কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আল্লাহর দিকে দাওয়াত : দলীয় মোড়কে নাকি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে? (পর্ব-১৫)

post title will place here

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : মুক্তির পথ

ইমাম আবূ নু‘আইম ইস্পাহানী তার ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া’ কিতাবে (২/২১৮) সুফিয়ান ইবনু উয়াইনাহ সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি আছেম আল-আহওয়ালকে আবুল আলিয়া থেকে বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি বলেন, وَإِيَّاكُمْ وَهَذِهِ الْأَهْوَاءَ؛ فَإِنَّهَا تُوقِعُ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ وَعَلَيْكُمْ بِالْأَمْرِ الْأَوَّلِ الَّذِي كَانُوا عَلَيْهِ قَبْلَ أَنْ يَتَفَرَّقُوا ‘…তোমরা পক্ষপাতিত্ব করা থেকে সাবধান থাকবে। কেননা পক্ষপাতিত্ব তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। তোমরা প্রথম অবস্থা আঁকড়ে ধরে থাকো, যে অবস্থার উপর তারা ছিলেন বিভক্তির আগে…’।

আছেম বলেন, আমি ব্যাপারটা নিয়ে হাসান বাছরীর সাথে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম! তিনি আপনাকে চমৎকার নছীহত করেছেন এবং সত্য বলেছেন’। বিবরণটির সনদ ছহীহ।[1]

আপনি একটি ঘটনা নিয়ে একটু চিন্তা করুন, যেটি আবু নু‘আইম তার ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া’ কিতাবে (২/২০৪) মুতার্রিফ ইবনু আব্দিল্লাহ ইবনিশ শিখখীর সূত্রে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেন; আবু নু‘আইম-এর সূত্রে যাহাবী তার ‘সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা’ গ্রন্থে (৪/১৯২) বর্ণনা করেন, মুতার্রিফ বলেন, ‘আমরা যায়েদ ইবনে ছূহানের কাছে যেতাম। তিনি বলতেন, ‘আল্লাহর বান্দারা! সম্মান করো এবং (আমল) চমৎকারভাবে সম্পন্ন করো। (মনে রেখো!) বান্দা কর্তৃক আল্লাহর নৈকট্য লাভ কেবল দু’টি উপায়ে সম্ভব: ভয় ও আশা। একদা আমি তার কাছে আসলাম, তখন দেখি তারা একটি পত্র লিখেছেন, যেখানে তারা এধরনের কিছু বাক্য সাজিয়েছেন:

إِنَّ اللهَ رَبُّنَـا.........وَمُحَمَّدٌ نَبِيُّنَـا

وَالقُرْآنُ إِمَامُنَا.....وَمَنْ كَانَ مَعَنَا

كُنَّا....وَكُنَّا.... وَمَنْ خَالَفَنَا كَانَتْ

يَدُنَـــا عَلَيْهِ.....وَكُـنَّـا....وَكُـنَّـا.

(গদ্যানুবাদ) ‘আল্লাহ আমাদের রব এবং মুহাম্মাদ আমাদের নবী। কুরআন আমাদের এবং যারা আমাদের সাথে আছে, তাদের আদর্শ। আমরা একসাথে কাজ করব, আমরা একসাথে কাজ করব। যে আমাদের বিরোধিতা করবে, তার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করব। আমরা একসাথে কাজ করব, আমরা একসাথে কাজ করব’।

তিনি পত্রখানা তাদের কাছে একজন একজন করে পেশ করতে লাগলেন আর তারা বলতে লাগলেন, ‘হে অমুক! আপনি কি এ ব্যাপারে স্বীকৃতি দিচ্ছেন?’ এভাবে তারা আমার পর্যন্ত পৌঁছে আমাকেও বলল, ‘হে অমুক! আপনি কি এ ব্যাপারে স্বীকৃতি দিচ্ছেন?’

