ভূমিকা : মুসলিম জীবনের মূল লক্ষ্যই হলো পাপ ক্ষমার মাধ্যমে পরকালে জান্নাত লাভ করা। সেই লক্ষ্য পূরণের বড় সহায়ক একটি মাধ্যম হলো আরাফার দিন। এই দিনে ছিয়াম রাখলে মহান আল্লাহ মানুষের দুই বছরের পাপ ক্ষমা করে দেন।[1] এই দিনে এত বেশি মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন, যা অন্য কোনো দিন করেন না।[2] তাই এই দিনের ছিয়াম মুসলিম জাতির কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু চন্দ্রের উদয়ের ভিন্নতায় ঠিক কোন দিনে এই ছিয়াম রাখা উচিত, তা নিয়ে রয়েছে মতের ভিন্নতা। নিম্নে এই বিষয়ে দলীলভিত্তিক আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশা-আল্লাহ।
ছিয়াম শুরু ও শেষ করার মূলনীতি : আরাফার ছিয়াম কবে রাখব সেই উত্তর জানার আগে আমরা ছিয়াম শুরু করা ও শেষ করার মূলনীতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,«صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ، وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ، فَإِنْ غُبِّىَ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلاَثِينَ» ‘তোমরা চাঁদ দেখে ছিয়াম আরম্ভ করো এবং চাঁদ দেখে ছিয়াম শেষ (ঈদ) করো। আকাশ যদি মেঘে ঢাকা থাকে তাহলে শা‘বানের গণনা ৩০ দিন পুরা করো’।[3]
এই হাদীছের আলোকে যে মূলনীতি দাঁড়ায় তা হলো— ‘ছিয়ামের শুরু ও শেষ চাঁদের উদয়ের উপর নির্ভরশীল’। অর্থাৎ স্থানীয় চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখতে হবে এবং চাঁদ দেখে ছিয়াম সমাপ্ত করতে হবে। অল্প কিছু লোক ব্যতীত সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এই মূলনীতির বিষয়ে একমত।
মূলনীতির প্রয়োগ : এই মূলনীতির আলোকে রামাযানের ছিয়াম, আইয়ামে বীযের ছিয়াম, আশূরার ছিয়ামসহ সকল ছিয়াম স্থানীয় উদয়স্থলে চাঁদ দেখার ভিত্তিতেই রাখা হয়। ব্যতিক্রম ঘটেছে শুধু আরাফার ছিয়ামের ক্ষেত্রে। আরাফার ছিয়ামের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরাম দুটি মত দিয়েছেন।
প্রথম মত : হাজীগণ যেদিন আরাফার মাঠে অবস্থান করবেন, সেদিন আরাফার ছিয়াম রাখতে হবে। এর প্রমাণ হিসেবে তারা বলেছেন, আরাফার ছিয়াম সম্পর্কে যতগুলো হাদীছ এসেছে, সবগুলোতেই বলা হয়েছে,يوم عرفة (আরাফার দিন)। যেহেতু হাদীছে ‘আরাফার দিন’ বলা হয়েছে, يوم التاسع (নবম তারিখ) বলা হয়নি, বিধায় আরাফার ছিয়াম ‘তারিখ’ এর সাথে সম্পর্কিত নয়; বরং ‘স্থান’ এর সাথে সম্পর্কিত। আর আরাফা হারামাইনের দেশ সঊদী আরবে অবস্থিত। তাই হজ্জ সম্পাদনকারীগণ যেদিন আরাফার ময়দানে অবস্থান করবেন, সেই দিনই এই ছিয়াম পালন করতে হবে। সেটা যে দেশের যে তারিখই হোক না কেন। এই মতে পক্ষে গিয়েছে শায়খ বিন বাযের তত্ত্বাবধানে লাজনা দায়েমা,[4] দারুল ইফতা আল-মিসরিয়্যা,[5] প্রফেসর ড. হুসামুদ্দীন[6] ও শায়খ সুলায়মান ইবনু আব্দুল্লাহ আল-মাজেদ।[7]
