খালেছ হৃদয়ে ইবাদত করার গুরুত্ব :
একজন মুসলিমকে সকল ইবাদত খালেছ অন্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে করতে হবে। আর সেটি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তরীকায় সম্পাদন করতে হবে। নতুবা তা মহান প্রভুর নিকটে গৃহীত হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,فَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ ذَلِكَ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ‘অতএব আত্মীয়স্বজন, অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকে তাদের প্রাপ্য দিয়ে দাও। এ কাজটি সর্বোত্তম ওদের জন্যে, যারা একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি কামনা করে এবং ওরাই সত্যিকার সফলকাম’ (আর-রূম, ৩০/৩৮)। আল্লাহ তাআলা ছাহাবীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় বলেন, يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا ‘তারা একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ কামনা করে’ (আল-ফাতহ, ৪৮/২৯)। তিনি আরও বলেন,وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّى وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى وَلَسَوْفَ يَرْضَى ‘তবে পরম মুত্তাক্বী ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। যিনি স্বীয় সম্পদ দান করে আরো কল্যাণ প্রাপ্তি তথা তা বৃদ্ধির আশায়। তার প্রতি কারোর অনুগ্রহের প্রতিদান হিসাবে নয়। শুধু তার মহান প্রভুর একান্ত সন্তুষ্টি লাভের আশায়। সে জান্নাত পেয়ে অচিরেই সন্তুষ্ট হবে’ (আল-লায়ল, ৯২/১৭-২১)।
আমল করার পূর্বে আক্বীদা পরিশুদ্ধ হওয়া জরুরী। কেননা সঠিক আক্বীদা পোষণ করত আমল করলে তা মহান প্রভুর নিকট গৃহীত হবে। অন্যথা তা বিফলে যাবে। বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করে খালেছ অন্তরে আমল করতে হবে। নচেৎ তা আল্লাহ কবুল করবেন না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِىَ بِهِ وَجْهُهُ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কোনো আমল কবুল করবেন না, যদি তাঁর জন্য তা খালেছ হৃদয়ে ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য না করা হয়’।[1]
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوْبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে দেখবেন না; বরং তিনি দেখবেন তোমাদের অন্তর ও আমলসমূহের দিকে’।[2] প্রকৃত মুমিন-মুসলিম হতে চাইলে সর্বপ্রথম আক্বীদা পরিশুদ্ধ করতে হবে। সঠিক আক্বীদাবিহীন আমল মূল্যহীন। কেননা হাদীছে আমলে পূর্বে আক্বীদার উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নের হাদীছগুলোর প্রতি গভীরভাবে মনোযোগ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رضي الله أَنَّ أَعْرَابِيًّا أَتَى النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ دُلَّنِىْ عَلَى عَمَلٍ إِذَا عَمِلْتُهُ دَخَلْتُ الْجَنَّةَ قَالَ تَعْبُدُ اللهَ لاَ تُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا وَتُقِيْمُ الصَّلاَةَ الْمَكْتُوْبَةَ وَتُؤَدِّى الزَّكَاةَ الْمَفْرُوْضَةَ وَتَصُوْمُ رَمَضَانَ قَالَ وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ لاَ أَزِيْدُ عَلَى هَذَا فَلَمَّا وَلَّى قَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى هَذَا.
