ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : কিছু সংশয় ও তার জবাব
দলবাজদের কোনো কোনো দাঈ নিজেদের দলাদলিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য কুরআন-হাদীছ ও আলেম-উলামার কিছু বক্তব্যকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে; অথচ সেগুলো তাদের বিরুদ্ধেই যায়। ‘অশিক্ষিত মানুষ এগুলোর মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে হোঁচট খাওয়ার ঝুঁকি না থাকলে এগুলো আসলে উল্লেখ করারই যোগ্য না’।[1]
তারা যেগুলোকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—
এক. আমীরুল মুমিনীন তথা মুসলিমদের একক শাসক ও (রাষ্ট্রীয়) সরকার সংশ্লিষ্ট বক্তব্যগুলোকে তারা দাওয়াতী জামা‘আত ও (ধর্মীয়) দলের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে; অথচ তারা এই দলীল গ্রহণ ও অপপ্রয়োগের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে। এমনকি তারা স্বীকারও করে যে[2], এই বক্তব্যগুলো সবই ‘সরকার ও রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট’।[3]
এরপরও তারা দলীল হিসেবে পেশ করে!!
কিন্তু কেন?!
আমরা নবম পরিচ্ছেদে (জামা‘আত পরিভাষাটির ব্যাখ্যা) দলীল গ্রহণের এই পদ্ধতি বাতিল প্রমাণ করেছি। আমরা স্পষ্ট বলেছি যে, এই পদ্ধতি দলীল গ্রহণের ইলমী পদ্ধতির মূলনীতিবিরোধী এবং উম্মতের বিভক্তির কারণ।
দুই. জামা‘আতবদ্ধভাবে আদায় করতে হয়— এমন কতকগুলো ফরয কাজকে তারা দাওয়াতের পদ্ধতি ও মাধ্যমের উপর ক্বিয়াস করে থাকে!! অথচ এটা ইবাদতে ক্বিয়াস, যা বাতিল বলে গণ্য। আসলে এসবগুলোই হচ্ছে নিছক ইবাদত (اَلتَّعَبُّدُ الْمَحْضُ)। তা না হলে ‘আমাদের দ্বীন জামা‘আতবদ্ধ’[4]-এই যুক্তি দেখিয়ে আমরা সুন্নাতে রতেবাহ ও অন্যান্য নফল ছলাতকেও জামা‘আতের সাথে আদায় করতে বলতে পারি কি?!
উত্তরে যদি বলা হয়, না, তা করা যাবে না। কেননা শরী‘আতে এমনটা আসেনি। তাহলে বলবো, হ্যাঁ, এটাও তো শরী‘আতে আসেনি। আর এদু’টোর মধ্যে তো কোনো পার্থক্য নেই।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে (মাধ্যম ও লক্ষ্যের ঠেলাঠেলির মাঝে দ্বীনী কার্যক্রম) এ ব্যাপারে বিস্তারিত কথা হয়ে গেছে, যা এখানে পুনর্বার উল্লেখ করার কোনো দরকার নেই।
তিন. মহান আল্লাহ বলেন, وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَر ِ ‘তোমাদের মধ্য থেকে যেন এমন একটা দল হয়, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে’ (আলে ইমরান, ৩/১০৪)।
তারা বলে, এখানে উম্মতের কতককে দাওয়াতদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আর এই ‘কতক’ কথাটি জামা‘আত[5] ছাড়া আর কিছু হতে পারে না! অতএব, ‘এটা শারঈভাবে ফরয এবং মানবিকভাবেও আবশ্যক’!! আর সূত্রে বলা আছে, ‘যা ছাড়া ওয়াজিব সম্পন্ন হয় না, তাও ওয়াজিব’[6] [مَا لَا يَتِمُّ الْوَاجِبُ إلَّا بِهِ فَهُوَ وَاجِبٌ]!!
