বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে মহানবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের জন্য ন্যায়বিচার, সমতা এবং মানবাধিকারের গুরুত্ব অপরিসীম। মানবসমাজের সকল স্তরের মানুষ যেন সমান মর্যাদা এবং সুযোগ পায়, এই লক্ষ্যই একটি ন্যায়সংগত সমাজের ভিত্তি। ইসলামের আদর্শে নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবন ও শিক্ষা দ্বারা বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষা ও কর্মের মাধ্যমে, সমাজে বৈষম্য নির্মূল এবং সকল মানুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ছাহাবীদের কাছে বারবার এই শিক্ষাটি দিয়েছিলেন যে, আল্লাহর কাছে সকল মানুষ সমান। বর্ণ, গোত্র বা আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য করা উচিত নয়। ইসলামের আগমনের পূর্বে আরব সমাজ ছিল গভীরভাবে বৈষম্যপূর্ণ। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য ছিল একাধিক মাত্রায়, যা সমাজের সামগ্রিক ন্যায়বিচারকে বিপর্যস্ত করেছিল। ধনী-গরীব, ক্রীতদাস-মুক্ত, পুরুষ-নারী— এই ধরনের বৈষম্য সমাজের সকল স্তরের মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্বল। ধর্মীয় সহনশীলতার অভাব ছিল এবং বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষ চলত। জাহেলিয়াতের যুগে আরবসমাজে কন্যাশিশুদের জীবিত কবর দেওয়ার প্রথা ছিল। এই বর্বর প্রথা নারীদের মর্যাদার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং সমাজের বৈষম্যমূলক মনোভাবের একটি উদাহরণ হিসেবে কাজ করে। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তা বন্ধ করেছিলেন, যা নারীদের মর্যাদা ও অধিকারের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ ছিল।
ইসলামের আগমন এবং মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভূমিকা:
ইসলামের মূল শিক্ষা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সকল মানুষকে সমান মর্যাদায় দেখা। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের প্রচার শুরু করেন এবং প্রথম দিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তারা ছিলেন সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। ইসলাম প্রচারের সময় মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতুন সমাজ গঠনের জন্য একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন, তখন তিনি মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মুহাজিরদের ও আনছারদের মধ্যে সম্পত্তি, ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য সম্পদ ভাগাভাগি করা হয়, যা ইসলামের সমতা ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা প্রতিফলিত করে। এই ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বৈষম্যহীন সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেন।
বৈষম্যহীন সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা:
মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজে সকল মানুষের জন্য সমান অধিকার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছিলেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ে যাকাতব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল, যা ধনীদের সম্পদ থেকে গরীবদের জন্য অংশ প্রদান নিশ্চিত করেছিল। যাকাত একটি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করে এবং এটি সমাজের গরীব ও দুর্বলদের সাহায্য করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। যাকাতব্যবস্থা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ, যা সম্পদের সুষম বণ্টন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্দেশ্যে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। জীবন চলার পথে বৈষম্য দূর করা অতীব জরুরী। যেটাকে আমরা অন্য ভাষায় ন্যায়বিচার বলতে পারি। কারণ ন্যায়বিচার ছাড়া মানুষ শান্তি-শৃঙ্খলা লাভ করতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে আদিষ্ট হয়েছি’ (আশ-শূরা, ৪২/১৫)। এখানে সরাসরি ন্যায়বিচার করতে আদেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলার বাণী অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেন। যেখানে একটুও অন্যায় হওয়ার সুযোগ ছিল না। ধর্ম, বর্ণ, আত্মীয়স্বজন, ধনী-দরিদ্র সকলের জন্য বিচার সমান। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে রিসালাত পূর্ণতা লাভ করে। লক্ষ্য ছিল যুলমের অবসান ঘটিয়ে মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা। দীর্ঘ ২৩ বছরে চেষ্টা চালিয়ে তিনি তা কার্যকর করেন। তাঁর উপস্থাপিত জীবনব্যবস্থা মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বদিক দিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিটার ধারক ও বাহক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মহান আল্লাহ সব নবী ও রাসূলকে ইনছাফ ও ন্যায়বিচারের বিধান এবং তা কার্যকর করার দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন’ (আল-হাদীদ, ৫৭/২৫)। বিচারক হিসেবে মনোনীত করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘(হে নবী)! আমি সত্য সহকারে আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যাতে আপনি আল্লাহর দেখানো মুক্তির আলোকে বিচার-আচার করতে পারেন’ (আন-নিসা, ৪/১০৫)। আমরা যদি একটা উদাহরণ নিয়ে আসি, তাহলে দেখতে পাব তিনি কতটা স্বজনপ্রীতি থেকে দূরে থাকতেন। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করে, তবে আমি নির্দ্বিধায় চুরির শাস্তি হিসেবে তার দু’হাত কেটে দেব’।[1] আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোনো ক্বওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনছাফ করবে না। তোমরা ইনছাফ করো, তা তাক্বওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় তোমরা যা করো, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত’ (আল-মায়েদা, ৫/৮)। অন্য জায়গায় আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘আর যখন তোমরা মানুষের কোনো বিচার মীমাংসা করতে আরম্ভ করো, তখন ইনছাফের সাথে বিচার মীমাংসা করো’ (আন-নিসা, ৪/৫৮)। হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে আমার বান্দা! আমি নিজের ওপর যুলম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও একে হারাম করেছি। অতএব, তোমরা একে অপরের ওপর যুলম করো না’।[2]
নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বৈষম্য দূরীকরণ:
জাহেলী যুগ ও পরের যুগে নারীদের প্রতি যে বৈষম্য করা হতো, সেটা আমাদের নবী দূর করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বলা যায় যে, মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় স্ত্রী খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা, যিনি একজন সম্মানিত ব্যবসায়ী ছিলেন। খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মর্যাদার গুরুত্ব প্রদর্শন করেন। তাঁর সাথে বিবাহের মাধ্যমে মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থনৈতিক স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি তিনি নারীদের বিয়েতে সম্মতি, সম্পত্তির অধিকার এবং শিক্ষার গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যা নারীদের যথার্থ অধিকারের বিষয়টি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক ছিল। নিচে আরও কিছু পয়েন্ট তুলে ধরা হলো— ইসলামের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন, যা তার সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটের তুলনায় ছিল বিপ্লবাত্মক। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের পূর্বে আরব সমাজে নারীদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ ছিল। তাদেরকে অনেক সময় সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হতো এবং নারীশিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর রীতি ছিল প্রচলিত। আল্লাহ তাআলা কুরআন ও হাদীছের মাধ্যমে নারীদের অধিকারের সুনির্দিষ্ট বিধান প্রদান করেছেন।
কুরআনে নারীর অধিকার: কুরআন মাজীদে বিভিন্ন জায়গায় নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পুরুষদের জন্য রয়েছে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল, আর নারীদের জন্য রয়েছে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল’ (আন-নিসা, ৪/৩২)। এখানে মহান আল্লাহ স্পষ্টভাবে নারী ও পুরুষকে সমান মর্যাদা প্রদান করেছেন এবং তাদের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটি ছিল এক যুগান্তকারী পরিবর্তন, যেখানে নারীকে পুরুষের সমান হিসাবে গণ্য করা হলো।
উত্তরাধিকার আইন: ইসলাম নারীদের সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করেছে, যা পূর্ববর্তী সমাজে অনুপস্থিত ছিল। কুরআন বলেছে, ‘পুরুষদের জন্য যা পিতামাতা ও নিকট আত্মীয়রা রেখে যায়, তার একটি অংশ রয়েছে। আর নারীদের জন্যও রয়েছে যা পিতামাতা ও নিকট আত্মীয়রা রেখে যায়’ (আন-নিসা, ৪/৭)। এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, ইসলাম নারীদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি লাভের অধিকার দিয়েছে, যা আগে কল্পনাও করা যেত না।
শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার: নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে নারীদের শিক্ষাগ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয’।[3] এক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এটি ছিল নারী শিক্ষা নিয়ে সেই যুগের অন্যতম বিপ্লবী নির্দেশনা। শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নারীরা সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কারণ সেই সময় নারীরা সকল জায়গায় বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
হাদীছের আলোকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিভঙ্গি: হাদীছে নারীদের মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে অসংখ্য নির্দেশনা পাওয়া যায়। এক হাদীছে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মাঝে সেই ভালো, যে তার পরিবারের নিকট ভালো’।[4] এই হাদীছ থেকে বোঝা যায়, নারীদের মর্যাদা কতটা উঁচু ছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগে। নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তাঁর স্ত্রীদের সাথে অত্যন্ত সহানুভূতি ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করতেন।
বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্যের অবসানে মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম:
নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবতার জন্য এমন এক সমাজ গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন, যেখানে বর্ণ, জাতি, গোত্র বা সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে কারও উপর কারও শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে না। বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্য ইসলামের পূর্ববর্তী আরবসমাজে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল, যেখানে গোত্রবাদ, বংশমর্যাদা এবং গায়ের রঙের ভিত্তিতে মানুষকে বিচার করা হতো। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ধরনের সব বৈষম্য দূর করার জন্য শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিলেন এবং সকল মানুষের মধ্যে সমতা ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা প্রচার করেছিলেন।
কুরআনের নির্দেশনা: কুরআন মাজীদে বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্যের অবসান বিষয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চেনো। নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে বেশি পরহেযগার’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১৩)। এই আয়াতটি বর্ণবাদ এবং জাতিগত বৈষম্যের অবসানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, মানুষের মধ্যে যে বিভক্তি তা শুধু পরিচয়ের জন্য; মর্যাদার জন্য নয়। প্রকৃত মর্যাদা আল্লাহর কাছে কেবল তাক্বওয়ার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
বিদায় হজ্জের ভাষণ: মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জে সমগ্র মানবতার জন্য একটি বার্তা দেন, যা আজও বর্ণবাদবিরোধী এবং সাম্যবাদী সমাজ গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘হে মানবজাতি! তোমাদের প্রভু এক এবং তোমরা সবাই আদমের সন্তান। আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কোনো আরবের উপর অনারবের এবং কোনো অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোনো শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কোনো কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, একমাত্র তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির মাধ্যমে’।[5] এটি ছিল বর্ণবাদবিরোধী একটি সুস্পষ্ট ঘোষণা, যা ইসলামের সাম্যবাদী সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
বেলাল রযিয়াল্লাহু আনহু-এর উদাহরণ: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণবাদ এবং জাতিগত বৈষম্য দূর করার জন্য প্রায়োগিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বেলাল রযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন একজন আফ্রিকান ক্রীতদাস, যার গায়ের রং ছিল কালো। ইসলাম গ্রহণের পর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মক্কার অন্যতম সম্মানিত এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত করেন— তিনি মসজিদে নববীতে আযান দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার গায়ের রং বা সামাজিক অবস্থানের কারণে তাকে কোনোভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করেননি, বরং তার যোগ্যতা ও ঈমানের ভিত্তিতে মর্যাদা প্রদান করেছিলেন।
হাদীছের দৃষ্টিতে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান: বর্ণবাদ দূর করার জন্য মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনা হাদীছের মাধ্যমেও পাওয়া যায়। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের বর্ণ, আকৃতি, সম্পদ কিংবা সামাজিক অবস্থানের দিকে তাকান না; তিনি তোমাদের অন্তরের দিকে এবং তোমাদের কাজের দিকে তাকান’।[6] এই হাদীছ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, ইসলামে মানুষের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য, যেমন— বর্ণ বা জাতিগত পরিচিতির উপর কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বরং একজন মানুষের প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয় তার কর্ম এবং আল্লাহভীতি দ্বারা।
সাম্যের মডেল মদীনা সনদ: মদীনায় যখন নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তখন সেখানে বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও গোত্রের মানুষ বাস করত। তিনি সবাইকে নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ‘মদীনা সনদ’ প্রণয়ন করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী, মদীনার সকল অধিবাসী, তাদের ধর্ম বা জাতিগত পরিচয় যাই হোক না কেন, সমান অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। এটি ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং বৈষম্যহীনতার এক অনন্য উদাহরণ।
ধর্মীয় সহনশীলতা:
মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করতেন। ধর্মীয় সহনশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো মদীনায় ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান এবং মুসলিমদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘মদীনার সনদ’ তৈরি করেছিলেন। মদীনার সনদ একটি লিখিত সংবিধান হিসেবে কাজ করে, যা বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সহাবস্থান এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এই সনদটি ধর্মীয় সহনশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ এবং মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সংবেদনশীলতা ও সহানুভূতির প্রতিফলন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধর্মীয় সহনশীলতা ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে এক অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার সময়ে আরব উপদ্বীপ ছিল গোত্রভিত্তিক এবং ধর্মীয়ভাবে বিচ্ছিন্ন। ইসলাম শুধু আল্লাহর প্রতি আনুগত্য নয়; বরং মানবজাতির জন্য সাম্য, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক সম্মানের বার্তা নিয়ে আসে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উদাহরণ রেখে গেছেন।
