ঈমান হচ্ছে আল্লাহর উপর বিশ্বাস। এই বিশ্বাস বিভিন্ন কারণে বিভিন্নভাবে নষ্ট হয়ে যায়। আর ঈমান নষ্ট হওয়া মানেই ঈমান ভঙ্গ হওয়া। আজ আমরা কী কী কারণে ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তা জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
প্রাককথা :
ঈমান ভঙ্গের কারণ জানতে হলে আগে পরিপূর্ণ ঈমান কী, সেটা জানতে হবে। আর পরিপূর্ণ ঈমান কী জানার আগে ইসলাম কী সেটা জানা উচিত। ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর পরিপূর্ণ বিধানে আনুগত্য করা। এই পরিপূর্ণ বিধানকে মুখে স্বীকৃতি, অন্তরে বিশ্বাস এবং কাজে পূর্ণ করাই হচ্ছে ঈমান। যার সহজ অর্থ হলো ইসলামের বিধানকে মুখে স্বীকার করা, অন্তরে বিশ্বাস করা এবং সেইমতে কাজ (আমল) করাই হচ্ছে ঈমান। যে এই কাজ অর্থাৎ ঈমান এনে ইসলামের প্রতি আনুগত্যশীল হয় তাকে বলা হয় মুসলিম।
সুতরাং ঈমানের অর্থ হলো আল্লাহ এবং আল্লাহ সম্পর্কিত সকল বিষয়ের উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস। এই বিশ্বাস মূলত তিনভাবে তথা বিশ্বাসগত, কর্মগত এবং উক্তিগতভাবে ভঙ্গ হয়ে থাকে। এখন আমরা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে প্রধানত কী কী কারণে ঈমান ভঙ্গ হয়ে যায় তা জানার চেষ্টা করব।
(১) শিরক করা :
আল্লাহর সাথে শিরক করার কারণে যেকোনো ঈমানদার তার ঈমান হারিয়ে ফেলে। শিরক অর্থ হলো আল্লাহর সাথে অন্যান্য ইলাহ বা উপাস্য সাব্যস্ত করা। অর্থাৎ আল্লাহর সমকক্ষ অন্য কাউকে মনে করা, স্বীকার করা বা কাজে প্রমাণিত করা। বিভিন্নভাবে শিরক হয়ে থাকে। যেমন—
(ক) ইবাদতের শিরক : আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করে তার ইবাদত করা হচ্ছে ইবাদতের শিরক। অর্থাৎ আল্লাহর জন্য যেমন সিজদা, ছিয়াম, কুরবানী, তাওয়াফ ইত্যাদি করা হয়, ঠিক তেমনি অন্য কোনো উপাস্যকে যেমন : দেব-দেবী, আল্লাহর কোনো বান্দার (পীরের) জন্য বা অন্য কারও (ওলী, আউলিয়ার) উদ্দেশ্যে একইভাবে জীবিত বা কবরের ব্যক্তির জন্য সিজদা, ছিয়াম, মান্নত, কুরবানী, তাওয়াফ ইত্যাদি করা হচ্ছে সুস্পষ্ট শিরক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর সাথে অন্য কোনো উপাস্য স্থির করো না। তাহলে নিন্দিত ও (আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে) বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’ (বানী ইসরাঈল, ১৭/৩৯)। অন্য আয়াতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী!) আপনি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকবেন না। তাহলে আপনি শাস্তিতে নিপতিত হবেন’ (আশ-শুআরা, ২৬/২১৩)।
আল্লাহ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা যাবে না। শুধু তাই নয়; আল্লাহ সরাসরি তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কেও নির্দেশ দিয়েছেন শরীক না করার জন্য। অথচ সকল নবী-রাসূলগণ হচ্ছেন নিষ্পাপ। আল্লাহ এটা এই জন্যই বললেন, যাতে মানুষ শিরকের ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারে। অথচ অনেকে শিরক সম্পর্কে না জানার কারণে বিভিন্ন পীর-ওলী-আউলিয়ার দরবারে গিয়ে সিজদা, মান্নত, তাওয়াফ, কুরবানী ইত্যাদি করছে- যদিও এইসব ইবাদত শুধু আল্লাহর জন্য।
(খ) আল্লাহর ছিফাতের সাথে শিরক : আল্লাহর গুণাবলিতে অন্য কাউকে গুণান্বিত করা। অর্থাৎ আল্লাহর যা করার ক্ষমতা আছে তা তাঁর অন্য কোনো বান্দা বা অন্য কেউ করতে পারে এমন বিশ্বাস রাখা হচ্ছে আল্লাহর ছিফাতের সাথে শিরক।
