কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

সমাজসংস্কারে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

post title will place here

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সমাজসংস্কার সম্পর্কে বলেন,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ‘আল্লাহর রাসূলের মধ্যে আছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ’ (আল-আহযাব, ৩৩/২১)। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে শান্তি, মুক্তি, প্রগতি ও সামগ্রিক কল্যাণের জন্য বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা এসেছে, وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ ‘আমরা আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি’ (আল-আম্বিয়া, ২১/১০৭)

মহানবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (৫৭০-৬৩২ খ্রি.) সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে সুখ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি আদর্শ জীবনবিধান প্রতিষ্ঠা করে সর্বাধিক কৃতিত্বের আসনে আসীন হয়েছেন। যা সর্বকালের ও সর্বযুগের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মুখে মুখে স্বীকৃত। তিনি এমনি এক যুগসন্ধিকালে পৃথিবীতে এসেছেন, যখন আরবের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। প্রাক-ইসলামী যুগে আরবদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। গোত্র কলহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারি, হানাহানি, চরম উচ্ছৃঙ্খলতা, পাপাচার, ব্যভিচার ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার নৈরাজ্যপূর্ণ অবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিল গোটা সমাজ।

সামাজিক সাম্য-শৃঙ্খলা, ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ, নারীর মর্যাদা ইত্যাদির নাজুক অবস্থা তৈরি হয়েছিল। সূদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, চুরি-লুণ্ঠন, ব্যভিচার, পাপাচার, অন্যায়-অপরাধের তাণ্ডবলীলায় সমাজকাঠামো ধসে পড়েছিল। এমন এক ক্রান্তিলগ্নে মহানবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাব হয়েছিল। তিনি আরবের বুকে এক বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করে বিশ্বের ইতিহাসে অতুলনীয় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে নবুঅতের আলোকে উদ্ভাসিত করেছিলেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমন আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্ব মানবতার জন্য বিশেষ অনুগ্রহ। আল্লাহ তাআলা বলেন,لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ ‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মাঝে তাদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের নিকট আল্লাহর আয়াত তেলাওয়াত করেন, তাদের পবিত্র করেন এবং তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান ও হিকমত শিক্ষা দান করেন’ (আলে ইমরান, ৩/১৬৪)

মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজের যাবতীয় অনাচার দূর করে যে এক জান্নাতী সমাজব্যবস্থা ক্বায়েম করেন, ইতিহাসে এর দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। নিম্নে তাঁর সংস্কারের কিছু নমুনা পেশ করা হলো।

তাওহীদের আদর্শে সমাজের গোড়া পত্তন: ধর্মীয় ক্ষেত্রে নানা অনাচার, পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র সমাজকে এক আল্লাহতে বিশ্বাসী তাওহীদের আদর্শে নবরূপে রূপায়িত করেন। সকল ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের উৎস একমাত্র আল্লাহকেই মেনে নিয়ে সমাজের সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার ব্যবস্থা করেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তার সাথে অন্য কিছুকে শরীক করো না’ (আন-নিসা, ৪/৩৬)

মানবতার ভিত্তিতে সমাজ গঠন: সমগ্র আরব দেশ জঘন্য পাপ ও অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে মহানবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাম্য, অকৃত্রিম ভ্রাতৃত্ব এবং বিশ্ব মানবতার ভিত্তিতে যে এক উন্নত ও আদর্শ সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন করেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। তাঁর প্রবর্তিত সমাজে গোত্রের বা রক্তের সম্পর্কের চেয়ে ঈমানের বন্ধনই ছিল মযবূত ঐক্যের প্রতীক। তিনি অন্ধ আভিজাত্যের গৌরব ও বংশ মর্যাদার গর্বের মূলে কুঠারাঘাত হানেন এবং সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ কাঠামো প্রস্তুত করেন।

