কুফর একটি স্পর্শকাতর বিষয়। উপযুক্ত কারণ ছাড়া কারো প্রতি কুফরের হুকুম আরোপ করা যায় না। দুনিয়াতে সবচেয়ে জঘন্য পাপ হচ্ছে কুফর। কুফরের সাথে মৃত্যুবরণ করলে তার জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী জাহান্নাম। সম্প্রতি আমাদের মাঝে একে অপরকে কাফের বলার প্রবণতা খুব বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর পরিণতি ও ভয়াবহতা অনেকেই জানে না। ফলে বেপরোয়াভাবে মুখ চালাতে দেখা যায়। উলামায়ে কেরাম কাউকে কাফের বলার ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতেন।
মুসলিমকে কাফের বলা নিষেধ:
কোনো মুসলিমকে উপযুক্ত কারণ ছাড়া কাফের বলে সম্বোধন করা কোনোভাবেই জায়েয নেই। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لاَ يَرْمِى رَجُلٌ رَجُلاً بِالْفُسُوقِ وَلاَ يَرْمِيهِ بِالْكُفْرِ إِلاَّ ارْتَدَّتْ عَلَيْهِ إِنْ لَمْ يَكُنْ صَاحِبُهُ كَذَلِكَ ‘একজন অপরজনকে ফাসেক্ব বলে যেন গালি না দেয় এবং একজন অন্যজনকে কাফের বলে অপবাদ না দেয়। কেননা অপরজন যদি তা না হয়, তবে সে অপবাদ তার নিজের উপরই আপতিত হবে’।[1] ইবনু হাজার আসক্বালানী রাহিমাহুল্লাহ এ হাদীছের ব্যাখ্যায় লিখেছেন,فَإِنْ كَانَ لَيْسَ كَمَا قَالَ كَانَ هُوَ الْمُسْتَحِقُّ لِلْوَصْفِ الْمَذْكُورِ وَأَنَّهُ إِذَا كَانَ كَمَا قَالَ لَمْ يَرْجِعْ عَلَيْهِ شَيْءٌ لِكَوْنِهِ صَدَقَ فِيمَا قَالَ অর্থাৎ ‘সে অপর ব্যক্তিকে যা বলেছে, যদি সে বাস্তবে এরকম না হয়ে থাকে, তবে সে নিজেই উল্লেখিত অপবাদের উপযুক্ত হবে। আর যদি ঐ ব্যক্তি বাস্তবেই সে রকম হয়ে থাকে, তাহলে সে সত্য বলার কারণে তার উপর কোনো কিছু আরোপিত হবে না’।[2] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,أَيُّمَا امْرِئٍ قَالَ لأَخِيهِ يَا كَافِرُ فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا إِنْ كَانَ كَمَا قَالَ وَإِلاَّ رَجَعَتْ عَلَيْهِ ‘কেউ তার ভাইকে কাফের বলে সম্বোধন করলে উভয়ের একজনের উপর তা ফিরে আসবে। যাকে কাফের বলা হয়েছে সে কাফের হলে তো (সমস্যা নেই), অন্যথা কথাটি বক্তার উপরই ফিরে আসবে’।[3] হাদীছে আরও এসেছে,مَنْ رَمَى مُؤْمِنًا بِكُفْرٍ فَهْوَ كَقَتْلِهِ ‘যে কোনো মুমিনকে কুফরের অপবাদ দেওয়া, তাকে হত্যা করার মতোই’।[4] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,أَيُّمَا رَجُلٍ مُسْلِمٍ أَكْفَرَ رَجُلاً مُسْلِمًا فَإِنْ كَانَ كَافِرًا وَإِلاَّ كَانَ هُوَ الْكَافِرَ ‘কোনো মুসলিম অপর মুসলিমকে কাফের বললে সে যদি তা না হয়, তাহলে ঐ ব্যক্তি নিজেই কাফের’।[5] ইমাম আবুল মা‘আলী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, أَنَّ إدْخَالَ كَافِرٍ فِي الْمِلَّةِ، وَإِخْرَاجَ مُسْلِمٍ عَنْهَا عَظِيمٌ فِي الدِّينِ ‘কোনো কাফেরকে মুসলিম বলে চালিয়ে দেওয়া এবং কোনো মুসলিমকে দ্বীন থেকে বের করে দেওয়া উভয়টাই দ্বীনে গুরুতর বিষয়’।[6] এ বিষয়ে শায়খ ইবনু উছায়মীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন,وَهَذَا هُوَ الْمَحْذُوْرُ الثَّانِيْ أَعْنِيْ عَوْدَ وَصْفِ الْكُفْرِ عَلَيْهِ إِنْ كَانَ أَخُوْهُ بَرِيْئًا مِنْهُ، وَهُوَ مَحْذُوْرٌ عَظِيْمٌ يُوْشِكُ أَنْ يَقَعَ بِهِ ‘আর এটা দ্বিতীয় সতর্কতার বিষয় যে, যদি তার অপর ভাই কুফরমুক্ত হয়, তবে কুফরের দোষটা তার দিকেই ফিরবে। এটি এতটা ভয়ানক বিষয়, যাতে সে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা করা হয়’।[7]
