কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মাদরাসা শিক্ষা সম্ভাবনা, সংকট ও বাস্তবতা

post title will place here

নতুন বছরের শুরুতেই অভিভাবকদের মধ্যে একটি অলিখিত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যার নাম ভর্তিযুদ্ধ! সন্তানকে পছন্দের স্কুল-মাদরাসায় ভর্তি করতে পারাটা একপ্রকার যুদ্ধই বটে। একসময় অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীরই ভর্তি গন্তব্য ছিল সরকারি স্কুল কিংবা কে জি স্কুলগুলো। কিন্তু সময়ের পালাবদলে অভিভাবকদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠছে কে জি স্কুলের আদলে গড়ে উঠা মাদরাসাগুলো। আজ আমরা জানার চেষ্টা করব এই মাদরাসা শিক্ষার সম্ভাবনা, সংকট ও বাস্তবতা সম্পর্কে।

সম্ভাবনা :

একসময় দ্বীনী ইলমের প্রতি আসক্ত মুসলিম ও গরীব ইয়াতীম ছাড়া সাধারণত কেউ তাদের সন্তানদের মাদরাসায় পড়াশোনা করাতো না। যারা মাদরাসায় পড়াশোনা করত, তাদেরকে একপ্রকার ব্যাকডেটেড হিসেবেই সমাজে ধরা হতো। তার প্রধান কারণ ছিল মাদরাসা-সার্টিফিকেটের অগ্রহণযোগ্যতা ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা না থাকা। তারপরও সময়ের সাথে অবস্থার পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে আজ মাদরাসা শিক্ষা একটি ঈর্ষণীয় অবস্থানে রয়েছে।

আমাদের দেশে ধর্মীয় সচেতনতা কম হলেও তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আজ মানুষ ইসলাম সম্পর্কে যথেষ্ট জানতে পারছে। ইসলাম প্রচারে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব এদেশের মানুষের মনে দাগ কেটেছে। যার প্রতিচ্ছবি আমরা বেশ কিছু বছর ধরেই দেখতে পাচ্ছি। একসময় শুধু গরীব ও ইয়াতীম সন্তানরাই মাদরাসায় পড়াশোনা করলেও বর্তমানে অধিকাংশ মধ্যবিত্তসহ উচ্চ-মধ্যবিত্তরাও মাদরাসামুখী হচ্ছে। যা এদেশের দ্বীন ইসলামের জন্য শুভসংবাদ।

অনেক ইসলামিক বোদ্ধা ইসলাম প্রচারে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারকে বাঁকা চোখে দেখে। অথচ এই পদ্ধতির ইসলাম প্রচারই আজ সাধারণ মুসলিমদের জাগ্রত করতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। যার ফলে ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষ আজ ইসলামমুখী হওয়ার চেষ্টা করছে। তাই এখন সাধারণ মানুষ যেকোনো আমল করার আগে যাচাই-বাছাই করে। একইসাথে কেউ কোনো বিষয়ে আপত্তি তুললে তা জানার চেষ্টা করে। আর এভাবেই সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ইসলামিক প্রভাব কাজ করছে। যার প্রেক্ষিতে মানুষ হাজারো পাপ করলেও নিজের সন্তানকে দ্বীনী আলেম বানানোর চেষ্টা করছে। ফলে আমাদের সমাজে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদি এভাবে প্রতিটি ঘর থেকে শিশুরা মাদরাসামুখী হয়, তাহলে প্রতিটি ঘরেই ইসলামের সঠিক বাণী পৌঁছে যাবে ইনশা-আল্লাহ। আর প্রতিটি ঘর যদি আল্লাহ কবুল করে নেয়, তাহলে এই দেশে ইসলামের ভিত্তি আরো সুদৃঢ় হবে ইনশাআল্লাহ।

সংকট ও বাস্তবতা :

করোনা মহামারিসহ আরও বিভিন্ন কারণে দিনদিন সরকারি স্কুল ও কে জি স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীসংখ্যা কমে গেছে। অপরদিকে মাদরাসাগুলোতে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় উঠেপড়ে লেগেছে। যাদের নীতি-নৈতিকতা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। শুধু ব্যবসার চিন্তা থেকেই তারা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করছে। যা মাদরাসা শিক্ষার জন্য একটি অশনিসংকেত।

একইসাথে শহরের নিম্নমধ্যবিত্তদের চাহিদার কারণে প্রায় মাদরাসায় ডে-কেয়ার সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। যা একটি ভালো উদ্যোগ। তবে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে গড়ে উঠা মাদরাসাগুলোতে গুণগত মান প্রশ্নবিদ্ধ। যা মাদরাসা শিক্ষার সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কেননা সাধারণ মানুষ যে উদ্দেশ্যে তাদের সন্তানদের মাদরাসায় দিচ্ছে, যদি সেই উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়, তাহলে এদেশে ইসলামী শিক্ষার চরম বিপর্যয় নেমে আসবে।