আমি বললাম, না।

যায়েদ ইবনে ছূহান বললেন, এই ছেলের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করো না।

বৎস! তুমি কী বলতে চাও?

আমি বললাম, إِنَّ اللهَ قَدْ أَخَذَ عَلَيَّ عَهْدًا فِي كِتَابِهِ فَلَنْ أُحْدِثَ عَهْدًا سِوَى الْعَهْدِ الَّذِي أَخَذَهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيَّ ‘মহান আল্লাহ তাঁর মহাগ্রন্থে আমার কাছ থেকে একটি অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন। অতএব, সেই অঙ্গীকার ছাড়া ভিন্ন কোনো অঙ্গীকারের জন্ম দেওয়া আমার পক্ষে কস্মিনকালেও সম্ভব নয়’।

এরপর লোকেরা সবাই তাদের উপর্যুক্ত অঙ্গীকার থেকে ফিরে আসলো, তাদের কেউ আর স্বীকৃতি দিল না। তারা সংখ্যায় ছিলেন প্রায় ৩০ জন।

এটি একটি আশ্চর্য ঘটনা। ‘জামা‘আতবদ্ধ কাজ’ বলতে সালাফে ছালেহীন কী বুঝতেন, ঘটনাটি সেকথা স্পষ্ট করে। তাদের বুঝ অনুযায়ী, ‘জামা‘আতবদ্ধ কাজ’ কোনোভাবেই আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর হাদীছের বাইরে যেতে পারে না।

এই ঘটনাটিতে অনেকগুলো উপকারী দিক রয়েছে:

(১) নিয়মিত আলেম-উলামার[2] নিকট উপস্থিত হয়ে তাদের কথা শোনা ও উপকৃত হওয়া।

(২) শরী‘আতসমর্থিত কল্যাণ গ্রহণে কোনো প্রকার দ্বিধা-সংকোচ চলবে না।

(৩) আমাদের শরী‘আতে যার বর্ণনা আসেনি, তার সবটাই প্রত্যাখ্যাত— যদিও মানুষ তাকে ভালো মনে করে। ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা যথার্থই বলেছেন,كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ، وَإِنْ رَآهَا النَّاسُ حَسَنَةً ‘প্রত্যেকটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা, যদিও মানুষ তাকে ভালো চোখে দেখে’।[3]

অতএব, ভুলকে রংচং মিশিয়ে সুন্দর করে সাজালেই তা সঠিক হয়ে যাবে না।[4]

(৪) শারঈ আমল ও দ্বীনী কথাবার্তা অবশ্যই শরী‘আতের ছাঁচে ফেলতে হবে; নবাবিষ্কৃত কোনো বিষয় বা দলীলবিহীন কোনো কিছুতে ফেলে সেগুলো মাপা যাবে না।

(৫) ব্যক্তি ছোট হোক বা বড় হোক হক্ব যার কাছ থেকেই আসুক না কেন, তা শুনতে হবে— যদি তার সাথে দলীল থাকে।

(৬) কুরআনে আল্লাহ কর্তৃক গ্রহীত অঙ্গীকারই উম্মতের জন্য পুরোপুরি যথেষ্ট। এই অঙ্গীকারের সাথে বহিরাগত অন্য কোনো অঙ্গীকারের দরকার নেই।

(৭) নাম আর বাহ্যিক রূপ বড় কথা নয়; বড় কথা হচ্ছে, বাস্তব রূপ। অতএব, শরী‘আতবিরোধী সবই প্রত্যাখ্যাত— তার নাম যাই হোক না কেন এবং ডিজাইন যতই চাকচিক্য হোক না কেন।

(৮) হক্বের দিকে ফিরে আসার মর্যাদা।

(৯) বেশি বা কম— ভুল ও সঠিক চেনার অথবা হক্ব ও বাতিল চেনার মানদণ্ড নয়।

(১০) দলীল জানা জরুরী।

(১১) পরামর্শ গ্রহণ ও অন্যের মতামত জানার গুরুত্ব।

(১২) বৈধ পদ্ধতিতে ও স্বাভাবিক রূপে ‘দলবদ্ধ কাজ’ অনেক ফলপ্রসূ— যদিও বাস্তবে তা খুব কম পাওয়া যায়।