দ্বিতীয় মত : উপরে বর্ণিত হাদীছের আলোকে চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতার ভিত্তিতে নিজ নিজ দেশের নয় তারিখে ছিয়াম রাখতে হবে। আর এই মূলনীতি ফরয ছিয়াম, আইয়ামে বীযের ছিয়াম, আশূরার ছিয়াম, আরাফার ছিয়ামসহ সকল ছিয়ামের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। এই মতের দিকে গিয়েছে মারকাযুল ফাতাওয়া,[8] ইসলাম সওয়াল ওয়া জওয়াব,[9] ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফাতওয়া অ্যান্ড রিসার্চ,[10] আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু উছায়মীন,[11] শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনু জিবরীন,[12] ড. হানী ইবনু আব্দুল্লাহ আল জুবায়র,[13] প্রফেসর ড. আহমাদ আল-হাজ্জী আল-কুরদী[14] ও প্রফেসর ড. খালিদ আল-মুশায়কীহ।[15]
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু উছায়মীন আলাইহিস সালাম-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, অঞ্চলের ভিন্নতায় চাঁদের উদয়স্থল ভিন্ন হওয়ার কারণে আরাফার দিন ভিন্ন ভিন্ন হলে আমরা কি স্থানীয় চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখব, না হারামাইনের চাঁদ দেখার ভিত্তিতে ছিয়াম রাখব?
তিনি উত্তরে বলেছেন, সঠিক কথা হলো— উদয়স্থলের ভিন্নতায় ছিয়াম ভিন্ন ভিন্ন দিনে হবে। ইবনু তায়মিয়্যা আলাইহিস সালামও এই মত গ্রহণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ যদি মক্কায় চাঁদ দেখা যায়, তাহলে এই দিনটি মক্কার নবম তারিখ। কিন্তু কোনো দেশে যদি মক্কার পূর্বে চাঁদ দেখা যায়, তাহলে মক্কার নবম তারিখ হবে তাদের ঈদের দিন। এই দিনে ছিয়াম রাখা তাদের জন্য জায়েয হবে না। কেননা তা তাদের ঈদের দিন। আবার কোনো দেশে যদি মক্কার পরে চাঁদ দেখা যায়, তাহলে মক্কার নবম তারিখ হবে তাদের অষ্টম তারিখ। তাই তারা নিজেরদের নবম তারিখে ছিয়াম রাখবে, যেটা মক্কার দশম তারিখ। এটাই অগ্রগণ্য মত। কারণ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমরা চাঁদ দেখবে তখন ছিয়াম রাখো। আবার যখন চাঁদ দেখেবে তখন ছিয়াম শেষ করো’। দৈনিক সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেমন তারা স্থানীয় সময় হিসাব করে, তদ্রূপ মাসিক সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রেও স্থানীয় সময় হিসাব করবে’।[16]
পর্যালোচনা :
(১) দ্বিতীয় পক্ষ যে হাদীছটি দলীল হিসেবে পেশ করেছেন তা সর্বজন স্বীকৃত একটি মূলনীতি। এই মূলনীতি সকল ছিয়ামের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। যদি কেউ নির্দিষ্ট কোনো ছিয়ামকে এই মূলনীতি থেকে পৃথক করতে চান তাহলে তার জন্য সুস্পষ্ট দলীল উপস্থাপন করা অপরিহার্য। অথচ এর পক্ষে সুস্পষ্ট কোনো দলীল নেই।
(২) হাদীছে يوم التاسع বা নয় তারিখ বলা হয়নি একথা ঠিক, তবে হজ্জের কার্যাবলির ধারাবাহিক বিবরণ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আরাফা নয় তারিখেই হয়ে থাকে। সালাফে সালেহীনগণও এ কথাই বলেছেন।