এর জবাবে বলা যায়—
(ক) ‘উম্মাহ’ (أُمَّةٌ) শব্দের অর্থকে উক্ত অর্থে সীমাবদ্ধ করা একগুঁয়েমি ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ ‘ভাষাবিদগণ শব্দটির ১৫টি অর্থ উল্লেখ করেছেন। আমি কাউকে কাউকে ৪০টি অর্থ পর্যন্ত বর্ণনা করতে দেখেছি। সেগুলোর মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে, জামা‘আত। আরেকটি অর্থ হচ্ছে, যে কোনো ব্যক্তি, যিনি হক্বের দাওয়াত দেন’।[7]
(খ) উক্ত আয়াতটির তাফসীরে উলামায়ে কেরামের দু’টি বক্তব্য পাওয়া যায়:
১. مِنْكُمْ–এর مِنْ অব্যয়টি জাতি বা শ্রেণি (جِنْسٌ) বুঝানোর জন্য এসেছে। অর্থাৎ তোমরা সকলেই অনুরূপ হও। এখানে কাউকে বাদ দিয়ে কাউকে উদ্দেশ্য করা হয়নি। উপর্যুক্ত আয়াতটি ঠিক নিম্নবর্ণিত আয়াতটির মতো:﴿وَإِنْ مِنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا ‘আর তোমাদের প্রত্যেককেই তা (পুলছিরাত) অতিক্রম করতে হবে, এটি তোমার রবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত’ (মারইয়াম, ১৯/৭১)। এখানে কোনো মানুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়নি। বরং এটি পুরো জাতির উদ্দেশ্যে সম্বোধন; প্রত্যেকেই তার শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী।
২. এখানে مِنْ অব্যয়টি ‘কতক’ অর্থে এসেছে। তখন আয়াতটির অর্থ হবে, যারা সৎকাজের আদেশ দিবেন, তাদের আলেম হওয়া ওয়াজিব। আর একথা জানা যে, প্রত্যেকটি মানুষ আলেম নন। এই অর্থটিকে ইমাম কুরতুবী তার তাফসীরে (৪/১৬৫) অগ্রাধিকার[8] দিয়েছেন।
(গ) মহান আল্লাহ উপর্যুক্ত আয়াতটির পরেই এই আয়াতটি উল্লেখ করেছেন—﴿وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ‘আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বিভক্ত হয়েছে এবং মতবিরোধ করেছে তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পর। আর তাদের জন্যই রয়েছে কঠোর আযাব’ (আলে ইমরান, ৩/১০৫)।
‘এখানে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ এবং বিভক্তির মাঝে বড় ধরনের সম্পর্কের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে। আয়াত দু’টি যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, উম্মত যতক্ষণ পর্যন্ত এক হয়ে ও একদেহ হয়ে কাজ না করতে পারবে, ততক্ষণ এই দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে না।
তারা যখন বিভিন্ন দলে ও মতে বিভক্ত হয়ে যাবে, তখন তারা নিজেরা অক্ষম হয়ে যাবে। ফলে অন্যদের প্রতি তাদের করণীয় সম্পন্ন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না’।[9]
(ঘ) আলোচ্য আয়াতটির পূর্বের আয়াতটিও এ অর্থকেই জোর দেয় এবং স্পষ্ট করে। যেখানে মহান আল্লাহ বলেছেন, ﴿وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ‘আর তোমরা সকলে একসঙ্গে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান, ৩/১০৩)।
কারণ আয়াতটিতে উম্মতের ঐক্যের বিবরণ রয়েছে এবং রয়েছে জামা‘আতবদ্ধভাবে থাকার আহ্বান। নিশ্চয় এখানে জাতিতে জাতিতে আর দলে দলে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার কোনো উপকরণ নেই। অতএব, বিষয়টি অনুধাবন করুন!
