বায়‘আতের শর্ত: বায়‘আত বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য নিম্নবর্ণিত শর্তসমূহ প্রযোজ্য—
(১) গণ্যমান্য ও নেতৃস্থানীয় (أَهْلُ الْحَلِّ وَالْعَقْدِ) ব্যক্তিবর্গের একটি দল বায়‘আত সম্পাদনে সরাসরি অংশগ্রহণ করবেন।
(২) যার বায়‘আত গ্রহণ করা হবে, তার মধ্যে রাষ্ট্রনেতা হওয়ার শর্ত বিদ্যমান থাকতে হবে।
(৩) যার বায়‘আত গ্রহণ করা হবে, তাকে বায়‘আত গ্রহণে রাজি হতে হবে। তিনি যদি বায়‘আত গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন, তাহলে তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না।
(৪) বায়‘আত নির্দিষ্টভাবে একজনের জন্যই হতে হবে। একাধিক ব্যক্তির বায়‘আত সংঘটিত হবে না।
(৫) বায়‘আত কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে হতে হবে। এ দু’টির উপর আমল করতে হবে এবং জনগণকে এ দু’টির উপর আমলের জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
(৬) বায়‘আতের ব্যাপারে জনগণকে স্বাধীনতা দিতে হবে। প্রত্যেকেই স্বেচ্ছায় বায়‘আত গ্রহণ করবেন; কাউকে বাধ্য করা যাবে না।
এগুলো বায়‘আতের গুরুত্বপূর্ণ কিছু শর্ত, যেগুলো পূর্ণ হলে বায়‘আত শুদ্ধ হবে। আর এগুলোর কোনো একটি না থাকলে বায়‘আত সংঘটিত হবে না।[1]
বায়‘আতের পদ্ধতি: রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য যার মধ্যে যথোপযুক্ত শর্ত পাওয়া যাবে, তাকে নির্বাচন করতে ও ক্ষমতায় বসাতে দেশের সজাগ, বিবেকবান, গণ্যমান্য নেতৃস্থানীয় আলেম-উলামা ও ব্যক্তিবর্গ প্রথমে তার হাতে হাত রেখে বায়‘আত করবেন। তবে তাদের সবাইকে সরাসরি বায়‘আত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হবে, সেটাও ঠিক নয়। যাহোক, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের পরে সাধারণ জনগণের সবাই মৌখিক বায়‘আত করবেন বা মেনে নিবেন।[2] সাধারণ জনগণ কর্তৃক মেনে নেওয়াই যথেষ্ট হবে; তাদেরকে হাতে হাত রেখে বায়‘আত করতে হবে না।
মাযেরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,يَكْفِي فِي بَيْعَةِ الْإِمَامِ أَنْ يَقَعَ مِنْ أَهْلِ الْحَلِّ وَالْعَقْدِ وَلَا يَجِبُ الِاسْتِيعَابُ وَلَا يَلْزَمُ كُلُّ أَحَدٍ أَنْ يَحْضُرَ عِنْدَهُ وَيَضَعَ يَدَهُ فِي يَدِهِ بَلْ يَكْفِي الْتِزَامُ طَاعَتِهِ وَالِانْقِيَادُ لَهُ بِأَنْ لَا يُخَالِفَهُ وَلَا يَشُقَّ الْعَصَا عَلَيْهِ ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ তথা গণ্যমান্য ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রনেতার বায়‘আত গ্রহণই যথেষ্ট হবে। তবে তাদের সবার অংশগ্রহণ যেমন ওয়াজিব নয়, তেমনি তাদের সবার সেখানে উপস্থিত হওয়া ও রাষ্ট্রনেতার হাতে হাত রেখে বায়‘আত করাও জরুরী নয়। বরং এমনভাবে রাষ্ট্রনেতার আনুগত্য করা ও তাকে মেনে নেওয়া যথেষ্ট হবে যে, তারা তার বিরোধিতা করবেন না এবং তার শক্তি খর্ব করবেন না’।[3]
ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,أَمَّا الْبَيْعَةُ فَقَدِ اتَّفَقَ الْعُلَمَاءُ عَلَى أَنَّهُ لَا يُشْتَرَطُ لِصِحَّتِهَا مُبَايَعَةُ كُلِّ النَّاسِ وَلَا كُلِّ أَهْلِ الْحَلِّ وَالْعِقْدِ وَإِنَّمَا يُشْتَرَطُ مُبَايَعَةُ مَنْ تَيَسَّرَ إِجْمَاعُهُمْ مِنَ الْعُلَمَاءِ وَالرُّؤَسَاءِ وَوُجُوهِ النَّاسِ ... لَا يَجِبُ عَلَى كُلِّ وَاحِدٍ أَنْ يَأْتِيَ إِلَى الْإِمَامِ فَيَضَعَ يَدَهُ فِي يَدِهِ وَيُبَايِعَهُ وَإِنَّمَا يَلْزَمُهُ إِذَا عَقَدَ أَهْلُ الْحَلِّ وَالْعَقْدِ لِلْإِمَامِ الِانْقِيَادُ لَهُ وأن لا يظهر خلافا ولا يشق لعصا ‘বায়‘আতের ব্যাপারে আলেমগণ একমত হয়েছেন যে, বায়‘আত শুদ্ধ হওয়ার জন্য না সকল মানুষের তাতে অংশ্রগহণ শর্ত, না গণ্যমান্য সকল ব্যক্তির অংশগ্রহণ শর্ত। বরং আলেম, নেতৃস্থানীয় ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যাদের একত্রিত করা সম্ভব, তাদের বায়‘আতে অংশগ্রহণ শর্ত। প্রত্যেকের হবু রাষ্ট্রনেতার নিকট উপস্থিত হয়ে তার হাতে হাত রেখে বায়‘আত করা আবশ্যক নয়। বরং নেতৃস্থানীয় ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক বায়‘আত সংঘটিত হলে সেই রাষ্ট্রনেতার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা, তার বিরোধিতা না করা এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা জরুরী’।[4]
উল্লেখ্য, কেবল পুরুষরা মনোনীত ব্যক্তির হাতে হাত রেখে বায়‘আত করবেন। আর নারীরা শুধু মৌখিক বায়‘আত করবেন। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে (নারীদেরকে) বলতেন, «انْطَلِقْنَ، فَقَدْ بَايَعْتُكُنَّ» وَلَا وَاللهِ مَا مَسَّتْ يَدُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَ امْرَأَةٍ قَطُّ، غَيْرَ أَنَّهُ يُبَايِعُهُنَّ بِالْكَلَامِ ‘যাও, আমি তোমাদের বায়‘আর গ্রহণ করেছি’। আল্লাহর কসম! কথার মাধ্যমে বায়‘আত গ্রহণ ছাড়া রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাত কখনো কোনো নারীর হাত স্পর্শ করেনি।[5] ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,فِيهِ أَنَّ بَيْعَةَ النِّسَاءِ بِالْكَلَامِ مِنْ غَيْرِ أَخْذِ كَفٍّ ‘হাদীছটিতে প্রমাণিত হয় যে, নারীদের বায়‘আত হবে কথার মাধ্যমে, এখানে হাত ধরার কোনো নিয়ম নেই’।[6]
বায়‘আত গ্রহণের অধিকার কার? এ বিষয়টা নিয়ে আমাদের দেশে যথেষ্ট ধুম্রজাল আছে। সেকারণে অনেককে বায়‘আত নিয়ে টানাটানি করতে দেখা যায়।
