কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

সুখী জীবন পেতে হলে...

post title will place here

সুখ কী?

সুখ একটি মানবিক অনুভূতি। সুখ মনের একটি অবস্থা বা অনুভূতি যা ভালোবাসা, তৃপ্তি, আনন্দ বা উচ্ছ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।[1] আমরা সাধারণত মনে করি যে, যদি কারও কাছে জীবনযাপনের জন্য ভালো বাসস্থান, ভালো গাড়ি, বেশি ধনসম্পদ বা ব্যাংক-ব্যালেন্স ইত্যাদি থাকে, তাহলেই সে সুখী। আবার কেউ কেউ মনে করে, ব্যক্তি তার নিজ ইচ্ছামতো জীবনযাপন করতে পারলেই সে সুখী— যদিও এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ চোর যদি সবসময় চুরি করে নিজেকে সুখী মনে করে, ঘুষখোর যদি ঘুষ খেয়ে নিজেকে সুখী মনে করে, অনুরূপভাবে হত্যাকারী যদি হত্যা করে নিজেকে সুখী মনে করে, তাহলে কি এ ধরায় সুখ বলে কোনো জিনিস থাকবে বা আদৌ কোনো সুখ আসবে?

তাছাড়া আবার কেউ কেউ মনে করে, মানুষের কাছে টাকা থাকলেই সুখী। কিন্তু এই ধারণাটাও ঠিক নয়। কারণ এই পৃথিবীতে অসংখ্য বিত্তশালী মানুষ আছেন, যাদের অঢেল সম্পদ তাদের জীবনকে সুখময় করতে পারেনি। তবে এটাকে কিছু ক্ষেত্রে একটা সহায়ক ও মাধ্যম মানা যেতে পারে কেবল। প্রকৃত সুখ-শান্তি রয়েছে আল্লাহর স্মরণে, তাঁর আদেশ-নিষেধ পালনে এবং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণে। আসুন! এবার আমরা সুখী হওয়ার কিছু ইসলামী পদ্ধতি জেনে নিই! 

(১) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের পর সারা জীবন নেক আমল করে যেতে হবে : মহান আল্লাহ বলেন,مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘নর অথবা নারীর মধ্যে যে কেউ মুমিন অবস্থায় সৎকাজ করবে, অবশ্যই আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যা আমল করত, অবশ্যই আমরা তার সর্বোত্তম প্রতিদান দান করব’ (আন-নাহল, ১৬/৯৭)। মুফাসসিরগণের মতে, এখানে ‘হায়াতে তাইয়্যেবা’ বলতে পবিত্র-হালাল রিযিক্ব, অল্পে তুষ্টি, দুনিয়ার পবিত্র ও সুখময় জীবন প্রভৃতিকে বোঝানো হয়েছে। সুখময় জীবনের অর্থ এটাও নয় যে, একজন মুমিনের জীবনে কোনো রকমের দুঃখ-কষ্ট, অসুখ-বিসুখ আসবে না; বরং এগুলো আসলেও একজন মুমিন ঈমান-ইসলামের উপর টিকে থাকবে, অল্পে তুষ্টি জীবনযাপনে অভ্যস্ত হবে। আর এসবের বিনিময়ে আখেরাতের সুমহান, চিরস্থায়ী নেয়ামতের আশাবাদী হবে। তখন তার জীবন সুখময় হবে।[2] 

অপর দিকে, যদি কেউ আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে থাকে, তার জীবন সুখময় হতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ থাকবে, নিশ্চয় তার জীবনযাপন হবে সঙ্কুচিত আর আমরা তাকে ক্বিয়ামতের দিন অন্ধ করে সমবেত করব’ (ত্ব-হা, ২০/১২৪)। তাদের দুনিয়ার জীবন সংকীর্ণ হবে। তাদের কাছ থেকে অল্পে তুষ্টির গুণ ছিনিয়ে নেওয়া হবে এবং সাংসারিক লোভ-লালসা বাড়িয়ে দেওয়া হবে, যা তাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলবে। ফলে তাদের কাছে যত অর্থসম্পদই সঞ্চিত হোক না কেন, আন্তরিক শান্তি তাদের ভাগ্যে জুটবে না। সদাসর্বদা সম্পদ বৃদ্ধি করার চিন্তা এবং ক্ষতির আশঙ্কা তাদেরকে অস্থির করে তুলবে। কেননা সুখ-শান্তি অন্তরের স্থিরতা ও নিশ্চিন্ততার মাধ্যমেই অর্জিত হয়; শুধু প্রাচুর্য্যে নয়।[3]

