কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মুসলিমদের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ

আজকের বিশ্ব অগণিত সমস্যায় জর্জরিত। বিশ্ব মানব আজ শান্তির সন্ধানে দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জড়বাদী সভ্যতার ঝলসানো মরীচিকার পেছনে উন্মাদের মতো ছুটে চলেছে। শান্তির জন্য একের পর এক মানবসৃষ্ট মতবাদের বাস্তবতারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। কিন্তু মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মানুষের মনগড়া সকল মতাদর্শ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মানবজাতি আজ মুক্তি, কল্যাণ, শান্তি, উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রগতির নামে আজ দুঃখ-দুর্দশা, অনাচার, অত্যাচার-নিপীড়ন, হতাশা ও বঞ্চনার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে মানবজীবনকে দুঃখ-দুর্দশা, বর্বরতা, অসভ্যতা ও যুলম-নির্যাতন তথা নিষ্পেষণের জাঁতাকল হতে মুক্তি প্রদানে একদিন একমাত্র ইসলামের অবদান গোটা জাতিকে বিস্মিত ও বিমোহিত করেছিল।

 ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাস ভাবাবেগকে কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি; বরং তা ঐতিহাসিক সত্যের রুদ্রালোকে সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ ও সমুজ্জ্বল যে, শুধু ইসলামী মূল্যবোধই মানবজীবনে কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় সাফল্য অর্জন করেছে, যা বিশ্বের ঐতিহাসিকগণ নির্দ্বিধায় স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।

তাওহীদের হে চির সেবক বীর মুসলিম! আমি এখন মুসলিমদের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল স্বর্ণালি ইতিহাস, বর্তমান দিশেহারা নির্যাতিত মুসলিম জাতির দুরবস্থার কারণ ও ভবিষ্যতে ধ্বংসোন্মুখ মহাদুর্গতির চরম দুর্ভাবনাকে সামনে রেখে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছি।

প্রথমেই আসুন আমরা বিশ্ব মুসলিমের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জেনে নিই।

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, শিক্ষায়, সভ্যতায়, ইবাদতে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, কাব্যে, সাহিত্যে, শিল্পে, বাণিজ্যে, বিজ্ঞানে, দর্শনে, ধর্মে-কর্মে, ত্যাগে-তিতিক্ষায়, মহানুভবতায়, পরোপকারিতায়, শৌর্যে-বীর্যে ও চরিত্রে মাধুর্যে মুসলিম জাতিই দুনিয়ায় শীর্ষ স্থান অধিকার করেছিলেন। প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর মাত্র এক শতাব্দীর মধ্যে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যে তারা ইসলামের সুমহান আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মদীনা, কূফা, বাছরা, দামেশ্ক, বাগদাদ, কর্ডোভা, সেভিল, গ্রানাডা, সমরখন্দ ও ইস্পাহান শহরগুলোকে ব্যবসা-বাণিজ্যে, পার্থিব সম্পদ, শিক্ষা, সভ্যতা, তাহযীব ও তামাদ্দুনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করেছিলেন তারা।