আল্লামা শায়খ আব্দুর রহমান ইবনে নাছের আস-সা‘দী বলেন, ‘…এই দলের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন আলেমগণ, সাধারণভাবে ও বিশেষভাবে বক্তব্যদানে ও মানুষকে ওয়ায-নছীহতে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং সে সমস্ত লোক, যারা মানুষকে ছলাত প্রতিষ্ঠা, যাকাত আদায় ও দ্বীনের বিধিবিধান বাস্তবায়নে বাধ্য করে এবং অন্যায়-অপকর্ম থেকে বারণ করে।
অতএব, যারাই মানুষকে সাধারণভাবে বা বিশেষভাবে কল্যাণের দিকে দাওয়াত দিচ্ছে অথবা সাধারণ বা বিশেষ নছীহত করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে, তারা সকলেই এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
অতঃপর তিনি (আল্লাহ) তাদেরকে বিভক্তদের পথে চলতে নিষেধ করেছেন, যাদের নিকট দ্বীন ও স্পষ্ট প্রমাণাদি এসেছে, যা তাদেরকে তদনুযায়ী আমল করা ও ঐক্যবদ্ধ থাকা আবশ্যক করেছে। তারপরও তারা দলে দলে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে’।[10]
সারকথা হচ্ছে, আলেম, দাঈ, শিক্ষার্থীসহ সকল মুসলিমের আমলের মূল্য ও মর্যাদা রয়েছে। ‘যেই হোক না কেন কোনো মুসলিমের জন্যই দাওয়াতী নীতিবিরোধী কোনো দাওয়াতী কার্যক্রম উদ্বোধন পর্যন্ত পৌঁছা উচিত নয়। আল্লাহর দ্বীন ও শরী‘আতে কোনো ধরনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও সংমিশ্রণ চলবে না; চলবে না কোনো ধরনের ছাড়’।[11]
ইসলামী কার্যক্রম কোনো ‘কোম্পানি’ বা কোনো ‘সংস্থা’ নয় যে, মানুষ সেখানে প্রবেশের অনুমতির অপেক্ষায় থাকবে অথবা তার কর্মচারী হওয়ার ব্যাপারে অনুমোদনের প্রতীক্ষায় থাকবে!!
চার. ‘যা ছাড়া ওয়াজিব সম্পন্ন হয় না, তাও ওয়াজিব’ [مَا لَا يَتِمُّ الْوَاجِبُ إلَّا بِهِ فَهُوَ وَاجِبٌ]- এই সূত্র দ্বারা দলীল দেওয়ার চেষ্টা করা একটি বাতিল পদ্ধতি। কারণ সূত্রের দু’টি ওয়াজিবই শরী‘আতসিদ্ধ হতে হবে অথবা শরী‘আতের অন্যান্য বক্তব্যের সাথে কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক হওয়া চলবে না।
আর ইতোপূর্বে আমরা বিস্তারিত দেখেছি যে, দাওয়াতের মাধ্যম তার লক্ষ্যের মতোই; অবশ্যই তা শরী‘আতসিদ্ধ, সুবিদিত ও দলীলসমর্থিত হতে হবে।
এই সূত্র দ্বারা দলীল গ্রহণের অসারতা আপনার কাছে নিম্নবর্ণিত কয়েকভাবে স্পষ্ট হয়ে যাবে:
(ক) কোনো ব্যক্তি মানত করলে তার উপর মানত পূর্ণ করা ওয়াজিব। কিন্তু যদি সে মানত পূর্ণ করার মতো মাল না পায়, তাহলে তাতে কি তার কোনো অপরাধ হবে? অথবা সেই মানত পূর্ণ করার জন্য চুরি করা তো দূরে থাক কোনো ধরনের ফন্দি আঁটা কি তার উপর ওয়াজিব হবে?
এর শারঈ সমাধান হচ্ছে, সামর্থ্য থাকা অবস্থায়[12] মানত পূর্ণ করা ওয়াজিব। সামর্থ্য না থাকলে ওয়াজিব নয়। ব্যাপারটা এখানে এরকমই।
শরী‘আত পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্যমতের আদেশ করেছে এবং দলাদলি ও বিভক্তি করতে নিষেধ করেছে। তাহলে যমীনে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নের মতো বিরাট ওয়াজিব পালনে উম্মতের কর্তব্য কী?’[13] এই ওয়াজিব পালনে নিষিদ্ধ কর্ম সম্পাদন করা কি তাদের উপর ওয়াজিব? নাকি শরী‘আতসিদ্ধ বিষয়ের কাছাকাছি থাকা এবং নিষিদ্ধ কর্ম বর্জন করা ওয়াজিব?
