পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই হক্ব-বাতিলের সংঘাত চলছে এবং মুসলিমদের প্রাণনাশকারী স্নিগ্ধ বায়ু প্রবাহিত হওয়া অবধি চলতে থাকবে। যে যুগে ইবরাহীন আলাইহিস সালাম ছিলেন, ওই যুগেই তার বিরোধী ছিল আল্লাহদ্রোহী নমরূদ। যে যুগে মূসা আলাইহিস সালাম ছিলেন, ওই যুগেই নিজেকে আল্লাহ দাবিদার ফেরাউন ছিল। প্রত্যেকটি নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম-কে আল্লাহ তাআলা মু‘জিযার তলোয়ার দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। এই অস্ত্র দিয়েই তারা কাফের-মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়েছেন।
মূসা আলাইহিমুস সালাম-এর যুগকে জাদুবিদ্যার রেনেসাঁস বলা চলে। চারদিকে জাদুর ছড়াছড়ি। বলা নেই কওয়া নেই, সময়ে অসময়ে একজন আরেকজনের উপর জাদুর কারিশমা দেখাতো। জাদুকররা জাদুর পসরা মেলে ধরত সাধারণ লোকজনের সামনে। যারপরনাই পুলক অনুভব করত তারা। উৎফুল্লতার জেরে একজন আরেকজনের উপর লুটোপুটি খেত।
অধুনা যুগে দেশের কর্ণধাররা যেমন চিত্তবিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, তদানীন্তন সময়ে ফেরাউনের সভাসদরা চিত্তবিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে জাদু খেলার ব্যবস্থা করত। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল বলতে ছিল জাদু খেলা।
সবার কাছে আকর্ষণের বিষয় ছিল এই জাদু। রাজা-বাদশাহদের নিকট ছিল জাদুকরদের যথেষ্ট সমাদর। মাঝেমধ্যে তো জাদুকররা পেত অঢেল উপঢৌকন। যার ফলে জাদু শিখার প্রতি সবার আলাদা একটা টান কাজ করত।
আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিমুস সালাম-কে হাজারো জাদুকরের ভিড়ে টিকিয়ে রাখার মানসে এমন এক মু‘জিযা দান করলেন, যা আজ অবধি কিংবদন্তিতুল্য হয়ে আছে। কুরআনের অনেক সূরায় এই উপাখ্যান চিত্রায়িত হয়েছে। এই লাঠির মু‘জিযার কাছে জাদুকরদের চোখ ধাঁধানো ভেল্কিবাজি নস্যাৎ হয়ে গেল। বুলন্দ হলো আল্লাহর কালেমা। নতশিরে পরাজয়ের তকমা পরিধান করল পারদর্শী জাদুকররা। শুধু কি তাই! সকল জাদুকর লাঠির মু‘জিযার কারিশমা দেখে সেজদায় লুটে পড়ল।
ঈসা আলাইহিস সালাম-এর যুগটা ছিল চিকিৎসাশাস্ত্রের ভরা জোয়ার। প্রায় সব রোগের চিকিৎসাই রপ্ত করেছিল তদানীন্তন সময়ের চিকিৎসকরা। ওই সময়টায় আল্লাহ তাআলা মু‘জিযার এমন এক ঝলকানি দিয়ে ঈসা আলাইহিস সালাম-কে প্রেরণ করেন, যার সামনে কোনো চিকিৎসা সাধনা টিকল না। প্রতিটি ব্যাধির চিকিৎসা আছে; কিন্তু মরণব্যাধির কোনো চিকিৎসা নেই। ঈসা আলাইহিস সালাম যদি মৃত, কবরস্থ কোনো ব্যক্তিকে বলতেন, قُمْ بإذنِ اللهِ ‘আল্লাহর নামে দাঁড়িয়ে যাও’। তখন সাথে সাথে ওই মৃত ব্যক্তি দাঁড়িয়ে যেত।
আল্লাহ তাআলা ঈসা আলাইহিস সালাম-কে এমন একটি মু‘জিযা দিয়ে শক্তিশালী করেছেন, যা দেখে সকলের চোখ চড়কগাছ। সবাই এই মু‘জিযার কাছে শির নত করতে বাধ্য হয়েছে।
মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এমন যুগে প্রেরণ করা হয়, যে যুগটা ছিল সাহিত্য, অলংকারশাস্ত্র ও কাব্যপ্রীতির যুগ। কবি-সাহিত্যিকরা কবিতা ও সাহিত্যের রস দিয়ে সাধারণ মানুষদের হৃদয় মাতিয়ে তুলত। এক গোত্র আরেক গোত্রকে ঘায়েল করত কাব্যের চরণের অস্ত্র দিয়ে। হজ্জের মৌসুমে হজ পালন শেষে দূরদূরান্ত থেকে আগত তীর্থযাত্রীরা উপভোগ করত কবিতার মাধুর্যতা থেকে। মনের মাধুরী মিশিয়ে কবিরা দেদারসে এঁকিয়ে-বেঁকিয়ে