ইমাম ইবনু কুদামা বলেন, আরাফার দিন হলো যুলহিজ্জা মাসের নবম তারিখ।[17] শামসুদ্দীন আল-খতীব বলেন, আরাফার ছিয়াম যুলহিজ্জার নবম তারিখে, হাজীগণ ছাড়া অন্যরা রাখবে।[18] এছাড়াও ইমাম শামসুদ্দীন রামলী, শায়খুল ইসলাম যাকারিয়া আনছারীসহ বহু বিদ্বান বলেছেন, আরাফার দিন হলো নয় তারিখ।
(৩) প্রথম পক্ষ বলেছেন, আরাফা হলো স্থানের নাম। অতএব হাজীগণ যেদিন আরাফার মাঠে অবস্থান করবেন, সেই দিনেই আরাফার ছিয়াম পালন করতে হবে। কিন্তুعرفة সময়ের নাম, না-কি স্থানের নাম— এই নিয়েও মতভেদ রয়েছে। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী আলাইহিস সালাম বলেন,
«قوله : من عرفة : على وزن فعلة اسم للزمان، وهو اليوم التاسع من ذي الحجة، وهذا هو الصحيح، وقيل: عرفة وعرفات كلاهما اسمان للمكان المخصوص»
عرفة শব্দটি فعلة এর ওযনে এসেছে, যা একটি সময়ের নাম। তা হলো জুলহিজ্জা মাসের নবম তারিখ। আর এই মতটিই বিশুদ্ধ। কেউ কেউ বলেছেন, عرفة ও عرفات দুটিই নির্দিষ্ট স্থানের নাম।[19] এছাড়াও আল্লামা শামসুদ্দীন কিরমানী عرفة দ্বারা উদ্দেশ্য সময় না স্থান, এর মধ্যে সময়কেই প্রাধান্য দিয়েছেন।[20]
[উল্লেখ্য যে, ‘আরাফা স্থানের নাম’ এই মতটি আমার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়। -আল্লাহই ভালো জানেন]।
(৪) তাদের বক্তব্যের প্রমাণে যা পেশ করেছেন তা কোনো সুস্পষ্ট দলীল নয়। বরং তা যুক্তিমাত্র। প্রশ্ন হতে পারে, হাদীছে উল্লিখিতيوم عرفة (আরাফার দিন) শব্দটি কি সুস্পষ্ট দলীল নয়? উত্তর : জি না, এটা সুস্পষ্ট দলীল নয়। কারণ ‘আরাফার দিন’ বলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার ময়দানকে নির্দিষ্ট করেননি। বরং তিনি উক্ত ছিয়াম পালনের সময়টার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আর সেটা হলো নয় তারিখ, যেদিন হাজীগণ আরাফার মাঠে অবস্থান করেন।
(৫) যদি কেউ বলে ‘আরাফার দিন’ বলে নবম তারিখকে বুঝানো হয়নি, বরং আরাফার মাঠে অবস্থান করাকে বুঝানো হয়েছে, তাহলে তাদের কাছে প্রশ্ন, আরাফার দিনটা তাহলে কবে হবে? উত্তর হবে : যেদিন হাজীগণ আরাফার মাঠে অবস্থান করেন। আবার প্রশ্ন করুন, হাজীগণ কবে আরাফার মাঠে অবস্থান করেন? উত্তর হবে : আরাফার দিনে। তাহলে কি তাদের মতানুসারে আরাফার মাঠে অবস্থানের নির্ধারিত কোনো তারিখ নেই? হাজীগণ নিজেদের ইচ্ছা অনুসারে যেকোনো দিনে আরাফার মাঠে অবস্থান করলেই তা আরাফার দিন বলে গণ্য হয়ে যাবে? হাজীগণ যদি সাত কিংবা আট তারিখে আরাফার মাঠে অবস্থান করেন, তাহলে কি সেটা আরাফার দিন বলে গণ্য হবে? অবশ্যই না। তাহলে বুঝা যাচ্ছে, يوم عرفة বা ‘আরাফার দিন’ বলতে নির্ধারিত তারিখকে বুঝানো হয়েছে। নির্ধারিত স্থানকে নয়।
