কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

পহেলা বৈশাখ : ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

post title will place here

আলোয় ভূবন জাগলো যখন

নতুন বছর সুস্বাগতম৷

নীড়ের পাখি, উঠলো ডাকি

পাখপাখালির ডাক।

বছর বাদে আসলো ফিরে—

পয়লা এ বৈশাখ।

পহেলা বৈশাখ বা পয়লা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ বা رأس السنة البنغالية বা New Year’s day বা বর্ষবরণ বা نيروز এই শব্দগুলো নতুন বছরের আগমন এবং এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসব-অনুষ্ঠানাদিকে ইঙ্গিত করে। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশে জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সার্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত।[1] এতদুপলক্ষ্যে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, হাসিঠাট্টা ও আনন্দ-উল্লাস, সাজগোজ করে নারীদের অবাধ বিচরণ ও সৌন্দর্যের প্রদর্শনী, রাতে অভিজাত এলাকার ক্লাব ইত্যাদিতে মদ্যপান তথা নাচানাচি, পটকা ফুটানো, শাখা-সিঁদুরের রঙে (সাদা ও লাল) পোশাক পরিধান, বিয়ের মিথ্যা সাজে দম্পত্তি সাজিয়ে বর-কনের শোভাযাত্রা, মূর্তির (কুমির, প্যাঁচা, বাঘ ইত্যাদির মুখোশ) প্রদর্শনী, উল্কি আঁকা, মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করছে। নববর্ষ উদযাপনে তাদের আনন্দ-ফূর্তি ক্রমেই যেন সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। বাংলা নববর্ষের নামে পৌত্তলিকতার প্রচার-প্রসার করা হচ্ছে, আর বলা হচ্ছে এটাই নাকি বাংলার সংস্কৃতি! আজ থেকে ৩৫ বছর আগে তা এমন ছিল না। যদি এটা বাংলা সংস্কৃতি হয়, তাহলে ৩৫ বছর আগে কেন ছিল না?

আসল কথা হলো, মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনো কালেই বাংলাদেশের বা বাঙালির ঐতিহ্য ছিল না। বরং এটা ছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক কৌশলের অংশ মাত্র। যাকে সংস্কৃতির লেবাস পরিয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ঢাকায় প্রথম চালু করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা পুরোটাই হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষঙ্গ। কেননা হিন্দু ধর্ম মতে, অসুরকে দমন করে দেবী দুর্গা। আর মঙ্গল শোভাযাত্রায় অসুর থেকে মঙ্গল কামনা করা হয়। তাদের মতে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছে অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে। তাই হিন্দুরা অশুভ তাড়াতে শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনে তথা জন্মাষ্টমীতে প্রতি বছর সারা দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। পশ্চিমবঙ্গের বরোদা আর্ট ইন্সটিটিউটের ছাত্র তরুণ ঘোষ ১৯৮৯ সালে এদেশে চারুকলা ইন্সটিটিউটের কাঁধে ভর করে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের উপর এটা চাপিয়ে দেয়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বা পরবর্তী সময়ে চারুকলা থেকে বের হওয়া ছাড়া এর অন্য কোনো উদাহরণ নেই। এখনও ধর্মনিরপেক্ষ ও কিছু গা ভাসানো লোক এবং মিডিয়া ও পত্রিকার পৃষ্ঠা ছাড়া দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এর জন্য তেমন কোনো আবেগ নেই। আর আবেগ হলেই সেটা ইসলামে গ্রহণযোগ্য হবে, এমনটি নয়। বরং ইসলাম বৈরীদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াসমূহের বদৌলতে হিন্দুদের বহুবিধ পূজা এখন এদেশে বাঙালি সংস্কৃতি বলে চালানো হচ্ছে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান সেসবেরই অন্যতম। হিন্দু পুরাণে বর্ণিত দেব-দেবীদের বিভিন্ন বাহনের মূর্তিসমূহ নিয়ে এই শোভাযাত্রা হয়ে থাকে। যেমন গণেশের বাহন ইঁদুর, কার্তিকের বাহন ময়ূর, সরস্বতীর বাহন হাঁস, লক্ষ্মীর বাহন বা মঙ্গলের প্রতীক হলো প্যাঁচা, বিষ্ণুর বাহন ঈগল, দুর্গার বাহন সিংহ-বাঘ, মৃত্যুদেবীর বাহন মহিষ, শিবের বাহন খ্যাপা ষাঁড় ইত্যাদি সবই হিন্দুদের বিভিন্ন বিশ্বাসেরই উপাত্ত। হিন্দুধর্মের প্রধান সৌর দেবতা হলো সূর্য। শোভাযাত্রায় বহনকৃত সকল মুখোশ ও মূর্তিই হিন্দুধর্মের বিভিন্ন বিশ্বাসের প্রতীক।