বায়‘আত কেবলমাত্র মুসলিম উম্মাহর একক খলীফা এবং কোনো দেশ বা অঞ্চলের মুসলিম সরকারের অধিকার। মুসলিম জাহানের একক খলীফা ছাড়া অন্য কারো জন্য বায়‘আত নেই মর্মে কেউ কেউ মত দিলেও তা আসলে সঠিক নয়। আমীর ছান‘আনী রাহিমাহুল্লাহ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী مَنْ خَرَجَ عَنْ الطَّاعَةِ ‘যে ব্যক্তি আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেল’-এর ব্যাখ্যায় বলেন, أَيْ طَاعَةِ الْخَلِيفَةِ الَّذِي وَقَعَ الِاجْتِمَاعُ عَلَيْهِ وَكَأَنَّ الْمُرَادَ خَلِيفَةُ أَيِّ قُطْرٍ مِنْ الْأَقْطَارِ إذْ لَمْ يُجْمِعْ النَّاسُ عَلَى خَلِيفَةٍ فِي جَمِيعِ الْبِلَادِ الْإِسْلَامِيَّةِ مِنْ أَثْنَاءِ الدَّوْلَةِ الْعَبَّاسِيَّةِ بَلْ اسْتَقَلَّ أَهْلُ كُلِّ إقْلِيمٍ بِقَائِمٍ بِأُمُورِهِمْ إذْ لَوْ حُمِلَ الْحَدِيثُ عَلَى خَلِيفَةٍ اجْتَمَعَ عَلَيْهِ أَهْلُ الْإِسْلَامِ لَقَلَّتْ فَائِدَتُهُ. ‘আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেল মানে এমন খলীফার আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেল, যার আনুগত্য করার ব্যাপারে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এখানে যে কোনো অঞ্চলের খলীফাকে বুঝানো হয়েছে। কেননা আব্বাসীয় শাসনামলের মাঝামাঝি সময় থেকে (আজ অবধি) সমগ্র মুসলিম জাহানে একক খলীফার ব্যাপারে মানুষ একমত হয়নি; বরং প্রত্যেকটা অঞ্চলের মানুষ নিজেদের শাসক নিয়ে পৃথক হয়ে গেছে। তাছাড়া হাদীছটিকে যদি মুসলিমদের একক খলীফার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে এর ফায়দা কমে যাবে’।[7]
আল্লামা শাওকানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আর ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও এর সীমানা প্রশস্ত হওয়ার পর একথা সুবিদিত যে, এখন প্রত্যেকটা অঞ্চলের শাসনভার একেকজন শাসকের উপর পড়েছে। অন্যান্য অঞ্চলেও একই অবস্থা। তাদের কারো আদেশ-নিষেধ অন্যের অঞ্চলে বাস্তবায়িত হয় না। এমন অনেক শাসক হওয়াতে কোনো দোষ নেই। এসব শাসকের প্রত্যেকের বায়‘আত সংঘটিত হওয়ার পর তার আনুগত্য করা ঐ অঞ্চলের লোকদের জন্য ওয়াজিব হয়ে যাবে, যেখানে তার আদেশ-নিষেধ কার্যকর হয়। যে অঞ্চলে কারো শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেখানকার লোকজন তার বায়‘আত নিয়েছে, সে অঞ্চলে যদি কেউ তার বিরোধিতা করতে আসে, তাহলে তওবা না করলে তাকে হত্যা করতে হবে। ...(পাঠক!) এই বিষয়টি উপলব্ধি করুন। কারণ তা শরী‘আতের সাধারণ নিয়ম এবং দলীল-প্রমাণের সাথে মিলে যায়। আর আপনি এর বিপরীত বক্তব্যকে পরিহার করুন। কেননা ইসলামের শুরুতে ইসলামী শাসনব্যবস্থা এবং বর্তমান সময়ের শাসনব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য সূর্যালোকের চেয়েও স্পষ্ট। যে ব্যক্তি এটাকে অস্বীকার করবে, সে মিথ্যুক; তার কাছে দলীল পেশ করার উপযুক্ত সে নয়; কারণ সে তা উপলব্ধি করতে পারে না’।[8]