(২) আখেরাতকে মূল উদ্দেশ্য বানাতে হবে : আমরা এই দুনিয়াতে হালাল পদ্ধতিতে যাই কিছু করি না কেন, এর মাধ্যমে সর্বদা পরকালের জীবনকে সুখময় করার নিয়্যত রাখতে হবে, তাহলে এই জীবনটাও সুখময় হবে ইনশা-আল্লাহ। মহান আল্লাহ বলেন,­ ‘যে কেউ আখেরাতের ফসল কামনা করে, তার জন্য আমরা তার ফসল বাড়িয়ে দেই এবং যে কেউ দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমরা তাকে তা থেকে কিছু দেই। আর আখেরাতে তার কোনো অংশ থাকবে না’ (আশ-শূরা, ৪২/২০)। অতএব, একজন মুমিনের উচিত আখেরাতমুখী হওয়া। যে আখেরাতমুখী হবে, সে দুনিয়া ও আখেরাত সব জায়গায় সুখে থাকবে। 

(৩) তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি : আমরা যদি আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে জীবন পরিচালনা করি, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা আমাদের দুনিয়াবী সমস্যা-সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দিবেন, আমাদের কাজকর্ম সহজ করে দিবেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا ‘আর যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে চলবে, তিনি তার জন্য চলার পথ সুগম করে দেবেন’ (আত-ত্বলাক, ৬৫/২)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করবে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দিবেন’ (আত-তালাক, ৬৫/৪)

(৪) আল্লাহর উপর ভরসা করা : জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদেরকে আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে। যখনই কোনো কাজের জন্য দৃঢ় সংকল্প করব, তখনই আল্লাহর উপর ভরসা করব। যখন আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য যথেষ্ট হবেন, তখন ইনশা-আল্লাহ জীবন সুখময় হয়ে যাবে। তবে ভরসার এর অর্থ এই নয় যে, আমরা হাত-পা গুটিয়ে কাজকর্ম না করে বসে থাকব। বরং প্রথমে মাধ্যম গ্রহণ করতে হবে, তারপর আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। যেমনটা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদের ভরসা করতে শিখিয়েছেন। এক ছাহাবী জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি আমার উটকে ছেড়ে দিয়ে ভরসা করব, না-কি বেঁধে রেখে? উত্তরে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, اعْقِلْهَا وَتَوَكَّلْ ‘সেটাকে বাঁধো এবং ভরসা করো’।[4]

অতএব, আমাদেরকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতো ভরসা করতে হবে, ছাহাবীদের মতো ভরসা করতে হবে এবং ভরসা করার মতো ভরসা করতে হবে, তাহলে জীবনে সফলকাম হতে পারা যাবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট হবেন’ (আত-তালাক, ৬৫/৩)। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথার্থ রূপে আল্লাহর উপর ভরসা করার উপমা দিয়ে বলেন, ‘যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহর উপর ভরসা করতে, তাহলে তিনি অবশ্যই তোমাদেরকে পাখির মতো রিযিক্ব দান করতেন। ভোরবেলা পাখিরা খালি পেটে (বাসা থেকে) বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যাবেলা উদর পূর্তি করে (বাসায়) ফিরে আসে’।[5]