এই বরকতময় দল, যারা হক্ব শুনে সেখানে আশ্রয় নেয়, তাদের এই সাহসী ভূমিকার ব্যাপারে আমি বলতে চাই, তাদের (সালাফে ছালেহীনের) পক্ষ থেকে ইজমা বা প্রায় ইজমা হয়ে গেছে যে, যেখান থেকে কোনোভাবে উম্মতের মধ্যে বিভক্তি ও ফাটলের দুর্গন্ধ পাওয়া যাবে, তা নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই বিষয়টি মুখস্থ রাখুন এবং সবসময় স্মরণে রাখুন; মতভেদের সময় তা আপনাকে উপকৃত করবে।

এ বিষয়টি জানার পর আমাদের কাছে ‘মুক্তির পথ’[5] স্পষ্ট হয়ে গেছে। মুক্তির পথ নির্ভর করে মহান আল্লাহর এই বাণীর উপর:وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ‘আর তোমরা পুণ্য ও তাক্বওয়ার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করো। কিন্তু পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে পরস্পরকে সাহায্য করো না’ (আল-মায়েদাহ, ৫/২)। যেমনটা বুঝেছেন এবং প্রয়োগ করেছেন সালাফে ছালেহীন।

অতএব, আমল, দাওয়াত ও মিলবন্ধনের মূল জায়গাটা হচ্ছে, ‘তাওহীদ ও মানহাজ। কেবল এই দু’টোর জন্যই শত্রুতা হতে পারে। আর তাওহীদের একটি আবশ্যিক বিষয় হচ্ছে, মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর অনুসরণ করা এবং অনুসরণ করা তার ছাহাবায়ে কেরামের। ফলে কোনোরূপ দলাদলির জন্য শত্রুতা চলবে না এবং কোনো প্রকার জামা‘আতের জন্য বিভেদ চলবে না’।[6]

‘দলবদ্ধ কাজে’র পক্ষে উপর্যুক্ত আয়াত দিয়ে নবাবিষ্কৃত ও বিদ‘আতী নিয়মে দলীল উপস্থাপন শরী‘আত উপলব্ধির উল্টো। কারণ মহান আল্লাহ বলেছেন,وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى ‘আর তোমরা পুণ্য ও তাক্বওয়ার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করো…’ (আল-মায়েদাহ, ৫/২)। তিনি কিন্তু এটাও বলেছেন, وَاعْتَصِمُوا ‌بِحَبْلِ ‌اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ‘আর তোমরা সকলে একসঙ্গে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো…’ (আলে ইমরান, ৩/১০৩)

অনুরূপভাবে তিনি বলেছেন, وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ‘তোমরা পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে পরস্পরকে সাহায্য করো না’ (আল-মায়েদাহ, ৫/২)। তিনি কিন্তু এটাও বলেছেন,وَلَا تَفَرَّقُوا ‘আর তোমরা বিভক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান, ৩/১০৩)

ফলে ‘পরস্পর সহযোগিতা’র আদেশটির বাস্তবায়ন শরী‘আতসম্মত পদ্ধতিতেই করতে হবে, যেন কোনোভাবেই ‘একতাবদ্ধ’ থাকার আদেশটি বাতিল না হয়ে যায়। অতএব, সাবধান! পদস্খলন ও ভ্রমে পতিতদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।