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘সকল মাযহাবের ইমামগণ ইজমা পোষণ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো দেশ বা অঞ্চলের ক্ষমতা দখল করে, সকল ক্ষেত্রে তার বিধান গোটা মুসলিম জাহানের একক খলীফার মতোই। এটা যদি না হতো, তাহলে দুনিয়া ঠিক থাকত না। কেননা ইমাম আহমাদের আগে থেকে আজ পর্যন্ত এই লম্বা সময় ধরে মানুষ শুধু একজন শাসকের অনুসরণের ব্যাপারে একমত পোষণ করেনি; অথচ তারা এমন একজন আলেমের কথাও জানেন না, যিনি বলেছেন যে, সারা জাহানের একক খলীফা ছাড়া কোনো হুকুম ও বিচার বিশুদ্ধ হবে না’।[9]
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ একসময় সমগ্র মুসলিম জাহানের একক খলীফা ছাড়া বায়‘আত সম্পন্ন হবে না বলে মন্তব্য করলেও পরবর্তীতে তিনি এই মত থেকে ফিরে আসেন। শায়খ আলবানীর বিখ্যাত ছাত্র শায়খ আলী হাসান হালাবী প্রণীত ‘মাসায়েল ইলমিইয়্যাহ ফিস সিয়াসাতি ওয়াদ দা‘ওয়াতিশ শার‘ইয়্যাহ’ গ্রন্থটি তিনি সম্পাদনা করেন এবং জরুরী অবস্থায় একাধিক শাসক থাকতে পারেন বলে এই বইয়ের তথ্যকে তিনি গ্রহণ করেন। শায়খ হালাবী বলেন,وَلَمَّا (رَاجَعَ) –نَفَعَ اللهُ بِعُلُوْمِهِ- كِتَابَنَا –هَذَا-، (وَصَحَّحَهُ)، وَوَقَفَ عَلىَ هَذِهِ الْكَلِمَاتِ الْعِلْمِيَّةِ الْعَالِيَةِ الَّتِيْ تُجِيْزُ مِثْلَ هَذَا (التَّعَدُّدِ) –لِلضَّرُوْرَةِ-: تَبَنَّاهُ، وَانْشَرَحَ لَهُ صَدْرُهُ، وَاطْمَأَنَّ بِهِ ‘(শায়খ আলবানী) যখন আমার প্রণীত এই বইটি সম্পাদনা ও সংশোধন করেছিলেন এবং উচ্চ গবেষণালব্ধ বক্তব্যগুলো অবগত হয়েছিলেন, যেগুলো জরুরী কারণে একাধিক শাসকের বৈধতা দেয়, তখন এটাকেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন, এর জন্য তার বক্ষ প্রসারিত হয়েছিল এবং এতেই প্রশান্তি লাভ করেছিলেন -আল্লাহ তার ইলমের মাধ্যমে উপকৃত করুন-’।[10]
(ইনশা-আল্লাহ চলবে)
বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিল ইসলামী, ৫/৩০৭-৩০৮।
[2]. আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ৯/২৭৪-২৭৫ ও ২৮০।
[3]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী, ৭/৪৯৪।
[4]. নববী, আল-মিনহাজ শারহু ছহীহি মুসলিম ইবনিল হাজ্জাজ, ১২/৭৭।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২৮৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৬৬।
[6]. নববী, আল-মিনহাজ শারহু ছহীহি মুসলিম ইবনিল হাজ্জাজ, ১৩/১০।
[7]. সুবুলুস সালাম, (দারুল হাদীছ, তা. বি.), ২/৩৭৪।
[8]. আস-সায়লুল জাররার, (দারু ইবনি হাযম, প্রথম প্রকাশ, তা. বি.), পৃ. ৯৪১।
[9]. আদ-দুরার আস-সানিইয়্যাহ ফিল আজবিবাতিন নাজদিইয়্যাহ, (তাহক্বীক্ব: আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে ক্বাসেম, ৬ষ্ঠ প্রকাশ: ১৪১৭ হি./১৯৯৬ খ্রি.), ৫/৯।
[10]. আলী আল-হালাবী, মাসায়েল ইলমিইয়্যাহ ফিস সিয়াসাতি ওয়াদ দা‘ওয়াতিশ শার‘ইয়্যাহ, (মাকতাবাতু ইবনিল ক্বাইয়িম, কুয়েত, দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৪২২ হি./২০০১ খ্রি.), পৃ. ৭৪, টীকা নং- ২।