বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য ঋতু হচ্ছে শীতকাল। শীতকাল একটি দারুন ঋতু। যদিও ঠাণ্ডায় গা হিম হয়ে যায়।
‘কনকনে ঠাণ্ডাতে
শীত এলো— এলো রে
ঠকঠকে কাঁপুনি
দম বুঝি গেল রে।
বিহানের সূর্যটা
ওই বুঝি— ওঠে রে
গেরামের চাষি ভাই
মাঠপানে ছুটে রে’।
হেমন্তের পরপরই আগমন করে এ শীতকাল। ঋতু পরিক্রমায় পৌষ ও মাঘ মাস শীতের জন্য হলেও প্রকৃতিতে শীত থাকে তিন-চার মাস। সাধারণত নভেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এই দুই মাস একটু বেশি বেশি শীত থাকে।
‘চায় না মনে এমন দিনে
লেপ কাঁথা সুখ ছাড়তে রে..
আরাম করে হিম শীতে যে
হাত-পাগুলো নাড়তে রে’।
শীত আমাদের বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক রূপের একটি। আহ! কী যে অপরূপ ধরণি হয় তখন, ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তবু কবিরা নীরব নিথর হাত গুটিয়ে বসে থাকেন না। কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন শীতের রূপ। লিখেন ছড়া, কবিতা, গল্প।
শীতের রাতে গাছের পাতায় পাতায় কুয়াশা পড়ে। ছেঁয়ে যায় আমাদের বাসা-বাড়ির চারপাশ। এত ঘন কুয়াশা, কিচ্ছু দেখা যায় না। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সাদা চাদরে যেন আবৃত হয়ে যায় পুরো দেশটা।
সারাদিন সূর্যের মুখ দেখা যায় না। সকালে কুয়াশা কাটতে না কাটতেই কখন যে সন্ধ্যা নামে ভাবাই যায় না। দিনটিও হয়ে যায় একেবারে ছোট। কিন্তু রাত হয় দীর্ঘ।
‘শীত কুয়াশা একই সাথে
বাইরে যাওয়া যায় না রে..
সূর্য কোথায় মুখ লুকালো
আলো জ্বেলে চায় না রে।
শিশির পড়ে টপটপাটপ
বৃষ্টি যেন ঝরছে রে..
হিম কুয়াশা ওড়ে ওড়ে
স্মৃতির মিনার গড়ছে রে’।
অপরূপ বৈশিষ্ট্যের জন্য শীতকাল বছরের অন্য ঋতু থেকে স্বতন্ত্র। শীতের সকালে কুয়াশা কাটলে আস্তে আস্তে বিরাট একটি লাল বর্ণের থালার মতো সূর্য পূর্ব দিগন্তে দেখা যায়।
‘বিহান বেলা টগবগিয়ে সূর্যের আলো ফুটে
মাঠের বুকে শিশিরগুলো এক নিমিষে লুটে।
আমন ধানের ক্ষেতে বসে চখাচখির মেলা
কৃষক চোখে স্বপ্ন বুনে কেটে যায় বেলা’।
হঠাৎ রোদ উঠে। শীতের রোদ আহা কী যে মিষ্টি! রোদ পোহানোর জন্য মানুষ খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পাটালি গুড় দিয়ে অথবা সর্ষে তেল পিঁয়াজ কাঁচামরিচ ধনে পাতায় মুড়ি মাখিয়ে খেতেও খুব মজা। রোদ ওঠার সাথে সাথেই কুয়াশা পালাতে শুরু করে। মানুষ রোদ না পোহায়ে অনেক সময় খড় কুটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে আগুন পোহায়। গাছের সবুজ কচিপাতা টগবগিয়ে জাগে। পাখিগুলো পাতার ফাঁকে বসে সূর্যের তাপ পোহাতে নতুন স্বপ্ন আঁকে।
‘শীত সকালে রোদের কিরণ
বড্ড মিঠা লাগে
সবুজ কচি গাছের পাতা
টগবগিয়ে জাগে।
