(সেপ্টেম্বর’২৪ সংখ্যায় প্রকাশিতের পর)
হাদীছের কঠোরতা: হাদীছের বিরুদ্ধে হাদীছ অস্বীকারকারীদের অন্যতম একটি অভিযোগ হচ্ছে, হাদীছের ভাষা কঠোরতায় পরিপূর্ণ। যে কঠোরতা থেকে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদের উত্থান হতে পারে আর এমন কঠোরতার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, কুরআন মাজীদে যে পরিমাণ জিহাদ ও কিতাল-সংক্রান্ত আদেশ এসেছে এবং বাহ্যিকভাবে সেই আয়াতগুলোকে যতটা কঠোর মনে হবে হাদীছের ভাণ্ডারে এমন কোনো কঠোর হাদীছ পাওয়া দুষ্কর। নিম্নে আমরা কিছু আয়াত পেশ করলাম, যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَأَخْرِجُوهُمْ مِنْ حَيْثُ أَخْرَجُوكُمْ وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ وَلَا تُقَاتِلُوهُمْ عِنْدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتَّى يُقَاتِلُوكُمْ فِيهِ فَإِنْ قَاتَلُوكُمْ فَاقْتُلُوهُمْ كَذَلِكَ جَزَاءُ الْكَافِرِينَ - فَإِنِ انْتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ - وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَلَا عُدْوَانَ إِلَّا عَلَى الظَّالِمِينَ - الشَّهْرُ الْحَرَامُ بِالشَّهْرِ الْحَرَامِ وَالْحُرُمَاتُ قِصَاصٌ فَمَنِ اعْتَدَى عَلَيْكُمْ فَاعْتَدُوا عَلَيْهِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدَى عَلَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
‘আর তাদেরকে যেখানে পাও, সেখানেই হত্যা করো। তাদেরকে সেখান থেকে বের করে দাও, যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করেছে। বস্তুত, ফেতনা-ফাসাদ বা দাঙ্গাহাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ। আর তাদের সাথে লড়াই করো না মসজিদুল হারামের নিকটে, যতক্ষণ না তারা তোমাদের সাথে সেখানে লড়াই করে। অবশ্য যদি তারা নিজেরাই তোমাদের সাথে লড়াই করে, তাহলে তাদেরকে হত্যা করো। এই হলো কাফেরদের শাস্তি। তবে যদি তারা বিরত হয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ফেতনা দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত এবং দ্বীন আল্লাহর জন্য নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। অতঃপর যদি তারা বিরত হয়, তবে যালেমদের উপর ছাড়া কোনো প্রকারের কঠোরতা অবলম্বন জায়েয হবে না। সম্মানিত মাস হচ্ছে সম্মানিত মাসের বিনিময়ে এবং পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব সবার জন্য সমান। কাজেই যে কেউ তোমাদের প্রতি কঠোর আচরণ করে, তাহলে তোমরাও তাদের প্রতি কঠোর আচরণ করো, যেমনি কঠোরতা সে তোমাদের প্রতি করেছে। আল্লাহকে ভয় করো এবং জেনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সঙ্গে আছেন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯১-১৯৪)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
‘আর হারাম মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলে তোমরা মুশরিকদের যেখানে পাও, সেখানেই হত্যা করো আর তাদেরকে বন্দি করো, তাদেরকে অবরোধ করো এবং প্রতিটি ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওঁত পেতে বসে থাকো। আর যদি তারা তওবা করে, ছালাত আদায় করে এবং যাকাত প্রদান করে, তাহলে তাদের রাস্তা ছেড়ে দাও। নিশ্চয় মহান আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু’ (আত-তাওবা, ৯/৫)।
অন্যত্র মহান আল্লাহ আরও বলেন,وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ ‘আর তোমরা সকলে মুশরিকদের সাথে লড়াই করো যেমনিভাবে তারা সকলে তোমাদের সাথে লড়াই করে। জেনে রেখো! নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথে আছেন’ (আত-তাওবা, ৯/৩৬)।
মহান আল্লাহ আরও বলেন,
فَإِذا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّى إِذَا أَثْخَنتُمُوهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاء حَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ذَلِكَ وَلَوْ يَشَاء اللَّهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ وَالَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَلَن يُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ
