حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ جَعْفَرٍ، عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ دِينَارٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «إِنَّ مِنَ الشَّجَرِ شَجَرَةً لَا يَسْقُطُ وَرَقُهَا، وَإِنَّهَا مَثَلُ المُسْلِمِ، فَحَدِّثُونِي مَا هِيَ» فَوَقَعَ النَّاسُ فِي شَجَرِ البَوَادِي قَالَ عَبْدُ اللهِ: وَوَقَعَ فِي نَفْسِي أَنَّهَا النَّخْلَةُ، فَاسْتَحْيَيْتُ، ثُمَّ قَالُوا: حَدِّثْنَا مَا هِيَ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: «هِيَ النَّخْلَةُ».
৬১. ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ: আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এমন কোনো গাছের খবর তারা জানে কি-না, যে গাছের পাতা ঝরে না? এটি জিজ্ঞেস করার পিছনে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্দেশ্য সাধারণ জ্ঞান চর্চা ছিল না, বরং ছাহাবীদেরকে মুসলিমের গুণাবলি ও উপকারিতার বাস্তব উদাহরণ দেওয়া উদ্দেশ্য ছিল। তাই তিনি সাথে সাথে এটিও বলে দিলেন, এই গাছটি মুসলিমের বাস্তব উদাহরণ। অতএব, সেই গাছ সম্পর্কে আমাকে জানাও। তখন উপস্থিত ছাহাবীরা পরস্পরে মরুভূমির বিভিন্ন গাছের নাম নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন এবং চিন্তা করে খুঁজতে লাগলেন সেটি কোন গাছ হতে পারে। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমার মনে হলো এটা নিশ্চয়ই খেজুরগাছ, কিন্তু আমি এত বড় বড় ছাহাবীদের উপস্থিতিতে এত ছোট মানুষ হয়ে লজ্জায় এই প্রশ্নের উত্তর দেইনি। এরপর ছাহাবীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি বলুন না, সেটি কোন গাছ? তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সেটি হলো খেজুরগাছ’।
তাখরীজ: ইমাম বুখারী[1] ও ইমাম মুসলিম[2] উভয়ই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন কুতায়বা রাহিমাহুল্লাহ থেকে, তিনি ইসমাঈল ইবনে জা‘ফর রাহিমাহুল্লাহ থেকে। ইমাম বুখারী[3] রাহিমাহুল্লাহ হাদীছটি আরও বর্ণনা করেছেন ইসমাঈল ইবনে আবী উয়াইস রাহিমাহুল্লাহ থেকে, তিনি মালেক ইবনে আনাস থেকে। তারা উভয়ে (ইমাম মালেক ও ইসমাঈল ইবনে জা‘ফর রহিমাহুমাল্লাহ) হাদীছটি বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার থেকে।
হাদীছটি ইমাম বুখারী[4] রাহিমাহুল্লাহ আরও বর্ণনা করেছেন আলী ইবনুল মাদীনী রাহিমাহুল্লাহ থেকে। ইমাম মুসলিম[5] রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেছেন আবূ বকর ইবনু আবী শায়বা রাহিমাহুল্লাহ থেকে। তারা উভয়ে (আলী ও ইবনু আবী শায়বা রহিমাহুমাল্লাহ) ও ইমাম আহমাদ[6] রাহিমাহুল্লাহ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রাহিমাহুল্লাহ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু আবীন-নাজিহ থেকে।
ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ হাদীছটি বিভিন্ন সনদে আবূ মুআবিয়া আয-যরীর ও জারীর ইবনু আব্দিল হামীদ আয-যব্বি রহিমাহুমাল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন, তারা দুইজন ইমাম আ‘মাশ রাহিমাহুল্লাহ থেকে।