মদীনা সনদের মূল বিষয় ছিল—
সকল ধর্মের মানুষকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা। মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক নিরাপত্তা। কোনো সম্প্রদায়ের উপর অন্য সম্প্রদায়ের বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধ।
ইয়াহূদীদের সাথে চুক্তি: মদীনায় ইয়াহূদীদের সাথে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য চুক্তি করেন। ইয়াহূদীদের জন্য তিনি তাদের ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেন। সেই চুক্তি অনুযায়ী, ইয়াহূদী ও মুসলিম উভয়ে মদীনার শান্তি রক্ষার দায়িত্বে সমানভাবে অংশ নেবে। এই উদাহরণ প্রমাণ করে যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধর্মীয় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সহনশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করতেন।
বিদায় হজ্জের ভাষণ: রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জে তাঁর ভাষণে সমগ্র মানবজাতির জন্য সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘কোনো আরবের উপর অনারবের এবং কোনো অনারবের উপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তবে কেবল তাক্বওয়ার মানদণ্ডে কারো উপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে’।[7] এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্যের বিরোধিতা করেন এবং মানবজাতির সকলকে সমান মর্যাদা প্রদানের আহ্বান জানান।
ইসলামে ধর্মান্তর করতে বাধ্য না করা: কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘ধর্মের বিষয়ে কোনো জবরদস্তি নেই’ (আল-বাক্বারা, ২/২৫৬)। এই নির্দেশনা অনুসারে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনোই কাউকে জোর করে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেননি। তিনি সব ধর্মের মানুষকে তাদের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে শিখিয়েছেন। ধর্মীয় সহনশীলতা এবং বৈষম্যহীনতার ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গড়ে তোলা সমাজ ছিল একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। তার জীবন ও কাজের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, ধর্মীয় বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল সমাজ গঠন করা সম্ভব। তার এই শিক্ষা আজও আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যেখানে বৈষম্য ও ধর্মীয় উগ্রবাদ এক বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নবীজির বার্তা:
মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতার কাছে ইসলামের বার্তা পাঠিয়েছিলেন এবং সকল মানুষের সমতা ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর বার্তাটি শুধু আরবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ— মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়কালে, তাঁর বার্তা পৌঁছেছিল বাইজেন্টাইন এবং পারস্য সাম্রাজ্যে। তাঁর শিক্ষার প্রভাব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেখা গিয়েছে, যা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর প্রচেষ্টার প্রমাণ।
মহানবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন ও শিক্ষা বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। তাঁর নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা এবং সাম্যের শিক্ষা শুধু তার সময়ের সমাজকেই পরিবর্তন করেনি, বরং এটি পরবর্তীতে মানবসমাজের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যবহৃত নীতিমালা ও পদক্ষেপগুলো আজও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মৌলিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি সকল মানুষের মধ্যে সমতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা করেছেন, নারীদের অধিকার উন্নত করেছেন এবং ধর্মীয় সহনশীলতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর নির্দেশনায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য একটি ন্যায়সংগত এবং সংহত সমাজ গঠনের পথ প্রশস্ত করেছে। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বৈষম্যহীন সমাজ গঠন একটি সমষ্টিগত প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ হতে পারে। এটি আমাদের সকলকে মনে করিয়ে দেয় যে, একে অপরকে সম্মান জানানো, সহযোগিতা করা এবং সাম্য ও ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা আমাদের সামাজিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও কর্ম আজও মানবতার জন্য দিশারী হিসেবে কাজ করে এবং সকল মানুষের মধ্যে শান্তি ও সাম্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।
এ. এস. এম. মাহবুবুর রহমান
শিক্ষার্থী, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া; দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া, ঢাকা।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৩০৪; মুসলিম, হা/১৬৮৮; মিশকাত, হা/৩৬১০।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৭৭।
[3]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৪।
[4]. তিরমিযী, হা/৩৮৯৫, হাদীছ ছহীহ।
[5]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৫৩৬; সিলসিলা ছহীহা, হা/২৭০০।
[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪।
[7]. সিলসিলা ছহীহা, হা/২৭০০।