, ২৮/৩৩৪।

[2]. ড. আব্দুল আযীয হুমাইদী, আল-মুনাফেকূনা ফিল কুরআনিল কারীম, পৃ. ৪৫০।

Magazine