(৫) সন্তুষ্ট থাকা : আমরা সাধারণত নিজের উপর আল্লাহর প্রদত্ত অনুগ্রহ লক্ষ করি না। অন্যের উপর আল্লাহর যে অনুগ্রহ রয়েছে, তা বেশি লক্ষ করে থাকি বলেই আমরা খুব বেশি অসন্তুষ্ট থাকি। অথচ উচিত ছিল যে, আমরা সদাসর্বদা পার্থিব বিষয়ে আমাদের থেকে নিচে যারা আছে, তাদের লক্ষ করব। যাতে করে বুঝতে পারি যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে অনেক কিছু দিয়েছেন এবং নিজে সন্তুষ্ট থাকতে পারি। যেমনটা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের মানুষদের প্রতি লক্ষ করবে, তোমাদের চেয়ে ঊর্ধ্বতন মানুষদের দিকে তাকাবে না। এটি বেশি উপযুক্ত যে, এতে তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহ তাআলার নেয়ামাতকে নগণ্য মনে করবে না’।[6]

অনুরূপভাবে আমরা যদি এই হাদীছের উপর গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করি, তাহলে বুঝতে পারব যে, আমরা কত সুখে আছি। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি নিজ বাসস্থানে বা পরিবারে নিরাপদে সকালে উপনীত হয়, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে এবং তার নিকট সারা দিনের খোরাকি থাকে, তবে তার জন্য যেন গোটা দুনিয়াটাই একত্র করা হলো’।[7] তাছাড়া একজন মুমিনের জন্য উচিত নয় যে, সে ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করবে আর হতাশায় ভুগতে থাকবে। বরং ভবিষ্যতের জন্য চেষ্টা করতে হবে আর বর্তমানে যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এটা না হলে সুখী হওয়া সম্ভব নয়। এর একটা উদাহরণ দিলে জিনিসটা বেশি স্পষ্ট হয়ে যাবে ইনশা-আল্লাহ।

এক ছেলে মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসে, তাই সে তার পিতার কাছে আবেদন করে মিষ্টি খেতে চায়, তখন তার পিতা তাকে কিছু মিষ্টি এনে দেন। যখন সে মিষ্টিগুলো খেতে বসে তখন সে মিষ্টি খায় আর খুব কাঁদতে শুরু করে! তার পিতা জিজ্ঞেস করে তুমি তো মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাস তাহলে কাঁদছ কেন? উত্তরে সে বলে যে, আমি মিষ্টি খেতে ভালোবাসি আর আপনার কাছে এগুলো আবেদন করে পেলাম। কিন্তু আমার চিন্তা হচ্ছে যে, এগুলো খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে আর মিষ্টি আমার কাছে থাকবে না বলেই আমি কাঁদছি। তখন তার পিতা বলল, ‘ধুর! এরকম বোকামি করলে হয়? তোমার কাছে এখন যা আছে তা তো আনন্দ সহকারে খাও, তারপর না হয় আবার চাইবে তখন আমি আবার দিব! কিন্তু তুমি এরকমভাবে ভবিষ্যৎ নিয়ে কাঁদলে হবে?’ এই উদাহরণ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। 

(৬) ভাগ্যের প্রতি রাযী-খুশী থাকা : একজন প্রকৃত মুমিনের উপর এটা অপরিহার্য বিষয় যে, তিনি তাক্বদীর তথা ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস করে জীবনযাপন করবেন। যেহেতু মুমিনদের জীবনের প্রতিটি সংঘটিত বিষয় আগে থেকেই লিখা থাকে। যখন সে এটা বিশ্বাস করে চলবে, তখন তার দুঃখ-কষ্ট বেশি হবে না এবং ধৈর্যধারণ করার ক্ষমতা পেয়ে যাবে আর তখনই জীবন সুখময় হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যমীনে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে কোনো বিপদ-বিপর্যয় আসে না কেন, তা আমি সংঘটিত করার পূর্বে একটি কিতাবে লিপিবদ্ধ রেখেছি, আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ। এটা এজন্য যে, যাতে তোমরা যা হারিয়েছ, সেজন্য যেন তোমরা হতাশাগ্রস্ত না হও এবং যা তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন তার জন্য ‍উল্লসিত না হও। আল্লাহ পছন্দ করেন না উদ্ধত ও অহংকারীদেরকে’ (আল-হাদীদ, ৫৭/২২-২৩)। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنْ أَصَابَك شَيْء فَلَا تَقُلْ لَوْ أَنِّي فَعَلْت كَانَ كَذَا وَكَذَا وَلَكِنْ قُلْ قَدَّرَ اللَّه وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ "لَوْ" تَفْتَح عَمَل الشَّيْطَان ‘যদি তোমাকে কোনো বিপদ পেয়ে বসে, তখন তুমি এভাবে বলো না, যদি আমি এটা করতাম তাহলে এরকম এরকম হতো। বরং তোমরা বলবে, আল্লাহ এটাই ভাগ্যে রেখেছিলেন, আর তিনি যা চেয়েছেন, তাই করেছেন। কেননা (لَوْ) তথা “যদি” শব্দটি শয়তানের কাজের পথকে খুলে দেয়’।[8]