বুঝা গেল, এই আয়াতে কারীমাটিই হচ্ছে মূল; এখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হবে। কারণ ‘আয়াতটিতে মানুষের পরস্পরের মধ্যকার এবং মানুষ ও তাদের রবের মধ্যকার ইহকালীন ও পরকালীন যাবতীয় কল্যাণ নিহিত রয়েছে। কোনো বান্দাই এই দু’টি অবস্থা ও কর্তব্য থেকে বিচ্ছিন্ন নয়: একটি কর্তব্য তার ও আল্লাহর মাঝে এবং অপরটি তার ও সৃষ্টির মাঝে।

মানুষ ও সৃষ্টির মধ্যকার কর্তব্যের মাঝে রয়েছে— পরস্পরের সম্পর্ক বজায় রাখা, সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং সঙ্গ দেওয়া। এসব ক্ষেত্রে তার করণীয় হচ্ছে, আল্লাহর আনুগত্য ও সন্তুষ্টির ব্যাপারে পারস্পরির সহযোগিতাস্বরূপ মানুষের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে এবং তাদের সঙ্গ দিয়ে কাজ করে যাওয়া। এভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই বান্দার সুখ ও সাফল্যের গোড়ার কথা। এটা ছাড়া তার সুখ বলে কিছু নেই। আর সেটাই হচ্ছে পুণ্য ও তাক্বওয়া, যে দু’টি হচ্ছে পুরো দ্বীনের নির্যাস।[7]

এ দু’টির কারণেই তার সম্পর্কহীনতা, এর কারণেই মিলবন্ধন, এর কারণেই ভালোবাসা, এর কারণেই শত্রুতা। সে তার যাবতীয় সম্পর্ক তৈরি করবে মহান আল্লাহর এ বাণীর উপর ভিত্তি করে: وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ‘আর তারা পরস্পর পরস্পরকে হক্বের উপদেশ দেয় এবং উপদেশ দেয় ধৈর্যের (আল-আছর, ১০৩/৩)

বান্দা তার ভাইদের সাথে একতাবদ্ধ থাকার সময় তাদের সাথে তার সব সম্পর্ক কেবল ‘মুক্তির উপায় এবং হক্ব ও ধৈর্যের উপদেশের ব্যাপারে পারস্পরিক সহযোগিতার উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আর এটা একটা বিরাট সম্পদ’।[8]

‘সৎ ও তাক্বওয়ার কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং পরস্পরের উপদেশ প্রদানের দাবি হচ্ছে, কল্যাণের দিকে আহ্বান করা এবং এ ব্যাপারে সাহায্য করা। এর আরো দাবি হচ্ছে, অনিষ্ট থেকে সতর্ক করা এবং খারাপদের সাথে সহযোগিতা বজায় না রাখা’।[9]

সৎ ও তাক্বওয়ার কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং পরস্পরকে উপদেশ প্রদানের আরো দাবি হচ্ছে— পরস্পর অধ্যবসায় করা, শিক্ষা দেওয়া, শিক্ষা নেওয়া, দাওয়াত দেওয়া, স্মরণ করিয়ে দেওয়া, পথ দেখানো, ভালো কাজের আদেশ করা, মন্দ কাজে নিষেধ করা, যৌথ দায়ভার গ্রহণ করা, ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি। আসলে এজাতীয় দাবি গণনা করে শেষ করা যাবে না। ইসলাম এগুলো বাস্তবায়নের আদেশ দিয়েছে এবং উৎসাহিত করেছে। এগুলোই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের বীজস্বরূপ হওয়া উচিত, দাঈগণ যার প্রচেষ্টা চালাবেন এবং এর জন্য সঙ্গবদ্ধ হবেন। إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ ‘নিশ্চয় আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে’ (আর-রা‘দ, ১৩/১১)

বিভিন্ন দল, জামা‘আত, সংগঠন যদি কিছু করে, তাহলে এগুলোর চেয়ে কী বেশি করবে?!