‘অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের গর্দানে আঘাত করো! অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাস্ত করবে, তখন তাদেরকে শক্ত করে বেঁধে ফেলো। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ করো, না হয় তাদের নিকট হতে মুক্তিপণ গ্রহণ করো। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে যে পর্যন্ত না শত্রুপক্ষ অস্ত্র সমর্পণ করবে! আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের পরস্পরকে পরস্পরের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়, আল্লাহ কখনই তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/৪)।
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
إِذْ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى الْمَلَائِكَةِ أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِينَ آمَنُوا سَأُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ فَاضْرِبُوا فَوْقَ الْأَعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ
‘স্মরণ করো! যখন তোমার রব ফেরেশতাদের প্রতি অহী প্রেরণ করেন যে, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাথে আছি। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে, তোমরা তাদেরকে অনড় রাখো। অচিরেই আমি কাফেরদের অন্তরে ভীতি ঢেলে দেব। অতএব, তোমরা আঘাত করো তাদের ঘাড়ের উপরে এবং আঘাত করো তাদের প্রত্যেক আঙুলের অগ্রভাগে’ (আল-আনফাল, ৮/১২)।
উপরিউক্ত আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, জিহাদ ও কিতাল-সংক্রান্ত হাদীছ বা বাহ্যিকভাবে কঠোর হাদীছের কারণে যদি হাদীছকে দোষারোপ করা হয়, তাহলে এই ধরনের আয়াতগুলোর কারণে কুরআনকে দোষারোপ করতে হবে (নাঊযুবিল্লাহ)। কুরআনের উপরিউক্ত আয়াতগুলোর যেমন বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে, বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতির আলোকে মহান আল্লাহ এই আদেশগুলো দিয়েছেন, ঠিক তেমনি বাহ্যিকভাবে কঠোর হাদীছগুলোও ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে এসেছে। তার ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। সেটি বুঝার জন্য প্রশস্ত হৃদয় থাকতে হবে এবং সালাফে ছালেহীনের নিকট থেকে জ্ঞান আহরণ করতে হবে। তাদের বই, ব্যাখ্যা ও তাফসীর অধ্যয়ন করতে হবে। অতএব, হাদীছের প্রতি কঠোরতা ও নিষ্ঠুরতার অভিযোগটি কুরআন দ্বারা সম্পূর্ণরূপে অসার প্রমাণিত হলো।
বিভেদের ভিত্তি পরস্পরবিরোধী হাদীছ:
হাদীছ অস্বীকারকারীদের অন্যতম একটি অভিযোগ হচ্ছে হাদীছের বিভিন্নতার কারণে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়েছে। অসংখ্য মাযহাব, পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন ফতওয়া, আক্বীদাগত মতভেদ ইত্যাদি সকল কিছুর মূল ভিত্তি হচ্ছে পরস্পরবিরোধী হাদীছ। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মাযহাব ও মতের পক্ষে হাদীছ থেকেই প্রমাণ পেশ করে থাকে। অতএব, মুসলিমদের এ সকল মতবিরোধের জন্য হাদীছই দায়ী।
হাদীছ অস্বীকারকারীদের এই অভিযোগের উত্তরে আমরা বলতে চাই, মতভেদের কারণে যদি হাদীছকে দায়ী করতে হয়, তাহলে কুরআনকেও দায়ী করতে হবে (নাঊযুবিল্লাহ)। কেননা কুরআনের মধ্যে পরস্পরবিরোধী আয়াত রয়েছে। নিম্নে কুরআন থেকে বাহ্যিকভাবে কিছু পরস্পরবিরোধী আয়াত তুলে ধরা হলো—
মহান আল্লাহ বলেন,وَلِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ ‘আর পূর্ব ও পশ্চিম সবই মহান আল্লাহর। অতএব, তোমরা যেখানেই থাক না কেন সেদিকেই মহান আল্লাহর চেহারা’ (আল-বাক্বারা, ২/১১৫)। অতঃপর আরেক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ ‘আপনি আপনার মুখমণ্ডলকে কা‘বাঘরের দিকে ফিরিয়ে নিন আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন কা‘বা ঘরের দিকে মুখ করবে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৪৪)। উক্ত আয়াত দুটি পরস্পরবিরোধী। এক আয়াতে বলা হচ্ছে, যেখানেই থাকি না কেন এবং যেদিকেই মুখ করি না কেন কোনো সমস্যা নেই। আরেক আয়াতে বলা হচ্ছে, যেখানেই থাকি না কেন কা‘বাঘরের দিকে মুখ করতে হবে।
