কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আল-কুরআনে মানুষ: মর্যাদা ও স্বরূপ বিশ্লেষণ

post title will place here

মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মানবজাতির কল্যাণের আধার। মানুষের সঠিক পথের দিশা দিতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ হলো আল-কুরআন। এটি সুদীর্ঘ ২৩ বছর যাবৎ বিভিন্ন সময় ও পরিস্থিতির আবর্তে মানুষের কল্যাণ সাধনের নিমিত্তে গাইডবুক হিসেবে নাযিল হয়েছে। এতে মানবজীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সমস্যা ও তার সমাধানের বর্ণনা বিবৃত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ ‘আমরা কিতাবে (কুরআনে) কোনোকিছুই বাদ দেইনি’ (আল-আনআম, ৬/৩৮)। অন্যত্র আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে,وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ ‘আর আমরা আপনার উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছি প্রতিটি বস্তুর বিশদ বর্ণনাকারী ও মুসলিমদের জন্য পথনির্দেশক, দয়া ও সুসংবাদ দানকারী হিসেবে’ (আন-নাহল, ১৬/৮৯)

মানুষ আল্লাহ তাআলার অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে এক অনন্য ও অসাধারণ সৃষ্টি। মানুষই একমাত্র সৃষ্টিজীব, যাদের রয়েছে বিবেক ও বোধশক্তি। এ বিবেকই তাদের চালিকাশক্তি এবং আল্লাহপ্রদত্ত কল্যাণের অনুসন্ধানী। ফলে মানুষকে তিনি বহু মাখলূকাতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভকারী সৃষ্টি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন (বানী ইসরাঈল, ১৭/৭০)। এ পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে, তার সবই মানুষের কল্যাণের জন্য। মহান আল্লাহ আপন কৃপায় সেসব সৃষ্টিজীবকে মানুষের অনুগত ও বশ্য করে দিয়েছেন। যদিও তারা আকার-আকৃতিতে শক্ত ও দেহাবয়বের দিক থেকে মানুষের চেয়ে অনেক বড়। এ মর্মে তিনি ইরশাদ করেন,أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ وَالْفُلْكَ ‘আপনি কি লক্ষ্য করেননি, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্য বশীভূত করে দিয়েছেন পৃথিবীতে যা কিছু আছে তৎসমুদয়কে’ (আল-হাজ্জ, ২২/৬৫)। মানুষের সৃষ্টি মহান আল্লাহর একক ইচ্ছার প্রতিফলন মাত্র। মহান আল্লাহ দুই ধরনের উপাদান দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।[1]

প্রথমত, মাটি থেকে: অতঃপর তাতে রূহ প্রবেশ করিয়েছেন। যেমন— আদম আলাইহিস সালাম-এর সৃষ্টি। কুরআনে এসেছে,الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنسَانِ مِنْ طِينٍ - ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ ‘যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন এবং কর্দম হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর তিনি তার বংশ উৎপন্ন করেছেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস হতে। তারপর তিনি তাকে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং তাতে ফুঁকে দিয়েছেন তার (সৃষ্ট) রূহ এবং তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ; তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো’ (আস-সাজদা, ৩২/৭-৮)। অন্যত্র সরাসরি পৃথিবীতে মানব আদম আলাইহিস সালাম-এর সৃষ্টি সম্পর্কে তিনি বলেন,وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ - فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ ‘(স্মরণ করুন) যখন আপনার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আমি গন্ধযুক্ত কর্দমের শুষ্ক ঠনঠনে মৃত্তিকা হতে মানুষ সৃষ্টি করব। সুতরাং যখন আমি তাকে সুবিন্যস্ত করব এবং তাতে আমার পক্ষ হতে রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হবে’ (আল-হিজর, ১৫/২৮-২৯)

