মানুষের স্বভাবজাত প্রকৃতি হলো সে নিজের অপরাধ আড়াল করতে চায়। হাজারো মানুষের কোলাহলে নিজেকে সবাই ভালো বলুক; আভিজাত্যে, মর্যাদায় ও সুনামে ঝরঝরে দেখা যাক- এটাই সে প্রত্যাশা করে থাকে। কারো কারো পক্ষে অন্যায় বা গোপন পাপ ঢেকে রাখা কখনো কখনো নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য সম্ভব হলেও সর্বদা তা লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়ে উঠে না। মানুষ যখন জেনেবুঝে ইচ্ছাকৃতভাবে গোপনে গুনাহ করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন অন্তর থেকে ধীরে ধীরে মহান আল্লাহর ভয় বিদায় নিতে থাকে। অন্তর যখন তাক্বওয়াশূন্য হয়ে যায়, তখন অন্তর পাথরের মতো শক্ত হতে যায়। তখন তার কাছে ইসলামী ধ্যানধারণা মনোরম ও আকর্ষণীয় লাগে না। ধর্মীয় বিধানাবলি বিরক্তিকর মনে হতে থাকে। অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত হয় না। মুনাজাতে চোখে পানি আসে না। এক পর্যায়ে তার কোনো আমলে আর মন বসে না। ইবাদত করতে ভালো লাগে না। কুরআন তেলাওয়াত আর আগের মতো মধুর মনে হয় না। ক্রমান্বয়ে সে ধ্বংস ও অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। জাহেলিয়াতের অন্ধকার গলিপথ তার কাছে আপন মনে হয়। মাঝে মাঝে সে অন্ধকারে নিমজ্জিত অবস্থা থেকে মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়; কিন্তু বাঁচতে পারে না, তার পক্ষে ইউটার্ন নেওয়া আর সম্ভব হয়ে উঠে না। অবস্থা তো কখনো এমন ভয়ানক হয় যে, তার ঈমান পর্যন্ত বিনষ্ট হয়ে যায় এবং ঈমানহীন অবস্থায়ই তার মৃত্যু ঘটে। আল্লাহ আমাদেরকে হিফাযত করুন।
আর কেউ কেউ আছে পাপ করতে করতে এক সময় পাপকে আর পাপই মনে করে না! তার কাছে পাপ করা তুচ্ছ ও সামান্য ব্যাপার হয়ে যায়। তখন আল্লাহর ক্রোধ আর পরকালের ভয়াবহ আযাবকে সে পরোয়া করে না। ফলে এক পর্যায়ে মহান আল্লাহ তার জন্য পাপের কাজকে তার কাছে প্রিয় করে তুলেন! আল্লাহ তাআলা বলেন,أَفَمَنْ زُيِّنَ لَهُ سُوءُ عَمَلِهِ فَرَآهُ حَسَنًا فَإِنَّ اللَّهَ يُضِلُّ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ فَلَا تَذْهَبْ نَفْسُكَ عَلَيْهِمْ حَسَرَاتٍ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِمَا يَصْنَعُونَ ‘যাকে তার মন্দ কর্ম শোভনীয় করে দেখানো হয়েছে, অতঃপর সে সেটাকে উত্তম মনে করেছে (সে কি তার সমান, যে সৎপথে পরিচালিত?) নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিপথগামী করেন। আর যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে পরিচালিত করেন। কাজেই তাদের জন্য আক্ষেপ করে আপনি আপনার জীবনকে ধ্বংস হতে দিয়েন না। তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (ফাত্বির, ৩৫/৮)।
পাপ কাজ শোভনীয় মনে হতে হতে একসময় সে পাপ কাজকে তখন ভালোবাসতে শুরু করে, ফলে তার তওবা করার নছীব হয় না। আর এই অবস্থায় সে আল্লাহর ক্রোধ এবং অসন্তুষ্টি নিয়ে মৃত্যুবরণ করে। এমন অনেক মানুষ রয়েছে, যারা অন্যদের কাছে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত, নিয়মিত ছালাত আদায় করে, দ্বীনদার, ধার্মিক, আলেম কিংবা আল্লাহওয়ালা বা তথাকথিত বুজুর্গ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, প্রকাশ্যে তাকে পাপ কাজ করতে দেখা যায় না; কিন্তু গোপনে গোপনে তিনি নানা ধরনের গুনাহের কাজে লিপ্ত (সাধারণত বাংলাদেশের কিছু মাযারের সেবক ও পীরদের ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে)। আবার অনেকে প্রকাশ্যে ভালো মানুষ হলেও গোপনে কবীরা গুনাহ করে। এটি একদিকে মুনাফেক্বী ও শঠতা, অন্যদিকে ধীরে ধীরে তার আমল ও ইবাদত নষ্ট হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এই জন্য মহান আল্লাহ বলেন,وَذَرُوا ظَاهِرَ الْإِثْمِ وَبَاطِنَهُ إِنَّ الَّذِينَ يَكْسِبُونَ الْإِثْمَ سَيُجْزَوْنَ بِمَا كَانُوا يَقْتَرِفُونَ ‘তোমরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গুনাহ পরিত্যাগ করো। নিশ্চয় যারা গুনাহ করবে, অতিসত্বর তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান দেওয়া হবে’ (আল-আনআম, ৬/১২০)।
এ ধরনের গোপন পাপ কথার দ্বারা হতে পারে, চিন্তা বা নিয়্যতের দ্বারাও হতে পারে আবার কর্মের দ্বারাও হতে পারে। যেমন— গোপনে গায়রুল্লাহর নাম নিয়ে পশু যবেহ করা গোপন পাপ। রিয়া বা অন্যকে দেখানোর জন্য ইবাদত করার নিয়্যত বা চিন্তা করা গোপন পাপ। আর অপ্রকাশ্য ব্যভিচার (পরকীয়া) বা গোপন যেনা (প্রেম) হলো কর্মগত গোপন পাপ। মহান আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ ‘আপনি বলে দিন! বস্তুত আমার পালনকর্তা হারাম করেছেন অশ্লীল বিষয়সমূহ, যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য। আর হারাম করেছেন গুনাহ, অন্যায়-অত্যাচার, আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, তিনি যার কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জানো না’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৩৩)।
প্রকাশ্য গুনাহের চেয়ে গোপনে করা গুনাহ বেশি ভয়াবহ। কেননা যখন কেউ গোপনে গুনাহ করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তার অন্তর থেকে আল্লাহর ভয় বিদায় নেয়। ক্রমাগত সে ধ্বংস ও অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। অবস্থা কখনো এত ভয়ানক হয় যে, তার ঈমান পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায় এবং ঈমানহীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। বর্তমান সময়ে গোপন গুনাহের সরঞ্জাম অনেক বেশি আর উপকরণগুলোও সহজলভ্য। আগের দিনে সিনেমা দেখতে অনেক দূর যেতে হতো, অনেক টাকা খরচ হতো আর এখন মোবাইল ফোনে সেকেন্ডে সেকেন্ডে সিনেমা আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। ডেটা অন করে মোবাইল খুললেই হাজারো নোটিফিকেশন আর পাপের হাতছানি। তাই সমাজের মানুষ দিন দিন গোপন গুনাহে বেশি জড়িয়ে পড়ছে। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া দ্বীনদার শ্রেণির মানুষ থেকে শুরু করে আলেম-উলামাও বাদ পড়ছেন না এর ভয়াল থাবা থেকে। তীব্র ঈমানী শক্তি ছাড়া এ জাহেলিয়াত থেকে বাঁচা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
বর্তমানে গোপন গুনাহের উপকরণগুলো অনেক বেশি ও অত্যন্ত সহজলভ্য। এর ভয়াবহ ফলাফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রচুর মানুষ এখন সংশয়ের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। দু-চারজন এটা নিয়ে চিন্তিত ও চিকিৎসা করার ব্যাপারে উদ্যোগী হলেও অধিকাংশ মানুষ এ ব্যাপারে উদাসীনই থেকে যাচ্ছে। শেষ যামানায় যে মানুষ ব্যাপকহারে ঈমানহারা হতে থাকবে, তার বাস্তবায়ন বোধ হয় শুরু হয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে কতজন যে আখেরাতে মুক্তি পাবে, তা একমাত্র মহান আল্লাহ জানেন!