(খ) যদি দলাদলি ও বিভিন্ন দল প্রতিষ্ঠা ওয়াজিব হতো, তাহলে ‘অবশ্যই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর উপর তা স্পষ্টরূপে বর্ণনা করে দেওয়া ওয়াজিব হতো, যা অজুহাত পেশ করার পথ বন্ধ করে দিত’।[14] তা বিভিন্ন মতের লুটের মাল, বিভিন্ন দলের পক্ষপাতিত্বের লক্ষ্যবস্তু, মতানৈক্যের উৎস ও বিভক্তির ভান্ডার হিসেবে রেখে দেওয়া হতো না।
বরং মহান আল্লাহ তার কিতাবে এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাদীছে যে বিষয়টি স্পষ্ট বর্ণনা করেছেন, তা হচ্ছে— ইসলাম ও মুসলিমদের ঐক্য ধরে রাখতে হবে; ডানে-বামে বিভক্ত হয়ে যাওয়া যাবে না।
(গ) উপর্যুক্ত কাঙ্ক্ষিত ওয়াজিব -তাদের ধারণা মতে- বিষয়ের উৎস কোথায়? বিবেক নাকি শরী‘আত? প্রবৃত্তি নাকি কুরআন-হাদীছের উদ্ধৃতি? অনৈক্য নাকি ঐক্য? বিভক্তি নাকি মিল? নাকি তারা মনে করে, লক্ষ্য মাধ্যমকে বৈধ করে দেয়?!
(ঘ) আলোচ্য সূত্রটির বাস্তবায়ন শুদ্ধ হওয়ার জন্য দু’টি শর্ত রয়েছে:
১. মূল ওয়াজিব বাস্তবায়নের বিষয়টি এই শাখাগত ওয়াজিবের উপর নির্ভরশীল হতে হবে। এর বাইরে কোনো পথ নেই।
২. শাখাগত ওয়াজিবটি বিদ্যমান থাকলে মূল ওয়াজিব বিষয়টি বিদ্যমান থাকা অবধারিত হতে হবে; স্রেফ ধারণা ও কল্পনাপ্রসূত হলে চলবে না।
এই দু’টি শর্তই এখানে অনুপস্থিত।
(ঙ) শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ-এর দিকে সম্বন্ধিত একটি বক্তব্যকে তারা উল্টো বুঝেছে এবং ভিন্ন অর্থে গ্রহণ করেছে।[15]
শায়খুল ইসলাম তার ‘মাজমূ‘উল ফাতাওয়া’ (১১/৯২)-তে ছূফীদের মতো কিছু দলের চালু করা কিছু শব্দ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মন্তব্য করেন। ফলে সেই মন্তব্যগুলো ‘পরিভাষায়’ পরিণত হয়, যার রয়েছে বিশেষ অর্থ ও সঙ্কেত। তার মন্তব্যসমূহের মধ্যে একটি মন্তব্যে তিনি বলেন, وَأَمَّا " رَأْسُ الْحِزْبِ " فَإِنَّهُ رَأْسُ الطَّائِفَةِ الَّتِي تَتَحَزَّبُ أَيْ تَصِيرُ حِزْبًا فَإِنْ كَانُوا مُجْتَمِعِينَ عَلَى مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ وَرَسُولُهُ مِنْ غَيْرِ زِيَادَةٍ وَلَا نُقْصَانٍ فَهُمْ مُؤْمِنُونَ لَهُمْ مَا لَهُمْ وَعَلَيْهِمْ مَا عَلَيْهِمْ. وَإِنْ كَانُوا قَدْ زَادُوا فِي ذَلِكَ وَنَقَصُوا مِثْلَ التَّعَصُّبِ لِمَنْ دَخَلَ فِي حِزْبِهِمْ بِالْحَقِّ وَالْبَاطِلِ وَالْإِعْرَاضِ عَمَّنْ لَمْ يَدْخُلْ فِي حِزْبِهِمْ سَوَاءٌ كَانَ عَلَى الْحَقِّ وَالْبَاطِلِ فَهَذَا مِنْ التَّفَرُّقِ الَّذِي ذَمَّهُ اللَّهُ تَعَالَى وَرَسُولُهُ فَإِنَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أَمَرَا بِالْجَمَاعَةِ والائتلاف وَنَهَيَا عَنْ التَّفْرِقَةِ وَالِاخْتِلَافِ وَأَمَرَا