কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

বর্তমান ওয়ায-মাহফিলের অবস্থা!

post title will place here

ভূমিকা: ওয়ায-মাহফিল মুসলিমদের আক্বীদা, ঈমান ও আমল শুদ্ধিকরণের এক আয়োজনের নাম। যেখানে পূর্ব নির্বাচিত আলোচকগণ ইসলামের নানা বিধিবিধানের উপর আলোচনা পেশ করেন এবং জনসাধারণ তা হতে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে স্বীয় আক্বীদা, ঈমান ও আমল পরিশুদ্ধ করেন। আয়োজকদের সুন্দর ব্যবস্থাপনা ও বক্তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনার মাধ্যমে এই মাহফিল হেদায়াতের মঞ্চে পরিণত হয়। ফলে আল্লাহর রহমতে যদি দুয়েকজন শ্রোতা দ্বীনের পথে ফিরে আসেন, তবেই একটি মাহফিল পূর্ণতা লাভ করে আর এটাই হলো ওয়ায-মাহফিলের মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম সমাজ উক্ত লক্ষ্য হতে অনেক দূরে ছিটকে গেছে। এত ওয়ায-মাহফিল হওয়া সত্ত্বেও সূদ-ঘুষ, খুনখারাবি, যেনা-ব্যভিচার, চুরি-ডাকাতি, বেপর্দা ইত্যাদি যাবতীয় পাপাচার ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

কয়েক দশক পূর্বে এত ওয়ায-মাহফিল হতো না, কিন্তু তারা অধিক আমলকারী কিংবা ইসলাম পালনকারী ছিলেন। বর্তমানে বছরে ৫২-৫৩টি খুৎবায়, জালসা-মাহফিলে কিংবা তাবলীগী সভায় ও মোবাইলে ওয়ায প্রচুর হচ্ছে। কিন্তু সবার মনে একটাই প্রশ্ন, এত ওয়ায শোনার পরও মানুষের মাঝে পরিবর্তন নেই কেন? আমল বৃদ্ধি নেই কেন?

মূল কথা হলো, একটি ওয়ায-মাহফিল সফল হতে আয়োজক, বক্তা, শ্রোতাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রায় উক্ত তিন শ্রেণিতেই যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে; ফলে মাহফিল ফলপ্রসূ হচ্ছে না। কেননা বর্তমানে প্রায় মাহফিলের চিত্র কিছুটা এমন যে, আয়োজকদের কিছু আশা, বক্তার পেশা, শ্রোতার নেশা, দোকানদারের ব্যবসা আর এসব নিয়েই জালসা।

সব মাহফিলে এরূপ না ঘটলেও প্রায় মাহফিলেই এমনটা সংঘটিত হয়। এই ত্রুটির কারণেই মাহফিলের উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ হচ্ছে না। নিম্নে তাদের ত্রুটিগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া হলো—

(১) মাহফিল কমিটির ত্রুটিসমূহ: আয়োজকদের সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই একটি মাহফিল সাফল্যমণ্ডিত হয়। তাই তাদের উচিত উপযুক্ত আলোচক শ্রোতাদের উপহার দেওয়া। কিন্তু কিছু মাহফিল কমিটি ভাইরাল বক্তা, গোমরাহ কিংবা ভাইরাল বক্তাদের কণ্ঠ নকলকারী বক্তা, শিশু বক্তা, প্রতিবন্ধী বক্তা, গায়ক বক্তা ইত্যাদি নির্বাচন করে লক্ষ টাকার বিনিময়ে তাদের দাওয়াত দিচ্ছে। যদিও তাদের কুরআন ও ছহীহ হাদীছের জ্ঞান কম থাকে কিংবা না থাকে। কেননা তাদের উদ্দেশ্য, যেন লক্ষ-কোটি মানুষের সমাগম হয়। এতেই মাহফিল কমিটির আনন্দ! মানুষ কী শিখবে, কী শিখল সেটা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। কারণ জনসমাগম যত বেশি হবে, তাদের কালেকশনও তত বেশি হবে। অন্যদিকে তারা যোগ্য ও অধিক উপযুক্ত আলেমদেরকে আলোচক হিসেবে নির্বাচন করে না। কারণ তারা ভাইরাল বক্তা নয়। উনাদের দাওয়াত করলে লোকজনের সমাগম হবে না। এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো অমুসলিম ইসলামের পক্ষে কিছু কথা বলে ভাইরাল হলে তাকে প্রধান আলোচক হিসেবে রাখে। তার থেকে শ্রোতাগণ কী ঈমান-আক্বীদা শুদ্ধ করবে! (লা হাউলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ)