(৬) তাছাড়া কোনো ঘটনা বা বিধান কোনো স্থানে ঘটলেই সেটা স্থানের সাথে খাছ হয়ে যায় না। যেমন ফেরাঊন মূসা আলাইহিস সালাম-কে ধাওয়া করতে গিয়ে লোহিত সাগরে বা বাহরে কুলযুমে ডুবে মারা গিয়েছিল। ফেরাঊনের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার শুকরিয়াস্বরূপ মূসা আলাইহিস সালাম মুহাররমের ১০ তারিখ ছিয়াম রেখেছিলেন।[21] সেই ঘটনাটা তো একটি স্থানে ঘটেছিল এবং সেটা সেই দেশের ১০ তারিখে ঘটেছিল। তাহলে আমরা কেন ছিয়ামটি আমাদের দেশের ১০ তারিখে রাখি? এতে তো সেই দেশের ১০ তারিখ এবং আমাদের ১০ তারিখ ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে? স্থানীয় ১০ তারিখে রাখার কারণ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখো এবং চাঁদ দেখে ছিয়াম ছাড়ো।[22]
(৭) তারা বলেছেন, নিজ নিজ অঞ্চলের উদিত চাঁদের ভিত্তিতে আরাফার ছিয়াম রাখা হলে আরাফা কি তাহলে দুইদিন হবে? এই প্রশ্ন অযৌক্তিক। কারণ রামাযানের ছিয়াম, আশূরার ছিয়াম, লায়লাতুল ক্বদর ইত্যাদি আমরা ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালন করি। তাহলে কি লায়লাতুল ক্বদর ও আশূরা একদিনে হবে, না দুই দিনে হবে? এছাড়া রাতের শেষ-তৃতীয়াংশে আল্লাহর সপ্তম আসমানে নেমে আসার বিষয়টি[23] যুক্তি দিয়ে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। অতএব, উক্ত প্রশ্ন সঙ্গত নয়।
সঊদীর সাথে আরাফা পালন করলে যে সকল সমস্যা হবে :
(১) চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখা ও চাঁদ দেখে ছিয়াম ছাড়ার হাদীছ লঙ্ঘিত হবে।
(২) সঊদী আরবের পশ্চিমের দেশগুলোতে যখন একদিন আগে চাঁদ দেখা যাবে, (২০২১ সালের ঈদুল ফিতরেই যা ঘটেছে।[24]) তখন সঊদী আরবের নয় তারিখের দিন তাদের হবে ১০ তারিখ। অর্থাৎ কুরবানীর দিনে তাদের আরাফার ছিয়াম রাখতে হবে। অথচ কুরবানীর দিনে ছিয়াম রাখা হারাম।[25] তাহলে কি তারা এই ছিয়ামের ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে? একই দিনে ঈদ পালন করা যে বাস্তবতা বিরোধী, তা এবার চাঁদপুরের মানুষের ঈদ উদযাপনের দুঃখজনক ঘটনায় আরও একবার প্রমাণিত হলো। চাঁদপুরের সাদ্রা দরবার থেকে ভোর রাতে ঈদ পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু এই ঘোষণা সবার কাছে না পৌঁছায় একই দিনে ঈদ পালনের অনুসারী হয়েও অনেকে সেদিন ঈদ পালন করতে পারেনি।[26]
(৩) আরাফার ছিয়াম রাখতে হয় ঈদের আগের দিনে। কিন্তু সঊদীর সাথে মিল রেখে আরাফা পালন করা হলে পূর্বাঞ্চলীয় লোকদের আরাফার ছিয়াম ঈদের দুই দিন আগে রাখতে হবে, যা ছহীহ সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
(৪) যুলহিজ্জার চাঁদ উঠার পর থেকেই তাকবীর পাঠ করা সুন্নাত। এটাকে বলা হয় ‘মুতলাক্ব তাকবীর’।[27] আর আরাফার দিন ফজর থেকে অর্থাৎ ছিয়ামের সাথে সাথে আইয়ামে তাশরীকের শেষ দিন (১৩ তারিখ) আছরের ছালাতের পর পর্যন্ত মোট পাঁচ দিন প্রতি ফরয ছালাতের পরে তাকবীর পাঠ করা সুন্নাত। এর নাম ‘মুকায়্যাদ তাকবীর’।[28] কিন্তু সঊদীর সাথে আরাফা পালন করলে পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোর জন্য মুকায়্যাদ তাকবীরের সময়সীমা হবে ছয় দিন। এক্ষেত্রে কি তারা সামঞ্জস্য বজায় রাখায় নিমিত্তে ৮ তারিখে ছিয়াম রাখবে এবং ৯ তারিখ থেকে তাকবীর পাঠ শুরু করবে, না ছিয়াম তাকবীর একই দিনে শুরু করা উচিত?