যিনি মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হক্বসহ পাঠিয়েছেন, তাঁর কসম করে বলি, যে দাবিগুলোর কথা বলেছি, তারা সেসবের চেয়ে বেশি কিছু করতে পারবে না। আর সেগুলো করলেও তারা করবে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এবং নির্দিষ্ট একটি বলয় থেকে।

এগুলো করার পেছনে তাদের মূল উদ্দীপক হচ্ছে, দলীয় ফরমান এবং সাংগঠনিক আনুগত্য।

এমনটা শোভনীয় নয় এবং জায়েযও নয়। কারণ ‘প্রত্যেকটা আমলের উৎস ও লক্ষ্য থাকা একান্ত জরুরী। সেজন্য কোনো আমলই আনুগত্য ও নৈকট্যের উপাদান হতে পারে না, যতক্ষণ না তা ঈমানী উৎস থেকে সঞ্চারিত হবে। ফলে আমলের উদ্দীপক হতে হবে খাঁটি ঈমান; না কোনো প্রথা-প্রচলন, না মনের খায়েশ, না প্রশংসা-প্রতিপত্তির অভিলাষ। বরং অবশ্যই তার উৎস হতে হবে খাঁটি ঈমান। আর লক্ষ্য হতে হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে নেকী ও তাঁর সন্তুষ্টি’।[10]

খাঁটি ঈমান এমন ঈমান, যেখানে কোনো ধরনের ভেজাল ঢোকেনি।

আপনাকে আমার রব কল্যাণের তাওফীক্ব দান করুন। যেসব দলবাজ দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে এবং এর কারণে তাদের কর্মস্পৃহা নিস্তেজ হয়ে গেছে, তাদের ব্যাপারে আপনি একটু চিন্তাফিকর করুন: তাদের আগের ও পরের অবস্থার মধ্যে আপনি কী দেখতে পাচ্ছেন?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনি তাদের আগের অবস্থা দেখবেন যে, তারা স্বতঃস্ফূর্ততা ও গতিময়তার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

আর তাদের পরের অবস্থা দেখবেন যে, তারা দুর্বলতা ও নিস্তেজতার কেন্দ্রবিন্দু।

কিন্তু এর কারণ কী?!

কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট। কারণ হচ্ছে, তাদের উপর প্রভাব বিস্তারকারী দলীয় চিন্তাচেতনা। তারা দলীয় নির্দেশনা বা সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত ছাড়া নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারে না! এমনকি তারা পুতুলে পরিণত হয়েছে, যারা কেবল পুতুলওয়ালার হাতের স্পর্শে নড়াচড়া করতে পারে! অথবা দাবার গুটিতে পরিণত হয়েছে, যারা খেলোয়াড়ের আঙুলের ছোঁয়া ছাড়া নড়তে পারে না!

দলীয় উদ্দীপনাই তাদের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে!

তবে কিছু মানুষ এমন আছে, যারা তাদের দলের অধঃপতন ও তিক্ত বাস্তবতা অনুভব করত দলাদলি ও বিভক্তি পরিত্যাগ করে দূরে থাকাকে প্রাধান্য দিয়েছে।

কিন্তু এটা তাদের উপর কোনো ধরনের প্রভাব ফেলতে পারেনি; কারণ তারা তাদের সচেতনতার কারণে জানতে পেরেছে যে, তাদের সব কাজের ‍উৎস ও উদ্দীপক হওয়া উচিত খাঁটি ঈমান। ফলে তাদের কোনো আমল পরিবর্তন হয়ে যায়নি। তাদের কোনো উপলব্ধি ও প্রয়োগও উল্টো হয়ে যায়নি।

বরং তারা ইসলামের ব্যাপকতার দৃষ্টিতে দেখে এবং উন্মুক্ত ঈমানী উপলব্ধি নিয়ে চলে। এই ব্যাপকতা ও উন্মুক্ত ঈমানের কারণে তারা ঈমানের তারতম্য ছাড়া অন্য কোনো কারণে মানুষের মধ্যে তারতম্য করে না। তারা দলীয় নেতৃত্বের কারণে মানুষের মধ্যে তারতম্য করে না। বরং তারা শুধু আলেম-উলামা ও বড় বড় ফক্বীহগণের অনুসরণ করে।