আল্লাহর ক্ষমতা হচ্ছে কাউকে জীবন দেওয়া, নেওয়া, সুখ, দুঃখ, সন্তান দেওয়া, বিপদে উদ্ধার করা ইত্যাদি। এখন কেউ যদি আল্লাহর কোনো বান্দার বা অন্য কারও এমন ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করে, তাহলে তা হবে শিরক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে নবী!) বলুন, তবে কি তোমরা আল্লাহ ব্যতীত এমন অভিভাবক স্থির করেছ, যারা ভালো ও মন্দের মালিকও নয়’ (আর-রা‘দ, ১৩/১৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র-কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান’ (আশ-শূরা, ৪২/৪৯-৫০)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোনো দুর্দশা (দুঃখ-কষ্ট) দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ছাড়া তা দূরকারী কেউ নেই। আর যদি কোনো কল্যাণ (সুখস্বাচ্ছন্দ্য) দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনিই তো সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’ (আল-আনআম,৬/১৭)।
উপরিউক্ত আয়াতগুলো দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, সবকিছুর উপরই আল্লাহর ক্ষমতা। তিনিই একক এবং একমাত্র ক্ষমতাবান। তিনিই মানুষকে দুঃখ, দুর্দশা, সুখ, শান্তি, সন্তান ইত্যাদি প্রদান করেন। তিনি তাঁর ক্ষমতা কাউকে প্রদান করেননি যে, অন্য কেউ তা দিতে পারবেন। সুতরাং কোনো বান্দা আল্লাহর জন্য খাছ, এমন কোনো কিছু তিনি ছাড়া আর কারো নিকট চাইলে তার ঈমান চলে যাবে।
(গ) আল্লাহর রাজত্বের সাথে শিরক : আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির সাথে তাদের জীবনযাপন করার জন্য বিভিন্ন বিধিবিধানও তৈরি করে দিয়েছেন। ইসলাম হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবন-বিধান। যে বিধান বা সংবিধান দিয়ে মুসলিমগণ তাদের সকল সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালনা করবে।
এখন যদি কেউ আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে নতুন কোনো দুনিয়াবী বিধান (বাধ্যতামূলক না হলে আপসে) মেনে নেয় বা প্রতিষ্ঠা করে বা করার জন্য সাহায্য করে, তাহলে তা হবে আল্লাহর রাজত্বের সাথে শিরক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জেনে রেখো! সৃষ্টি যেহেতু তাঁর (আল্লাহর) সুতরাং সমগ্র সৃষ্টির উপর ক্ষমতাও একমাত্র (আল্লাহর) তাঁর’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৫৪)। অন্য আয়াতে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ ব্যতীত বিচার-ফয়সালা ও শাসন করার ক্ষমতা কারও নেই’ (আল-আনআম, ৬/৫৭)।
উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য এই ঘোষণা দিচ্ছেন যে, সবকিছুর মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। আর তাঁর সৃষ্টির উপর তাঁর বিধিবিধানেরই ক্ষমতা চলবে। দুনিয়ার কারও কোনো বিধান বা সংবিধান এখানে প্রযোজ্য নয়। যদি আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কিছু তালাশ করে, তবে তা হবে শিরক।
(২) কারো মাধ্যমে আল্লাহর কাছে চাওয়া :
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা দেন যে, তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি তাঁর বান্দাদের শোনেন এবং দেখেন। তাঁর বান্দাদের যেকোনো প্রয়োজনে তিনি সাড়া দেন। তারপরও কেউ যদি আল্লাহর কাছে কিছু চাইতে বা বিপদে উদ্ধার হতে আল্লাহর কোনো বান্দাকে মাধ্যম ধরে বা অছীলা মনে করে, তবে তা হবে শিরক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তবে আল্লাহর উপর ভরসা করো’ (আল-মায়েদা, ৫/২৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘বলুন, (হে নবী!) আমার পক্ষে আল্লাহই যথেষ্ট। নির্ভরকারীরা যেন তাঁরই উপর নির্ভর করে’ (আয-যুমার, ৩৯/৩৮)।
অর্থাৎ যারা ঈমানদার তারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করবে। যারা সরাসরি আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহর কাছে মাধ্যম বানাবে তারা গোমরাহীতে লিপ্ত হয়ে ঈমানহারা হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা আল্লাহকে ব্যতীত যার ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না; উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, ‘এইগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী’। বলুন, ‘তোমরা কি আল্লাহকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর এমন কিছুর সংবাদ দিবে যা তিনি জানেন না? তিনি মহান, পবিত্র’ এবং তারা যাকে শরীক করে তা হতে তিনি ঊর্ধ্বে’ (ইউনুস, ১০/১৮)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘জেনে রেখো, আল্লাহর জন্যই বিশুদ্ধ ইবাদত-আনুগত্য। আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ইবাদত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে’। যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে নিশ্চয় আল্লাহ সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী কাফের, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হেদায়াত দেন না’ (আয-যুমার, ৩৯/৩)।