(৫) প্রযুক্তির কল্যাণে এখন আমরা আরাফার ময়দানে হাজীগণের অবস্থান করাটা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু প্রযুক্তি আবিষ্কার হওয়ার পূর্বে এটা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তখন পূর্বাঞ্চলীয় দেশের লোকজন কীসের ভিত্তিতে আরাফার ছিয়াম পালন করত? তারা কি ‘আরব দেশে সাধারণত একদিন আগে চাঁদ উঠে’ এই নীতির ভিত্তিতে নিজ দেশে চাঁদ না দেখেই অনুমান করে একদিন আগে আরাফার ছিয়াম রাখত, না নিজ দেশে উদিত চাঁদের তারিখের ওপর ভিত্তি করে ছিয়াম রাখত? তাছাড়া কিয়ামতের পূর্বে প্রযুক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে, এমনটা বিভিন্ন হাদীছ থেকে বুঝা যায়।[29] যখন প্রযুক্তি থাকবে না তখন পূর্বাঞ্চলীয় দেশসমূহের লোকেরা অনুমাননির্ভর আরাফার ছিয়াম রাখবে, না নিজ দেশের চাঁদের তারিখ অনুযায়ী রাখবে?
(৬) এর মাধ্যমে তারা নিজেরাই স্ববিরোধিতায় অবতীর্ণ হচ্ছেন :
(ক) হাদীছভিত্তিক মূলনীতিকে লঙ্ঘন করে তারা আরাফার দিন ছিয়াম রাখার কথা বলছেন। কিন্তু পশ্চিমাঞ্চলীয় দেশগুলোর ক্ষেত্রে তারা সেই নীতি থেকে বের হয়ে তাদেরকে নিজ দেশের নয় তারিখে ছিয়াম রাখার কথা বলছেন। কারণ তারা হারামাইনের সাথে আরাফার ছিয়াম পালন করতে গেলে ঈদের দিনে ছিয়াম রাখতে বাধ্য হবে। অথচ তা সম্পূর্ণরূপে হারাম।[30]
(খ) প্রযুক্তি ধ্বংস হলে পুনরায় তারা নিজ মত থেকে ফিরে হাদীছভিত্তিক মূলনীতির দিকে ফিরে আসতে বাধ্য হবেন।
সর্বোপরি এই ফতওয়া সার্বজনীন নয়। বরং কিছু দেশের জন্য প্রযোজ্য, অন্য কিছু দেশের জন্য নয়; কিছু সময়ের জন্য প্রযোজ্য, অন্য সময়ের জন্য নয়।
আর ইসলামের বিধান নির্দিষ্ট সময় কিংবা দেশের সাথে নির্দিষ্ট হতে পারে না। বরং তা সকল দেশ ও সকল সময়ের জন্য যথোপযুক্ত। তাই শুধু একটি শব্দের (عرفة) মাধ্যমে ইসতিদলাল করতে গিয়ে ফতওয়াকে সংকীর্ণ না করে দিয়ে সার্বজনীন ফতওয়ার প্রতি আমল করা উচিত। -(ওয়াল্লাহু আ‘লাম)।
পুনশ্চ : সঊদী আরবের সাথে মিল রেখে আরাফার ছিয়াম পালন করার পক্ষে কয়েকজন বিদ্বান ফতওয়া দিয়েছেন। বিধায় যদি কেউ আট তারিখে ছিয়াম রাখা ভালো মনে করেন, তাহলে রাখতে পারেন। তবে নিজ নিজ অঞ্চলের চাঁদের তারিখ অনুযায়ী নয় তারিখে ছিয়াম রাখাটাই দলীলের সবচেয়ে নিকটবর্তী মত বলে মনে হয়। -(ওয়াল্লাহু আ‘লাম)।
দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা মুহাম্মাদিয়া আরবিয়া, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা; শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৫৭০।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৪৮; মিশকাত, হা/২৫৯৪।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৮১।