দ্বিতীয়ত, বীর্য থেকে: মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে বীর্য থেকে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ - ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَكِينٍ - ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَامًا فَكَسَوْنَا الْعِظَامَ لَحْمًا ثُمَّ أَنشَأْنَاهُ خَلْقًا آخَرَ فَتَبَارَكَ اللهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ ‘অবশ্যই আমরা তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকার নির্যাস হতে, অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে স্থাপন করেছি সংরক্ষিত আধারে, অতঃপর শুক্রবিন্দুকে জমাটবদ্ধ-ঝুলন্ত মাংসে, অতঃপর জমাটবদ্ধ-ঝুলন্ত মাংসকে পরিণত করি মাংসপিণ্ডে এবং মাংসপিণ্ডকে পরিণত করি অস্থি-পাঞ্জরে, অতঃপর অস্থি-পাঞ্জরকে ঢেকে দেই গোশত দ্বারা। অবশেষে তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব, সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান’ (আল-মুমিনূন, ২৩/১২-১৪)। অন্যত্র সৃষ্টি সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে,يَخْلُقُكُمْ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ خَلْقًا مِنْ بَعْدِ خَلْقٍ فِي ظُلُمَاتٍ ثَلَاثٍ ذَلِكُمُ اللهُ رَبُّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُصْرَفُونَ ‘তিনি তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভের ত্রিবিধ অন্ধকারে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক, সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁরই, তিনি ব্যতীত প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই। তবে তোমরা মুখ ফিরিয়ে কোথায় চলছ?’ (আয-যুমার, ৩৯/৬)। মূলত মানুষকে একটি প্রাণ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারপর তা থেকে তার সঙ্গীকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাদের উভয়ের মাধ্যমে অসংখ্য নারী-পুরুষ বিস্তৃতি লাভ করেছে। মহান আল্লাহ সূরা আন-নিসার শুরুতে ঘোষণা দিয়েছেন এভাবে,يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ‘হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাদের দুইজন হতে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন’ (আন-নিসা, ৪/১)। মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং তাদের দিয়েছেন ভালো ও মন্দের মাঝে পার্থক্য করার ক্ষমতা, মুক্ত ও স্বাধীনভাবে যমিনে বিচরণের অধিকার, চিন্তার স্বাধীনতা প্রভৃতি। তিনি বলেন,وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا - فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا - قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا - وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا ‘শপথ নফসের এবং তার, যিনি তাকে সুবিন্যস্ত করেছেন, অতঃপর তিনি তাকে অবহিত করেছেন তার পাপসমূহ এবং তাক্বওয়া সম্পর্কে। নিশ্চয়ই সেই সফলকাম হবে, যে আত্মাকে পবিত্র করবে এবং সেই ব্যর্থ হবে, যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে’ (আশ-শামস, ৯১/৭-১০)। প্রকৃতপক্ষে, মানুষের শ্রেষ্ঠ জীব হওয়ার মূলে যে বৈশিষ্ট্যটি খুবই গুরুত্বের দাবিদার, তা হলো জ্ঞান। তিনি মানুষকে জ্ঞানের ভাণ্ডার দান করেছেন, শুধু তাই নয়, এ জ্ঞান দ্বারাই মানুষ ফেরেশতাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এ মর্মে তিনি ইরশাদ করেন, اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ- الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ - عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ‘পাঠ করুন আর আপনার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না’ (আল-আলাক্ব, ৯৬/৩-৫)। সূরা আল-বাক্বারাতে এসেছে,وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَؤُلَاء إِنْ كُنتُمْ صَادِقِينَ - قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ ‘আর তিনি আদমকে সমস্ত কিছুর নাম শিক্ষা দিলেন, অতঃপর সেসব ফেরেশতার সামনে পেশ করলেন এবং বললেন, এই সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তারা বলল, আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তাছাড়া আমাদের তো কোনো জ্ঞান নেই’ (আল-বাক্বারা, ২/৯-১০)। এতদ্ব্যতীত জ্ঞানের যে-সব উপদান রয়েছে, তা সবই তিনি স্বীয় অনুগ্রহে মানুষকে দিয়েছেন। এ মর্মে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন,وَجَعَلَ لَكُمْ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ‘তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং হৃদয়, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো’ (আন-নাহল, ১৬/৭৮)। কুরআনের অন্যত্র এসেছে, أَلَمْ نَجْعَلْ لَهُ عَيْنَيْنِ - وَلِسَانًا وَشَفَتَيْنِ ‘আমি কি তার জন্য সৃষ্টি করিনি দুটি চক্ষু, একটি জিহ্বা ও দুটি ওষ্ঠ?’ (আল-বালাদ, ৯০/৮-৯)। এছাড়াও তিনি মানুষকে বায়ান বা কথা বলা শিখিয়েছেন। সূরা আর-রহমানে এসেছে,الرَّحْمَنُ - عَلَّمَ الْقُرْآنَ- خَلَقَ الْإِنسَانَ- عَلَّمَهُ الْبَيَانَ ‘দয়াময় আল্লাহ। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনিই তাকে শিখিয়েছেন বাকপটুতা’ (আর-রহমান, ৫৫/১-৪)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে নেয়ামত দ্বারা মানুষকে ভূষিত করা হয়েছেম তা হলো যুগে যুগে প্রেরিত আসমানী গ্রন্থসমূহ।