بِالتَّعَاوُنِ عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَنَهَيَا عَنْ التَّعَاوُنِ عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ. ‘দলনেতা, যিনি এমন দলের নেতা, যে দলটি আসলেই একটি দলে পরিণত হয়েছে। তারা যদি কোনো রকম কম-বেশি করা ছাড়া আল্লাহ ও তার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর আদেশের উপর সমবেত হয়, তাহলে তারা মুমিন। ভালো করলে তাদের পক্ষে যাবে; মন্দ করলে তাদের বিপক্ষে যাবে। আর যদি তারা আল্লাহ ও তার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর আদেশে কম-বেশি করে, তাহলে তা হবে বিভেদ, যাকে আল্লাহ ও তার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিন্দা করেছেন। যেমন— হক্ব বা বাতিল যে কোনো উপায়ে সে ব্যক্তির পক্ষাবলম্বন করা, যে তাদের দলে যোগ দিয়েছে। পক্ষান্তরে যে তাদের দলে যোগ দেয়নি, সে হকের উপর থাক বা বাতিলের উপর থাক, তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। কারণ আল্লাহ ও তার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামা‘আতবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে আদেশ করেছেন এবং বিভক্তি ও বিভেদ করতে নিষেধ করেছেন। তারা পুণ্য ও তাক্বওয়ার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে আদেশ করেছেন; কিন্তু পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছেন’।
এটাই শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহর বক্তব্য। এতে আসলে কী আছে?
উপর্যুক্ত উক্তি দ্বারা দলাদলি বৈধ করার দলীল গ্রহণকারীকে নিম্নবর্ণিত কয়েকভাবে জবাব দেওয়া যায়:
১. শায়খুল ইসলামের গবেষণাটি হচ্ছে নামের ব্যাপারে; নামধারীর ব্যাপারে নয়। কারণ আলোচ্য বক্তব্যটির আগে ও পরে তিনি (الْفُتُوَّة), (الزَّعِيم) ও (الدَّسْكَرَة) নামগুলো উল্লেখ করেছেন।
সেজন্যই আলোচ্য বক্তব্যটির ঠিক আগের পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেকটি নাম, যার সাথে মহান আল্লাহ কুরআন ও হাদীছে প্রশংসা ও নেকী জুড়ে দিয়েছেন, সেসব নামধারীরা প্রশংসিত। পক্ষান্তরে, কুরআন ও হাদীছে যেসব নামের সাথে তিনি নিন্দা ও শাস্তি জুড়ে দিয়েছেন, সেগুলোর নামধারীরা নিন্দিত। যেমন— মিথ্যা (الكذب), খিয়ানত (الخيانة), পাপাচার (الفجور), যুলম (الظلم), অশ্লীলতা (الفاحشة) ইত্যাদি’।
আর ইতোপূর্বে আমরা স্পষ্ট বলেছি যে, ‘হিযব’ (الحزب) বা দল শব্দটি কুরআনে কখনও প্রশংসা অর্থে এসেছে। আবার কখনও নিন্দা অর্থে এসেছে। দল যখন একটি হবে, তখন তা প্রশংসা অর্থে হবে আর যখন বিভিন্ন দলে বিভক্ত হবে, তখন তা নিন্দা অর্থে হবে। তাহলে ইবনু তাইমিয়্যাহ কর্তৃক ‘হিযব’ শব্দের ব্যাখ্যায় দলাদলিকে বৈধতা দেওয়া হলো কোথায়?