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالنَّصَارَى وَالصَّابِئِينَ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ‘নিশ্চয় যারা ঈমান আনয়ন করে এবং যারা ইয়াহূদী মতবাদ গ্রহণ করে, নাছারা ও সাবিঈ মতবাদ গ্রহণ করে, তাদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহর প্রতি এবং পরকাল দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকাজ করে তাদের প্রতিদান তাদের প্রতিপালকের নিকটে। আর তাদের কোনো ভীতি এবং দুশ্চিন্তা নেই’ (আল-বাক্বারা, ২/৬২)। অন্য একটি আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الإسْلامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ ‘আর যারা ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীনকে জীবনবিধান হিসেবে অনুসন্ধান করে, তাদের নিকট থেকে তা গ্রহণ করা হবে না আর তারা পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান, ৩/৮৫)।
উপরের দুটি আয়াত পরস্পরবিরোধী। প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ ইয়াহূদী-নাছারাদেরকেও জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন, যদি তাদের মহান আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস থাকে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় আয়াতে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো মতবাদ গ্রহণ করা হবে না মর্মে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কুরআনে এক আয়াতে মহান আল্লাহ মদপান সম্পর্কে বলেন,يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ ‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞস করে। আপনি বলে দিন! এই দুটিতে বড় গুনাহ রয়েছে এবং মানুষের জন্য উপকারও রয়েছে’ (আল-বাক্বারা, ২/২১৯)।
আরেক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা মদ্যপ অবস্থায় ছালাতের নিকটবর্তী হয়ো না’ (আন-নিসা, ৪/৪৩)।
উপরিউক্ত আয়াত প্রমাণ করে, ছালাতের সময়ের বাইরে মদপান বিষয়টি স্বাভাবিক। আরেক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ ‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তিপূজা ও শর নিক্ষেপ শয়তানের কাজ। অতএব, তোমরা এগুলো পরিত্যাগ করো’ (আল-মায়েদা, ৫/৯০)।
উপর্যুক্ত আয়াতগুলোতে মদের বিষয়ে বিভিন্নমুখী নির্দেশনা রয়েছে। কুরআন মাজীদে বাহ্যিকভাবে পরস্পরবিরোধী এই ধরনের অনেক আয়াত রয়েছে। তবে প্রতিটি পরস্পরবিরোধী আয়াতের সঠিক ও চমৎকার উত্তর রয়েছে। যেমন বেশিরভাগ পরস্পরবিরোধী আয়াতগুলো মূলত নাসেখ এবং মানসূখ। তথা মহান আল্লাহ পূর্বে এক বিধান দিয়েছেন এবং পরবর্তীতে তা রহিত করেছেন। আর এই রহিত করার বিষয়টি কুরআন দ্বারাই স্বীকৃত। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘আর যে আয়াত আমরা রহিত করে দেই অথবা মিটিয়ে দেই, তার পরবর্তীতে অনুরূপ অথবা তার চেয়ে উত্তম আয়াত আমরা নিয়ে আসি। তোমরা কি জানো না মহান আল্লাহ সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান?’ (আল-বাক্বারা, ২/১০৬)।
অতএব, কুরআন নাসেখ-মানসূখ হতে পারে। পূর্ববর্তী বিধানের সাথে পরবর্তী বিধানের অমিল থাকতে পারে। তাহলে একই ঘটনা হাদীছের ক্ষেত্রে কেন ঘটবে না? বরং তা যে ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে হাদীছের মধ্যে পরস্পরবিরোধী হাদীছ রয়েছে এই অভিযোগ তুলে হাদীছকে বাতিল করা কুরআনকে বাতিল করার সমতুল্য।
উল্লেখ্য, শুধু নাসেখ-মানসূখ নয়; বরং বহু আয়াত থাকে ব্যাপক অর্থবোধক, যা অন্য আয়াতে বা হাদীছে সেটিকে খাছ করা হয়েছে। অথবা কোনো বিধান থাকে উন্মুক্ত বা মুত্বলাক্ব, যাকে পরবর্তীতে অন্য কোথাও শর্তযুক্ত করা হয়েছে। এগুলো পরস্পর বিরোধিতা নয়, বরং ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে একটি আয়াত যেমন আরেকটি আয়াতের ব্যাখ্যাকারী, ঠিক তেমনি একটি হাদীছ আরেকটি হাদীছের ব্যাখ্যাকারী। অনুরূপই প্রতিটি আয়াত ও হাদীছ পরস্পরের ব্যাখ্যাকারী; কোনোটিই পরস্পরবিরোধী নয়।
মুহাদ্দিছদের বাছাইকৃত হাদীছ কেন সত্য?