তারা দুইজন (ইবনু আবীন-নাজিহ ও ইমাম আ‘মাশ রহিমাহুমাল্লাহ) হাদীছটি বর্ণনা করেন ইমাম মুজাহিদ থেকে।
আমরা দেখলাম, উপরের সকল সূত্রের মিলনস্থল দুজন তথা ইমাম মুজাহিদ ও আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার। তারা দুজন এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে।
রাবীগণের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
এই হাদীছের সকল রাবীর পরিচয় পূর্বে চলে গেছে।
হাদীছ থেকে ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ-এর ইসতিদলাল:
ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ-এর মূল উদ্দেশ্য এটি দেখানো যে, ‘হাদ্দাছানা’ ও ‘আখবারানা’ সমার্থক শব্দ। হাদীছ বর্ণনার গ্রহণযোগ্য সকল ধরনে এই শব্দগুলো ব্যবহার করা যায়। এটি প্রমাণের জন্য ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ এমন একটি উদাহরণ গ্রহণ করেছেন, যেখানে হাদীছ বর্ণনার ধরন হিসেবে বর্তমান যুগের পরিভাষা অনুযায়ী ‘আখবারানা’ শব্দ ব্যবহার করার কথা, কিন্তু হাদীছে ব্যবহৃত হয়েছে ‘হাদ্দাছানা’ শব্দ।
উক্ত হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদেরকে বলেছেন ‘হাদ্দিছূনী’ তথা তোমরা আমাকে হাদীছ শুনাও বা জানাও এই রকম কোনো গাছের কথা, যার পাতা ঝরে পড়ে না। এখানে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘হাদ্দাছানা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। যদি ছাহাবীরা প্রশ্নটির উত্তর দিতেন, তাহলে এটি হতো ছাত্রের পড়া এবং উস্তাযের শ্রবণ। আর পূর্বে আমরা দেখেছি সাধারণত এই ধরনের ক্ষেত্রে ‘আখবারানা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়, কিন্তু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে ‘হাদ্দাছানা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। ছাহাবীরা উত্তর দিলে সেটি ‘হাদ্দাছানা’ শব্দেই বর্ণিত হতো। অতএব, প্রমাণিত হলো ‘হাদ্দাছানা’ ও ‘আখবারানা’ একই অর্থবোধক।
মুমিনের সাথে খেজুরগাছের সাদৃশ্য:
খেজুর পৃথিবীর একটি ব্যতিক্রমধর্মী গাছ। খেজুরগাছের মধ্যে একসাথে যতগুলো বিষয় একত্রিত হয়েছে, তা পৃথিবীর আর কোনো গাছে একত্রিত হয়নি। বৃষ্টিস্নাত নদীর অববাহিকায় কোনো গাছের বেড়ে ওঠা অনেক সহজ। অন্যদিকে ধু-ধু মরুভূমির মধ্যে নদী ও বৃষ্টিবিহীন এলাকায় খেজুরগাছের বেড়ে উঠা অবশ্যই বিস্ময়কর। খেজুরগাছের মূল (Taproot) ভূগর্ভস্থ পানির সন্ধানে ৬–১২ মিটার গভীর পর্যন্ত চলে যায়। খেজুরগাছ আকাশের দিকে যতটা বাড়তে থাকে, তার গোড়া ততটাই শক্ত হতে থাকে। মরুভূমির বালির উপর অবস্থান করেও মরুঝড়ে উপড়ে যায় না। আর খেজুরগাছের কাণ্ডের অভ্যন্তরীণ তন্তু কাঠের মতো শক্ত নয়, বরং তন্তুযুক্ত নমনীয় (Fibrous flexible) কাণ্ড দিয়ে গঠিত। ফলত প্রচণ্ড ঝড়েও তা ভেঙেও যায় না; বরং বাতাসের সাথে দুলতে থাকে। খেজুরগাছের পাতাও সেভাবে ঝরে পড়ে না। অন্যান্য গাছের যেমন নির্দিষ্ট মওসুমে সব পাতা ঝরে পড়ে এবং প্রতি বছর নতুন পাতা গজায়, খেজুরের ক্ষেত্রে তা হয় না। এই জন্য খেজুরগাছ সবসময় সবুজ থাকে। এটি একটি চিরসবুজ (Evergreen) উদ্ভিদ।