উপরিউক্ত আয়াত দ্বারা এটা সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, যারা আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া বা পাওয়ার জন্য অন্য কাউকে মিডিয়া বা মাধ্যম বানাবে বা প্রয়োজন মনে করবে, তাহলে তা হবে আল্লাহর সাথে শিরক। অর্থাৎ যিনি আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী হিসাবে কাউকে মাধ্যম মানবেন তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ আল্লাহর কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশায় তথাকথিত পীর-ওলী-আউলিয়া ইত্যাদির দরবারে গিয়ে তাদের নাম করে সিজদা, মান্নত, কুরবানী করা হচ্ছে শিরক। যা ঈমানদারের ঈমান নষ্ট করে শিরকে লিপ্ত করে।
(৩) মুশরিক-কাফেরদের কাফের মনে না করা :
কেউ যদি স্বীকৃত মুশরিক-কাফেরদের কাফের মনে না করে, তাদের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে, তাদের খারাপ মনে না করে, তাহলে ঐ ব্যক্তির ঈমান চলে যাবে। আল্লাহ সুস্পষ্ট বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুশরিকরা অপবিত্র’ (আত-তওবা, ৯/২৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আহলে কিতাবদের (ইয়াহূদী, খ্রিষ্টানদের) মধ্যে যারা কুফরী করেছে এবং শিরক করে, তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং এরাই সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট সৃষ্টি’ (আল-বাইয়িনাহ,৯৮/৬)।
অতএব আল্লাহর ঘোষণা চূড়ান্ত যে, ইয়াহূদী, নাছারা, মুশরিক (যারা আল্লাহর সাথে শিরক করে) তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী। তাদের ব্যাপারে কাফের নয় (তারাও আল্লাহর বান্দা তারাও ভালো কাজে নাজাত পাবে) এমন সন্দেহ করা যাবে না। কেউ এমন করলে তার ঈমান থাকবে না।
(৪) ইসলামের বিধানকে অচল মনে করা :
আল্লাহর দেওয়া বিধিবিধানকে প্রাগৈতিহাসিক পুরোনো অচল ইত্যাদি মনে করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা। অর্থাৎ আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেওয়া বিধিবিধান না মেনে অন্য কোনো দুনিয়াবী বিধিবিধান বা সংবিধান মেনে চলা এবং ঐটাকেই যথার্থ মনে করা।
যারা আপসে কোন বাধ্যবাধকতা ছাড়াই ইসলামী বিধিবিধান মানবে না এবং দুনিয়াবী বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করবে এবং মানবে তাদের ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো কাজের আদেশ করলে কোনো ঈমানদার নারী-পুরুষের সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার নেই। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে, সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে’ (আল-আহযাব, ৩৩/৩৬)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তার কাছে সরল পথ (ইসলাম) প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সব মুসলিমের অনুসৃত পথের (রাসূলের সুন্নাহর) বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থল’ (আন-নিসা, ৪/১১৫)।
উপরিউক্ত আয়াত দ্বারা এটা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর কাছে ইসলাম ব্যতীত কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই কেউ যদি ইসলাম ব্যতীত অন্য কিছু মানে, ভালো লাগে বা মানানোর জন্য অন্যকে উৎসাহিত বা চাপ দেয়, তাহলে তার ঈমান বাতিল হয়ে যাবে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।