পক্ষান্তরে ইসলামে ছবি-মূর্তি হারাম। এছাড়া প্রাচীনকালের ন্যায় শয়তানের উপাসনা কল্পনা করে রাক্ষস-খোক্কসের মুখোশ পরিধান করে সেগুলোকে খুশী করা হয়, যাতে শয়তান কোনো অমঙ্গল না ঘটায়। এই শোভাযাত্রায় এভাবে নতুন বছরে মঙ্গল কামনা করা হয়। সুতরাং এই পৌত্তলিক শোভাযাত্রা নিঃসন্দেহে মুসলিমদের ঈমান-আক্বীদার বিরোধী, অসামঞ্জস্যপূর্ণ; কুফর ও শিরকে পরিপূর্ণ। বৈশাখ বরণের নামে এসব অনুষ্ঠান কখনো মুসলিম সংস্কৃতির অংশ নয়; হতে পারে না। বর্ষবরণের এই অপসংস্কৃতির থাবায় পড়ে কত তরুণ-তরুণী যে জীবনের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। কত মায়ের সন্তান যে মুশরিকত্ব বরণের উৎসবে আটকা পড়েছে। ধর্মহীনতার চোরাবালিতে তারা তলিয়ে যাচ্ছে। তা একটু ভেবে দেখা দরকার। কেননা মুসলিমরা একমাত্র আল্লাহর কাছেই মঙ্গল কামনা করেন ও তাঁর কাছেই প্রার্থনা করেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾ ‘আর যদি আল্লাহ তোমাকে কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী আর কেউ নেই। পক্ষান্তরে যদি তোমার কল্যাণ করেন। তবে তিনি তো সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান’ (আল-আনআম, ৬/১৭)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর হাতেই সকল ক্ষমতা, আল্লাহই রাত ও দিন পরিবর্তন করেন’।[2] এর বিপরীত হলো শিরক। যার পাপ আল্লাহ কখনো ক্ষমা করেন না। অথচ একদল বোকা মানুষ তথাকথিত একদল মূর্খের দল মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে আল্লাহর সাথে শিরকে লিপ্ত হচ্ছে এবং অন্যকে শিরক করাচ্ছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ﴾ ‘নিশ্চয়ই যে কেউই আল্লাহর অংশীদার স্থির করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন, আর তার বাসস্থান হবে অগ্নি এবং যালেমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই’ (আল-মায়েদা, ৫/৭২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,﴿لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾ ‘যদি তুমি আল্লাহর সাথে শরীক করতে, তাহলে অবশ্যই তোমার আমল নিষ্ফল হয়ে যেত এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হতে’ (আয-যুমার, ৩৯/৬৫)

তাছাড়াও আমাদের এ জীবন নিছক আনন্দ-উল্লাস কিংবা ভোগবিলাসে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। এ জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে এবং একদিন তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব দিতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ﴾ ‘জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে’ (আয-যারিয়াত, ৫১/৫৬)। আর উৎসব সাধারণত একটি জাতির ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত হয়। উৎসবের উপলক্ষ্যগুলো