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একদা একজন বেদুঈন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বললেন, আমাকে এমন আমলের কথা বলে দিন, যে আমল করলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে— তাঁর সাথে কোনকিছুকে শরীক করবে না, ফরয ছালাত আদায় করবে, ফরয যাকাত আদায় করবে এবং রামাযানের ছিয়াম পালন করবে। তখন ঐ ব্যক্তি আল্লাহর শপথ করে বললেন, আমি এর বেশি করব না। যখন লোকটি চলে গেলেন, তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি একজন জান্নাতী ব্যক্তিকে দেখে আনন্দিত হতে চায়, সে যেন এই ব্যক্তির দিকে দেখে।[3]
হুযায়ফা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমার বুকে লাগালাম। অতঃপর তিনি বললেন, مَنْ قَالَ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ خُتِمَ لَهُ بِهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ صَامَ يَوْمًا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ خُتِمَ لَهُ بِهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ خُتِمَ لَهُ بِهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলে এবং সেটাই তার শেষ কথা হয়, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একটি ছিয়াম পালন করবে এবং সেটাই তার শেষ আমল হবে, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কিছু ছাদাক্বা করে এবং সেটা তার শেষ কর্ম হয়, তবে সেও জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[4]
আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, مَنْ الْتَمَسَ رِضَا اللَّهِ بِسَخَطِ النَّاسِ كَفَاهُ اللَّهُ مُؤْنَةَ النَّاسِ وَمَنْ الْتَمَسَ رِضَا النَّاسِ بِسَخَطِ اللَّهِ وَكَلَهُ اللَّهُ إِلَى النَّاسِ ‘যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি কামনা করে, মানুষের ব্যাপারে তার জন্য একমাত্র আল্লাহই যথেষ্ট। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলাকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করে, আল্লাহ তাআলা তাকে মানুষের হাতে ছেড়ে দেন’।[5]
আল্লামা ইবনু কাছীর রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘কোনো আমল আল্লাহ কবুল করবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ আমলের মধ্যে এ দুটি শর্ত একত্রিত না হবে: (ক) কাজটি সঠিক পদ্ধতিতে শরীআত মোতাবেক অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশিত পন্থায় হওয়া এবং (খ) শিরক থেকে মুক্ত হওয়া’।[6]
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খালেছ অন্তরে ইবাদত করার গুরুত্ব অত্যধিক। এরূপ ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা জান্নাতে প্রবেশ লাভের সুযোগ দিয়ে ধন্য করবেন। এককথায় শিরকমুক্ত আক্বীদা ও বিদআতমুক্ত আমলের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত।
খালেছ অন্তরে ঈমান আনার ফযীলত :
খালেছ অন্তরে ঈমান আনলে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ পাওয়া যাবে। কোনো অপরাধ থাকলেও এক সময় খাঁটি ঈমানের বদৌলতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অপরাধ অনুযায়ী হয়তো তাকে আযাবে পতিত হতে পারে। তবে তাকে শিরক হতে মুক্ত থাকতে হবে। আর খাঁটি ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করতে হবে। বিশুদ্ধ ঈমানের প্রতিদান সম্পর্কে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, মুআয ইবনু জাবাল রযিয়াল্লাহু আনহু কতৃর্ক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّداً رَسُولُ اللَّهِ صَادِقاً مِنْ قَلْبِهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করবে এমতাবস্থায় সততার সাথে হৃদয় থেকে (ইখলাছের সাথে) সাক্ষ্য দিবে আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই এবং নিশ্চয় মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল— সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[7] অপর বর্ণনায় রয়েছে- উছমান রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘যে ব্যক্তি জেনে বুঝে এই বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুবরণ করবে যে, ‘আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই, সে ব্যক্তি অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[8]
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رضي الله أَنَّهُ قَالَ قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ مَنْ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِكَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ.