ইমাম ইবনুল জাওযী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,وَالْحَذَرَ الْحَذَرَ مِنَ الذُّنُوْبٍ خُصُوْصًا ذُنُوْبِ الْخَلَوَاتِ فَإِنَّ الْمُبَارَزَةَ للهِ تَعَالَى تُسْقِطُ الْعَبْدَ مِنْ عَيْنِهِ وَأَصْلِحْ مَا بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ فِي السِّرِّ وَقَدْ أَصْلَحَ لَكَ أَحْوَالَ الْعَلَانِيَةِ ‘গুনাহ থেকে সর্বাত্মকভাবে বেঁচে থাকবে; বিশেষত গোপন গুনাহ থেকে। কেননা আল্লাহর সাথে (গোনাহের মাধ্যমে) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে পাপ বান্দাকে তাঁর দৃষ্টি থেকে ফেলে দেয়। আল্লাহ ও তোমার মাঝে গোপনীয় বিষয় সংশোধন করো, তাহলে তিনি তোমার বাহ্যিক বিষয় সংশোধন করে দেবেন’।[1] ইমাম ইবনুল আরাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,أَخْسَرُ الْخَاسِرِيْنَ مَنْ أَبْدَى لِلنَّاسِ صَالِحَ أَعْمَالِهِ، وَبَارَزَ بِالْقَبِيْحِ مَنْ هُوَ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيْدِ ‘সর্বাধিক ক্ষতিগস্ত সে, যে মানুষের সামনে ভালো আমল জাহির করে, আর বদ আমলের মাধ্যমে সেই মহান সত্তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়, যিনি তার শাহরগ থেকেও অধিক নিকটবর্তী’।[2] হাফেয ইবনু রজব হাম্বলী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,أَنَّ خَاتِمَةَ السُّوءِ تَكُونُ بِسَبَبِ دَسِيسَةٍ بَاطِنَةٍ لِلْعَبْدِ لَا يَطَّلِعُ عَلَيْهَا النَّاسُ إِمَّا مِنْ جِهَةِ عَمَلٍ سَيِّئٍ وَنَحْوِ ذَلِكَ، فَتِلْكَ الْخَصْلَةُ الْخَفِيَّةُ تُوجِبُ سُوءَ الْخَاتِمَةِ عِنْدَ الْمَوْتِ ‘বান্দার মন্দ মৃত্যু হয়ে থাকে গোপন গুনাহের কারণে, যা মানুষ জানে না; চাই তা খারাপ কোনো আমল হোক বা অন্য কিছু। তার এ গোপন চরিত্রই মৃত্যুর সময় মন্দ পরিণাম অবধারিত করে’।[3]
গোপন গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার উপায় :
(১) পাপের জন্য আন্তরিকভাবে অনুশোচনা ও কান্নাকাটি করা এবং আল্লাহর কাছে দু‘আ করা; যেন তিনি তাকে তাঁর সকল নাফরমানী ও গুনাহ থেকে হেফাযত করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ ‘আর আমার বান্দারা যখন আপনাকে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে; (তখন আপনি বলে দিন) নিশ্চয়ই আমি (তাদের) সন্নিকটেই রয়েছি; আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করি, যখন সে আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই তারা যেন আমাকে মান্য করে, আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, যাতে তারা সৎপথে পরিচালিত হতে পারে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৬)।
(২) নিজের অন্তর্গত সত্তার সাথে যুদ্ধ করা, তার কুমন্ত্রণা দূর করা এবং আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا - فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا - قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا - وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا ‘শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, তাঁর। অতঃপর তাকে অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। অবশ্যই সফলকাম হয়েছে সেই ব্যক্তি, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে, আর অবশ্যই ব্যর্থ হয়েছে সেই ব্যক্তি যে নিজেকে কলুষিত করেছে’ (আশ-শামস, ৯১/৭-১০)। তিনি আরও বলেন,وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ ‘যারা আমাদের (সন্তুষ্টি লাভের) জন্য প্রচেষ্টা করবে, অবশ্যই আমরা তাদেরকে আমাদের পথসমূহে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৬৯)।
(৩) ক্বিয়ামতের দিন গোপন গুনাহকারীদের আমলসমূহ ধূলিকণার ন্যায় উড়িয়ে দেওয়ার কথা মনের ভাবনায় চিরজাগরুক করে রাখা। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لأَعْلَمَنَّ أَقْوَامًا مِنْ أُمَّتِى يَأْتُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِحَسَنَاتٍ أَمْثَالِ جِبَالِ تِهَامَةَ بِيضًا فَيَجْعَلُهَا اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ هَبَاءً مَنْثُورًا قَالَ ثَوْبَانُ يَا رَسُولَ اللَّهِ صِفْهُمْ لَنَا جَلِّهِمْ لَنَا أَنْ لاَ نَكُونَ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لاَ نَعْلَمُ قَالَ أَمَا إِنَّهُمْ إِخْوَانُكُمْ وَمِنْ جِلْدَتِكُمْ وَيَأْخُذُونَ مِنَ اللَّيْلِ كَمَا تَأْخُذُونَ وَلَكِنَّهُمْ أَقْوَامٌ إِذَا خَلَوْا بِمَحَارِمِ اللهِ انْتَهَكُوهَا ‘আমি অবশ্যই আমার উম্মতের কিছু মানুষ সম্পর্কে জানি, যারা ক্বিয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালা সমতুল্য নেক আমল নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন’। ছাওবান রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যাই। তিনি বললেন, ‘তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা ইবাদত করবে, যেভাবে তোমরা করে থাকো। কিন্তু তারা এমন লোক হবে যে, যখন তারা একাকী থাকবে, তখন তারা আল্লাহর হারামকৃত কর্মে লিপ্ত হবে’।[4]