(৭) ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা : একজন প্রকৃত মুমিনের বিপদের সময় ধৈর্যধারণ করা এবং খুশীর সময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এক দারুণ বৈশিষ্ট্য, যা একজন মুমিনের জীবনকে সুখময় করার বড় মাধ্যম। এ প্রসঙ্গে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মুমিনের অবস্থাটি বড়ই বিস্ময়কর। তার সকল কাজই তার জন্য কল্যাণকর। এমনটা মুমিন ছাড়া অন্য কারো হয় না। যদি তাকে আনন্দদায়ক কোনো কিছু পেয়ে বসে, তবে তিনি শুকরিয়া আদায় করেন, ফলে সেটি তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়। আর তাকে অসচ্ছলতা বা দুঃখ-কষ্ট পেয়ে বসলে, তাতে তিনি ছবর করেন, ফলে সেটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়’।[9]

(৮) মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করা : আমরা যদি আমাদের জীবনকে সুখময় করতে চাই, তাহলে একা একা সুখী থাকার চেষ্টা করলে হবে না; বরং নিজের পাশাপাশি নিজের আত্মীয়স্বজন, অন্য মুসলিম ভাইদের আপদ-বিপদেও বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে হবে। তাহলেই আল্লাহ তাআলা আমাদের সাহায্য করবেন। আর এভাবে আমরা প্রভূত সুখময় জীবন লাভ করতে পারব ইনশা-আল্লাহ। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্ত লোকের জন্য সহজ ব্যবস্থা (দুর্দশা লাঘব) করবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দুর্দশা মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের ক্রটি গোপন রাখবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার ক্রটি গোপন রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে, আল্লাহ ততক্ষণ তার সাহায্যে নিয়োজিত থাকেন’।[10]

(৯) ছালাত আদায় করা : সফলকাম ও সুখময় জীবনের একটা বড় মাধ্যম হচ্ছে ছালাত, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। যখন বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে, তখন আল্লাহ তাআলা তাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন। আল্লাহ তাআলা ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ ‘আর তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো’ (আল-বাক্বারা, ২/৪৫)। অনুরূপভাবে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর কোনো দুঃখ-কষ্ট আসলে তিনি ছালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন। হাদীছে এসেছে,كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا حَزَبَهُ أَمْرٌ صَلَّى ‘যখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর কোনো কিছু গুরুতর হতো, তখন তিনি ছালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন’।[11] 

(১০) তওবা ও ইস্তেগফার : জীবনেকে সুখময় করতে হলে গুনাহ থেকে ফিরে এসে বেশি বেশি ইস্তেগফার তথা ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে। ইস্তেগফার করলে যেমন পরকালে বদলা পাওয়া যাবে, ঠিক তেমনি ইহকালেও এর অসীম বদলা পাওয়া যাবে। 

একবার এক ব্যক্তি হাসান বাছরী রাহিমাহুল্লাহ-এর মজলিসে অনাবৃষ্টির অভিযোগ করলে তিনি বললেন, আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করো। অপর এক ব্যক্তি দারিদ্রের অভিযোগ করল। তৃতীয় এক ব্যক্তি বলল, আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। চতুর্থ এক ব্যক্তি বলল, আমার ফসলের মাঠে ফলন খুব কম হচ্ছে। তিনি সবাইকে একই জবাব দিলেন। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করো। লোকেরা বলল, ‘কী ব্যাপার! আপনি প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগের একই প্রতিকার বলে দিচ্ছেন? তখন তিনি সূরা আন-নূহের ১০-১২ নম্বর আয়াতগুলো পাঠ করে শুনালেন।[12]