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হলো, কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে আপনার শাফাআত পেয়ে কে সবচেয়ে বেশি ধন্য হবে? উত্তরে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কিয়ামতের দিন মানুষের মাঝে ঐ ব্যক্তি আমার শাফাআত পেয়ে বেশি ধন্য হবে, যে একনিষ্ঠচিত্তে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে।[9]
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنِّى رَسُولُ اللَّهِ لاَ يَلْقَى اللَّهَ بِهِمَا عَبْدٌ غَيْرَ شَاكٍّ فِيهِمَا إِلاَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল। যে এ বিষয় দুটির প্রতি নিঃসন্দেহে বিশ্বাস রেখে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[10] অপর বর্ণনায় রয়েছে, فَلايُحْجَبَ عَنِ الْجَنَّةِ ‘সে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হবে না’।[11] অন্যে আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,يَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ مُسْتَيْقِنًا بِهَا قَلْبُهُ فَبَشِّرْهُ بِالْجَنَّةِ ‘যে ব্যক্তি সত্য দৃঢ় মনে বিশুদ্ধ আক্বীদার সাথে এ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই। তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও’।[12]
বিশুদ্ধ ঈমানের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। যে ব্যক্তি অন্তর থেকে لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ বলবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কারো জীবনের সর্বশেষ স্বীকৃতি যদি উক্ত বাক্যটি হয়, তাহলেও সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। নবী-রাসূলগণের মৌলিক দাওয়াতই এটি।
রিয়া থেকে বাঁচার উপায় :
রিয়া এবং সুমআ তথা লোক দেখানো আমল থেকে পরিত্রাণের জন্য কতিপয় উপায় তুলে ধরা হলো। যেমন—
(১) ইবাদতের সময় আল্লাহকে গভীরভাবে স্মরণ করা। কায়মনোবাক্যে গভীরভাবে ইবাদাতে মনোনিবেশ করা। এটা চিন্তা করা যে, আল্লাহ আমার মনের খবর জানেন। আমি কেন করছি, কী করছি সবই তিনি দেখছেন। যেমন হাদীছে এসেছে, أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করো যেন তুমি তাঁকে দেখছ। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে তিনি তোমাকে দেখছেন’।[13]
(২) রিয়ার ভয়াবহতার কথা স্মরণ করা। প্রদর্শন আল্লাহর ক্রোধের কারণ, তা সবসময় মনে রাখা। কেননা রিয়া শিরক, যার পরিণতি জাহান্নাম।[14]
(৩) রিয়ামুক্ত আমলের পুরস্কারের কথা স্মরণ করা এবং তা অর্জনের প্রত্যয় গ্রহণ করা। কেননা আল্লাহর জন্য নিবেদিত আমলের প্রতিদান জান্নাত।[15]
(৪) সকল প্রকার অহংকার বর্জন করা। কেননা অহংকার হতেই রিয়া জন্মলাভ করে থাকে। আর অহংকারীর শেষ ঠিকানা জাহান্নাম।[16]
(৫) আল্লাহর নিকট অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়া। যেন তিনি অনুগ্রহ করে আমলটি কবুল করে নেন। তাঁর নিকট ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করেন।[17]
(৬) রিয়ামুক্ত আমলের তাওফীক্ব চেয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।[18]
‘আমি অনেকের মুখে নীতির কথা শুনেছি, কিন্তু তার মধ্যে নীতির লেশমাত্র দেখিনি। অনেককে অহংকারের সমালোচনা করতে শুনেছি, কিন্তু অহংকারের ডিপো হিসাবে তাকেই পেয়েছি। অনেককে আমিত্বের বদনাম করতে শুনেছি, কিন্তু তাকেই দেখেছি তিনিই আমিত্বের ফাউন্ডেশন। অনেকের মুখে তাক্বওয়ার বয়ান শুনেছি, কিন্তু তাকেই পেয়েছি তাক্বওয়াশূন্য। অনেকের মুখে সদাচরণের উপদেশ শুনেছি, কিন্তু তার মধ্যেই বদমেযাজের গন্ধ পেয়েছি। অনেকের মুখে কোমল স্বভাবের গল্প শুনেছি, কিন্তু তার মুখেই শুনেছি কর্কশের ঝনঝনানি’। -তাঈস
দান করে অনুগ্রহ (খোঁটাদানকরীর) প্রকাশকারীর পরিণতি :
দান করা ও কারো উপকার করার পর খোঁটা দেওয়া বা অনুগ্রহ প্রকাশ করা নিন্দনীয় স্বভাব। বিপদে কোনো ব্যক্তিকে সাহায্য করে অন্য সময়ে তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে খোঁটা দেওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। বিপদে সাহায্য করা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ আমল। কিন্তু এরূপ করে তাকে অন্য সময় লজ্জা দেওয়া যাবে না। অন্যথা তার দানে রিয়া (লোক দেখানো আমল) হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে তার সবকিছুই বিফলে যাবে। সেজন্য কাউকে খোঁটা দেওয়া বা দান করার পর অনুগ্রহ প্রকাশ করা যাবে না। এমর্মে এরশাদ হচ্ছে,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى كَالَّذِي يُنفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلاَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَأَصَابَهُ وَابِلٌ فَتَرَكَهُ صَلْدًا لاَ يَقْدِرُونَ عَلَى شَيْءٍ مِمَّا كَسَبُوا وَاللهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-খয়রাত বরবাদ করো না সেই ব্যক্তির মতো যে নিজের ধনসম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে দান করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত এমন এক মসৃণ পাথরের মতো, যার উপর কিছু মাটি পড়েছিল। তারপর ঐ পাথরের উপর প্রবল বৃষ্টি হলো এবং তাকে পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল। তারা ঐ বস্তুর কোনো নেকী পায় না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে সঠিক পথ দেখান না’ (আল-বাক্বারা, ২/২৬৪)।
খোঁটাদানকারীর কোনো আমল কবুল হয় না :
উপকার করে খোঁটাদানকারীর ফরয ও নফল কোনো আমল গ্রহণ করা হয় না। আবূ উমামা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,ثلاثةٌ لا يَقْبَلُ الله مِنْهُمْ يَوْمَ القِيامَةِ صَرْفاً ولا عَدْلاً عاقٌّ وَمَنَّانٌ ومُكَذِّبٌ بالقَدَرِ ‘কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির ফরয ও নফল কোনো আমল কবুল হবে না। তারা হলো— পিতা-মাতার অবাধ্য, উপকার করে খোঁটাদানকারী ও তাক্বদীরের প্রতি অবিশ্বাসকারী’।[19]
বিপদে কাউকে সহযোগিতা করে সেই অনুগ্রহের প্রকাশ করলে তা কঠিন পাপে পরিণত হয়। পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, খোঁটাদানকারী ও ভাগ্যে অবিশ্বাসকারীর ফরয ও নফল কোনো ইবাদত কবুল হয় না। কিয়ামতে তার আমল কোনো কাজে আসবে না। রিয়া বা লোক দেখানোর পাপে জাড়িয়ে যাওয়ার কারণে তা শিরকে রূপান্তরিত হয়। তার খোঁটা দিয়ে কাউকে লজ্জিত করা উচিত নয়।
খোঁটাদানকারীর সাথে আল্লাহ কথা বলবেন না :
খোঁটা দেওয়া অত্যন্ত জঘন্য স্বভাব। এরূপ ব্যক্তির পরিণত খুব ভয়াবহ। আবূ যার রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,ثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلاَ يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ الْمَنَّانُ بِمَا أَعْطَى وَالْمُسْبِلُ إِزَارَهُ وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ ‘তিন ব্যক্তির সাথে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না। তাদের দিকে তাকাবেন না। আর তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তারা হলো— দানকৃত বস্তুর খোঁটাদানকারী, পায়ের গিরার নিচে কাপড় পরিধানকারী এবং মিথ্যা কসম করে মাল বিক্রয়কারী’।[20]
দান করার পর অনুগ্রহ প্রকাশকারীর সাথে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা কথা বলবেন না। রহমতের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাবেন না। তাকে পবিত্র করবেন না। পরকালে তার জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা। তাই এমন নোংরা কর্ম পরিহার করা জরুরী।
খোঁটাদানকারী জান্নাতে যাবে না :
খোঁটাদানকারী ব্যক্তির পরিণাম অত্যন্ত ভয়ংকর। শেষ দিবসে তাকে ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। এরূপ ব্যক্তি জান্নাতে যাওয়ার সুযোগ পাবে না। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنَّانٌ وَلاَ عَاقٌّ وَلاَ مُدْمِنُ خَمْرٍ ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, জুয়া ও লটারীতে অংশগ্রহণকারী, খোঁটাদানকারী এবং সর্বদা মদপানকারী জান্নাতে যাবে না’।[21] অপর বর্ণনায় রয়েছে— সালেম ইবনু আব্দুল্লাহ রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,ثَلاَثَةٌ لاَ يَنْظُرُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْعَاقُّ لِوَالِدَيْهِ وَالْمَرْأَةُ الْمُتَرَجِّلَةُ وَالدَّيُّوثُ وَثَلاَثَةٌ لاَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ الْعَاقُّ لِوَالِدَيْهِ وَالْمُدْمِنُ عَلَى الْخَمْرِ وَالْمَنَّانُ بِمَا أَعْطَى ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তিন শ্রেণির ব্যক্তির দিকে দৃষ্টি দিবেন না। তারা হলো— পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী ও দায়্যূছ (নিজ স্ত্রীর পাপাচারে যে ঘৃণাবোধ করে না)। আর তিন শ্রেণির ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তারা হলো— পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, নেশাদার দ্রব্য সেবনকারী ও উপকার করে খোঁটাদানকারী (দান করার পর অনুগ্রহ প্রকাশকারী)’।[22]