এসকল নেয়ামতের পিছনে উদ্দেশ্য ছিল কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন, তাঁর বিধিবিধানের আনুগত্য করা, তাঁকে সিজদা করা প্রভৃতি। এসব অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে স্বয়ং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় অবনত হয়েছেন। ছহীহ মুসলিমে এসেছে, তিনি বলেছেন, سَجَدَ وَجْهِى لِلَّذِى خَلَقَهُ وَصَوَّرَهُ وَشَقَّ سَمْعَهُ وَبَصَرَهُ تَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ ‘আমার চেহারা সিজদা করেছে ঐ সত্তার জন্য, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, অবয়ব দিয়েছেন এবং দিয়েছেন তাকে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি। আল্লাহ অতীব বরকতময়, সবচেয়ে উত্তম স্রষ্টা’।[2] কিন্তু মানুষ অতিশয় অকৃতজ্ঞ। মহান আল্লাহর এসব অনুগ্রহের স্বীকৃতি দিতে চায় না এবং চেষ্টাও করে না। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الْإِنسَانَ لَكَفُورٌ ‘মানুষ তো অতিমাত্রায় অকৃতজ্ঞ’ (আল-হাজ্জ, ২২/৬৬)। আল-কুরআন নানা ধরনের দ্বীনী বিষয় বর্ণনার সাথে সাথে মানুষের বিভিন্ন প্রকারের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত অথচ মূল্যবান চিত্র তুলে ধরেছে। যা সকল যুগের সকল মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। মানুষের এ স্বরূপগুলো স্থায়ী। কোনো জাতি বা কোনো গোত্রই এ সকল বৈশিষ্ট্যের বাইরে নয়।

কুরআনে কারীমে যেমন মানুষের প্রশংসা করা হয়েছে, তেমনি নিন্দাও করা হয়েছে। তাকে একদিকে যেমন আসমান, যমীন ও ফেরেশতার চাইতেও মহীয়ান-গরীয়ান করা হয়েছে, অপরদিকে তেমনি তাকে চতুষ্পদ জন্তু, শয়তানের চেয়েও হীন ও নিকৃষ্টতর প্রাণীরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। তারা যেমন ফেরেশতার উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারে, আবার তারা এত দুর্বল যে, নিকৃষ্টতম অবস্থানেও নেমে যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِنْ الْجِنِّ وَالْإِنسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أُوْلَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُوْلَئِكَ هُمْ الْغَافِلُونَ ‘আমি তো বহু জিন ও মানবকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাদের হৃদয় আছে তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তাদের কর্ণ আছে তা দ্বারা তারা শ্রবণ করে না, তারা পশুর ন্যায় বরং তারচেয়েও বিভ্রান্ত, তারাই গাফেল’ (আল-আরাফ, ৭/১৭৯)। কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে,لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيم - ثُمَّ رَدَدْنَاهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ - إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ أَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُونٍ ‘অবশ্যই আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে, অতঃপর আমরা তাদেরকে সর্বনিম্ন স্তরে ফিরিয়ে দেই। কিন্তু তাদেরকে নয়, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে। তাদের জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার’ (আত-তীন, ৯৫/৪-৬)