মানুষের মাঝে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যিনি আল্লাহর সবচেয়ে বেশি অনুগত ও মানুষের সর্বাধিক কল্যাণকামী। তাঁর সমাজ ব্যবস্থায় উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র, কালো-সাদার কোনো বৈষম্য রইল না। মানুষে মানুষে সকল প্রকার অসাম্য ও ভেদাভেদ দূরীভূত করে মানবতার অত্যুজ্জ্বল আদর্শে সমাজবন্ধন সুদৃঢ় করেন। আরবের ইতিহাসে রক্তের পরিবর্তে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ গঠনের এটাই প্রথম দৃষ্টান্ত। হাদীছে এসেছে, ‘প্রত্যেক মানুষ আদম ও হাওয়ার সন্তান। অনারবের ওপর আরবের আর আরবের ওপর অনারবের, কালোর ওপর সাদার কিংবা সাদার ওপর কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শুধু তাক্বওয়া ও নেক আমল ছাড়া’।[1] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘হে কুরাইশ বংশের লোকেরা! আল্লাহ তোমাদের জাহেলী যুগের অহংকার-গৌরব ও পূর্ব বংশীয় শ্রেষ্ঠত্ববোধকে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে দিয়েছেন’।[2]

দাসদের সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা দান: মনিবরা গোলামদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করত। মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মর্যাদাই ছিল না। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনিবদের নির্দেশ দিলেন ক্রীতদাসদের প্রতি সদাচরণ করতে। তিনি বললেন, তোমরা যা খাও, পরিধান করো, তাদের তা খেতে এবং পরিধান করতে দাও। তিনি তাদের মুক্তির পথনির্দেশ করে ঘোষণা দিলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিন দাসকে আজাদ করবে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে আজাদকারীর প্রতিটি অঙ্গকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দিবেন। এমনকি তার (দাসের) লজ্জাস্থানের বিনিময়ে মুক্তকারীর লজ্জাস্থানকে মুক্তি দিবেন’।[3] তিনি নিজেও অনেক দাসকে মুক্ত করেন। এতে অনেক ছাহাবী তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তাঁর উদারতার জন্য দাস বেলাল রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ইসলামের প্রথম মুয়াযযিন এবং ক্রীতদাস যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সেনাপতির পদে অধিষ্ঠিত করে দাসদের পূর্ণ সামাজিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন।

নারীর মর্যাদা দান: তৎকালীন আরবে নারীদের ভোগ্যসামগ্রী মনে করা হতো। তারা ছিল পুরুষদের দাসী মাত্র। এমনকি কন্যাসন্তানের জন্মকে অপমানের বিষয় মনে করা হতো। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ ‘আর যখন তাদেরকে কন্যাসন্তানের সংবাদ দেওয়া হতো, তখন তাদের মুখমণ্ডল কালো হয়ে যেত’ (আন-নহল, ১৬/৫৮)। তাই কন্যা সন্তানদের জীবন্ত দাফন প্রথা প্রসিদ্ধ ছিল।

পরিবারের কর্তা ইচ্ছা করলে নারীকে ক্রয়-বিক্রয় এবং হস্তান্তর করতে পারত। পিতা এবং স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের কোনো অংশ ছিল না। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই কুসংস্কার ও জঘন্য প্রথা বন্ধ করেন এবং নারী সমাজের প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা দূর করতে তিনি ঘোষণা করেন, ‘মেয়ের ব্যাপারে কোনো কিছু দিয়ে যাকে পরীক্ষা করা হয়, সে যদি তাতে ধৈর্যধারণ করে, তবে তারাই তার জন্য জাহান্নামের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে’।[4] অন্য হাদীছে আছে, ‘যে ব্যক্তি দুটি মেয়ে সন্তান লালনপালন করবে, সে আর আমি এমনভাবে জান্নাতে প্রবেশ করব’। এই বলে তিনি দুই আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখান।[5]

নারীসমাজের অধিকার সংরক্ষণ পুরুষদের উপর আবশ্যক করেছেন, দিয়েছেন সমাজে নারীদের পরিপূর্ণ মর্যাদা। হাদীছে এসেছে, মুআবিয়া ইবনু জাহেমা সুলামী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন নিবাসের জন্য আপনার সাথে থেকে জিহাদ করার মনস্থির করেছি। একথা শুনে তিনি বললেন, ‘তোমার জন্য দুঃখ হয়, তোমার মা বেঁচে আছেন কি? জবাবে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, ‘তোমার জন্য দুঃখ হয়, তুমি তার পায়ের কাছে লেগে থাকো। কেননা সেখানেই জান্নাত রয়েছে’।[6]

নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজে নারীদের অভূতপূর্ব মর্যাদা দেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম’।[7] তিনি সর্বপ্রথম নারীদেরকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা দেন। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা নারী জাতির (অধিকারের) ব্যাপারে সতর্ক হও। কেননা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ’।[8] এসবের জন্য নারী জাতি সমাজের অভিশাপ না হয়ে আশীর্বাদে পরিণত হয়।

সংঘাতমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা: তৎকালীন আরবের বিভিন্ন গোত্রে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকত। সামান্য অজুহাতে ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা বেজে যেত। তা দীর্ঘকাল পর্যন্ত দাবানলের মতো জ্বলতে থাকত। রক্তপাত ও লুণ্ঠন ছিল তাদের নিত্যদিনের পেশা। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রাক-নবুঅতে ‘হিলফুল ফুযূল’ এবং পরে ‘মদীনা সনদ’-এর মাধ্যমে সমাজে শান্তি আনয়ন করেন।

মদ্যপান রহিতকরণ: মদ্যপ্রিয়তা আরবদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। মদপান করে নর্তকীদের সঙ্গে উন্মত্ত হয়ে তারা যেকোনো অশ্লীল কাজ করত। মহানবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনে চরম ক্ষতি সাধনকারী। তাই তিনি কঠোরভাবে মদ্যপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সমাজের কল্যাণ সাধন করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী, ভাগ্য নির্ধারক শর নাপাক ও শয়তানী কর্ম। কাজেই তোমারা এসব থেকে বেঁচে থাকো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’ (আল-মায়িদা, /৯)

জুয়া খেলা নিষিদ্ধ: আরবে তখন জুয়া খেলার ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং এটাকে তারা সম্মানজনক অভ্যাস মনে করত। জুয়া খেলায় হেরে মানুষ অসামাজিক কাজে লিপ্ত হতো। ফলে ব্যাহত হতো সামাজিক জীবন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুয়া খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সমাজকে ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন।

কুসীদপ্রথা উচ্ছেদ: কুসীদপ্রথা হলো একপ্রকার সূদের কারবার। আরব সমাজে জঘন্য কুসীদপ্রথা বিদ্যমান ছিল। আরবে প্রচলিত এই ব্যবস্থা সুস্থ সমাজ বিকাশে প্রচণ্ড বাধাস্বরূপ ছিল। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূদ হারাম ঘোষণা করেন এবং আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীকে ‘ক্বরযে হাসানা’ দানে উৎসাহ প্রদান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً ‘কে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করবে? তাহলে তিনি তাকে তা বহুগুণে বাড়িয়ে দিবেন’ (আল-বাক্বারা, ২/২৪৫)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ الْمُصَّدِّقِينَ وَالْمُصَّدِّقَاتِ وَأَقْرَضُوا اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعَفُ لَهُمْ وَلَهُمْ أَجْرٌ كَرِيمٌ ‘নিশ্চয় দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী এবং যারা আল্লাহকে উত্তম কর্য দেয়, তাদেরকে তিনি বহুগুণ বাড়িয়ে দিবেন এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান’ (আল-হাদীদ, ৫৭/১৮)

কুসংস্কার হতে মুক্তি: আরবের জাহেলী সমাজে নানা কুসংস্কার ছিল। ভাগ্য নির্ধারক তির, দেবদেবীর সাথে অলীক পরামর্শ, মৃতের অজ্ঞাতযাত্রার ধারণা প্রভৃতি চালু ছিল। শুধু তাই না, আরও নানা প্রকার ভূত-প্রেত, দৈত্য প্রভৃতিকে তারা বিশ্বাস করত। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্নভাবে তাদের মন ও মগজ থেকে সমস্ত কুসংস্কার দূর করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী, ভাগ্য নির্ধারক শর নাপাক ও শয়তানী কর্ম। কাজেই তোমারা এসব থেকে বেঁচে থাকো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। নিশ্চয়ই শয়তান মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও ছালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না? আর তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং আনুগত্য করো রাসূলের। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আমার রাসূলের দায়িত্ব শুধু সুস্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়া’ (আল-মায়েদা, ৫/৯০-৯২)

নিষ্ঠুরতার অবসান: প্রাচীন আরব নিষ্ঠুরতায় ভরপুর ছিল। ভোগবাদী আরবরা দাস-দাসী, এমনকি শত্রু গোত্রের লোকদের সাথে অমানবিক আচরণ করত। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজ হতে এরূপ বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা দূর করে সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধন করেন।

যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তন: অর্থনৈতিক দৈন্যদশা বিদূরিত করে সমাজের সার্বিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সৌধ নির্মাণের নিমিত্তে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতের বিধান প্রবর্তন করেন। যাতে করে সমাজ হতে দারিদ্র্য বিমোচনের পথ সুগম হয়। তিনি ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য সমাজ হতে চিরতরে উৎখাত করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ ‘তোমরা ছালাত ক্বায়েম করো এবং যাকাত দাও। তোমরা যা কিছু উত্তম আমল নিজেদের জন্য অগ্রীম প্রেরণ করবে, আল্লাহর নিকট তা পাবে’ (আল-বাক্বারা, ২/১১০)

আর্থ-সামাজিক অসাধুতা দূরীকরণ: মহানবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর্থ-সামাজিক অসাধুতা, প্রতারণা, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, হঠকারিতা, মজুদদারি, কালোবাজারি ইত্যাকার যাবতীয় অনাচার হারাম ঘোষণা করেন এবং তা সমাজ থেকে উচ্ছেদ করে একটি সুন্দর, পবিত্র সমাজ কাঠামো বিনির্মাণ করেন।[9] নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘একমাত্র পাপী ব্যক্তিরাই মজুদদারি করে থাকে’।[10]

জীবনসম্পদের নিরাপত্তা: রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করেন। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং কারো সম্পদ গ্রাস করা যাবে না। সকলের জীবন ও সম্পদ পবিত্র- এ বিশ্বাসের ওপর সমাজ কাঠামোকে গড়ে তোলেন। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا ‘যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমদের সম্পদ গ্রাস করে, নিশ্চয়ই তারা তাদের পেট আগুন দিয়ে পূর্ণ করে। শীঘ্রই তারা জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে’ (আন-নিসা, ৪/১০)। বিদায় হজ্জের ভাষণে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, সম্ভ্রম পবিত্র; যেমন পবিত্র আজকের এই দিন, এই মাস ও এই নগরী।[11]

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: বিভিন্ন প্রকার অবিচার, অনাচার দূরীকরণের জন্য নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আইনের শাসন ক্বায়েম করেন। আইনকে ব্যক্তি বিশেষ অথবা কোনো গোত্রের হাতে না দিয়ে কেন্দ্রীয় বিচার বিভাগের হাতে ন্যস্ত করেন। যেন আইন কারো ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার না হয়।

উপর্যুক্ত আলোচনায় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতি অল্প সময়ে স্বীয় প্রচেষ্টা, অদম্য শক্তিবলে সকল অনাচারের মূলোৎপাটন করে অসভ্য, দ্বিধাবিভক্ত, সদা কলহপ্রিয় সে সময়ের সর্বাপেক্ষা অধঃপতিত আরবকে সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের বন্ধনে সংঘবদ্ধ জাতিতে পরিণত করে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এভাবে তিনি পুরো বিশ্বের জন্য সর্বোত্তম সমাজসংস্কারক হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। সেজন্য বলতে হয়, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মহামানব ও আখেরী নবী। ক্বিয়ামত পর্যন্ত যারা তাঁর অনুসরণ করবে অবশ্যই তারা হেদায়াত পাবে। ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি লাভ করবে।

নাজমুল হাসান সাকিব

দাওরায়ে হাদীছ (মাস্টার্স), ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা;

অধ্যয়নরত (ইফতা), আল-মারকাজুল ইসলামী, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।


[1]. ইমাম বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান, হাদীছ/৫১৩৭।

[2]. আল-বিদায়া ওয়াল নিহায়া, ৪/৩০১; ইবনে হিশাম, ২/৪১২।

[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫০৯; তিরমিযী, হা/১৫৪১; ইরওয়াউল গলীল, হা/১৭৪২।

[4]. তিরমিযী, হা/১৯১৯।

[5]. তিরমিযী, হা/১৯২০।

[6]. ইবনু মাজাহ, হা/২৭৮১, হাদীছ ছহীহ।

[7]. তিরমিযী, হা/৩৮৯৫; ইবনু মাজাহ, হা/১৯৭৭।

[8]. আবূ দাঊদ, হা/১৯০৫।

[9]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/২৩৯৮।

[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬০৫।

[11]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬২২-১৬২৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৯৮।

Magazine