সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক মহান আল্লাহ জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাথীর প্রতি।
পরকথা হলো, ‘বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সালাফীদের ভূমিকা’ বিষয়ে আলোচনা করা বর্তমান সময়ে খুবই গুরুত্বের দাবিদার। কেননা বর্তমানে পুরো বিশ্ব ফিলিস্তীন ও অন্যান্য স্থানের মুসলিমদের প্রতি কাফেরদের মহা অত্যাচার প্রত্যক্ষ করছে।
ইউক্রেনে যখন যুদ্ধ হলো, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো, তখন আমেরিকা ও ইউরোপের কাফেররা বলল, এ যুদ্ধ মোটেও ঠিক হচ্ছে না। এটা অন্যায়। পক্ষান্তরে যখন ফিলিস্তীনে যুদ্ধ হলো, তাদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে ফেলা হলো, তখন তারাই আবার গলাবাজি করে বলল, এটা ইয়াহূদীদের অধিকার। এটা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়। তারা মূলত যুদ্ধ করছে নিজেদের দেশ থেকে শত্রু দূর করার জন্য!
রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা করল, তখন তা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়ে গেল, কিন্তু ইয়াহূদীরা যখন ফিলিস্তীনের উপর হামলা করল, তখন তা কিছুই নয়। তারা যুদ্ধ করছে নিজেদের রক্ষার জন্য। তারা যুদ্ধ করছে শত্রুদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য! (আল্লাহই সর্বোত্তম সহায়ক) তাই সালাফদের অনুসারী আহলেহাদীছদের উপর আবশ্যক হলো, বিশ্বে কোথায় কী হচ্ছে সে সম্পর্কে সচেতন থাকা, উদাসীন না থাকা।
ভারতের মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীকে কারা সাহায্য করত? সে নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবি করত, অথচ সে মুসলিম ছিল না। তাকে সাহায্য করত বৃটিশরা। কেন তারা তাকে এত কাড়িকাড়ি টাকা দিয়ে সাহায্য করত? কী ছিল তাদের অভিপ্রায়? তারা তাকে সাহায্য করত মুসলিমদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করার জন্য। মুসলিমদের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করার জন্য।
এ বৃটিশরাই ভারতে আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে দেওবন্দী তাবলীগ জামাআতকে শক্তি জোগাত, তাদেরকে সাহায্য করত। কেন তারা তাদেরকে সাহায্য করত? তাদেরকে সাহায্য করত মুসলিমকে দলে দলে বিভক্ত করার জন্য।
ইরানে খোমেনীকে কারা সহায়তা জোগায়? বিপদে কারা তার পাশে দাঁড়িয়ে সাপোর্ট করে? তাকে সহায়তা করে ফ্রান্স ও ব্রিটেন। তারাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতকে হত্যা করার জন্য ইরানের শীআদেরকে সাহায্য করে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে উসামা ইবনে লাদেনের ‘আল-কায়েদা’ সংস্থাকে আমেরিকা সম্পদ দিয়ে সহায়তা করল। তাকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করল। তারপর তারাই ঘোষণা করল উসামা একজন প্রথম শ্রেণির সন্ত্রাসী এবং তাকে হত্যা করল। তারাই তাকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তৈরি করল, তারাই তাকে শক্তি জোগালো, পরে আবার তারাই তাকে হত্যা করল। এটা কি শান্তি!? এটাই কি শান্তি প্রতিষ্ঠার নমুনা!?