অতএব, উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের স্বরূপ নির্ণয়ে কুরআন দুই ধরনের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছে। যেমন— ১. ভালো বৈশিষ্ট্য ও ২. মন্দ বৈশিষ্ট্য। এগুলোকে আমরা দুভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি তথা- ১. ইতিবাচক দিক (যা কল্যাণকর ও অর্জনযোগ্য) ও ২. নেতিবাচক দিক (যা অকল্যাণকর ও বর্জনীয়)।

(ক) ইতিবাচক দিক:

(১) মানুষ দুনিয়াতে আল্লাহর খলীফা: খলীফা শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী।[3] মহান আল্লাহ তাঁর অসংখ্য সৃষ্টির মাঝে মানুষকে স্বীয় খলীফা মনোনীত করেছেন। তারা দুনিয়ায় তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এ মর্মে সৃষ্টির প্রারম্ভেই তিনি ফেরেশতাদের উদ্দেশ্য করে ঘোষণা দিয়েছেন,وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ ‘(স্মরণ করো) যখন আপনার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই। তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে ফাসাদ সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস স্তুতি গাঁই ও পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না’ (আল-বাক্বারা, ২/৩০)। তিনি (আল্লাহ) মানুষকে শুধু খলীফা হিসেবেই সৃষ্টি করেননি, বরং তাদেরকে পরীক্ষার জন্য একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ إِنَّ رَبَّكَ سَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ ‘তিনিই তোমাদেরকে দুনিয়ার প্রতিনিধি করেছেন এবং যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন, সে সম্বন্ধে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তোমাদের কতক জনকে কতকের উপর মর্যাদায় উন্নীত করেছেন’ (আল-আনআম, ৬/১৬৫)। এছাড়াও খলীফা হিসেবে একজন মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি তাঁর মনোনীত বান্দা দাঊদ আলাইহিস সালাম-কে লক্ষ্য করে বলেন, হে দাঊদ! আমি আপনাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি। অতএব, আপনি লোকদের মধ্যে সুবিচার করুন এবং খেয়ালখুশির অনুসরণ করবেন না, কেননা তা আপনাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করবে (ছোয়াদ, ৩৮/২৬)। এখানে প্রতিনিধি হিসেবে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী তার দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা মহান আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে প্রমাণিত করতে হলে তাঁর আইনকেই শুধু মানুষের মাঝে পরিচালিত করতে হবে, অন্যথা তা হবে ব্যক্তিপূজা বা প্রবৃত্তির অনুসরণ। আর দাঊদ আলাইহিস সালাম এ ধরনেরই একজন শাসক ছিলেন।

(২) সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত জ্ঞানের অধিকারী হওয়া: মানুষ বোধশক্তিসম্পন্ন প্রাণী। মহান আল্লাহ মানুষকে এমন জ্ঞান দান করেছেন, যার সাহায্যে ভালো ও মন্দ, কল্যাণ ও অকল্যাণ প্রভৃতির মাঝে পার্থক্য করা যায়। এ জ্ঞান দ্বারাই তিনি ফেরেশতাদের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। অতএব, জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ সকল প্রাণীর মধ্যে সেরা। কুরআনে কারীমে এসেছে,

وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَؤُلَاء إِنْ كُنتُمْ صَادِقِينَ- قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ- قَالَ يَاآدَمُ أَنْبِئْهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ فَلَمَّا أَنْبَأَهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُلْ لَكُمْ إِنِّي أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنتُمْ تَكْتُمُونَ