 খোঁজ করলে পাওয়া যাবে উৎসব পালনকারী জাতির নিজ ধর্মীয় অনুভূতি, সংস্কার ও ধ্যানধারণার ছোঁয়া। যেমন, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন তাদের বিশ্বাস মতে স্রষ্টার পুত্রের জন্মদিন। মধ্যযুগে ইউরোপীয় দেশগুলোতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালিত হতো ২৫শে মার্চ এবং তা পালনের উপলক্ষ্য ছিল এই যে, ঐ দিন খ্রিষ্টীয় মতবাদ অনুযায়ী মাতা মেরীর নিকট ঐশী বাণী প্রেরিত হয় এই মর্মে যে, মেরী ঈশ্বরের পুত্রের জন্ম দিতে যাচ্ছেন। পরবর্তীতে ১৫৮২ সালে গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের সূচনার পর রোমক ক্যাথলিক দেশগুলো পয়লা জানুয়ারি নববর্ষ উদযাপন করা আরম্ভ করে। ঐতিহ্যগতভাবে এই দিনটি একটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবেই পালিত হতো। ইয়াহূদীদের নববর্ষ ‘রোশ হাশানাহ’ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ইয়াহূদীদের ধর্মীয় পবিত্র দিন সাবাত হিসেবে পালিত হয়। এমনিভাবে প্রায় সকল জাতির উৎসব-উপলক্ষ্যের মাঝেই ধর্মীয় চিন্তাধারা খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এজন্যই ইসলামে নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিষ্কারভাবে মুসলিমদের উৎসবকে নির্ধারণ করেছেন। ফলে অন্যদের উৎসব মুসলিমদের সংস্কৃতিতে প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। নববর্ষ আরবী হোক, বা বাংলা হোক, বা ইংরেজি, তা পালন করা বৈধ নয়। এ ব্যাপারে কয়েকজন যুগশ্রেষ্ঠ বিদ্বানের বক্তব্য নিম্নরূপ—

১. ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, مَنْ مَرَّ بِبِلَادِ الْأَعَاجِمِ فَصَنَعَ نَيْرُوزَهُمْ وَمَهْرَجَانَهُمْ وَتَشَبَّهَ بِهِمْ حَتَّى يَمُوتَ وَهُوَ كَذَلِكَ حُشِرَ مَعَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যে ব্যক্তি (অগ্নিপূজক) পারসিকদের দেশে গমন করে, অতঃপর তাদের নওরোজ (নববর্ষ) ও মেহেরজান (উৎসবের দিবস) পালন করে, আর তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং এ অবস্থাতেই মারা যায়, তাহলে ক্বিয়ামতের দিন তার হাশর তাদের সাথেই হবে’।[3]

২. সঊদী আরবের ইলমী গবেষণা ও ফতওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটি (সঊদী ফতওয়া বোর্ড) প্রদত্ত ফতওয়ায় বলা হয়েছে, لا تجوز التهنئة بالسنة الهجرية الجديدة، لأن الاحتفاء بها غير مشروع ‘হিজরী নববর্ষ উপলক্ষ্যে মুবারকবাদ জানানো জায়েয নয়। কেননা নববর্ষকে অভ্যর্থনা জানানো শরীআতসম্মত নয়’।[4]

৩. ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছায়মীন রহিমাহুল্লাহ বলেছেন,ليس من السنة أن نحدث عيدا لدخول السنة الهجرية أو نعتاد التهاني ببلوغه ‘হিজরী নববর্ষের আগমন উপলক্ষ্যে উৎসব করা কিংবা নববর্ষের দিবস উপলক্ষ্যে পরস্পরকে সম্ভাষণ জানানোর রীতি চালু করা সুন্নাহবহির্ভূত কর্ম’।[5]

ইসলামী শরীআত মুসলিমদের জন্য স্রেফ দুটি ঈদ (উৎসব) নির্ধারণ করেছে। তাই এই দুই উৎসব ব্যতীত অন্য কোনো উৎসব পালন করা মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় পৌঁছে দেখতে পান যে, সেখানকার অধিবাসীরা দুইটি দিন (নওরোজ ও মেহেরজান) খেলাধুলা ও আনন্দ-উৎসব করে থাকে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, এই দুটি দিন কীসের? তারা বলে, জাহেলী যুগে আমরা এই দুই দিন খেলাধুলা ও উৎসব করতাম। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে এই দুই দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি উত্তম দিন দান করেছেন। আর তা হলো, ঈদুল আযহা (কুরবানীর ঈদ) এবং ঈদুল ফিত্বর (রামাযানের ঈদ)’।[6]