এই রকম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি গাছের ফলের উপকারিতাও সীমাহীন ও ব্যতিক্রম। প্রথমত, খেজুরের ফলন প্রক্রিয়াটাই পৃথিবীর অন্যান্য ফল থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। পৃথিবীতে সাধারণত এক গাছেই পুরুষ ফুল ও স্ত্রী ফুল থাকে। আর খেজুরের সম্পূর্ণ গাছটাই হয় পুরুষ গাছ হয়, নাহলে স্ত্রী গাছ। আর পুরুষ গাছের অস্তিত্ব ছাড়া পরাগায়ন হয় না এবং স্ত্রী গাছে ফলন আসে না। সাধারণত পৃথিবীর অন্যান্য ফলে বাতাসের মাধ্যমেই পরাগায়ন হয় আর খেজুরগাছে বাতাসের মাধ্যমে পরাগায়ন অনেক সীমিত হয়, বরং মালিককে প্রত্যেকটা থোকায় থোকায় গিয়ে ম্যানুয়ালি পরাগায়ন করতে হয়। একমাত্র খেজুরের মধ্যেই ভিটামিন, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি প্রায় ৩০-৩৫টি উপাদান একসাথে পাওয়া যায়, যা পৃথিবীর অন্য কোনো ফলে বিরল। এমন কোনো ফল নেই যেটি একই সাথে শক্তি, হরমোন, স্নায়ু, কোষ, রক্ত, ঘুম ও হজম সবক্ষেত্রে একযোগে কাজ করে; কিন্তু একমাত্র খেজুরই এই অলৌকিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।
এটি প্রকৃতির এমন এক সুষম খাদ্য, যা নিজেই মেডিসিন ফুড হিসেবে কাজ করে। খেজুরই পৃথিবীর একটি অনন্য উপাদানসমৃদ্ধ ফল, যা শুধু খাদ্য হিসেবে দীর্ঘদিন মানবদেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পূরণ করতে সক্ষম।
খেজুরগাছের বৈশিষ্ট্য |
মুমিনের বৈশিষ্ট্য |
চিরসবুজ, পাতা ঝরে না। |
মুমিনের আমল ও দু‘আ
কখনো বিফলে যায় না। |
গোড়া মাটিতে দৃঢ় আর ডাল আকাশমুখী ও উঁচু। |
মুমিনের দুনিয়াতে ঈমান অনেক মজবুত আর তার হৃদয় সবসময় আকাশমুখী তথা
পরকালমুখী। |
কষ্ট সহ্য করে মরুতে টিকে থাকে। |
মুমিন বিপদে ধৈর্যশীল। ছবর ও ভরসা করে আল্লাহর উপর। |
খেজুর চাষ অনেক
কষ্টের, তবে ফল অত্যন্ত উপকারী। |
দুনিয়াতে
মুমিনের জীবন অনেক কষ্টের, তবে পরকালের ফল সুমিষ্ট। |
খেজুরের পরাগায়ন পদ্ধতি ব্যতিক্রম। |
মুমিনেরা সমাজ সৃষ্টি, সন্তান উৎপাদন ও বৈবাহিক সম্পর্ক বিষয়ে সবসময়
পবিত্র ও সচেতন। |
সারমর্ম: সারমর্ম হিসেবে বলা যায়, খেজুরগাছ কঠিন মরুভূমিতে বহু গভীরে শিকড় নিয়ে গিয়ে পানি খুঁজে, তারপর মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, হাজারো ঝড়ে টিকে থাকে, মানুষকে ফল দেয়; মুমিনের অবস্থাও অনুরূপ, পরিবেশ যত কঠিনই হোক মুমিন ব্যক্তি তার ঈমান খুঁজে নেয়। ঈমান আঁকড়ে মুমিন মাথা উঁচু করে থাকে পরকালমুখী চিন্তায়। দুনিয়ার কোনো বাধা ও বিপদে সে টলে না বা ভেঙে পড়ে না, বরং ধৈর্যধারণ করে। ফলত, তার কোনো দু‘আ ও আমল বিফলে যায় না। দীর্ঘ কষ্টের প্রতিদান হিসেবে সে পরকালে সুমিষ্ট প্রতিদান ও সুখ লাভ করে।
(ইনশা-আল্লাহ চলবে)
* ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বিএ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,
সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১, ৬২, ৭২, ১৩১, ২২০৯, ৪৬৯৮, ৫৪৪৪, ৬১২২।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮১১।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১, ৬২, ৭২, ১৩১, ২২০৯, ৪৬৯৮, ৫৪৪৪, ৬১২২।
[4]. প্রাগুক্ত।
[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮১১।
[6]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৪৬৮৯।