কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মুমিনগণ মৌমাছির মতো

post title will place here

মৌমাছি, মৌমাছি

কোথা যাও নাচি নাচি

দাঁড়াও না একবার ভাই।

ওই ফুল ফোটে বনে

যাই মধু আহরণে

দাঁড়াবার সময় তো নাই...!

আরবীতে ক্রিয়ার (فعل) মতো নির্দেশসূচক (امر) শব্দের ক্ষেত্রেও পুরুষ ও স্ত্রীবাচক উভয়ই বিদ্যমান। যেমন: আরবীতে একজন পুরুষকে (المفرد) খাবার খেতে নির্দেশ দিতে হলে বলতে হবে كُلْ মানে হলো ‘খাও’৷ কিন্তু স্ত্রীবাচকে (مؤنث) সেটা হবে كُلِيْ। একইভাবে পথ চলার নির্দেশ দানের ক্ষেত্রে স্ত্রীবাচক শব্দ হলো اُسْلُكِيْ মানে হলো ‘গমণ করো’৷ সাথে আরও আছে اِتَّخِذِيْ মানে হলো ‘গ্রহণ করো’। আলোচিত নারীবাচক এই শব্দগুলোই ব্যবহৃত হয়েছে পবিত্র কুরআনের নিম্নবর্ণিত আয়াত দু’টিতে। লক্ষ করুন- আল্লাহর বাণী,

وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ - ثُمَّ كُلِي مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلًا يَخْرُجُ مِنْ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِلنَّاسِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

‘আপনার রাব্ব মৌমাছির অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিয়েছেন, তুমি গৃহ নির্মাণ করো পাহাড়, বৃক্ষ এবং মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে। এরপর প্রত্যেক ফল হতে কিছু কিছু আহার করো, অতঃপর তোমার রবের সহজ পথ অনুসরণ করো। ওর উদর হতে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয়, যাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিষেধক। অবশ্যই এতে রয়েছে নিদর্শন চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য’ (আন-নাহল, ১৬/৬৮-৬৯)

প্রথম কথা হলো, এখানে ‘অহী’ মানে নবীদের কাছে আগত অহীর মতো কোনো ব্যাপার নয়। বরং এর মানে হলো ইলহাম বা ইঙ্গিত করা অথবা বলতে পারেন অন্তরে জাগিয়ে দেওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷ যেমন ইবনু কাছীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, اَلْمُرَادُ بِالْوَحْيِ هُنَا الإِلْهَامُ وَالْهِدَايَةُ وَالْإِرْشَادُ لِلنَّحْلِ অর্থাৎ ‘এখানে অহী দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মৌমাছির প্রতি ইলহাম, পথ-প্রদর্শন এবং নির্দেশনা’।[1]

মজার বিষয় হলো, দার্শনিক শেক্সপিয়রের লিখিত henry iv নাটকে দেখানো হয়েছে তাদের রাজ্য পরিচালনা করে একজন পুরুষ এবং কর্মী মৌমাছিদেরও সকলেই পুরুষ।[1] সেই ধারণাকে ভেস্তে দিয়ে karl von frisch[2] ১৯৭৩ সালে প্রমাণ করে দেখান, মৌমাছিদের রাজ্য পরিচালনার দায়ভার মূলত রাণী মৌমাছির, এমনকি কর্মী মৌমাছিদের ব্যাপারেও তিনি বলছেন, They are females but do not lay eggs. অর্থাৎ ‘তারা স্ত্রী মৌমাছি, তবে ডিম পাড়ে না’।[3] কেবল তাই নয়, তিনি আরও বলেন, In short, they perform all the duties with which the queen and the drones (male bee) do not concern themselves. অর্থাৎ ‘সোজা কথায়, এই কর্মী মৌমাছিগুলো এমন কর্মও যোগান দেয়, যে কাজে তাদের নিযুক্ত করা হয়নি’।[4]

বলুন তো, কে তাকে এই ব্যাপারগুলো বুঝিয়ে দিল?

