কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ই‘তিকাফের গুরুত্ব ও ফযীলত

ই‘তিকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত ইবাদত। দাওয়াত, রাষ্ট্র পরিচালনা, যুদ্ধ-জিহাদসহ অনেক ব্যস্ততা সত্ত্বেও নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় থাকাকালীন সময়ে প্রতি বছর ই‘তিকাফ করতেন। ই‘তিকাফকারী ব্যক্তি ই‘তিকাফরত অবস্থায় জাগতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যস্ততা থেকে নিজেকে আলাদা করে ঐকান্তিকভাবে মাশগূল হয়ে পড়ে আল্লাহর ইবাদত ও নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায়। ই‘তিকাফ ঈমান-আমল বৃদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একটি মুখ্য সুযোগ। তাই সকলের উচিত এই মূল্যবান সুযোগ গ্রহণ করা।

ই‘তিকাফের পরিচয় :

ই‘তিকাফ একটি আরবী শব্দ। যার অর্থ হলো নিঃসঙ্গতা, এক স্থানে নিজেকে বন্দি করে রাখা ইত্যাদি। শারঈ পরিভাষায় ই‘তিকাফ হচ্ছে— আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের নিয়্যতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করা।

ই‘তিকাফের বিধান :

আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমাস সালাম-কে আদেশ করে বলেছিলেন, ‘আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ই‘তিকাফকারী ও রুকূ-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো’ (আল-বাক্বারা, ২/১২৫)। এই আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, ই‘তিকাফ আল্লাহ প্রদত্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান।

ই‘তিকাফ করা সুন্নাত।[1] ই‘তিকাফের সবচেয়ে উপযোগী সময় রামাযানের শেষ দশক। ই‘তিকাফ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। ইমাম আহমাদ রহিমাহুল্লাহ বলেন, কোনো মুসলিম ই‘তিকাফকে সুন্নাত বলে স্বীকার করেনি এমনটি আমার জানা নেই।

ই‘তিকাফের ফযীলত :

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ই‘তিকাফের ফযীলত সম্পর্কিত অনেক হাদীছ পাওয়া যায়। নিম্নে তার কিছু বিশুদ্ধ বর্ণনা পেশ করা হলো—

عَنْ عَائِشَةَ i زَوْجِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ .

আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন। মৃত্যুর পর তাঁর সহধর্মিণীগণও ই‘তিকাফ করতেন।[2] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত রামাযানের শেষ দশকে গুরুত্বসহকারে ই‘তিকাফ করাটাই প্রমাণ করে যে, ই‘তিকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।

আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রামাযানে ই‘তিকাফ করতেন’।[3] আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রামাযানের শেষ ১০ দিন ই‘তিকাফ করতেন। তবে যে বছরে ইন্তিকাল করেন সে বছর ২০ দিন ই‘তিকাফ করেছেন।[4] আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পত্নীগণ তাঁর সাথে মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন।[5]

ই‘তিকাফের উপকারিতা :

ই‘তিকাফ একটি উপকারী ইবাদত। ই‘তিকাফকারী এক ছালাতের পর অন্য ছালাতের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। আর এ অপেক্ষার অনেক উপকারিতা ও ফযীলত রয়েছে।

(১) ই‘তিকাফকারী ব্যক্তি এক ওয়াক্তের ছালাতের পর অপর ওয়াক্তের ছালাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যতক্ষণ পর্যন্ত ছালাতের পর উক্ত স্থানে বসে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতাগণ এ বলে তার জন্য দু‘আ করতে থাকে যে, হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও। হে আল্লাহ! তুমি তাকে রহমত দান করো। আর তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি ততক্ষণ ছালাতরত বলেই গণ্য হবে যতক্ষণ সে ছালাতের জন্য অপেক্ষমান থাকে’।[6]

(২) ই‘তিকাফকারী এর মাধ্যমে লায়লাতুল ক্বদর তালাশ করতে থাকে। আর তার জন্য ১০ রাত জাগরণের ফলে সে লায়লাতুল ক্বদরের মহান ফযীলত পেয়ে থাকেন।

(৩) ই‘তিকাফের ফলে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয় এবং আল্লাহর মানব জাতি সৃষ্টির উদ্দেশ্য ইবাদতের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। কেননা মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য’ (আয-যারিয়াত, ৫১/৫৬)

(৪) ই‘তিকাফের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে।

(৫) বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াতের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

(৬) ঐকান্তিকভাবে তওবা করার সুযোগ লাভ হয়।

(৭) তাহাজ্জুদ ছালাতে অভ্যস্ত হওয়া যায়।

(৮) সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যায়।

এছাড়াও ই‘তিকাফের মাধ্যমে আল্লাহকে খুশি করার অনেক সুযোগ অর্জন হয়। আল্লাহকে বেশি বেশি ডাকা যায়। নির্জনে আল্লাহর কাছে চোখের পানি ফেলে অতীত জীবনের পাপরাশির জন্য ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ পাওয়া যায়। তওবার সুযোগ লাভ হয়। একনিষ্ঠচিত্তে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার ফলে আল্লাহ বান্দার সকল পাপ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আয-যুমার, ৩৯/৫৩)

ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য :

(১) আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা : সকল ব্যস্ততা দূর করে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য নিজেকে ব্যতিব্যস্ত করা। যার ফলে আল্লাহর সাথে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি হয়।