কাফের বলার অনুমতি ও সাবধানতা:
অমুসলিমরা তো স্পষ্ট কাফের। তাদেরকে কাফের বলতে নিষেধাজ্ঞা নেই। বরং তাদের কুফরকে কুফর মনে না করলে অথবা তাদের কুফরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে ঈমান চলে যাবে। মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন,مَنْ لَمْ يُكَفِّرِ الْمُشْرِكِيْنَ أَوْ شَكَّ فِيْ كُفْرِهِمْ أَوْ صَحَّحَ مَذْهَبَهُمْ كَفَرَ ‘যে ব্যক্তি মুশরিকদের কাফের বলে না অথবা তাদের কুফরীতে সন্দেহ করে কিংবা তাদের মতাদর্শকে সঠিক মনে করে, সে কাফের হয়ে গেলো’।[8]
অনুরূপভাবে কোনো মুসলিমের পক্ষ থেকেও যদি এমন কোনো কথা বা কাজ প্রকাশ পায়, যা স্পষ্ট কুফর তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। যেমন— কেউ যদি বড় শিরক করে, আল্লাহর কোনো বিধান অস্বীকার করে, দ্বীনের কোনো অকাট্য বিষয়কে অপছন্দ করে, সেগুলো নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে, আল্লাহর মনোনীত ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনীত জীবনব্যবস্থার তুলনায় অন্য কোনো জীবনব্যবস্থাকে উত্তম মনে করে, তাহলে সে মুরতাদ ও কাফের হয়ে যাবে।[9]
সতর্কতা:
কারো থেকে কুফর প্রকাশ পেলে তাকে কাফের বলে ঘোষণা দেওয়া সাধারণ মানুষের কাজ নয়; বরং উলামায়ে কেরাম ঐ ব্যক্তির সার্বিক অবস্থা যাচাই-বাছাই করে তাকফীরের মূলনীতি সামনে রেখে কাফের ফতওয়া দিবেন। ফাতওয়া লাজনা দায়েমায় রয়েছে,وَالْوَاجِبُ التَّثَبُّتُ فِيْ هَذِهِ الْأُمُوْرِ وَعَدَمُ التَّعَجُّلِ بِالتَّكْفِيْرِ حَتَّى يَتَّضِحَ الدَّلِيْلُ ‘কাউকে কাফের বলার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হলো ব্যাপারগুলো যাচাই-বাছাই করা এবং দলীল স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তাকফীর করার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করা’।[10] শারহু আক্বীদাতুত ত্বাহাবীতে রয়েছে, اَلْقَاعِدَةُ الْأَخِيْرَةُ: أَنَّهُ لَا يَتَنَاوَلُ التَّكْفِيْرَ إِلَّا الرَّاسِخُوْنَ فِي الْعِلْمِ ‘সর্বশেষ মূলনীতি হচ্ছে, তাকফীরের কাজ আঞ্জাম দিবেন কেবল গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেমগণ’।[11]
কাউকে কাফের ঘোষণা দেওয়ার ক্ষেত্রে খারেজীদের ন্যায় বাড়াবাড়ি করা যাবে না। একইভাবে মুরজিয়াদের ন্যায় ছাড়াছাড়ি করে কাফের বা মুরতাদকে মুসলিম আখ্যা দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মধ্যমপন্থার মূলনীতি অনুসরণ করতে হবে।[12]
কুফরের হুকুম আরোপে প্রতিবন্ধকতাসমূহ:
অল্প বিদ্যার অধিকারী অনেকেই সামান্য বিষয়ে হুট করে অন্যকে কাফের বলে দেয়। এক্ষেত্রে মূলনীতির কোনো তোয়াক্কা করে না। তাদের জেনে রাখা উচিত, কারো থেকে কুফর প্রকাশিত হলেও তার মাঝে কিছু বিষয় পাওয়া গেলে তাকে কাফের বলা যায় না। বরং শুধু তার কাজটাকে কুফরী বলা হয়। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,أن الكفر لا يطلق على كل من عمل الكفر، بل يقال: من عمل هذا العمل فهو كافر، أو هذا العمل كفر، أو يقال لمن عمله من عمل عملك فهو كافر، وهكذا من الألفاظ المجملة ‘কুফর করে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির উপর কুফরীর হুকুম আরোপ করা যায় না; বরং বলা হবে, ‘যে ব্যক্তি এ কাজ করবে, সে কাফের’ অথবা বলবে, ‘এই কাজটি কুফরী’ অথবা যে ঐ কুফরী কাজটি করে তাকে বলা হবে, ‘তোমার মতো কাজ যে করবে, সে কাফের। এ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করা উচিত।[13] যেসব বিষয়ের কারণে কাউকে কাফের বলা যায় না, সেগুলোকে পরিভাষায় বলা হয় ‘মাওয়ানেউত তাকফীর’ তথা কাফের বলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাসমূহ। এগুলো মোট সাতটি। যথা-