অধিকাংশ মা-বাবা সন্তানকে মাদরাসায় দিলেও তাদের ব্যক্তিজীবনে ইসলামের চর্চা নেই। ফলে সন্তানরা মাদরাসায় পড়লেও তাদের জীবনে ইসলামের প্রভাব থাকে না। ফলে এসব শিক্ষার্থী কয়েক বছর পরই মাদরাসা থেকে বিদায় নিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়ে যায়। মূলত যে সন্তান ঘরে ইসলামের চর্চা দেখে না, সেই সন্তান যখন মাদরাসায় ইসলামের নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা পায়, তখন তার পক্ষে ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ এবং চর্চা করাটা খুবই দুরূহ হয়ে পড়ে।

এছাড়াও অধিকাংশ শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত মাদরাসায় পড়াশোনা শেষ করলেও, তাদের ব্যক্তি জীবনে ইসলামের চর্চা দেখা যায় না। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের জন্যই তারা মাদরাসায় পড়েছে। যার ফলে এসব শিক্ষার্থী থেকে সমাজ ইসলামের কিছুই পায় না। তারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাংক-বীমাসহ এমন সব জায়গায় চাকরি নেয়, যা ইসলামের নীতি-নৈতিকতার সাথে সাংঘর্ষিক।

তাছাড়া ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে গড়ে উঠা অধিকাংশ মাদরাসায় দ্বীন ইসলামের সঠিক চর্চা হয় না। ফলে যারাই এসব মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভ করে, তারা প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে থাকে। একারণে আজ অধিকাংশ পরিবারের সন্তানরা মাদরাসায় পড়লেও তাদের মধ্যে সঠিক ইসলামের ঈমান-আক্বীদা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ মাদরাসায় পড়ানোর মূল উদ্দেশ্যই হলো ইসলামের সঠিক ঈমান-আক্বীদা চেনা। তাই আমাদের উচিত, এসব সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা।

করণীয় :

আমরা যারা দ্বীন পালনের উদ্দেশ্যে সন্তানকে মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই, তাদের উচিত হবে বেশকিছু বিষয় মাথা রাখা। প্রথমত, আমাদের নিয়্যত থাকতে হবে সৎ। অর্থাৎ আমার সন্তান যদি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, তাহলে এর প্রতিদান আল্লাহ আমাকে দুনিয়া এবং আখেরাতে উভয় জায়গায়ই দিবেন ইনশাআল্লাহ। দ্বিতীয়ত, মাদরাসা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছহীহ আক্বীদার মাদরাসা খুঁজে বের করা। প্রয়োজনে দূরে এবং কষ্টকর হলেও ছহীহ আক্বীদায় সন্তানকে মানুষ করতে পারলে, সেই সন্তান দুনিয়া ও আখেরাতে পিতা-মাতার জন্য অশেষ নেয়ামত হবে। তাই যেখানে-সেখানে সন্তানকে ভর্তি না করিয়ে ছহীহ আক্বীদা দেখে তবেই সন্তানকে ভর্তি করাতে হবে।

একইসাথে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেও ইসলামের চর্চা করতে হবে। শুধু সন্তানকে মাদরাসায় দিয়ে নিজেরাই অনৈসলামিকভাবে চললে সেই সন্তান ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। শিক্ষিত হলেও তার থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র ইসলামের ব্যাপারে উপকৃত না হওয়ার সম্ভাবনা। তাই সর্বাবস্থায় পিতা-মাতাকে সৎ এবং ইসলামিক জীবনযাপন করতে হবে।

সেই সাথে যারা মাদরাসা পরিচালনা করবেন, তাদেরও নিয়্যত থাকতে হবে সৎ এবং পবিত্র। মাদরাসাকে কখনই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাবা যাবে না। যারা মাদরাসায় চাকরি করবেন, তাদেরও এই বিষয়গুলো হিসাবে রাখতে হবে। কেননা একজন সৎ শিক্ষকই অনেকগুলো সৎ শিক্ষার্থী তৈরি করতে পারেন। তাই সব সময়ই দ্বীন ইসলামের কথা মাথায় রেখে সবকিছু পরিচালনা করতে হবে। তাহলেই প্রতিটি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে ইসলামের সুবাতাস বইতে থাকবে।

সুতরাং আসুন! আমাদের সন্তানদের ইসলামের ছহীহ শিক্ষা দেই, যাতে এই সন্তান আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের পাথেয় হয়। মহান আল্লাহ তাওফীক্ব দিন।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

Magazine