আল্লাহ তাআলা মুসলিমদেরকে দুটি দিবস নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যে দুটি দিবসে তারা উৎসব পালন করবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বলতে পারতেন যে, তোমাদের দুই দিন থাক। সাথে এই দুই দিনকে গ্রহণ করো। কিন্তু তিনি তা বলেননি। কারণ ইসলাম এসেছে জাহেলিয়াতকে অপসৃত করতে। ইসলাম চায় জাহেলিয়াতের অপনোদন। ইসলাম আর জাহেলিয়াত কখনো এক হতে পারে না। এই হাদীছ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল যে, মুসলিমদের জীবনে এই দুটি দিবস ছাড়া অন্য কোনো দিবস থাকতে পারে না। সুতরাং নববর্ষ পালন করা ইসলামী শরীআতের দৃষ্টিতে অবৈধ।[7]

নতুন বছর নতুন কল্যাণ বয়ে আনে, দূরীভূত হয় পুরোনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানি– এধরনের কোনো তত্ত্ব ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়, বরং নতুন বছরের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ধারণা আদিযুগের প্রকৃতিপূজারি মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যানধারণার অবশিষ্টাংশ। ইসলামে এ ধরনের কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। বরং মুসলিমের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই পরম মূল্যবান হীরকখণ্ড, হয় সে এই মুহূর্তকে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করে আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয় করবে, নতুবা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে শাস্তির যোগ্য হয়ে উঠবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বছরের প্রথম দিনের কোনো বিশেষ তাৎপর্য নেই। আর তাই তো ইসলামে হিজরী নববর্ষ পালনের কোনো প্রকার নির্দেশ দেওয়া হয়নি। না কুরআনে এর কোনো নির্দেশ এসেছে, না হাদীছে এর প্রতি কোনো উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, না ছাহাবীগণ এরূপ কোনো উপলক্ষ্য পালন করেছেন। এমনকি পয়লা মুহাররমকে নববর্ষের সূচনা হিসেবে গণনা করা শুরুই হয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর বহু পরে, উমার ইবনুল খাত্তাব রযিয়াল্লাহু আনহু-এর আমলে। এ থেকে বোঝা যায় যে, নববর্ষ উদযাপন ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা তাৎপর্যহীন, এর সাথে জীবনে কল্যাণ-অকল্যাণের গতি প্রবাহের কোনো দূরতম সম্পর্কও নেই, আর সেক্ষেত্রে ইংরেজি বা অন্য কোনো নববর্ষের কিই-বা তাৎপর্য থাকতে পারে ইসলামে?

কেউ যদি এই ধারণা পোষণ করে যে, নববর্ষের প্রারম্ভের সাথে কল্যাণের কোনো সম্পর্ক রয়েছে, তবে সে শিরকে লিপ্ত হলো অর্থাৎ আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করল। যদি সে মনে করে যে আল্লাহ এই উপলক্ষ্যের দ্বারা মানবজীবনে কল্যাণ বর্ষণ করেন তবে সে ছোট শিরকে লিপ্ত হলো। আর কেউ যদি মনে করে যে নববর্ষের আগমনের এই ক্ষণটি নিজে থেকেই কোনো কল্যাণের অধিকারী, তবে সে বড় শিরকে লিপ্ত হলো, যা তাকে ইসলামের গণ্ডির বাইরে নিয়ে গেল। আর এই শিরক এমন অপরাধ যে, শিরকের উপর কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে চিরতরে হারাম করে দিবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। নববর্ষ উদযাপনের সাথে মঙ্গলময়তার এই ধারণার সম্পর্ক রয়েছে বলে কোনো কোনো সূত্রে দাবি করা হয়, যা কিনা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। মুসলিমদেরকে এ ধরনের কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে ইসলামের যে মূলতত্ত্ব, সেই তাওহীদ বা একত্বের উপর পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। ইসলাম ধর্ম ব্যতীত বর্তমান যুগে যত ধর্ম আছে, সব বাতিল ধর্ম। এগুলো আল্লাহর নিকটবর্তী করে না বরং আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِى أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِىٌّ وَلاَ نَصْرَانِىٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ ‘সে সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! ইয়াহূদী হোক আর খ্রিষ্টান হোক, যে ব্যক্তিই আমার এ রিসালাতের খবর শুনেছে অথচ আমার রিসালাতের উপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করবে, সে অবশ্যই জাহান্নামী হবে’।[8]