প্রথম যুগের শীর্ষব্যক্তিবর্গের অবস্থা ছিল এটাই, যারা বিভক্তির আগে এমনই ছিলেন।

অতএব, আপনাকে এপথই ধরতে হবে, এ থেকে পদস্খলিত হওয়া যাবে না।

আপনি সেসব ভালো মানুষের অনুসরণ করুন, যারা ভালো কাজের আদেশ দিয়েছেন, মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করেছেন এবং আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিয়েছেন পারস্পরিক সহযোগিতার বেষ্টনী থেকে এবং পরস্পরকে হক্ব ও ছবরের উপদেশের আওতায় থেকে।

আপনি বিখ্যাত ছাহাবী হিশাম ইবনে হাকীম ইবনে হিযাম রযিয়াল্লাহু আনহু–এর দিকে লক্ষ করুন। তার সম্পর্কে ইমাম যুহরী বলেছেন, كَانَ يَأْمُرُ بِالْمَعْرُوْفِ فِيْ رِجَالٍ مَعَهُ ‘তিনি তার সাথের লোকদের মাঝে থেকে ভালো কাজের আদেশ দিতেন’।[11]

তার এই কাজের উদ্দীপক কী ছিল?

সংকীর্ণ দলাদলি আর সীমাবদ্ধ জোট কি তার উদ্দীপক ছিল নাকি পুণ্য ও তাক্বওয়ার ব্যাপারে পারস্পরিক সহযোগিতা তার উদ্দীপক ছিল?[12]

প্রথম যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আলেম ও দাঈগণ এই ধারাবাহিকতার উপরই অব্যাহত রয়েছেন। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল থেকে এটা শুরু হয়েছে। ‘খলকুল কুরআন ফেতনা’র সামনে তার এবং তার সঙ্গীদের বীরত্বগাথা ভূমিকা সকলের নিকট সুবিদিত। তারপর তাতারী ও তাদের ফেতনার বিরুদ্ধে শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়ার ভূমিকার কথাও আমাদের জানা। তিনি, তার সঙ্গীসাথী ও দেশবাসী কীভাবে ফেতনার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন! তার সঙ্গীসাথী ও দেশবাসী কীভাবে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন! বর্তমান উন্নতি ও উৎকর্ষতার এই যুগেও বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন স্থানে অনেক আলেম-উলামা একই ভূমিকা রেখেছেন। যেমন— আল্লামা আলূসী, আল্লামা কাসেমী, শায়খ মুহাম্মাদ বাহজাত আল-বায়তার, শায়খ আহমাদ শাকের, শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী, শায়খ ইবনে বায প্রমুখ।

এসব আলেমের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ইসলামের নির্মলতা ও সুন্নাতের স্বচ্ছতার উপর ভিত্তিশীল ছিল। কোনো ধরনের বিরোধিতা বা ধূর্ততার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না, যা কিনা দলাদলি, ভেদাভেদ বা বিভক্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে। সেজন্য তাদের সকলের উপর মহান আল্লাহর এ বাণীটি যথাযথ প্রযোজ্য হয়েছিল,وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يُوقِنُونَ ‘আর আমি তাদের মধ্য হতে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার নির্দেশ মোতাবেক সৎপথ প্রদর্শন করতেন, যতদিন তারা ধৈর্য অবলম্বন করেছিল আর আমার আয়াতসমূহের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রেখেছিল’ (আস-সাজদাহ, ৩২/২৪)

(চলবে)

মূল : আলী ইবনে হাসান আল-হালাবী আল-আছারী

অনুবাদ : আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী

বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।


[1]. দ্রষ্টব্য: আল-মুনতাক্বা আন-নাফীস মিন তালবীসি ইবলীস, পৃ. ৩৩।

[2]. যায়েদও আলেম-উলামার মধ্যে গণ্য। দ্রষ্টব্য: ত্ববাক্বাত ইবনে সা‘দ, ৬/১২৩-১২৬; তারীখু বাগদাদ, ৮/৪৩৯।