[4]. লাজনা দায়েমা, ১০/৪০৫২।
[5]. www.dar-alifta.org ফতওয়া নং ৩৪৭১।
[6]. ফাতাওয়া ইয়াসআলূনাক, ১০/৩৪৮।
[7]. দেখুন : শায়খ সুলায়মান আব্দুল্লাহ আল-মাজেদ এর ওয়েব সাইট, ফতওয়া নং ১৭১৬৫।
[8]. মারকাযুল ফাতাওয়া (islamweb.net), ফতওয়া নং ১০৩৩৫।
[9]. ইসলাম সওয়াল ওয়া জওয়াব (islamqa.info), ফতওয়া নং ৪০৭২০।
[10]. আল-ক্বারারাত ওয়াল ফাতাওয়া, পৃ. ৮২-৮৩।
[11]. মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িল, ২০/৪৭।
[12]. ইবনু জাবরীনের ওয়েব সাইটে দেখুন (http://ibn-jebreen.com)।
[13]. দেখুন,«النور الساطع من أفق الطوالع» পৃষ্ঠা নং ০৭।
[14]. [شبكة الفتاوى الشرعية (http://www.islamic-fatwa.com), ফতওয়া নং ৩৩৯৬৯।
[15]. موقع المسلم (http://almoslim.net/55164)।
[16]. ইসলাম সওয়াল ওয়া জওয়াব (islamqa.info), ফতওয়া নং ৪০৭২০।
[17]. আল-মুগনী, ৪/৪৪৩।
[18]. মুগনিল মুহতাজ, ২/১৮২।
[19]. উমদাতুল কারী, ২/২৫৯।
[20]. الكواكب الدراري في شرح صحيح البخاري ২য় খণ্ড, ১৭৮ পৃষ্ঠা।
[21]. ইবনু মাজাহ, হা/১৭৩৪; ছহীহ বুখারী, হা/৩৯৪২।
[22]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৮১।
[23]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৪৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৫৮; মিশকাত, হা/১২২৩।
[24]. ২০২১ সালের ঈদুল ফিতরের চাঁদ মে মাসের ১২ তারিখে সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তানসহ সাতটি দেশে চাঁদ দেখার সংবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের চাঁদপুরে ৫০ গ্রাম ঈদুল ফিতর উদযাপন করেছেন। সূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১৩ মে ২০২১; The Daily Star; বাংলা ট্রিবিউনসহ আরও অনেক সংবাদ মাধ্যমে এই খবর প্রচারিত হয়েছে।
[25]. আবূ দাঊদ, হা/২৪১৬; ইবনু মাজাহ, হা/১৭২২।
[26]. সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন, ১৩ মে ২০২১।
[27]. সূরা আল-হজ্জ, ২২/২৮; সূরা আল-বাক্বারা, ২/২০৩; ছহীহ বুখারী, অধ্যায় ‘আইয়্যামে তাশরীকে আমল করার ফযীলত’; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৪১।
[28]. আশ-শারহুল মুমতে‘, ৫/২২০-২২৪; মাজমূ‘উল ফাতাওয়া বিন বায, ১৩/১৭।
[29].ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৯৯, ২৯৩৭; মিশকাত, হা/৫৪২২, ৫৪৭৫।
[30]. আবূ দাঊদ, হা/২৪১৬; ইবনু মাজাহ, হা/১৭২২।