‘আর তিনি আদমকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। তারপর ফেরেশতাদের সামনে সেগুলো পেশ করলেন এবং বললেন, এগুলোর নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তারা বলল, আপনি মহাপবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তাছাড়া আমাদের তো কোনো জ্ঞান নেই। বস্তুত, আপনি মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। তিনি বললেন, হে আদম! তাদেরকে এসকল নাম বলে দিন। তিনি তাদেরকে এসবের নাম বলে দিলেন’ (আল-বাক্বারা, ২/৩১-৩৩)। জ্ঞানের মাধ্যমেই মানুষ প্রভূত কল্যাণের অধিকারী হয়েছে। এজন্যই কুরআনে কারীমে বারবার জ্ঞান আহরণে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا ‘যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়েছে, তাকে প্রভূত কল্যাণ দেওয়া হয়েছে’ (আল-বাক্বারা, ২/২৬৯)

(৩) মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন: মানুষ সাধারণত স্বাধীনচেতা ও মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় চলাফেরা করতে পছন্দ করে। কীসে কল্যাণ এবং কীসে তাদের অকল্যাণ তা জ্ঞাত হওয়ার পরও তা গ্রহণের ক্ষেত্রে রয়েছে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা। মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থাশীল হওয়া পয়গম্বরী মিশন পরিচালনার প্রয়োজনীয় গুণাবলিতে মানবজীবন বিমণ্ডিত। তারা দায়িত্বশীল জীব। উদ্যোগ ও কঠোর শ্রমের মাধ্যমে জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের জন্য মানুষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। সমৃদ্ধি বা বিপর্যয় যে কোনো একটিকে বেছে নেওয়ায় তার রয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা। হয় সে সঠিক পথে চলে সমৃদ্ধির পানে পা বাড়াবে অথবা অকৃতজ্ঞ হয়ে বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাবে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا- إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا ‘নিশ্চয় আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্রিত শুক্রবিন্দু হতে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য। অতঃপর আমি তাকে করেছি শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন। আমি তাকে সঠিক পথ দেখিয়েছি; হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে’ (আদ-দাহর, ৭৬/২-৩)

(৪) মহত্ত্ব ও মর্যাদায় বিভূষিত: জন্মগতভাবেই মহত্ত্ব ও মর্যাদার গুণাবলিতে মানুষ বিভূষিত। বাস্তবেই আল্লাহ অপরাপর অসংখ্য প্রাণীর উপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সে তার আসল সত্তাকে তখনই আবিষ্কার করতে পারে, যখন সে তার মহত্ত্ব ও মর্যাদাকে উপলব্ধি করতে পারবে এবং নিজেকে সকল নীচতা, দাসত্ব, অধীনতা, ভোগ-লালসা, ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে পারবে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنْ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا

‘অবশ্যই আমরা আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে তাদের ভ্রমণ করিয়েছি; তাদেরকে উত্তম রিযিক্ব দান করেছি এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি’ (বনী ইসরাঈল, ১৭/৭০)

(৫) নৈতিক চেতনাবোধসম্পন্ন: মানুষের নৈতিক চেতনা আছে। তারা প্রকৃতিগতভাবেই ভালো আর মন্দ বুঝে নিতে পারে। কল্যাণ ও অকল্যাণের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। মানুষের সত্তার মাঝেই নৈতিক চেতনা লুকিয়ে আছে। কুরআনে বলা হয়েছে,وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا- فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا ‘শপথ নফসের এবং যিনি তাকে সুবিন্যস্ত করেছেন। তাকে (মানুষকে) তার অসৎকর্ম ও তার সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন’ (আশ-শামস, ৯১/৭-৮)

(ইনশা-আল্লাহ চলবে)

ড. মোহাম্মদ হেদায়াত উল্লাহ

সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস, সাধারণ শিক্ষা), সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।


[1]. আব্দুর রহমান আন-নাহলাভী, উছূলুত তারিবিয়াতিল ইসলামিয়্যাহ ওয়া আসালিবুহা (দারুল ফিকর: দামেশক, ১৯৭৯ খ্রি.) পৃ. ৩০।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৭১।

[3]. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আরবী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান, (রিয়াদ প্রকাশনী: ঢাকা, চতুর্থ সংস্করণ-২০০২ খ্রি.), পৃ. ৩২২।

Magazine