[3]. লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ, আছার নম্বর: ১২৬, সনদ ছহীহ।

[4]. সেজন্যই মুতার্রিফ সাজানো সেই কথাগুলোর বাহ্যিক রূপ নিয়ে ভাবেননি। কারণ ঐ কথাগুলোতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সেই কাঠামোকে ঘিরে, যেখানে কথাগুলো রাখা হয়েছিল।

[5]. এখানে আমরা ‘বিকল্প’ (اَلْبَدِيْلُ) কথাটি বলব না, যেমনভাবে আমরা ‘আধুনিক চিন্তাবিদদের’ কাছ থেকে সর্বদা শুনে থাকি। যারা দ্বীনের ভেতর অনেক কিছুই নতুনভাবে সৃষ্টি করেছে সেগুলোকে ‘বিকল্প’ কল্পনা করে। সেজন্য তাদেরকে বলতে দেখি, ‘ইসলামী ব্যাংক’, ‘ইসলামী সংগীত’, ‘ইসলামী নাটক’ ইত্যাদি।

আমরা আর কতকাল অন্ধ অনুকরণ-অনুসরণের গুহায় পড়ে থাকব?! আমাদের আশপাশে দেখব এবং অন্যদের অনুকরণ করব; যখন কোনো কিছুকে দ্বীনবিরোধী দেখব, তখন দ্রুত তার ‘বিকল্প’ বের করার চেষ্টা করব! সেটা করতে গিয়ে আমরা ব্যবহার করব নানা ‘ছলচাতুরী’, গলে মিশে যাব সবার সাথে, ‘ছাড় ও পদস্খলন’ খুঁজে বেড়াব এবং ‘ইসলামের আধুনিকীকরণ’ নিয়ে ব্যস্ত থাকব!

আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওফীক্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির নিকট অস্পষ্ট নয় যে, এমনটি করা ইসলামী ব্যক্তিত্বের মূলনীতিবিরোধী, যে মূলনীতি স্বতন্ত্র, স্পষ্ট ও প্রকাশিত। আল-হামদুলিল্লাহ আমাদের দ্বীন আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করা এবং দাওয়াত দেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করে। কিন্তু আমাদের পরিস্থিতিপরিপন্থী বিষয়গুলো সে ব্যাপারে উৎসাহিত করে না। অতএব, বুঝার চেষ্টা করুন।

সেকারণে ‘বিকল্প’ পরিভাষাটিকে ‘নিষিদ্ধ শব্দাবলি’র তালিকায় রেখে দিতে হবে।

[6]. আদনান আর‘ঊর, আস-সাবীল ইলা মানহাজি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ, পৃ. ১৪৬।

[7]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আর-রিসালাহ আত-তাবূকিয়্যাহ, পৃ. ১০।

[8]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ, পৃ. ৫০।

[9]. মাজাল্লাতুল ফুরক্বান, ১৪ সংখ্যা, পৃ. ১০, প্রবন্ধ: পুণ্য ও তাক্বওয়ার কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা অপরিহার্য, প্রণয়ন: আল্লামা আব্দুল আযীয ইবনে বায।

[10]. আর-রিসালাহ আত-তাবূকিয়্যাহ, পৃ. ১২।

[11]. ইবনু হাজার, আল-ইছাবাহ, ৬/২৮৫।

[12]. ‘আল-মুনতালাক্ব’ প্রণেতার একটি কথায় আশ্চর্য হতে হয়। তিনি বলেছেন, ‘তিনি আদেশদাতাদের একটি দল গঠন করেছিলেন’!! উক্ত কথাই তার বক্তব্য খণ্ডনের জন্য যথেষ্ট।

Magazine