শীতসকালে পাখিগুলো
পাতার ফাঁকে থাকে
রোদের কিরণ তাপ পোহাতে
নতুন স্বপ্ন আঁকে’।
মূলত শীতের আসল সৌন্দর্য গ্রামে। কুয়াশার চাদরে আবৃত থাকা গ্রামীণ দৃশ্য ধরা পড়ে সকালের মিষ্টি রৌদ্রময় সময়ের অপেক্ষা করার অনুভূতিগুলোতে। আর কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতি, শিশির সিক্ত রাস্তাঘাট, হিমেল বাতাসের মিষ্টি মধুর আমেজ শীতকালে এক ভিন্ন রূপ বয়ে নিয়ে আসে সোনার বাংলায়।
‘এলো পৌষ মাস—
সকাল গিয়ে সন্ধ্যা নামে
শহর নগর গাঁও গেরামে
ঠাণ্ডায় বসবাস।
এলো পৌষ মাস—
কনকনে শীত রাস্তা ঘাটে
চাষীরা নেই ধানের মাঠে
যদিও বিজয় মাস’।
শীতকালে আল্লাহর আরেক নেয়ামত ফুলে-ফলে ভরপুর হয় সারা দেশ। এসব ফুলের রূপ সৌন্দর্য, পরশ মানুষের মনে দারুণ অনুভূতির জন্ম দেয়।
‘বাতাস পেলে দোল খেয়ে যায়
মল্লিকা ফুলগুলি,
রোদের ঝলক হাসি ছড়ায়
গান ধরে বুলবুলি’।
শীতকালে টাটকা শাকসবজি ও তরকারি পাওয়া যায়। মূলা, গাজর, লাউ, কুমড়া, সরিষা, শালগম, আলু, পালংশাক, বেগুন, শিম, বরবটি, মটরশুঁটি, ফুলকপি, বাঁধাকপি প্রভৃতি শীতকালীন সবজি ও ফসলের দৃশ্য গ্রামবাংলার ক্ষেতে ক্ষেতে দেখলে মন ভরে ওঠে।
‘সর্ষে ফুলে খেত ভরেছে
মৌমাছি যে ওড়ছে
ফুল তুলিতে ছেলেমেয়ে
খেতের পাশে ঘুরছে’।
আহা রে! শীতকালে কত রকমের মাছ ধরা পড়ে খালে, বিলে, নদীতে। আর শিং, শৈল, কৈ, বোয়ালসহ বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু মাছ শীত মৌসুমেই বেশ মিলে। এ আল্লাহর এক খাছ নেয়ামত।
পিঠাপুলি তো শীতকালে গ্রামবাংলার আরেক ঐতিহ্য। বাংলার শীতকাল আর পিঠা যেন একসূত্রে গাঁথা। কৃষকের ঘরে হেমন্তে নতুন ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পিঠা তৈরির কাজ। চলতে থাকে তা পুরো শীতকাল জুড়ে।
‘হেমন্তে ঐ মাঠে মাঠে
আমন ধান যে পাকে
গন্ধ ছড়ায় ছন্দ গড়ায় গাঁয়ের বধুর নাকে।
মন ভরে যায় ধানের ঘ্রাণে
অবকাশের ফাঁকে
নবান্ন তাই পিঠাপুলি হাতছানিতে ডাকে’।
বেশির ভাগ পিঠাই মিষ্টিপ্রধান, কিছু পিঠা ঝালজাতীয়। এক এক অঞ্চলে এক এক রকমের পিঠা তৈরি হয়। একই পিঠার নামও আবার অঞ্চলভেদে ভিন্ন। তবে এমন কিছু পিঠা আছে, যা দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বানানো হয়।
শীতকালীন পিঠার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— চিতই, পাকান, পাটিসাপটা, ভাপা, পুলি, ম্যারা, নারকেল ভাজা পুলি, নারকেল সিদ্ধ পুলি, নারকেল ঝুরি পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, ঝাল পিঠা, বিস্কুট পিঠা, খাস্তা পিঠা, তেলেভাজা, ফুলঝুরি, নকশি, গোলাপ ফুল, দুধ পিঠা, লাউ পায়েস, ছিট পিঠা, সিদ্ধ পিঠা, মালপোয়া পিঠা, মালভোগ, ক্ষীরকুলি, মালাই পিঠা, গজা, রুটি পিঠা, দুধ পায়েস, পুতুল পিঠা, লরি পিঠা, তারাজোড়া, জামাই