সোনালি অতীত, সুবিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত আলকিন্দি দর্শনশাস্ত্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন। মুহাম্মাদ ইবনে যাকারিয়া একজন শ্রেষ্ঠ রসায়নশাস্ত্র বিশারদ ছিলেন। তিনি হীরাকসকে শোধন করে গন্ধকদ্রাবক তুঁতিয়া প্রস্তুত করেছিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে সারা জগতকে আবুল কাশেম আল-জাহরবী তার আশ্চর্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি একজন শ্রেষ্ঠতম অস্ত্র চিকিৎসা বিশারদ ছিলেন। জাবের ইবনে হাইয়ানই রসায়নশাস্ত্রের জন্মদাতা। শুধু জাবের ইবনে হাইয়ানই নন; আল-ফারাবী, ইবনে সিনা, আল-বিরুনী, আল-গাযালী, ইবনে বাজা ও ইবনে রুশদের মতো দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের চরমোৎকর্ষ সাধনকারী মুসলিম মনীষীগণ পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ। মুসলিম মনীষী মূসা আল-খারেযমী সৌরমণ্ডল জ্যোতির্মণ্ডল সম্বন্ধে গবেষণা করে পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। শুধু তাই নয়, বীজগণিতের ভিত্তি রচনা করেছিলেন তিনিই। তার আল-জাবর নামক বীজগণিতের মৌলিক গ্রন্থ হতে ইউরোপীয় অ্যালজেবরা শব্দটি চয়ন করা হয়েছে। এছাড়া আল-বাত্তানী, আল-ফারগানী, আল-বিরুনী, উমার খৈয়াম ও নাছিরুদ্দীন তুসীর মতো মুসলিম মনীষীগণ জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারকে বহুগুণে সমৃদ্ধ করে গেছেন। সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসশাস্ত্রে মুসলিমদের কাছে দুনিয়াবাসী ঋণী। বিখ্যাত মুসলিম মনীষী ইবনে খালদুন সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসশাস্ত্রের আবিষ্কারক ছিলেন। কেবল ইবনে খালদুনই নন; বালাজুরির মতো, হামাদানীর মতো, আল-বিরুনীর মতো, আল-তাবারীর মতো, আল-মাসঊদীর মতো, ইবনে হাযমের মতো, ইবনুল আছীরের মতো, ইবনে খল্লিকানের মতো, শাহ ওয়ালিউল্লাহর মতো শত শত মুসলিম ঐতিহাসিকদের অবদানে মানব ইতিহাস সমৃদ্ধ ও উন্নত হয়েছে। মুসলিম বৈজ্ঞানিক আবুল হাসান সর্বপ্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। আবুল হাসান ও আলী ইবনে আমাজুর সর্বপ্রথম চন্দ্র সম্বন্ধে গবেষণায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। কায়রোতে ইবনে ইউনুস নামে এক মহা মনীষী সর্বপ্রথম পেন্ডুলাম আবিষ্কার করে তার দোলনের সাহায্যে সময় নিরূপণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মুসলিমরাই স্থাপত্য শিল্পে জগতের শীর্ষস্থান অধিকার করেছিলেন। আগ্রার তাজমহল, জেরুযালেমের উমারের মসজিদ, কনস্টান্টিনোপল বা ইস্তাম্বুলের সেন্টসফিয়া মসজিদ, কর্ডোভার মসজিদ, স্পেনের আল-হামরা, দিল্লির দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাছ, মতি মসজিদ যার বাস্তব প্রমাণ।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধে কামান ব্যবহার করে মুসলিমরাই দুনিয়াবাসীকে কামান ও বারুদের ব্যবহার শিখিয়েছেন। গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড তৈরি করে এ জাতিই রাস্তা নির্মাণের আদর্শ দেখিয়েছে। ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করে এ জাতিই ডাক বিভাগের সূত্রপাত করেছেন। আমরা যাকে চীনের প্রাচীন সভ্যতা বলে দেখতে পাই, আসলে তা মুসলিমদের জ্ঞানালোক বর্তিকা থেকে ধার করা স্ফুলিঙ্গ ছাড়া আর কিছুই না। সার্বিক উন্নতির অগ্রযাত্রায় বিশ্ববাসী যে মুসলিমদের কাছে ঋণী, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। 

যে জাতি মাত্র কয়েকটা বছরের এক অখণ্ড আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন। যে জাতির আদর্শ, শিক্ষা ও সভ্যতার জ্যোতি আরব ভূমি হতে বিকিরণ হয়ে সারা দুনিয়াকে উদ্ভাসিত করেছিল। সেই জাতি আজ চরম অধঃপতিত, নিগৃহীত। ভাবতেই অশ্রুবানে দুচোখ ভেসে যায়। 

আয়নার পারদ আয়না থেকে ঝরে গেলে আয়নার যে দুরবস্থা হয়, বর্তমানে মুসলিমদের ঠিক সেই অবস্থাই হয়েছে। এর কারণ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে গিয়ে শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কবি সম্রাট আল্লামা ইকবাল রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এই দুরবস্থার কারণ ইসলাম নয় বরং ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুতি। 

তিনি এর দুর্ভোগের কারণ আরও পরিষ্কার করে বলেছেন নিম্নোক্ত ভাষায়—

উহ যামানা মে মুয়াযযায থে

মুসলমা হো কার

আজ তুম যালিল ও খার হু-য়ে

তারেকে কুরআ হো কর।

অর্থাৎ সে যুগের মুসলিম ছিল অতি মহান, আজ তারা লাঞ্ছিত হয়েছে ছাড়িয়া কুরআন।

বাস্তবেও তাই আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি। ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড গ্লার্ডস্টোন সংসদ অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে কুরআন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে নিজ হাতে কুরআন মাজীদ উঁচু করে বলেছিলেন, ‘এই পুস্তকের বদৌলতে আরবের বেদুঈনরা পারস্য ও রোমের মতো শক্তিশালী সাম্রাজ্য বিজয় করেছিল। তাই যতদিন পর্যন্ত এই পুস্তক মুসলিমদের কাছে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আমরা তাদের হুমকির ভয়াবহতা থেকে নিরাপদ হতে পারব না’।