আইএসকে কারা সাহায্য করে? তারা কোথা থেকে আসল? ইরান, আমেরিকা, ইসরাঈল মুসলিমদের জবাই করার জন্য তাদেরকে সাহায্য করে।
ইয়ামানের ছোট একটি দল হূছীকে আমেরিকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেন কেন সাহায্য করে? তাদেরকে সাহায্য করে সঊদীতে অস্থিরতা তৈরি করার জন্য। ইয়ামান ও সঊদীর আহলুল হাদীছদের মাঝে যুদ্ধ সৃষ্টি করার জন্য।
কাফেররা জোর গলায় দাবি করে যে, তারাই শান্তিকামী! অথচ বাস্তব কথা হলো, তারাই ফেতনাবাজ, যুদ্ধবাজ ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী।
ইসলাম হলো শান্তির জীবনবিধান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই হলেন— শান্তিদাতা, নিরাপত্তা বিধায়ক, রক্ষক, পরাক্রমশালী, প্রবল, অতীব মহিমান্বিত। তিনিই মানুষদেরকে শান্তির নিবাসের দিকে আহ্বান করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা সরল সঠিক পথের হেদায়াত করেন। আল্লাহ তাআলা ইসলামকে শান্তির জীবনবিধান নামে অভিহিত করে বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা পূর্ণাঙ্গভাবে শান্তি তথা ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (আল-বাক্বারা, ২/২০৮)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ ‘সেই প্রকৃত মুসলিম, যার জিহ্বা ও হাত হতে সকল মুসলিম নিরাপদ’।[1]
সুতরাং মুসলিমগণ তার অপর মুসলিম ভাইদের নিরাপত্তাদাতা। আর যারা শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে, তাদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিতকারী। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ‘আর তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তবে আপনিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবেন এবং আল্লাহর উপর নির্ভর করুন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (আল-আনফাল, ৮/৬১)।
সুতরাং মুসলিমদের দুর্বলতার সময় কাফেররা যদি শান্তিচুক্তি করতে চায়, তাহলে আমরা তাদের সাথে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হব। তাদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। কিন্তু ইসলাম ও মুসলিমগণ যখন শক্তিশালী থাকবেন, তখন তারা যদি শান্তিচুক্তি করতে চায়, তবে আমরা বলব ইসলাম ছাড়া কোনো শান্তি নেই, নিরাপত্তা নেই। অথবা মুসলিমদের নিকট আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনো নিরাপত্তা নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,فَلَا تَهِنُوا وَتَدْعُوا إِلَى السَّلْمِ وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ وَاللَّهُ مَعَكُمْ وَلَنْ يَتِرَكُمْ أَعْمَالَكُمْ ‘কাজেই তোমরা হীনবল হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না যখন তোমরা প্রবল; আর আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন এবং তিনি তোমাদের কর্মফল কখনো বিনষ্ট করবেন না’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/৩৫)।
সুতরাং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সালাফীদের ভূমিকা কী?
(১) তারা আল্লাহর তাওহীদ বাস্তবায়ন করেন এবং শিরকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
সুতরাং হে আহলেহাদীছগণ! একনিষ্ঠভাবে তাওহীদের দিকে আহ্বানে প্রচেষ্টা করুন। ‘আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার অর্থে কোনো মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল’ —এ বাণীর প্রচারে নিজেকে বিলিয়ে দিন। শিরক ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যয় করুন।