(১) জাহালাত তথা অজ্ঞতা: জমহূর উলামায়ে কেরাম অজ্ঞতাকে ওযর হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু যরূরতে দ্বীন তথা দ্বীনের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়াবলি (যেমন— ছালাত, পর্দা, হজ্জ ইত্যাদি) ক্ষেত্রে এ ওযর গ্রহণযোগ্য নয়।[14]
(২) তা’বীল তথা ব্যাখ্যা পেশ করা: কেউ যদি তার কুফরীর বিষয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পেশ করে অথবা তার কুফরীটি সন্দেহপূর্ণ হয়, তাহলে তাকে তাকফীর করা যাবে না। তবে যরূরতে দ্বীনের ক্ষেত্রে তা’বীলকে ওযর ধরা হবে না।[15]
(৩) ইকরাহ তথা কুফরীতে বাধ্যকরণ: জীবন নাশের আশঙ্কা থাকা অবস্থায় কাউকে কুফরীতে বাধ্য করার কারণে তার থেকে যে কুফর প্রকাশ পায়, তা ওযর হিসেবে গণ্য হবে (আন-নাহল, ১৬/১০৬)।
(৪) ভুল করা: কেউ ভুলবশত মুখে কুফরী উচ্চারণ করে ফেললে তাকে তাকফীর করা যাবে না (আল-আহযাব, ৩৩/৫)।[16]
(৫) অক্ষমতা: নির্জন মরুভূমি বা দ্বীপে থাকার কারণে যার কাছে দ্বীনের জরুরী বিষয়গুলো পৌঁছেনি তাকে তাকফীর করা যাবে না।[17]
(৬) নতুন ইসলাম গ্রহণ: কোনো নওমুসলিম থেকে যদি এমন কুফর প্রকাশ পায় যে বিষয় সম্পর্কে সে সম্যক অবগত নয়, তাহলে তাকে তাকফীর করা হবে না।[18]
(৭) বড় কুফর প্রতিরোধে ছোট কুফর করা।[19]
উল্লিখিত বিষয়ের কোনো একটি ঐ ব্যক্তির মাঝে পাওয়া গেলে তাকে কাফের বলা যায় না; বরং শুধু তার কাজটাকে কুফরী বলতে হয়। কুফর ও তাকফীরের বিষয়গুলো স্পর্শকাতর। শারঈ দলীল ব্যতীত কাউকে কাফের বলা যাবে না। অন্যথায় এ কুফর নিজের দিকেই ফিরে আসবে। সুতরাং এ ব্যাপারে সবার সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কাউকে কাফের বলার আগে উক্ত বিষয়ে অভিজ্ঞ আলেমদের শরণাপন্ন হওয়া অপরিহার্য।
পরিচালক, দারুস সুন্নাহ মডেল মাদ্রাসা, খিলক্ষেত, ঢাকা।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৪৫; মিশকাত, হা/৪৮১৬।
[2]. ফাতহুল বারী, ১০/৪৬৬।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬০।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১০৫।
[5]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬৮৭, হাদীছ ছহীহ।
[6]. নায়লুর আওত্বার, ৭/১৯৯।
[7]. ইবনু উছায়মীন, মাজমূউ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েল, ৭/৪২, ২/১৩৪।
[8]. শায়খ বিন বায, মাজমূ ফাতাওয়া, ১/১৩১।
[9]. শারহু নাওয়াক্বিযুল ইসলাম, পৃ. ৯৭-১২৮।
[10]. ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা, ২/১৩৯, ফতওয়া নং ৪৪৪৬।
[11]. শরহে আক্বীদাতুত ত্বাহাবী, পৃ. ৯২।
[12]. শরহে আক্বীদাতুত ত্বাহাবী, পৃ. ৯১।
[13]. মাজমাউল ফাতাওয়া, ১২/৫২৫।
[14]. ইকফারুল মুলহেদীন, পৃ. ৭১।
[15]. প্রাগুক্ত।
[16]. ইবনু মাজাহ, হা/২০২৩।
[17]. মাজমুউল ফাতাওয়া ইবনু উছায়মীন, ২/১৩৬
[18]. তিরমিযী, হা/২১৮০; ফাতাওয়া শাবকাতুল ইসলামিয়্যা, হা/৩৭৩৪।
[19]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০৩১।