এই বিষোদগার করে শ্লেষ্মাভরে কুরআন মাজীদকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। -নাঊযুবিল্লাহ-

আজ মুসলিমদের প্রত্যেক ঘরেই আক্ষরিক অর্থে কুরআনের পাণ্ডুলিপি বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন না থাকায় আমাদের এহেন দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

আমাদের জাতীয় জীবনে কুরআনের অলঙ্ঘনীয় বাণীকে উপেক্ষা করে দুনিয়ার চির অভিশপ্ত ইয়াহূদী, নাছারাদের কৃষ্টি-কালচার, শিক্ষা-সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, চালচলন, সভ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি বরণ করে নিয়েছি। মানবতার সুমহান প্রতীক বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুমহান আদর্শকে পরিত্যাগ করে মার্কস, লেনিন, হেগ, ডারউইনের মতাদর্শ গ্রহণ করেছি। এ অবস্থা উল্লেখ করতে গিয়ে কবি সম্রাট আল্লামা ইকবাল রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আজকের মুসলিম পোশাক-পরিচ্ছদে খ্রিষ্টান ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে হিন্দু। আমাদের প্রতি লক্ষ্য করে আক্ষেপ ছলে তিনি আরও বলেন, আজকের মুসলিমদের দিকে তাকালে ইয়াহূদী-নাছারারাও লজ্জায় মুখ ঢাকবে। জাতীয় জীবনে এহেন সমস্যা সমাধানকল্পে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিভক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান, ৩/১০৩)

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিদায় হজ্জের অমীয় বাণীতে তাই-ই প্রমাণ করে; তিনি বলেন, ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত বিভ্রান্ত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও আমার সুন্নাতকে ধারণ করে রাখবে’। সর্বোপরি এটাই প্রমাণিত হয় যে, আমাদের জীবনে দুঃখ-দুর্দশা, অশান্তি, অরাজকতা, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, যুলম, অন্যায়, অবিচার সবকিছুর মূল কারণ কুরআনকে আমাদের জীবন পথের সর্বস্তরে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ না করা। শান্তি, স্বস্তি, উন্নতি, অগ্রগতি, প্রগতির জীবন্ত সাক্ষী হিসেবে দণ্ডায়মান মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও বিশ্ব নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুমহান আদর্শ।

মুসলিমরা যদি এই মহাসংকট ও দুরবস্থার সমাধানে এখনই এগিয়ে না আসে, তাহলে ভবিষ্যতে বিশ্ব মুসলিমের মাথার উপরে থেকে যাবে আরও মহাবিপদের আশঙ্কাজনক ধ্বংসাত্মক হুমকি। আত্মভোলা মুসলিম জাতির ভাবধারা দেখেশুনে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন—

শক্তি সিন্ধু মাঝে রহি হায়

শক্তি পেল না যে,

মরিবার বহু পূর্বে জানিও

মরিয়া গিয়াছে সে।

মুসলিম জাতির হাতে সবকিছু থাকতে যদি তারা নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষায় আজও সচেতন না হয়, তাহলে কবির কথাই বাস্তব রূপ নিবে। গতানুগতিকভাবে গড্ডালিকা প্রবাহে যদি মুসলিমরা বিজাতীয় অনুকরণ-অনুসরণ করে চলতে থাকে, তাহলে জাতীয় জীবনে নেমে আসবে এর চেয়ে মারাত্মক অভিশাপ। ফলে বিপন্ন হবে গোটা জাতি। নেমে আসবে জ্বালাময়ী ধ্বংসের বিভীষিকা। অশান্তির দাবানল দাউদাউ করে জ্বলতে থাকবে পৃথিবীতে। তাই সুপ্ত মুসলিম মিল্লাত যদি সে মহাবিপদ ঠেকাতে চান, তাহলে আজই শপথ নিতে হবে মানব রচিত কোনো মতাদর্শ আমরা মানব না। শুধু তাই নয়, মানব রচিত সকল মতাদর্শকে খড়কুটার ন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে জাতীয় জীবনের সকল স্তরে আল-কুরআনের প্রতিফলন ঘটাব। আদর্শ নেতা হিসেবে মানবতার মুক্তির দিশারী প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মেনে নিব। যদি আমরা মুসলিম জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে আবার জেগে উঠি তথা হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি, তবে বিজয়ের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সময়ের ব্যবধান মাত্র।

* কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা।

Magazine