(মিন্নাতুল বারী- ১৫তম পর্ব)
[যে হাদীছের ব্যাখ্যা চলছে : ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমাকে ইয়াহইয়া ইবনু বুকায়র হাদীছ শুনিয়েছেন; তিনি বলেন, তাকে লায়ছ হাদীছ শুনিয়েছেন; তিনি বলেন, তাকে উকায়ল হাদীছ শুনিয়েছেন; তিনি ইবনু শিহাব থেকে, তিনি উরওয়া ইবনু যুবায়ের থেকে, তিনি আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে, তিনি বলেন, সর্বপ্রথম সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অহির আগমন শুরু হয়। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন না কেন সেই স্বপ্ন সকালের মতো তার সামনে সত্যরূপে প্রকাশিত হতো। অতঃপর তার কাছে একাকিত্ব ভালো লাগতে লাগল। তিনি হেরা গুহায় একাকী থাকতেন এবং রাত্রিকালীন ইবাদতে মগ্ন থাকতেন- যতক্ষণ না পরিবারের কাছে ফিরে প্রয়োজনীয় জিনিস নেওয়ার প্রয়োজন না হতো। অতঃপর তিনি খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকট ফিরে আসতেন তিনি তার জন্য অনুরূপ পাথেয় প্রস্তুত করে দিতেন। এভাবেই তার নিকট একদিন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অহি চলে আসে এমতাবস্থায় তিনি হেরা গুহায় ছিলেন। ফেরেশতা তার নিকটে এসে তাকে বললেন, পডুন! তিনি বললেন, আমি পড়া জানি না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ফেরেশতা আমাকে ধরলেন এবং চাপ দিলেন। পুনরায় বললেন, পড়ুন! আমি বললাম, আমি পড়া জানি না। ফেরেশতা আমাকে পুনরায় ধরলেন এবং চাপ দিলেন অতঃপর আমাকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, পড়ুন! আমি বললাম, আমি পড়া জানি না। তিনি আমাকে আবারও সজোরে চাপ দিলেন অতঃপর তিনি বললেন, ‘পড়ুন! আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে জমাটবাধা রক্ত হতে সৃষ্টি করেছেন। পড়ুন! আর আপনার প্রতিপালক মহাসম্মানিত’।
এই আয়াতগুলো নিয়ে আল্লাহর রাসূল ফিরে আসলেন এমতাবস্থায় তার বুক ধড়ফড় করছিল। তিনি খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকটে আসলেন এবং বললেন, আমাকে চাদর দাও! চাদর দিয়ে ঢেকে দাও! অতঃপর খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা তাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অতঃপর তার ভয় কেটে গেলে খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-কে তিনি পুরো ঘটনা জানালেন এবং বললেন, আমি আমার জীবনের ভয় পাচ্ছি। তখন খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, আল্লাহর কসম! কখনোই নয়! মহান আল্লাহ আপনাকে কখনোই অপমানিত করবেন না। নিশ্চয় আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, দুর্বলের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের সম্মান করেন, বিপদ-আপদে মানুষকে সাহায্য করেন। অতঃপর খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা তাকে সাথে করে নিয়ে তার চাচাতো ভাই ওয়ারাক্বা ইবনু নওফেলের নিকট নিয়ে গেলেন। যিনি জাহেলী যুগে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি হিব্রু ভাষায় বই লিখতেন। তিনি ইঞ্জীল গ্রন্থকে হিব্রু ভাষায় যতদূর আল্লাহ তাওফীক্ব দিয়েছিলেন লিখেছিলেন। তিনি একজন বৃদ্ধ ও অন্ধ মানুষ ছিলেন। খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা তাকে বললেন, হে আমার চাচার ছেলে! আপনার ভাইয়ের ছেলে কী বলে শুনুন! তখন ওয়ারাক্বা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন, আপনি কী দেখেছেন? রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা দেখেছিলেন তাকে তা জানালেন। অতঃপর ওয়ারাক্বা বললেন, ইনিই সেই ‘নামূস’ যাকে মহান আল্লাহ মূসার নিকট পাঠিয়েছিলেন। হায়! আমি যদি সেদিন বেঁচে থাকতাম যেদিন তোমার জাতি তোমাকে বের করে দিবে! তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সত্যিই কি আমার জাতি আমাকে বের করে দিবে? হ্যাঁ, ইতোপূর্বে কোনো ব্যক্তির নিকটে এই লোক প্রেরিত হয়েছেন আর তাকে তার জাতি বের করে দেয়নি এমনটা হয়নি। তবে তোমার সাথে যেদিন এমন ঘটবে সেদিন যদি আমি বেঁচে থাকি আমি তোমাকে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করব। এর কিছুদিন পর ওয়ারাক্বা রযিয়াল্লাহু আনহু ইন্তেকাল করেন। আর অহি স্থগিত হয়ে যায়।
আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ ও আবূ ছালেহ রহিমাহুল্লাহ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। হেলাল ইবনু রাদদাদ রহিমাহুল্লাহ যুহরী রহিমাহুল্লাহ থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইউনুস ও মা‘মার রহিমাহুমাল্লাহفؤادهএর স্থলে بَوَادِرُهُশব্দ উল্লেখ করেছেন।]
সর্বপ্রথম কখন অহি পেয়েছেন মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম?