অতএব, জীবনের বদ্ধ দুয়ারগুলো খোলার জন্য আপনার হাতে একটা চাবি আছে। সেই চাবির নামই হলো ‘ইস্তেগফার’। চাবিটা ব্যবহার করে নিজের শেষ সম্বল গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আজ থেকেই তৎপর হতে পারেন। ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ শব্দটাকে বানিয়ে নিতে হবে জীবনের নিত্যসঙ্গী।[13]

শেষ কথা হলো এই যে, জীবনে সুখী থাকা সমুদ্রের সাঁতার শেখার মতো, যেটা খুব সহজে সম্ভব নয়; এর জন্য পরিশ্রম করতে হবে। ঠিক তেমনি সুখী হতে হলে বিভিন্নভাবে আমাদেরকেও চেষ্টা করতে হবে। আর এটা বিশ্বাস রাখতে হবে যে, জীবনে দুঃখ-কষ্ট আসবে এটাই বাস্তব। এই পৃথিবীতে কেউ শত ভাগ সুখী হতে পারে না। তবে তুলনামূলক কম বা বেশি সুখী হতে পারে। যেমনটা শায়খ ইবনু উছয়মীন রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘এ ধরায় একজন মানুষ সর্বদা খুশী থাকবে এটা অসম্ভব, বরং সে এক দিন খুশী হয়, আরেক দিন দুঃখিত হয়। একদিন সে (তার ঈপ্সিত বস্তু) পায় আবার আরেক দিন সে পায় না’।[14]

তবে এর জন্য মুমিনরা বেশি চিন্তিত বা বিচলিত হন না। কারণ তাদের ব্যাপারটা খুবই বিস্ময়কর এবং তাদের প্রত্যেকটা ব্যাপারই কল্যাণকর। তারা সুখ-শান্তি লাভ করলে শুকরগুজার করে আর দুঃখ-কষ্টে আক্রান্ত হলে ছবর করে। আর এভাবে প্রত্যেকটা জিনিসই তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়।

আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের সবাইকে তার দেওয়া বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করার তাওফীক্ব দান করেন আর আমাদের জীবনকে সুখময় করেন- আমীন!

তাওহীদুর রহমান সালাফী

 ফারেগ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বানারাস, ভারত।


[1]. উইকিপিডিয়া।

[2]. তাফসীরে যাকারিয়া, সূরা আন-নাহল, ১৬/৯৭-এর তাফসীর দ্রষ্টব্য।

[3]. তাফসীর ইবনে কাছীর; ফাতহুল ক্বাদীর; গৃহীত : তাফসীরে যাকারিয়া, সূরা ত্বো-হা, ২০/১২৪-এর তাফসীর থেকে।

[4]. তিরমিযী, হা/২৫১৭, হাদীছ হাসান।

[5]. ইবনু মাজাহ, হা/৪১৬৪, হাদীছ ছহীহ। 

[6]. তিরমিযী, হা/২৫১৩, হাদীছ ছহীহ।

[7]. তিরমিযী, হা/২৩৪৬, হাদীছ হাসান।

[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৬৪; মিশকাত, হা/৫২৯৮; আল-আহকামু আশ-শারীআতুল কুবরা, ৩/৪৬১।

[9]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৯৯।

[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯৯।

[11]. আবূ দাঊদ, হা/১৩১৯; হাদীছ হাসান; মিশকাত, হা/১৩২৫।

[12]. তাফসীর ইবনে কাছীর; কুরতুবী; গৃহীত : তাফসীরে যাকারিয়া, সূরা আন-নূহ, ৭১/১০-১২-এর তাফসীর থেকে।

[13]. লেখক আরিফ আযাদ।

[14]. ইবনু উছায়মীন, রিয়াযুছ ছালেহীন, ১/২৪৩।

Magazine