কমিটির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো জালসাকে কেন্দ্র করে মেলা বন্ধ করতে না পারা। অপ্রিয় হলেও সত্য কথা এই যে, এদের ব্যর্থতার ফলেই বর্তমানের বেশির ভাগ জালসা যুবক-যুবতীদের অবৈধভাবে মেলামেশার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। অনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ ধর্ষণের মতো ঘটনার কথাও শুনতে পাওয়া যায়। এমনকি অনেক মাহফিল কমিটি দোকানদারদের কাছে চাঁদা কালেকশন করে। ফলে তারা কোনো দোকানদারকে কিছু বলতেও পারে না। এসব বিনোদন আর যেনা-ব্যভিচারকে প্রশ্রয় দিয়ে মাহফিলের আয়োজন করে লাভ কী?

আবার অনেক আলোচককে দেখা যায়, যারা কন্ট্রাক্ট করে জালসায় অংশগ্রহণ করে পক্ষান্তরে সে সমস্ত আলেম কন্ট্রাক্ট করে না, কমিটি তাকে পর্যাপ্ত রাস্তাখরচও দেয় না। এটা খুবই দুঃখজনক।

অনেক অঞ্চলেই দেখা যায়, কমিটি দুই-তিন দিনব্যাপী জালসার ব্যবস্থা করেন। এখানেও একটু কারণ খোঁজা উচিত যে, আসলে আমরা দুই-তিন দিনব্যাপী প্রোগ্রাম কেন করব? এতে জনসাধারণের উপকার কী হবে? আদৌ এর কোনো প্রয়োজন আছে কিনা?

কমিটির কাছে আমরা আকুল আবেদন করছি, বিভিন্ন কারণকে কেন্দ্র করে আর্থিক উন্নতির জালসা করুন, তবে যোগ্য ব্যক্তিদের আলোচক নির্বাচন করে জনগণকে সঠিক আক্বীদা-মানহাজ ও ঈমান-আমলের শুদ্ধিকরণের ব্যবস্থা করুন। আর্থিক উন্নতিই যেন মূল উদ্দেশ্য না হয়, বরং মানুষের ঈমান-আমলের উন্নতিই যেন থাকে মূল টার্গেট হয়। আর বন্ধ করুন এই জালসা-মাহফিলের নাম দিয়ে মেলার এই আয়োজন!

সাথে আলোচক আনুন ছহীহ মানহাজের। মাহফিলের প্যান্ডেল করতে তো লক্ষ টাকা খরচ করতে দ্বিধা করেন না, তাহলে যাকে দিয়ে দাওয়াতী কাজ করাচ্ছেন তার ব্যাপারে কেন একবারও চিন্তা করছেন না? ১০ টাকা বেশি খরচ হলেও ভালো দ্বীন জানা আলেম আনুন। আজকে আপনার আমার দরকষাকষির কারণে অনেক আলেম কন্ট্রাক্ট করে মাহফিলে আসতে বাধ্য হয়। তবে কন্ট্রাক্ট করা যাদের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, তাদের বিষয় ভিন্ন। আপনি কি মনে করেন যে, আলেম ও তার পরিবার গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে? কন্ট্রাক্টধারী বক্তার ক্ষেত্রে টাকার বান্ডিল দিতে পারেন আর হক্বপন্থি আলেমকে তার যোগ্য মর্যাদা দিতে পারেন না, এটা কেমন ইনছাফ! মনে রাখবেন, একটি প্রবাদ বাক্যে বলা হয়, যেই জায়গায় যোগ্য/শিক্ষিত ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করা হয় না, সেই জায়গায় যোগ্য/শিক্ষিত মানুষের জন্মও হয় না। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!