সকল মুহাদ্দিছ এ বিষয়ে একমত যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট সর্বপ্রথম অহি সোমবারের দিন এসেছে এবং ৪০ বছর পূর্ণ করার পর এসেছে। কিন্তু কোন মাসে এসেছে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ইমাম ইবনু আব্দিল বার রহিমাহুল্লাহ-এর মতে, রবীউল আওয়াল মাসের ৮ তারিখে সর্বপ্রথম অহি এসেছে। তথা তখন তার বয়স পূর্ণ ৪০ বছর। আর ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক্ব রহিমাহুল্লাহ-এর মতে, পবিত্র রামাযান মাসের ১৭ তারিখে সর্বপ্রথম অহি এসেছে। তথা তখন তার বয়স ৪০ বছর ৬ মাস। হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী রহিমাহুল্লাহ এই দুই মতের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে বলেন, সত্য স্বপ্ন আসা শুরু হয় রবীউল আওয়ালের ৮ তারিখ সোমবার থেকে আর তার ঠিক ৬ মাস পর ১৭ রামাযান সোমবার সরাসরি জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম অহি নিয়ে আসেন। আর মহান আল্লাহই এ বিষয়ে সঠিক অবগত।
গারে হেরায় কেন?
কা‘বাঘর থেকে মিনার দিকে যেতে ৩ মাইল দূরত্বে হাতের বামে অবস্থিত একটি পাহাড়ের নাম জাবালুন নূর। যার উপরে একটি ঘরের মতো গুহা রয়েছে। যার উচ্চতা এতটুকু যে, মানুষ স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াতে পারবে। আর প্রশস্ততা এতটুকু যে, মানুষ স্বাভাবিকভাবে শুয়ে থাকতে পারবে। সামনের ছিদ্র দিয়ে কা‘বাঘর দেখা যায়। এটাকেই বলা হয় গারে হেরা বা হেরা গুহা।
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেরা পাহাড় বা জাবালুন নূরকে কেন ধ্যানের জন্য বাছাই করলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে মুহাদ্দিছগণ বলেন যে, স্বাভাবিক জীবন থেকে বের হয়ে মহান আল্লাহর যিকিরে মাশগূল হওয়া ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দ্বীনের একটা অংশ। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব নিজেও হেরা গুহায় ধ্যান করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে একাকিত্ব অবলম্বন করেন। এছাড়াও হেরা গুহা থেকে বায়তুল্লাহ কা‘বাঘর দেখা যেত। ফলে ইবাদতে মনোযোগ আরও বাড়ত। যদিও বর্তমানে বড় বড় বিল্ডিংয়ের কারণে হেরা গুহা থেকে সরাসারি কা‘বাঘর দেখা যায় না। ওয়াল্লাহু আ‘লাম।
কত দিন ধ্যান করেছেন?
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত দিন হেরা গুহায় ধ্যান করেছিলেন এ বিষয়ে উক্ত হাদীছে কিছু বলা না হলেও অন্য বর্ণনায় ছহীহ সূত্রে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। যথা— জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, جَاوَرْتُ بِحِرَاءٍ شَهْرًا ‘আমি হেরা গুহায় প্রায় এক মাস ইবাদত করেছি’।[1] ইমাম বায়হাক্বীর দালায়িলুন নবুয়্যতে এই হাদীছের স্বপক্ষে আরও কয়েকটি হাদীছ আছে। যথা—
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُجَاوِرُ فِي حِرَاءَ مِنْ كُلِّ سَنَةٍ شَهْرًا.