(১) মহান আল্লাহ কুরআনের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য কুরআনকে পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোর সত্যায়নকারী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ ‘আর আমি আপনার উপর অবতীর্ণ করেছি কুরআনকে সত্য সহকারে, যা পূর্ববর্তী অন্যান্য কিতাবের সত্যায়নকারী’ (আল-মায়েদা, ৫/৪৮)। তথা তাওরাত, ইনজীল ও কুরআনের মধ্যে বেশিরভাগ মৌলিক বিষয়ে ও ঘটনাবলিতে মিল রয়েছে। এই মিল থাকাই প্রমাণ করে যে, সবগুলোই আসমানী গ্রন্থ আর কোনোটিই মিথ্যা নয়।
ঠিক তেমনি হাদীছের ক্ষেত্রেও আমরা বলতে পারি যে, হাদীছ এবং কুরআন পরস্পরের সত্যায়নকারী। বেশিরভাগ হাদীছের সাথেই কুরআনের মিল রয়েছে। অতএব, হাদীছ এবং কুরআন উভয়টিই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।
(২) মহান আল্লাহ কুরআনের সত্যতার জন্য কুরআনের মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা না থাকাকে দলীল হিসেবে পেশ করেছেন। যেমন তিনি বলেন,أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا ‘তারা কি কুরআন বুঝে না? যদি কুরআন মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নিকট থেকে আসত, তাহলে তাতে অনেক মতভেদ থাকত’ (আন-নিসা, ৪/৮২)।
আমরাও বলতে চাই, অধিকাংশ হাদীছের মধ্যে কোনো পরস্পর বিরোধিতা নেই। প্রত্যেক ছহীহ হাদীছ আরেকটি ছহীহ হাদীছের সত্যায়নকারী। অতএব, এই মাপকাঠিতেও প্রমাণিত হয় যে, হাদীছ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। কেননা বেশিরভাগ হাদীছের মধ্যে যেমন পরস্পর মিল রয়েছে, ঠিক তেমনি বেশিরভাগ হাদীছের সাথে কুরআনেরও মিল রয়েছে।
(৩) আমরা যদি হাদীছের গ্রন্থগুলো নিয়ে গবেষণা করি, তাহলে দেখতে পাব প্রতিটি গ্রন্থের সাথে আরেক গ্রন্থের হাদীছের প্রচুর মিল রয়েছে। যে হাদীছগুলো মুওয়াত্ত্বা মালেকে আছে, তার বেশিরভাগ হাদীছ বুখারী-মুসলিমেও আছে। আবার যে হাদীছ বুখারী-মুসলিমে আছে, তার বেশিরভাগ মুসনাদে আহমাদে আছে। আবার যে হাদীছ মুসনাদে আহমাদে আছে, তার বেশিরভাগ হাদীছ আবূ দাঊদ, নাসাঈ ও তিরমিযীতে আছে। এভাবে সকল গ্রন্থকে সামনে রাখলে এই রকম একটি হাদীছ পাওয়াও খুব কঠিন হয়ে যাবে, যে হাদীছটি শুধু একটি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে অন্য আর কোনো গ্রন্থে সংকলিত হয়নি। তথা ৯৯% হাদীছ একই সাথে বিভিন্ন বইয়ে সংকলিত হয়েছে। অথচ উক্ত বইয়ের সংকলকগণ বিভিন্ন যুগের ও বিভিন্ন দেশের মানুষ। তাদের একসাথে একত্রিত হয়ে মিটিং করাও অসম্ভব। সেক্ষেত্রে কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই বাস্তবতার কারণেই সংকলিত গ্রন্থগুলোর হাদীছের মধ্যে ব্যাপক মিল রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, এগুলো বানোয়াট কিছু নয়; বরং বাস্তব সত্য।