(২) বক্তাদের ত্রুটিসমূহ: আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রযিয়াল্লাহু আনহুম হতে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,بَلِّغُوُا عَنِّى وَلَو آيَةً، وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِى إِسْرَائِيْلَ وَلَا حَرَجَ، وَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ ‘আমার কথা পৌঁছে দাও, তা যদি এক আয়াতও হয়। আর বনী ইসরাঈলের ঘটনাবলি বর্ণনা করো, এতে কোনো দোষ নেই। তবে কেউ যদি ইচ্ছা করে আমার উপর মিথ্যারোপ করে, তাহলে সে যেন নিজের থাকার জায়গাটা জাহান্নামে করে নিল’।[1]

উক্ত হাদীছকে সামনে রেখে অনেক দাঈ আল্লাহর পথে বিশুদ্ধতার সাথে দাওয়াতী কাজ করে চলছেন। আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দান করুন- আমীন!

তবে অনেক বক্তা এর বিপরীত। যেহেতু মাহফিল কমিটি ভাইরাল বক্তা ছাড়া দাওয়াত দেয় না, তাই অনেকে কুরআন-হাদীছের গভীর জ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে বক্তা হওয়ার প্রতি মনোনিবেশ করছে কিংবা কোনো ভাইরাল ব্যক্তির হুবহু কণ্ঠ নকল করছে। ফলে সেও ভাইরাল হচ্ছে। এই সুযোগে প্রায় বক্তা এটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে ৬০-৭০ হাজার টাকা, আবার কেউ লক্ষ টাকা না হলে দাওয়াত গ্রহণ করেন না।

ওয়ায হলো এমন এক আলোচনার নাম, যার মাধ্যমে মানুষের অন্তর নরম হয়, চোখে পানি আসে, শ্রোতাগণ আল্লাহমুখী হয়। অথচ বর্তমানে অধিকাংশ আলোচক গল্প, গযল, হাসিঠাট্টা, লম্বা সুর ও টান দিয়ে সামান্য কিছু কুরআন-হাদীছ মুখস্থ বলে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়। অথচ এই দুই ঘণ্টার মূল্যবান সময়টা ছিল আলোচকের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে জনগণের জন্য আমানতস্বরূপ। মাহফিলে তারা একে অন্যের সমালোচনা বেশি করে আর এটাই যেন তাদের আলোচ্য বিষয়। পাণ্ডিত্য যাহির করার উদ্দেশ্যে জনসম্মুখে অধিকহারে ইখতিলাফী মাসআলা আলোচনা করে ও লক্ষ লক্ষ টাকার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। অন্যদিকে ঈমান শুদ্ধিকরণ, আক্বীদা, তাওহীদ-শিরক, সুন্নাত-বিদআতের মতো ভয়াবহ পাপ সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর সঠিক মানহাজভিত্তিক আলোচনা খুবই কম শোনা যায়। ফলে জনসাধারণ দিকভ্রান্ত হয়ে মাহফিলের মুখ্য অভিপ্রায় থেকে ছিটকে পড়ছে।

(৩) শ্রোতাদের ত্রুটিসমূহ: মাহফিল ফলপ্রসূ না হওয়ার জন্য সর্বোপরি দায়ী হলেন শ্রোতৃবৃন্দ। কারণ তাদের উদ্দেশ্য হবে উপযুক্ত আলোচকদের নিকট হতে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনে তার প্রতি আমল করা। কিন্তু তারা এর বিপরীতে অনেক হাস্য-কৌতুককারী, গায়ক, নকলকারী বক্তার ভক্ত এবং তাদেরই আলোচনা শুনতে অভ্যস্ত। ফলে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা তাদের ভালো লাগে না। বিশেষ করে বর্তমানে শ্রোতাগণ ‘ভাইরাল’ নামক ভাইরাসের ব্যাধিতে প্রবলভাবে আক্রান্ত। ভাইরাল আলোচক ছাড়া তারা আলোচনা শুনতেই চায় না। এদের জন্য মাহফিল কমিটি অযোগ্য ভাইরাল বক্তাদের নিয়ে আসতে এক প্রকার বাধ্য হয়। নিকটবর্তী এলাকায় ভাইরাল বক্তার আগমন হলে শ্রোতাদের হিড়িক পড়ে যায়। অথচ পাশে কোনো অপরিচিত তবে জ্ঞানী কেউ আসলে মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। শ্রোতাদের ভাইরাল বক্তার আলোচনা শোনার পর জিজ্ঞেস করা হলে বলে যে, (উদাহরণস্বরূপ) আজকে বক্তা পর্দা (ভারতের বিভিন্ন বিতর্কিত চ্যানেলের নাটক) সম্পর্কে অগ্নিঝরা বক্তব্য দিয়েছে। অথচ আজও তার বাড়িতেই পর্দা নেই, এমনকি আজও তার বাড়ির মহিলারাই ভারতের এই নোংরা নাটক দেখতে অভ্যস্ত। এই অগ্নিঝরা বক্তব্য শুনেও তার ও তার বাড়ির মহিলারা পরিবর্তন হলো কি? আরেকজন বলছে যে, আজকে বক্তা সূদ নামক জাহিলিয়্যাত সম্পর্কে অনেক সুন্দর ও অগ্নিঝরা বক্তব্য দিয়েছে। অথচ আজও সে নিজেই এই ভয়াবহ সূদে ডুবে আছে। প্রিয় পাঠক! তাহলে এবার বলুন, এই অগ্নিঝরা বক্তব্য শুনে তার অন্তর কিঞ্চিৎ পরিমাণও পরিবর্তন হয়েছে কি?