২. তিনি যে দলের আভিধানিক অর্থ বর্ণনা করছিলেন, তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন, ‘তাদেরকে কোনো রকম কম-বেশি করা ছাড়াই আল্লাহ ও তার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর আদেশের উপর সমবেত হতে হবে’। দলাদলি আসলে কি তদ্রুপ নাকি (উল্টো) কম-বেশির উপরই তা প্রতিষ্ঠিত?!
৩. বরং দলাদলি থেকে সতর্কতামূলক বহু বক্তব্য শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ থেকে এসেছে, যেগুলোর সামান্য কিছু ইতোপূর্বে গত হয়ে গেছে। আপনি তার নিম্নবর্ণিত বক্তব্যটি একটু অনুধাবন করুন:وَلَيْسَ لِلْمُعَلِّمِينَ أَنْ يحزبوا النَّاسَ وَيَفْعَلُوا مَا يُلْقِي بَيْنَهُمْ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ بَلْ يَكُونُونَ مِثْلَ الْإِخْوَةِ الْمُتَعَاوِنِينَ عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى ‘…শিক্ষকমণ্ডলীর জন্য মানুষের মাঝে দলাদলি সৃষ্টি করে দেওয়া[16] সমীচীন নয়। তাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে পারে— এমন কিছু করা উচিত নয়। বরং তাদের নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে পারস্পরিক সহযোগী ভাইয়ের মতো হওয়া উচিত’।[17]
তার এ বক্তব্যটিও অনুধাবন করুন: ‘…কারো জন্য কোনো শায়খের দিকে এমনভাবে সম্বন্ধিত হওয়া উচিত নয় যে, তার অনুসরণ করতে গিয়ে মিত্রতা বা শত্রুতা গড়ে তুলবে। বরং প্রত্যেক ঈমানদার এবং তাক্বওয়াবান শায়খ ও ব্যক্তির সাথে মিত্রতা পোষণ করা তার উপর আবশ্যক। সে কারো সাথে অতিরিক্ত মিত্রতা পোষণ করবে না। তবে যদি কারো অতিরিক্ত ঈমান ও তাক্বওয়া দেখা যায়, তাহলে তার সাথে অতিরিক্ত মিত্রতা পোষণ করবে। সে সেই ব্যক্তিকে এগিয়ে রাখবে, যাকে আল্লাহ ও তার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগিয়ে রেখেছেন এবং তাকে প্রাধান্য দিবে, যাকে আল্লাহ ও তার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রাধান্য দিয়েছেন’।[18]
এরকম বহু জায়গায় এই বিদগ্ধ ইমামের বহু বক্তব্য রয়েছে, যার পরিসংখ্যান জানা আপনার জন্য প্রায় অসম্ভব।
অতএব, আলোচ্য বক্তব্যটির বিকৃত অর্থ নিলে তা হবে স্পষ্ট যুলম এবং স্পষ্ট হকের ক্ষতিসাধন।
(চলবে)
মূল : আলী ইবনে হাসান আল-হালাবী আল-আছারী
অনুবাদ : আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী
বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. আল-মুনতাক্বা আন-নাফীস মিন তালবীসি ইবলীস, পৃ. ৩১৪।
[2]. যেমনটা স্বীকার করেছেন আব্দুল্লাহ উলওয়ান তার ‘বায়নাল আমালিল ফারদি ওয়াল আমালিল জামাঈ’ বইয়ের ৭৯ পৃষ্ঠায়।
[3]. প্রাগুক্ত।
[4]. যেমনটা তারা সারাক্ষণ বুলি আওড়ায়। দেখুন: আদ-দাওয়াহ আল-ইসলামিয়্যাহ: ফারীযাহ শার‘ঈয়্যাহ, পৃ. ৩৭; আত-তানযীমুল হারাকী ফিল ইসলাম, পৃ. ১৮; মাশরূ‘ইয়্যাতুল আমাল আল-জামাঈ, পৃ. ১০-১১।