(৪) আল্লাহ তাআলার পর্যবেক্ষণের কথা চিন্তা করা ও মনে করা যে, তিনি আমাকে সর্বদাই দেখছেন এবং এ ব্যাপারে তাঁকে ভয় করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا ‘হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন; আর তাদের দুজন থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু নর ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচ্ঞা করে থাকো এবং তোমরা ভয় করো রক্ত সম্পর্ক (ছিন্ন করাকে)। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক’ (আন-নিসা, ৪/১)।
(৫) পাপ, অন্যায় বা গুনাহ করার সময় এ চিন্তা করা যে, আমার শ্রদ্ধেয় বড় কেউ দেখলে কি আমি এমন গুনাহ করতে পারতাম? এভাবে নিজের লজ্জাবোধ জাগ্রত করা। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,اسْتَحي اللهَ اسْتِحْيَاءَ رَجُلٍ ذِي هَيْبَةٍ مِنْ أَهْلِكِ ‘তুমি আল্লাহকে লজ্জা করো, যেভাবে তুমি তোমার পরিবারের কোনো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে লজ্জা পাও’।[5]
(৬) নিজে মনে মনে এ চিন্তা করা যে, গুনাহরত অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হয়ে যায়, তাহলে কীভাবে আমি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করব। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,يُبْعَثُ كُلُّ عَبْدٍ عَلَى مَا مَاتَ عَلَيْهِ ‘প্রত্যেক ব্যক্তিকে (ক্বিয়ামতের দিন) ওই অবস্থায় উঠানো হবে, যে অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করেছে’।[6]
(৭) আল্লাহর নেয়ামত ও জান্নাতের সুখ-শান্তির কথা স্মরণ করা এবং জাহান্নামের আযাব ও ভয়াবহ শাস্তির কথা কল্পনা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي آيَاتِنَا لَا يَخْفَوْنَ عَلَيْنَا أَفَمَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ خَيْرٌ أَمْ مَنْ يَأْتِي آمِنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ‘নিশ্চয় যারা আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে বক্রপথ অবলম্বন করে তারা আমার অগোচরে নয়। যে অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হবে সে কি উত্তম, নাকি সে, যে ক্বিয়ামত দিবসে নিরাপদভাবে উপস্থিত হবে (সে উত্তম)? তোমাদের যা ইচ্ছা আমল করো। নিশ্চয় তোমরা যা আমল কর তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা’ (ফুছছিলাত, ৪১/৪০)।
(৮) ব্যক্তিগত জীবনের অবসরে যিকির ও ফিকিরে থাকার চেষ্টা করা। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ ‘নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনের মাঝে বহু নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য’ (আলে ইমরান, ৩/১৯০)।
তিনি আরও বলেন,الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ ‘যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে এবং তারা আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে। (তারা বলে,) হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এসব অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি পবিত্র মহান। সুতরাং আপনি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন’ (আলে ইমরান, ৩/১৯১)।
আল্লাহ তাআলার কাছে আমরা ঈমানের জন্য নিয়মিত দু‘আ করতে থাকি, গোপন গুনাহ থেকে সর্বাত্মকভাবে বেঁচে থাকি, মোবাইল ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার থেকে দূরে থাকি। দ্বীনদার আলেমদের ছোহবতে বেশি বেশি থাকি এবং কুরআন তেলাওয়াত, যিকির-আযকার ও ইসলামী বই অধিকহারে অধ্যয়ন করতে শুরু করি। পাপ হয়ে গেলে দ্রুতই ফিরে আসতে হবে এবং তওবা করতে হবে। পাপের উপর অটল থাকা যাবে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন। শিরকমুক্ত ঈমান ও বিদআতমুক্ত আমল করার তাওফীক্ব দান করুন। ঈমানের হালতে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
[1]. ছয়দুল খাত্বির (প্রকাশনী : দারুল ক্বালাম, দামেশক), পৃ. ২০৭।
[2]. তারীখু দিমাশক্ব (প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরূত), ৫/৩৫৬।
[3]. জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম (প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরূত), ১/১৭২-১৭৩।
[4]. ইবনু মাজাহ, হা/৪২৪৫, হাদীছ ছহীহ।
[5]. মুসনাদে বাযযার, ১/৪০৫, হা/২৬৪২।
[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৭৮।