পক্তিমালা উচ্চারণ করত। নিশি রাতে শুরু হতো কবিপ্রেমীদের কবিতা শুনার সব আয়োজন। শত শত কবি-সাহিত্যিক উপস্থিত হতো এই কাব্যের মিছিলে। সুর তুলত গলা ছেড়ে আপন মনে। যুগটা এমন ছিল, মুহূর্তে কোনো কোনো প্রতিভাবান কবি নিজ মস্তিষ্কে কবিতার চরণ অঙ্কন করে ফেলতে পারত। কোনো ধরনের আটকানো ব্যতিরেকে অবলীলায় বলত, ছন্দপতন ঘটত না। কবিতা প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী কবিকে পরানো হতো বছরের সেরা সম্মানের কাঙ্ক্ষিত মুকুট। লিখে রাখা হতো তার কবিতাকে স্মৃতির পাথরে অঙ্কন করে কা‘বার দেয়ালে, যেন শতবছর পরও মানুষ তাকে স্মরণ করে। তার চলে যাওয়াটা যেন প্রস্থান না হয়। মরেও অমর থাকে মানুষের হৃদয়ে। কবি ইমরুল কায়েস, আনতারা ইবনে শাদ্দাদ আরও কত কবি! এই সাহিত্যের ভরা মৌসুমে আল্লাহ তাআলা ইয়াতীম নিরক্ষর মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এক মু‘জিযা কুরআন দিয়ে সহযোগিতা করলেন, যা দেখে বড় বড় প্রাজ্ঞ সাহিত্যিক হতভম্ব হয়ে গেল। টনক নড়ে গেল সকলের। শুধু কি তাই! দৃপ্তকণ্ঠে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল গোটা বিশ্বের প্রতি। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِنْ مِثْلِهِ ‘আমাদের বান্দার উপর যে জিনিস (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, এতে যদি তোমরা সংশয় পোষণ করো, তাহলে তার (কুরআনের) অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে এসো’ (আল-বাক্বারা, ২/২৩)।
একজন সাহিত্যিক বুকের পাটা তুলে এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার সাহস করেনি। বাকরুদ্ধ হয়ে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। কুরআনের মতো এমন হৃদয়গ্ৰাহী, শ্রুতিমধুর সাহিত্যের সামনে হার মানতে বাধ্য হলো।
আশ্চর্যের বিষয়! কুরআনে একেকটা ঘটনা বারবার আলোচিত হয়েছে; কিন্তু বর্ণনাশৈলী ও ভাষার মাধুর্যতায় রয়েছে বিস্তর ফারাক। আর হবেই না কেন? এটা তো অবতীর্ণ হয়েছে বিশ্বজাহানের নিয়ন্তার পক্ষ থেকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ ‘কুরআনের অগ্ৰ ও পশ্চাত থেকে বাতিল (শয়তান) প্রবেশ করে না। এটা তো প্রজ্ঞাময় প্রশংসিতের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ’ (ফুছছিলাত, ৪১/৪২)।
এখন অবধি কোনো ব্যক্তি কুরআনের ভুল ধরতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। আমাদের বর্তমান যুগে বিদআতী ও মুশরিক, মুসলিম নামধারী বক্তায় ভরপুর। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হলে জ্ঞানের তলোয়ার লাগবে। জ্ঞান ছাড়া তাদের সাথে পেরে উঠা খানিকটা মুশকিল হয়ে যাবে। কারণ তাদের অসার বস্তাপচা ঠুনকো যুক্তিকে মিথ্যা প্রমাণে জ্ঞানের বিকল্প নেই। যখন আপনার কাছে জ্ঞানের মশাল থাকবে, তখন বাতিলের অন্ধকার মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যাবে। তাই প্রিয় দাঈদের বলব, অনেক জ্ঞান অর্জন করুন। অহেতুক কাজে সময় নষ্ট না করে পড়ালেখা করুন। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া, ইবনুল ক্বাইয়িম, ইবনু হাজার আসক্বালানী, নবাব ছিদ্দীক্ব হাসান খান ভুপালী, ছালেহ আল-উছায়মীন ও নাছিরুদ্দীন আলবানী রাহিমাহুমুল্লাহ-দের মতো জ্ঞানের অথই সাগর হোন। আল্লাহ তাআলা আমাকে-আপনাকে তাদের কাতারে শামিল করুন- আমীন!
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।