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁর উম্মাহর একটি দল আল্লাহর শত্রু ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানের অনুসরণ করবে। যেমন আবূ সাঈদ খুদরী রযিয়াল্লাহু আনহু নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন,لَتَتْبَعُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ شِبْرًا شِبْرًا وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ دَخَلُوا جُحْرَ ضَبٍّ تَبِعْتُمُوهُمْ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى قَالَ فَمَنْ ‘অবশ্যই অবশ্যই তোমরা তোমাদের আগের লোকদের রীতিনীতি বিঘতে বিঘতে, হাতে হাতে অনুকরণ করবে। এমনকি তারা যদি সাপের গর্তে ঢুকে, তাহলে তোমরাও তাদের অনুকরণ করবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এরা কি ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টান? তিনি বললেন, তবে আর কারা?’[9]

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, বর্তমানে নববর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে মুসলিম যুবক-যুবতিরা হিন্দু/খ্রিষ্টানদের অনুসরণ করছে। এমনকি তথাকথিত সুশীল সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠরাও এ থেকে পিছিয়ে নেই। ওয়াল্লাহুল মুস্তাআন।

প্রতিটি পরিবারের প্রধানের এ বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত যে, তার পুত্র, কন্যা, স্ত্রী কিংবা অধীনস্থ অন্য কেউ যেন নববর্ষের কোনো অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সহপাঠী, সহকর্মী ও পরিবারের মানুষকে উপদেশ দেবেন এবং নববর্ষ পালনের সাথে কোনোভাবে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবেন। আপনার সচেতনতার অভাবে যদি আপনার সন্তান নষ্ট হয়, তবে আপনি ব্যর্থ অভিভাবক। জেনে রাখুন! রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[10]

প্রিয় তরুণ-তরুণী ভাই-বোন! নিজেকে অবমূল্যায়ন করবেন না। আপনার মতো যুবকের হাতে ইসলাম শক্তিশালী হয়েছে। আপনার মতো তরুণীরা কত পুরুষকে দ্বীনের পথে অবিচল থাকতে সাহস জুগিয়েছে। আপনার বয়সে মুছ‘আব ইবনু উমাইর রযিয়াল্লাহু আনহু গিয়েছেন উহুদ যুদ্ধে শহীদ হতে। সুতরাং আসুন! সেদিন আসার আগেই আমরা সচেতন হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক্ব দান করুন এবং কল্যাণ ও শান্তি বর্ষিত হোক নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর, তাঁর পরিবার ও ছাহাবীগণের উপর। আল্লাহর বাণী,﴿وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ﴾ ‘আর তোমরা তোমাদের রবের ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও, যার পরিধি আসমান ও জমিনব্যাপী, যা প্রস্তুত করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য’ (আলে ইমরান, ৩/১৩৩)। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!

আবূ লাবীবা মুহাম্মাদ মাকছুদ

শিক্ষক, মাদরাসা ইশাআতুল ইসলাম আস-সালাফিয়্যাহ, রাণীবাজার, রাজশাহী।


[1]. সমবারু চন্দ্র মহন্ত (২০১২)। ‘পহেলা বৈশাখ’। বাংলাপিডিয়া : বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ : বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৮২৬।

[3]. বায়হাক্বী, ৯/২৩৪, গৃহীত : ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম রহিমাহুল্লাহ, আহকামু আহলিয যিম্মাহ, পৃ. ১২৪৮; ইমাম ইবনু তায়মিয়্যা ও ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম রহিমাহুমাল্লাহ হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।

[4]. ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা, ফতওয়া নং ২০৭৯৫, গৃহীত : sahab.net.

[5]. আয-যিয়াউল লামি, পৃ. ৭০২, গৃহীত : sahab.net.

[6]. আবূ দাঊদ, হা/১১৩৪, সনদ ছহীহ।

[7]. ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু আলী ইবনু আদম আল-আসয়ূবী t, শারহু সুনানিন নাসাঈ (যাখীরাতুল উক্ববা ফী শারহিল মুজতাবা), [দারু আলি বারূম, ১ম প্রকাশ, মক্কা কর্তৃক প্রকাশিত : ১৪২৩ হি./২০০৩ খ্রি.], ১৭/১৫৩-১৫৪।

[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪০৩।

[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩২০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৬৯।

[10]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১৩৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৯; মিশকাত, হা/৩৬৮৫।

Magazine