এর উত্তর রয়েছে পবিত্র কুরআনে وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ ‘আর আপনার রব অহী করলেন মৌমাছির নিকট’ অংশের মধ্যে৷ অর্থাৎ তাকে শিক্ষা দেন আপনার আমার এবং এই মহাবিশ্বের একমাত্র রব মহান আল্লাহ তাআলা।

কথা এখানেই শেষ নয়, গৃহ নির্মাণ, তাকে বসবাস উপযোগী করে তোলা, পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কাজে তারা Architect-এর ভূমিকায় কাজ করে৷ karl von frisch এর মত অনুযায়ী, act as Architects of the bee residence.[6]

গমনরত বিভিন্ন পথে তারা এক ধরনের সংকেত-ধ্বনির আদানপ্রদানের মাধ্যমে খাদ্যের অনুসন্ধান করে, যার নাম দেওয়া হয়েছে waggle dance.[7] তারা কেবল অনুসন্ধানই করে না বরং বাছাইও করে৷ Christop Ghuter এবং walter M. Farina এর একটি যৌথ রিসার্চে বলা হচ্ছে, The honeybee (Apis mellifera) waggle dance, whereby dancing bees communicate the location of profitable food sources to other bees in the hive, is one of the most celebrated communication behaviours in the animal world.[8]

সোজা কথায় মৌমাছিরা খাদ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কেবল সেই সোর্সগুলোই বাছাই করে, যা উপকারী। এমনকি তাদের পেট থেকেও নির্গত হয় উপাদেয় ও উপকারী পানীয়, যা মধু নামে পরিচিত ৷ পবিত্র কুরআনের ভাষায়, يَخْرُجُ مِنْ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِلنَّاسِ ‘ওর উদর হতে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয়, যাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিষেধক’।

মধুর এই উপকারিতা আজ সর্বজন স্বীকৃত একটি বিষয়। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الشِّفَاءُ فِى ثَلاَثَةٍ شَرْطَةِ مِحْجَمٍ أَوْ شَرْبَةِ عَسَلٍ ، أَوْ كَيَّةٍ بِنَارٍ وَأَنْهَى أُمَّتِى عَنِ الْكَىِّ ‘রোগমুক্তি আছে তিনটি জিনিসে। শিঙ্গা লাগানোতে, মধু পানে এবং আগুন দিয়ে দাগ দেওয়াতে। আমার উম্মাতকে আগুন দিয়ে দাগ দিতে নিষেধ করছি’।[9]

মৌমাছিদের এই কাজগুলো হঠাৎ বনে যাওয়া কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। বরং এর পেছনে রয়েছে এক মহাপবিত্র, মহান জ্ঞানী, সুমহান রব মহান আল্লাহ তাআলার অপার জ্ঞানের পরিচয়। যা উক্ত আয়াতে উল্লেখিত اتخذي- كلي - فاسلكي শব্দত্রয়ের মাঝে যথাযথভাবে ফুটেছে। আর এই শব্দত্রয় আরো ইঙ্গিত বহন করে যে, নির্দেশগুলো দেওয়া হয়েছে ‘স্ত্রী’ মৌমাছিকে। যার স্বীকারোক্তি karl von frish এর নিজস্ব উক্তিতেই রয়েছে, They are females but do not lay eggs. অর্থাৎ ‘তারা স্ত্রী মৌমাছি, তবে ডিম পাড়ে না’।[10] অতএব, يَا أَيُّهَا الْإِنْسَانُ مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيمِ ‘হে মানুষ! কীসে তোমাকে তোমার মহান রব সম্পর্কে বিভ্ৰান্ত করল?’ (আল-ইনফিত্বার, ৮২/৬)