(২) পাশবিক প্রবণতা এবং অহেতুক কাজ থেকে দূরে থাকা : ছিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহ যেমন বান্দাকে অতিরিক্ত খাওয়া-পানাহার, যৌনাচারসহ প্রবৃত্তির সকল চাহিদা রক্ষা করেন, তদ্রূপ ই‘তিকাফের মাধ্যমে অন্যায়-অশ্লীল, অহেতুক কথা-বার্তা, মন্দ সংস্পর্শ ও অধিক ঘুম থেকে বাঁচিয়ে ইবাদতের সুযোগ তৈরি করে দেন।

(৩) লায়লাতুল ক্বদর তালাশ করা : রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘শেষ দশকে লায়লাতুল ক্বদর রয়েছে, তোমরা তা তালাশ করো। ই‘তিকাফকারী শেষ ১০ রাত্রি জাগরণ করার কারণে সহজেই লায়লাতুল ক্বদর পাওয়ার সুযোগ পান। আবূ সাঈদ খুদরী রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি প্রথম দশকে ই‘তিকাফ করেছি এই (ক্বদর) রজনী খোঁজ করার উদ্দেশ্যে। অতঃপর ই‘তিকাফ করেছি মাঝের দশকে, অতঃপর মাঝ দশক পেরিয়ে এলাম, তারপর আমাকে বলা হলো, (ক্বদর) তা শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ই‘তিকাফ করতে চায় সে যেন ই‘তিকাফ করে। অতঃপর লোকেরা তাঁর সাথে ই‘তিকাফ করলেন’।[7]

(৪) মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে তোলা : ই‘তিকাফকারীর মসজিদে যাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়। যা মুমিন জীবনের একটি বড় পাওয়া।

(৫) দুনিয়া ত্যাগ ও বিলাসিতা থেকে দূরে থাকা।

(৬) ইচ্ছাশক্তি প্রবল করা এবং প্রবৃত্তিকে খারাপ অভ্যাস ও কামনা-বাসনা থেকে বিরত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা।

ই‘তিকাফে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার সময় :

রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফের নিয়্যতকারী ব্যক্তি ২১তম রাত্রির সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করবে। কেননা তার উদ্দেশ্য ক্বদরের রাত তালাশ করা, যা আশা করা হয়ে থাকে বিজোড় রাতগুলোতে। যার মধ্যে ২১ এর রাতও রয়েছে।[8]

আর বের হওয়ার উত্তম সময় হচ্ছে— চাঁদ রাত্রিতে মসজিদে অবস্থান করে পরের দিন সকালে সরাসরি ঈদের মাঠে ঈদের ছালাত আদায় করে বাসায় যাওয়া। তবে শাওয়ালের চাঁদ দেখার পর চাইলে মসজিদ থেকে বের হয়ে বাসায় চলে যেতে পারে।

ই‘তিকাফের শর্তাবলি :

(১) ই‘তিকাফের নিয়্যত করা।[9]

(২) রামাযানের ই‘তিকাফের জন্য ছিয়াম থাকা আবশ্যক।[10]

(৩) জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি হওয়া। কেননা পাগলের কাজের কোনো উদ্দেশ্য থাকে না।[11]

(৪) মুসলিম হওয়া।[12]

(৬) ই‘তিকাফকারী নারী হলে হায়েয অবস্থা থেকে মুক্ত থাকা।[13]

(৭) ইস্তিহাযাগ্রস্ত নারী ই‘তিকাফ করতে পারে। তবে, হায়েযের রক্তজাতীয় কোনো নাপাকী যেন মসজিদকে স্পর্শ না করে তা লক্ষ রাখা।[14]

(৮) স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা (আল-বাক্বারা, ২/১৮৭)

(৯) ই‘তিকাফ মসজিদে হওয়া। বাড়িতে কিংবা অন্য স্থানে ই‘তিকাফ হবে না।[15]

ই‘তিকাফকারীর জন্য নিষিদ্ধ বিষয়াবলি :

ই‘তিকাফকারী পেশাব-পায়খানা, গোসল ও ওযূ ছাড়া অনর্থক কোনো কাজের জন্য মসজিদের বাহিরে গমন করতে পারবে না। তবে প্রয়োজনীয় কাজে স্বল্প সময়ের জন্য যেতে পারে।[16]

আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ই‘তিকাফকারীর জন্য সুন্নাত হলো— সে কোনো রোগী দেখতে যাবে না, জানাযায় অংশগ্রহণ করবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না, তার সাথে সহবাস করবে না এবং অধিক প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবে না, ছিয়াম না রেখে ই‘তিকাফ করবে না এবং জামে মসজিদ ছাড়া ই‘তিকাফ হবে না। ইমাম আবূ দাঊদ রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘উল্লেখিত বিষয়গুলোকে আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা সুন্নাত বলেছেন’।[17]

আব্দুল হামীদ বিন মুজিবুর রহমান

শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. আল-মাজমূ‘ লিন-নববী, ৬/৫০১।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২০২৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৭২; মিশকাত, হা/২০৯৭।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৪৪।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৪৪; আবূ দাঊদ, হা/২৪৬৬।

[5]. মুসনাদে আবী ইয়ালা, হা/৩০৭৪; মুশকিলুল আছার, হা/৪১০০।

[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৯৪।

[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬৭।

[8]. ছহীহ বুখারী, হা/২০২৫।

[9]. ছহীহ বুখারী, হা/১।

[10]. আবূ দাঊদ, হা/২৪৭৩; মিশকাত, হা/২১০৬।

[11]. আবূ দাঊদ, হা/৪৪০৩।

[12]. প্রাগুক্ত।

[13]. মুওয়াত্ত্বা, ১/৩১৬।

[14]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৩৭।

[15]. সূরা আল-বাক্বারা, ২/১৮৭; আবূ দাঊদ, হা/২৪৭৩।

[16]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৩৫।

[17]. আবূ দাঊদ, হা/২৪৭৩।

Magazine