‘তথা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর হেরা গুহায় এক মাস ইবাদত করতেন’।[2] এই হাদীছগুলো প্রমাণ করে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় প্রতিবছরই এক মাস গারে হেরায় ইবাদত করতেন। আর সেই সম্ভাব্য মাস অবশ্যই রামাযান মাস। যেহেতু তিনি গারে হেরায় থাকা অবস্থায় অহি অবতীর্ণ হয়েছে আর আমরা জানি প্রথম অহি রামাযান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। সেহেতু এটা প্রমাণিত হয় যে, তিনি নবুয়্যত পাওয়ার আগেই প্রতি বছর রামাযান মাসে হেরা গুহায় ইবাদতে মগ্ন হতেন।
কীভাবে ইবাদত করতেন?
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গারে হেরায় কীভাবে ইবাদত করতেন সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। হাদীছে বর্ণিত ‘তাহান্নুছ’ শব্দের জায়গায় ইবনু হিশামের সীরাতে ‘তাহান্নুফ’ পাওয়া যায়। ‘তাহান্নুফ’ শব্দ থেকে এতটুকু অনুমান করা যায় যে, তিনি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দ্বীনের আলোকে ইবাদত করতেন। ওয়াল্লাহু আ‘লাম।
একাকিত্বের উপকারিতা :
বর্তমানে হাতে হাতে মোবাইল ও ইন্টারনেট সুবিধার কারণে একাকিত্ব কী জিনিস তা মানুষ কল্পনা করাও ভুলে গেছে। সারা দুনিয়ার সকল খবরের সাথে দ্রুত আপডেট থাকার পাল্লায় আর নিজের সকল খবরাখবর বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার আগ্রহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুঁদ হয়ে কেটে যায় কত সময় তা ঠাহর করাও মুশকিল হয়ে পড়ে। আপনি টানা এক সপ্তাহ বা কয়েকদিন ইন্টারনেটবিহীন ও মোবাইলবিহীন থাকলেই অনুভব করতে পারবেন একাকিত্বের উপকারিতা। আর সেই একাকিত্ব যদি হয় রিয়াল লাইফের বিভিন্ন সম্পর্ক থেকেও একাকিত্ব তাহলে মানুষ পায় নিজেকে নিয়ে ভাবার সুযোগ। তার সামনে ফুটে উঠে তার ভুলত্রুটি ও অসহায়ত্ব। মাথা নত হয়ে আসে রবের সামনে। স্মরণ করা যায় মহান সৃষ্টিকর্তাকে। এক আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক তৈরি হয় মহান প্রতিপালকের সাথে। যা মানুষকে মানসিক শক্তি ও সঠিক পথের দিশা দেয়।
একাকিত্বই সকল ভালো কাজের প্রথম স্তর। ভালোভাবে পড়তে চান একাকিত্ব দরকার। মনোযোগ দিয়ে কিছু করতে চান একাকিত্ব দরকার। ভালোভাবে ইবাদত করতে চান একাকিত্ব দরকার। একাকিত্ব এমন এক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস মানুষ যদি অযোগ্যও হয় কিন্তু সে বন্ধুবান্ধবের আড্ডা থেকে দূরে থেকে একাকী নিজের জ্ঞান বিকাশে মনোযোগ দেয় তাহলে একদিন সে তার অযোগ্যতাকে শানিত করে নিজেকে হীরা বানিয়ে ফেলতে পারবে। অন্যদিকে হীরার মতো মানুষ যদি চায়ের স্টলের আড্ডা বা বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় নিজেকে জাড়িয়ে ফেলে সে একদিন হীরা থেকে অপদার্থে পরিণত হবে। এই জন্য আমি বলে থাকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে ডিজিটাল চায়ের স্টলের আড্ডা। যেখানে হারিয়ে যায় লাখো মেধাবীর মেধা। অপচয় হয় কোটি প্রতিভাবানের মূল্যবান সময়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কেও মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে নেওয়ার জন্য অহি গ্রহণের মতো পরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্যে মহান আল্লাহ তার অন্তরে একাকিত্বের প্রতি ভালোবাসা দান করেন। আমাদেরও উচিত মাঝে মাঝে একাকিত্ব অবলম্বন করা।
আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার উপায় কী?