মুমিনকে তুলনা করা যেতে পারে এই মৌমাছির সাথে ৷ যে তার রবের command-কে দায়িত্বশীলতার সাথে পালন করে, তার চেতনার পুরোটা জুড়ে থাকে কেবলই তার রবের প্রতি আত্মসমর্পণ, সে কখনও তার রবকে ভুলে যায় না৷ সে যখন খায়, তখন পবিত্র বস্তু খায় আর যখন দান করে তখন পবিত্র বস্তু দান করে।

কথাগুলো মূলত আমার নিজের নয়। বরং বিশ্ব মানবতার মহান মুক্তিদূত বিগত সাড়ে ১৪০০ বছর আগে ঈমানদার বান্দাগণকে এভাবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ৷ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَثَلُ الْمُؤْمِنِ مَثَلُ النَّحْلَةِ لَا تَأْكُلُ إِلَّا طَيِّبًا وَلَا تَضَعُ إِلَّا طَيِّبًا ‘মুমিনগণ মৌমাছির মতো৷ সে পবিত্র বস্তু ছাড়া আহার করে না এবং পবিত্র বস্তু ছাড়া দান করে না’।[11] অন্য বর্ণনায় আছে, وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، إِنَّ مَثَلَ الْمُؤْمِنِ ‌لَكَمَثَلِ ‌النَّحْلَةِ، ‌أَكَلَتْ طَيِّبًا، وَوَضَعَتْ طَيِّبًا، وَوَقَعَتْ فَلَمْ تُكْسَرْ وَلَمْ تَفْسُدْ ‘যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, তাঁর শপথ! নিশ্চয়ই মুমিনগণ মৌমাছির মতো। সে পবিত্র বস্তু খায় এবং পবিত্র বস্তু দান করে ৷ সে ওয়াদা ভঙ্গ করে না, ফাসাদ সৃষ্টি করে না’।[12]

তবে সকলেই এখান থেকে শিক্ষা নেবে না। কেবল তারাই নেবে, যাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন, إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ ‘নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে সেই সকল লোকের জন্য, যারা চিন্তাভাবনা করে’ (আন-নাহল, ১৬/৬৯)

প্রশ্ন হলো, কারা সেই চিন্তাভাবনাকারী?

ইমাম ত্ববারী রহিমাহুল্লাহ-এর ভাষায়, তারা হলো সেই সমস্ত লোক, যারা এই সকল নিদর্শন দেখে বুঝতে পারে যে, أَنَّهُ الْوَاحِدُ الَّذِيْ لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ، وَأَنَّهُ لَا يَنْبَغِيْ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ شَرِيْكٌ، ‌وَلَا ‌تَصِحُّ ‌الْأُلُوْهِيَّةُ ‌إِلَّا ‌َلَهُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ একক, তাঁর মতো কোনো কিছুই নেই। এটা উচিত হবে না যে, আমরা তাঁর যাথে শিরক করব৷ আর এটাও ঠিক হবে না যে, তার উলূহিয়্যাহ তথা ইবাদতকে তিনি ছাড়া অন্য কারও জন্য নির্ধারণ করব’।[13]

মেরাজুল ইসলাম

যাত্রাবাড়ি, ঢাকা।

[1]. ইবনু কাসীর, ৪/৪৯৯।

[2].https://academic.oup.com/isle/article/23/4/835/2740728.

[3].একজন অষ্ট্রিয়ান প্রাণিবিদ। বিস্তারিত: https://www.newworldencyclopedia.org/entry/Karl_von_Frisch.

[4]. Karl von Frisch, The dancing bee, p. 3.

[5]. Karl von Frisch, The dancing bee, p. 3.

[6]. Karl von Frisch, The dancing bee, p. 3.

[7]. Karl von Frisch, The dancing bee, p. 177.

[8]. https://www.researchgate.net/publication/24220378.

[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৮১।

[10]. Karl von Frisch, The dancing bee, p. 3.

[11]. ছহীহ ইবনে হিব্বান, হা/২৪৭, হাসান।

[12]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৮৭২, সনদ ছহীহ।

[13]. তাফসীরে তাবারী, ১৭/২৫০।

Magazine