[5]. মুহাম্মাদ আল-হাসান, আল-মাযাহিবু ওয়াল আফকারুল মু‘আছিরাহ ফিত-তাছাওউর আল-ইসলামী, পৃ. ৬।
[6]. আব্দুল্লাহ উলওয়ান, বায়নাল আমালিল ফারদি ওয়াল আমালিল জামাঈ, পৃ. ৮১।
[7]. কাযী ইবনুল আরাবী আল-মালেকী, আহকামুল কুরআন, ১/২৯২।
[8]. শায়খ বাকর আবু যায়েদ ‘হুকমুল ইনতিমা’ বইয়ের ৬৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘এখানে উম্মাহ বলতে আলেমশ্রেণি উদ্দেশ্য, যাদের মাধ্যমে আল্লাহ উম্মতের সাধারণ জনগণকে সংশোধনের ব্যবস্থা করেন। তারাই হচ্ছেন উম্মতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। তাদের নিকট গেলে মানুষের মন প্রশান্তি পায়। তারাই অহির আলোর মশাল জ্বালান এবং তারাই আল্লাহর দিকে ডাকেন’।
[9]. হুকমুল ইনতিমা, পৃ. ১৩২।
[10]. তাইসীরুল কারীমির রহমান, ১/১৯৫।
[11]. হুকমুল ইনতিমা, পৃ. ১৫৯।
[12]. ইবনুল ক্বাইয়িম, এ‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন, ৩/২৯।
[13]. যেমনিভাবে সর্বদা তাদেরকে বলতে শুনি এবং তাদের থেকে পড়ে থাকি।
[14]. শায়খ রবী‘ ইবনে হাদী, মানহাজুল আম্বিয়া ফিদ-দাওয়াতি ইলাল্লাহ, পৃ. ১১৪।
[15]. আল-মুনতালিক্ব, পৃ. ১৪৬! এই বইয়ের লেখকের কাছ থেকে তার মুক্বাল্লিদরা গ্রহণ করেছে। দেখুন: আদ-দাওয়াহ আল-ইসলামিয়্যাহ বায়নাল ফারদিয়্যাতি ওয়াল জামা‘ইয়্যাহ, পৃ. ৮১; মাহমূদ উবাইদাত, আছারুল জামা‘আতিল ইসলামিয়্যাহ ফিল ক্বরনিল ‘ইশরীন, পৃ. ১৬১; ছদিক আমীন, আদ-দাওয়াহ আল-ইসলামিয়্যাহ ফারীযাহ শার‘ইয়্যাহ ওয়া যরূরাহ বাশারিয়্যাহ, পৃ. ৪৪; নাদের নূরী, রসাইলুল ইখা, পৃ. ১৩।
[16]. বর্তমান যুগের দলবাজরা এই অকাট্য উক্তিটির ব্যাপারে কী করবে, যা অপব্যাখ্যার কোনো ধরনের সুযোগ নেই?!
এখানে আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই, তা হচ্ছে— শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ-এর এই বক্তব্যটি শিক্ষকমণ্ডলীর উদ্দেশ্যে পেশকৃত, অথচ তারা জ্ঞানী এবং মানুষের পথনির্দেশক ও শিক্ষক।
তাহলে অবস্থা কেমন হতো, যদি তিনি দলীয় দাঈ ও বিভিন্ন আন্দোলনধর্মী সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে দেখতেন, যাদের মধ্যে জ্ঞান কমে গেছে, শিক্ষা বিলীন হয়ে গেছে, অথচ তারা যুগশ্রেষ্ঠ আলেমগণের বিরোধিতায় মত্ত এবং এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ইমামগণের বক্তব্যের বিপরীতে অবস্থানরত?!
কোনো সন্দেহ নেই যে, এমন প্রেক্ষিতে তার বক্তব্য আরো শক্ত হতো এবং তার প্রত্যাখ্যান আরো কঠিন হতো। ইবনুল হাজ্জ প্রণীত ‘আল-মাদখাল’ (৩/২১৬) বইটি দেখুন; সেখানে এধরনের বক্তব্যের খণ্ডন বিধৃত হয়েছে।
[17]. মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ২৮/১৫-১৬।
[18]. মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ১১/৫১২।