পিঠা, ঝুরি পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, খান্দেশা পিঠা, পাতা পিঠা, গুলগুলা, লবঙ্গ পিঠা, ক্ষীরডুবি, খাস্তা পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, কুলি পিঠা, দুধকুলি পিঠা, জামাই কুলি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চুটকি পিঠা, রসপুলি, মুরালি পিঠা, খান্দাশ, পয়সা পিঠা, চুষি পিঠা ইত্যাদি।
‘ফাগুন মাসে গ্রামাঞ্চলে
নতুন ধানে ভরে
সেই ধানেতে পিঠাপুলি
সবার ঘরে ঘরে।
চিতই ভাপা-খেজুর রসে
তেলের পোয়া পিঠা
মায়ের হাতে তৈয়ার করা
খাইতে বড়ই মিঠা’।
অতিথি পাখির আগমন বাংলার আরেক বৈচিত্র্য। প্রতি বছর শীতকালে শীতের যেসব পাখি আমাদের দেশে আসে, তাদেরকে বলা হয় অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখি। কবি বলেছেন—
‘নীলাকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি,
শীতে নামে বিলেঝিলে ভালোবাসে আঁখি।
বড্ড মায়া লাগে— অসহায়ের বেশে,
পরিযায়ী পাখিগুলো আসে বাংলাদেশে।
ভালোবাসে বাংলা এই মৌসূমে
বিলেঝিলে থাকে— নিগূঢ় ঘুমে।
ভয় নেই, তারা যেন শীতদেশ ছেড়ে
তবু পড়ে যায়— দুষ্টদের ফাঁদে’।
অতিথি পাখি আসে মূলত হিমালয়ের পাদদেশ আর রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে। এই পাখিগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই সুন্দর এদের গায়ের বাহারি রং। ওদের দেখলেই মন ভরে যায়। নামগুলোও বেশ চমৎকার। শীতের পাখিদের মধ্যে বালিহাঁস, গিরিয়া হাঁস, সাদা মানিকজোড়, নারুদ্দি, চিনাহাঁস, নাইরাল ল্যাঙ্গি, ভোলাপাখি, হারিয়াল, বনহুর, বুরলিহাস, সিরিয়া পাতিরা, পিয়াংচিনা, কবালি, যেনজি, প্রোভায়, নাইবাল, ডেলা ঘেনজি, গ্রাসওয়ার, গেন্ডাভার, বারহেড, রাঙ্গামুরি, বড়গুলিন্দা, হট্টি টি, ডাহুক, কোড়া, বাটাং, পানকৌড়ি, বড় বক অন্যতম।
‘অচেনা দেশ সাইবেরিয়া
নানান পাখির দেশ,
শীত ঋতুতে ঠাণ্ডা পড়ে
কঠিন পরিবেশ।
জীবন বাঁচার লড়াই করে
উড়ে আসে সব,
বাংলাদেশে পাড়ি জমায়
করে কলরব।
কী অপরূপ অতিথি এই
পাখির কারুকাজ,
নদীর কুলে পাখির মেলায়
নানা রকম সাজ’।
শীতকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে এ পাখিগুলো আমাদের দেশে আসতে শুরু করে। তারপর মার্চ থেকে এপ্রিলের দিকে ওদের দেশে বরফ গলতে শুরু করলে ফিরে যেতে থাকে নিজেদের দেশে। কিন্তু কিছু দুষ্ট মানুষ তাদের শিকার করে।
‘ধরে পাখি পরিযায়ী— দুষ্ট দলে দলে
ছলে বলে শিকারীরা কূটকৌশলে।
মানে না যে— আইন বিধান তারা অভয়াশ্রম
ভালোবাসা নেইতো কভু— তাই শিকারেতে যম’।
এ সবকিছুই আল্লাহর নেয়ামত। নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে উভয় জগতের সুফল ভোগ করা যায়।
মহিউদ্দিন বিন জুবায়েদ
মুহিমনগর, চৈতনখিলা, শেরপুর।