দান করে খোঁটা দেওয়ার নোংরা স্বভাবের লোক সমাজে অনেক দেখা যায়। যারা কথায় কথায় তার সহযোগিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চায়। সে বড় দাতা হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। অনেক সময় গ্রহীতার নিকট থেকে বিভিন্ন সুবিধা ভোগের ফন্দি আঁটতে থাকে। এরূপ গর্হিত কাজ ইসলামের দৃষ্টি বৈধ নয়। এর মাধ্যমে গ্রহীতাকে হেয় করা হয়। সামাজিকভাবে তাকে লজ্জার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। মানসিকভাবে তাকে কষ্ট দেওয়া হয়। অথচ কোনো মানুষকে কষ্ট দেওয়া বা তার সম্মানের হানি করা শরীআতে নিষিদ্ধ। প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মমর্যাদা রয়েছে। তাকে সম্মান নিয়ে জীবনযাপনের সুযোগ দেওয়া প্রতিটি মুসলিমের নৈতিক দায়িত্ব। এ সম্মানটুকু হরণ করা নেহায়েত অন্যায়। খোঁটাদানকারী ব্যক্তি তার আত্মমর্যাদার হানি করে থাকে, যা খুবই খারাপ কাজের মধ্যে গণ্য। তাই এরূপ জঘন্য কাজ বর্জন করে আল্লাহর নিকট তওবা করা উচিত।
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. নাসাঈ, হা/৩১৪০; ত্বাবারানী কাবীর, হা/৭৬২৮; কানযুল উম্মাল, হা/৫২৬১; আল-মুসনাদুল জামে‘, হা/৫৩৩৪; সিলসিলা ছহীহা, হা/৫২, সনদ ছহীহ।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৭০৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৮১৪; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩৯৪; মিশকাত, হা/৫৩১৪।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬; মিশকাত, হা/১৪।
[4]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৩৭২; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হা/৩৯১৯; কানযুল উম্মাল, হা/৪৩৩৭৬; আল-মুসনাদুল জামে‘, হা/৩২৬২, সনদ ছহীহ।
[5]. তিরমিযী, হা/২৪১৪; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/২৭৭; সিলসিলা ছহীহা, হা/২৩১১; মিশকাত, হা/৫১৩০, সনদ ছহীহ।
[6]. আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম (দারু তাইয়েবা, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০৩।
[7]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২০৫৬; শুআবুল ঈমান, হা/৭; মুসনাদে আবী ইয়া‘লা, হা/৩২২৮; সিলসিলা ছহীহা, হা/২২৭৮, সনদ ছহীহ।
[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৪৯৮; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/২০১; ত্বাবারানী আওসাত্ব, হা/১৬৬৩; মিশকাত, হা/৩৭।
[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৮৪৫; মুসতাদরাকে হাকেম, হা/২৩৩; মুসনাদে বাযযার, হা/৮৪৬৯; ছহীহ আত-তারগীব, হা/১৫২০।
[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭, ১৪৭; মুসনাদে আবূ আওয়ানা, হা/১৬; আল-মুসনাদুল জামে‘, হা/১৪৭৪৮; ছহীহুল জামে‘, হা/১০০৯।
[11]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৮; মিশকাত, হা/৫৯১২।
[12]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩১, ১৫৬; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৫৪৩; মুসনাদে আবূ আওয়ানা, হা/১৭; আল-মুসনাদুল জামে‘, হা/১২৬৩০; মিশকাত, হা/৩৯।
[13]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০; ছহীহ মুসলিম, হা/১০২; আবূ দাঊদ, হা/৪৬৯৫; নাসাঈ, হা/৪৯৯০; আহমাদ, হা/৩৬৭; মিশকাত, হা/২।
[14]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৩২; ছহীহ মুসলিম, হা/১৯০৫; নাসাঈ, হা/৩১৩৭; আহমাদ, হা/৮২৬০; শুআবুল ঈমান, হা/৬৮০৫; মিশকাত, হা/২০৫।
[15]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৪৯৬; ছহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/২২৫৭; মিশকাত, হা/১৪।
[16]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৬; আবূ দাঊদ, হা/৪০৯১; তিরমিযী, হা/১৯৯৮; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৭৩; আহমাদ, হা/৪৩১০; মিশকাত, হা/৫১০৭।
[17]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৮৭, ৭০০৯; ইবনু মাজাহ, হা/৩৮২১; বায়হাক্বী শুআবুল ঈমান, হা/৭০৪৭; মিশকাত, হা/২২৬৫।
[18]. আদাবুল মুফরাদ, হা/৭১৬; ছহীহুল জামে‘, হা/৩৭৩১, সনদ ছহীহ।
[19]. ত্বাবারানী কাবীর, হা/৭৫৪৭; কানযুল উম্মাল, হা/৪৩৮১২; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২৫১৩; সিলসিলা ছহীহা, হা/১৭৫৮, সনদ হাসান।
[20]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৬ ও ৩০৭; নাসাঈ, হা/৫৩৩৩; ইবনু মাজাহ, হা/২২০৮; বায়হাক্বী কুবরা, হ/৭৬৩০, সনদ ছহীহ।
[21]. নাসাঈ, হা/৫৬৭২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১২৩৮; দারেমী, হা/২০৯৪; সিলাসলা ছহীহা, হা/৬৭৩; মিশকাত, হা/৪৯৩৩, সনদ হাসান।
[22]. নাসাঈ, হা/২৫৬২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬১৮০; ত্বাবারানী আওসাত্ব, হা/২৪৪৩; সিলসিলা ছহীহা, হা/৬৭৪, সনদ হাসান।