বিপদাপদ মানবজীবনের চিরসঙ্গী। জীবন ফুলশয্যা নয়। বরং লড়াই করে টিকে থাকাই জীবন। জীবনের প্রতিটি পদে রয়েছে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি। প্রয়োজন রয়েছে সিদ্ধান্ত পরবর্তী সমস্যা মোকাবেলা করার সাহস। মানুষ যেহেতু দুর্বল সৃষ্টিজীব সেহেতু সবসময় সে নিজের টাকা-পয়সা, ক্ষমতা ও বুদ্ধির জোরে সকল সমস্যার সমাধান করতে পরবে না; বরং প্রয়োজন হয় মহান আল্লাহর সাহায্যের। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রব্বুল ইযযতের দয়া ও সাহায্য ছাড়া দুনিয়ার কোনো মানুষের পক্ষে কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়। আপনি যদি সবসময় আপনার উপর মহান আল্লাহর দয়ার দৃষ্টি রাখতে চান, আবৃত থাকতে চান তার করুণার আঁধারে, পাশে পেতে চান তাকে সবসময়, তাহলে আপনার জন্য এই হাদীছে তার সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর পথ বলে দেওয়া হয়েছে। আর তা হচ্ছে— আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা, ঋণগ্রস্তের বোঝা উঠানো, যার কিছুই নেই তাকে সহযোগিতা করা, যে বিপদে পড়েছে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধারে এগিয়ে যাওয়া, মেহমানের মেহমানদারী করা।
আমাদের দাওয়াতে সফলতা না আসার কারণএই হাদীছের সবচেয়ে বড় শিক্ষা :
এই হাদীছের সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, যেখানে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহর ইবাদত ও ধ্যান থেকে ফিরে আসছেন সেখানে তাকে অভয়বাণী দেওয়ার জন্য খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা চাইলে একথা বলতে পারতেন যে, মহান আল্লাহ আপনার ক্ষতি করবেন না, কেননা আপনি হেরা গুহায় মহান আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন ছিলেন। এই উত্তর দেওয়াই সার্বিক পরিস্থিতির সাথে বেশি মানানসই ছিল। কিন্তু তিনি তা না বলে এমন পাঁচটি গুণের কথা বললেন, যার একটারও সরাসরি মহান আল্লাহর ইবাদতের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি হেরা গুহার ইবাদত, ছিয়াম, জাহেলী যুগের যেনা-ব্যভিচার ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি কোনো গুণের কথাই বললেন না। তিনি যতগুলো গুণের কথা বলেছেন, তার সবগুলোই মানবসেবার সাথে সম্পর্কিত। তার এই মানবসেবার গুণ শুধু তাকে মহান আল্লাহর সাহায্য পেতেই সহযোগিতা করেনি; বরং দাওয়াতী ময়দানে বিপ্লব আনতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের বর্তমান দায়ী ও আলেমগণের মধ্যে এই পাঁচটি গুণের সবচেয়ে বেশি অভাব পরিলক্ষিত হয়। শুধু তাই নয়; বরং এর বিপরীতটাই পাওয়া যায়। পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, মানুষকে বিদআতী-মুশরিক, কাফের-ফাসেক্ব ইত্যাদি বলে ছোট করা, সহযোগিতা করা তো দূরে থাক, বরং মানুষের সহযোগিতা পাওয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা। বর্তমান যুগে ভালো আলেম মানে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে গবেষণায় ব্যস্ত থাকা। অনেকেই মনে করতে পারেন, ভালো আলেম মানে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে ইবাদতে মগ্ন থাকা। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাজার-ঘাট থেকে শত মাইল দূরে থাকা। অথচ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর এই পাঁচটি গুণের প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক গুণ। এখনকার সমাজের অধঃপতনের সবচেয়ে বড় কারণ বর্তমান যুগের আলেম-ওলামা, ইমাম-মুযাযযিন, ক্বওমী মাদরাসার ছাত্ররা সমাজবিচ্ছিন্ন। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সমাজের মূল স্রোতের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশ্রিত। ফলে তার প্রতিটি দাওয়াত সমাজে ফেলেছে ব্যাপক ও সীমাহীন প্রভাব। জড় বা গোড়া থেকে তিনি সমাজকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। সুতরাং বর্তমান যুগে সেই কুরআন ও সেই হাদীছ থাকার পরও দাওয়াতের কাঙ্ক্ষিত সফলতা না আসার প্রধান কারণ দুটি—
(১) সমাজের সাথে সম্পৃক্ত থেকে সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালন না করা। (২) মানবসেবাকে অবহেলা করে আল্লাহর ইবাদতকে সবকিছুর মানদণ্ড মনে করা।
অথচ কিয়ামতের মাঠে সবচেয়ে ভারী হবে ভালো চরিত্রের পাল্লা। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সমাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে মানবসেবা করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
(চলবে)
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; এম. এ. (অধ্যয়নরত), উলূমুল হাদীছ বিভাগ,
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯২৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬১।
[2]. তাগলীকুত তা‘লীক্ব, ৫/৮৯।