(৪) মুনকিরে হাদীছরা হাদীছশাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে মনে করে থাকে, যে হাদীছ বুখারীতে আছে কিন্তু মুসলিমে নেই, তার অর্থ হচ্ছে ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ ওই হাদীছকে বাতিল বলেছে। আবার যে হাদীছ মুসলিমে আছে কিন্তু মুসনাদে আহমাদে নেই, তার অর্থ হচ্ছে ইমাম আহমাদ রহিমাহুল্লাহ সেই হাদীছকে বাতিল বলেছেন। বিষয়টি অত্যন্ত হাস্যকর এবং হাদীছশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানের দৈন্যের প্রমাণ বহন করে। কেননা স্বয়ং ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ অসংখ্য হাদীছকে ছহীহ বুখারীর অন্তর্ভুক্ত করেননি, কিন্তু তার নিজেরই আরেকটি গ্রন্থে আল-আদাবুল মুফরাদে নিয়ে এসেছেন। শুধু তাই নয় ইমাম তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ তার সুনানে অসংখ্য হাদীছের ক্ষেত্রে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-এর মন্তব্য পেশ করেছেন। সুনানে তিরমিযীর অসংখ্য হাদীছকে স্বয়ং ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ ছহীহ বলেছেন অথবা সেগুলোকে তিনি তার ছহীহ বুখারীর অন্তর্ভুক্ত করেননি। তথা ছহীহ বুখারীর বাইরেও অসংখ্য ছহীহ হাদীছ আছে, যা ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-এর নিকটেও ছহীহ। দুনিয়ার কোনো মুহাদ্দিছ দাবি করেননি যে, তিনি সকল ছহীহ হাদীছ সংকলন করেছেন আর তার গ্রন্থের বাইরের সকল হাদীছ বাতিল। যেখানে সংকলকগণ এই ধরনের কোনো দাবি করেননি, সেখানে মুনকিরে হাদীছদের এই ধরনের দাবি চাপিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ একটি অন্যায় দাবি। প্রত্যেক মুহাদ্দিছের নিজ নিজ কিতাব সংকলনের বিভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। তারা সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে হাদীছ জমা করে থাকেন। যেমন ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ছহীহ হাদীছ দিয়ে বিভিন্ন মাসআলা-মাসায়েল ইসতিনবাত বা বের করা। সেক্ষেত্রে একটি মাসআলার জন্য একটি হাদীছই যথেষ্ট। এজন্য ছহীহ বুখারীর অধিকাংশ অধ্যায়ে হাদীছের সংখ্যা একটি। আবার ইমাম আহমাদ রহিমাহুল্লাহ-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ছাহাবীগণের নাম অনুযায়ী হাদীছ সংকলন করা। ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ-এর উদ্দেশ্য হলো, একই বিষয়ক বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হাদীছগুলোকে এক জায়গায় একত্রিত করা। এভাবে নিজ নিজ উদ্দেশ্য অনুযায়ী তারা তাদের গ্রন্থকে সাজিয়েছেন আর এই বিষয়ে তারা স্বাধীন।
অতএব, ঢালাওভাবে কারো বইয়ে কোনো হাদীছ নেই— এর অর্থ এই নয় যে, সেই হাদীছটি তার নিকটে বাতিল। আর এই ধরনের উদ্ভট অভিযোগ উত্থাপন করে হাদীছশাস্ত্রকে দুর্বল করার চেষ্টা করা আসমানে থুথু নিক্ষেপের সমতুল্য।
বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।