আসলে প্রায় অধিকাংশ শ্রোতাই ভাইরাল বক্তায় আসক্ত। এজন্য বক্তা কী বলছে, কাকে বলছে, সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত নেই। কারণ তারা ভাইরাল বক্তার ওয়ায শুনতে যায় বিনোদনের জন্য, আমল করার উদ্দেশ্যে নয়। এছাড়া শ্রোতাদের মাঝে জুমআর খুৎবা কিংবা মাহফিলে বক্তব্য শোনার ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। প্রায় মসজিদে কিছু মুছল্লী খুৎবার সময় ঘুমিয়ে কাটায় কিংবা মাহফিলে ওয়ায শুনতে গিয়ে বাদাম, জিলাপি ইত্যাদি খেতে ব্যস্ত থাকে, যার মাধ্যমে তাদের চরম উদাসীনতার পরিচয় পাওয়া যায়।

এসব থেকে উত্তরণের উপায়:

সমস্যা যত বড়ই হোক না কেন তার সমাধান অবশ্যই রয়েছে। আমরা যদি আবারও পূর্বেকার মতো শ্রোতাদের মাঝে ঈমানী চেতনা ফিরিয়ে আনতে চাই, তবে অবশ্যই তা সম্ভব। নিম্নে কিছু পয়েন্ট আলোচনা করা হলো—

১. ইখলাঅবলম্বন করা: সর্বস্তরের ব্যক্তিদের সর্বদা ইখলাছ অবলম্বন করতে হবে। কী উদ্দেশ্যে মাহফিল করছি? কী উদ্দেশ্যে ওয়ায শুনছি? এসব সমস্ত প্রশ্নের উত্তর যেন হয় একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। কারণ মানুষ যা নিয়্যত করে, তা অনুযায়ী প্রতিদান পায়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى ‘প্রত্যেক কাজের ফলাফল নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল। মানুষ তার নিয়্যত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে’।[2]

তাই নিয়্যত বিশুদ্ধ করে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য কাজ করুন।

২. যোগ্য আলোচক নির্বাচন করা: ওয়ায-মাহফিল আয়োজন করার সময় আমাদেরকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, যার কাছ থেকে ইলম গ্রহণ করব বা যার কাছ থেকে আলোচনা শুনে দ্বীন পালনে ব্রতী হব, তিনি যেন সঠিক আক্বীদা ও মানহাজের হন। তিনি যেন কুরআন ও হাদীছের গভীর জ্ঞানের অধিকারী হন। তার যোগ্যতার প্রশ্নে তিনি হবেন আপসহীন। তার প্রতিটি কথাই হবে কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক। পক্ষান্তরে অযথা গালগল্প করা, অন্যের সমালোচনা করা, কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করা, টাকার মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট হওয়া যেসব বক্তার বৈশিষ্ট্য, এমন বক্তাকে বয়কট করতে হবে।