তবে আমরা অবশ্যই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথনির্দেশনা অনুসরণ করব। তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ করব। কেননা কিছু মানুষ শান্তি প্রতিষ্ঠার অজুহাত দিয়ে সমাজে আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, ইসলামের বিকৃতি সাধন করে। খারেজীদের চরমপন্থার দিকে মানুষকে আহ্বান করে এবং ইসলামকে লোক সমাজে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যেন মনে হয় ইসলাম একটি সন্ত্রাসী ধর্ম। আবার কেউ কেউ রয়েছে গোল আলু, সুবিধাবাদী। মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব রাখে, কাফেরদেরকে ভালোবাসে, ধর্ম স্বাধীনতা চায়, আক্বীদার ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখায়। যেমন- ইখওয়ানুল মুসলিমীন বা জামাআতে ইসলামী।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত হলো মধ্যমপন্থী; সীমালঙ্ঘনকারীও নয়, শিথিলতা প্রদর্শনকারীও নয়। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন,وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ ‘আর এভাবে আমরা তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির উপর সাক্ষী হও’ (আল-বাক্বারা, ২/১৪৩)।
(২) তারা শারঈ ইলম অর্জন করেন এবং তা প্রচারের মাধ্যমে মূর্খতা দূর করার কাজে নিয়োজিত থাকেন। ইলমের দিকে মানুষকে আহ্বান করেন। কেননা মুশরিক ও বিদআতীদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তারা শারঈ ইলম সম্পর্কে অজ্ঞ। ইসলাম সম্পর্কে জাহেল। —মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। মাদরাসা ও আলেমদের সমর্থন করেন। তালেবুল ইলমদেরকে সাপোর্ট করেন, যেন তারা সমাজে উন্নতি করতে পারে। তাদের মাঝে সঠিক ইলম প্রচার করতে পারে। বিদআত ও শিরকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। আলেমদেরকে সম্মান করেন, তাদেরকে মর্যাদা দেন; তবে তারা অতি সতর্ক থাকেন, এ সম্মান যেন তাদেরকে ইবাদত করার পর্যায়ে নিয়ে না যায়। অপাত্রে কন্যাদানের মতো না হয়ে যায়। বরং তারা অবলম্বন করেন মধ্যমপন্থা, তাদেরকে সম্মান করেন, মর্যাদা দেন, তবে তাদের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেন না।
(৩) মুসলিম ও মুশরিকদের সাথে কৃত অঙ্গীকার ও চুক্তি রক্ষা করেন। চুক্তির ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার শরীআত প্রয়োগ করেন। আর ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিম নেতাদের সাথে শারঈ আচরণ করেন অর্থাৎ যতক্ষণ না আল্লাহর শরীআত-বিরোধী কোনো নির্দেশ দেয়, ততক্ষণ তাদের আনুগত্য করেন। তাদের জন্য দু‘আ করেন আল্লাহ তাআলা যেন তাদেরকে সঠিক বুঝ দান করেন ও সঠিক পথে পরিচালনা করেন।
পরিশেষে একটি প্রশ্ন, হে সালাফী ভাইয়েরা! আমরা কি ইয়াহূদীদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে চাই না? হ্যাঁ, অবশ্যই চাই। তবে আল্লাহ তাআলার এ বাণীটি স্মরণ রাখুন। তিনি বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ ‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো, তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পাসমূহ সুদৃঢ় করবেন’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/৭)।
‘আল্লাহকে সাহায্য করো’-এর মর্মার্থ কী? —এর মর্মার্থ হলো, তাঁর শরীআত বাস্তবায়ন করো, তাঁর একত্ব ঘোষণা করো, তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের অনুসরণ করো এবং সঠিক পন্থায় সংগ্রাম করো, তাহলে আল্লাহ আপনাদেরকে সাহায্য করবেন।
হে আল্লাহ! আপনি ইয়াহূদীদের ধ্বংস করুন, তাদের সংখ্যাগুলো গণনা করে রাখুন, তাদের শক্তি নস্যাৎ করে দিন, তাদের কাউকে ছাড় দিবেন না। হে আল্লাহ! আপনি ইয়াহূদীদের অপবিত্রতা থেকে মসজিদে আক্বছাকে মুক্ত করুন। ফিলিস্তীনকে ইয়াহূদীদের কবল থেকে রক্ষা করুন। হে আল্লাহ! স্পষ্ট হক্বের উপর মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করুন। আমাদেরকে আপনার দ্বীনের আনছার (সাহায্যকারী) হিসেবে কবুল করে নিন। মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দান করুন। আপনার সৎ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন।
মূল : শায়খ ড. উসামা ইবনে আত্বায়া আল-উতায়বী*
* বিশিষ্ট দাঈ, জর্ডান।
পরিমার্জিত অনুবাদ : মাহফুজুর রহমান বিন আব্দুস সাত্তার**
** কুল্লিয়া ১ম বর্ষ, মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া, উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১০।