৩. নিজেই পরিবর্তন হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা: শুধু ওয়ায শুনে যাব, কিন্তু আমল বৃদ্ধির দিকে খেয়াল করব না— এমন নীতি পরিহার করতে হবে; বরং ওয়ায শুনে নিজেকে পরিবর্তন করার স্পৃহা থাকতে হবে। নিজেকে পরিবর্তনের জন্য অগ্রসর না হলে আল্লাহ তাআলা আমাদের পরিবর্তন করবেন না। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ ‘নিশ্চয় আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে’ (আর-রা‘দ, ১৩/১১)

তাই নিজেকে পরিবর্তন করার বাসনা তৈরি করুন। যদি নিজেকে পরিবর্তন করে নেন, তাহলে আপনার জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। মহান আল্লাহ বলেন,إِلَّا مَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُولَٰئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا ‘তবে তারা নয়, যারা তওবা করে (নিজেকে সংশোধন করে), ঈমান আনে এবং সৎ কাজ করে; আল্লাহ তাদের পাপগুলোকে নেকী দিয়ে পরিবর্তন করে দিবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আল-ফুরক্বান, ২৫/৭০)

৪. জানার পর মানার প্রতি আগ্রহী হওয়া: জানার পর নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়াই হলো ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا ‘আর তারা বলে, আমরা শুনলাম এবং মান্য করলাম’ (আল-বাক্বারা, /২৮৫)। অপরদিকে অবাধ্যদের বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহর বিধানকে মেনে চলতে বললে তারা বলে,قَالُوا سَمِعْنَا وَعَصَيْنَا ‘তারা বলে, আমরা শুনলাম এবং অমান্য করলাম’ (আল-বাক্বারা, /৯৩)

যারা ওয়ায বা বক্তব্য শোনার পরও আমল করার প্রতি আগ্রহী হয় না, আল্লাহ তাদের জন্য জাহান্নামের কথা বলেছেন এবং তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তুর সাথে তুলনা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لَّا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَّا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَّا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَٰئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَٰئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ ‘আর আমি বহু জিন ও মানুষকে জাহান্নামে দেওয়ার জন্য সৃষ্টি করেছি। কেননা তাদের হৃদয় রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না; তাদের চক্ষু রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা দেখে না। তাদের কান রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা শোনে না। তারাই হলো পশুর ন্যায়, বরং তার চেয়েও অধিক পথভ্রষ্ট। তারাই হলো গাফেল বা উদাসীন’ (আল-আ‘রাফ, /১৭৯)

৫. আলোচনা শোনামাত্রই কমপক্ষে একটি আমলের প্রতিজ্ঞা করা: যখনই কোনো আলোচনা শুনবেন, তখনই সব মানতে না পারলেও কমপক্ষে প্রতি ওয়ায বা খুৎবার আলোচনা শোনার পর প্রতিনিয়ত একটি করে আমল বৃদ্ধি করার প্রতিজ্ঞা করুন। এমনটি প্রতিজ্ঞা করলে তবেই ওয়ায-মাহফিল পরিপূর্ণভাবে ফলপ্রসূ হবে। ফলে সমাজে কলহ-বিবাদ, সূদ-ঘুষ, যেনা-ব্যভিচার ইত্যাদি যাবতীয় পাপ দূরীভূত হবে ইনশা-আল্লাহ।

উপসংহার: ওয়ায-মাহফিল কৃষক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিদের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত ধর্মীয় পাঠশালা। মহৎ ভাবনাসম্পন্ন পরিচালক ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকই একমাত্র আদর্শ ও সৎ ছাত্র তৈরি করতে পারেন। তাই উক্ত পাঠশালা তথা ওয়ায-মাহফিলে যোগ্যতাসম্পন্ন আলোচকের মাধ্যমে বিভিন্ন পেশার ছাত্রদের সঠিক ঈমান-আক্বীদা শুদ্ধিকরণের সুব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে সমাজে সৎ ও আমলদার ব্যক্তির বিপ্লব সৃষ্টি হয়। আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করুন- আমীন!

 আব্দুল মালেক বিন ইদ্রিস

বি.এ, অনার্স, হাদীছ বিভাগ, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৬১; মিশকাত, হা/১৯৮।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৯০৭; মিশকাত, হা/১।

Magazine