[ক]
সেক্যুলারিজম প্রসঙ্গে লেখা হঠাৎ-ই শুরু। মিশর সম্পর্কে পড়ছিলাম, ভাবলাম নিজের পড়াটা সবার সাথে শেয়ার করি। বিশেষ করে যারা এ সময়ে ইসলাম নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, তাঁদের সাথে। হয়তো আমি উপকৃত হব, নয়তো তাঁরা। এ পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে আরো দুএকটা লেখা লিখব এ প্রসঙ্গে।
সে সূত্র ধরেই এ লেখায় লিখতে চাচ্ছি সেক্যুলারিজম এর পরিচয়। বিশেষ করে, এ নিয়ে আমাদের দেশে এক প্রকার অস্পষ্টতা আছে। সাধারণ মুসলিমদের অনেকেই সেক্যুলারিজমের ছেলে-ভুলানো কথায় ভুলে আছেন। হয়তো তাঁরা ইসলামের বক্তব্য বুঝতে পারবেন। ইসলাম ও সেক্যুলারিজম পরস্পর বিরোধী— এটা হয়তো তাঁদের কাছে স্পষ্ট হবে।
এটা এমন না যে, আমিই প্রথম বলছি আর উলামায়ে কেরাম এসব বলছেন না। উলামায়ে কেরাম সবসময়ই একথা বলে উচ্চকিত। কিন্তু আমরা, সাধারণ মুসলিমরা আবার অনেক ক্ষেত্রে আলেমগণের এই বিরোধিতা অন্য আঙ্গিকে দেখি। অনেকে বলতে চাই, উলামায়ে কেরাম এসবের কী জানেন? না জেনেই তাঁরা সেক্যুলারিজমের বিরুদ্ধে লেগেছেন। আজকের লেখা হয়তো এসব মুসলিমদের দ্বিতীয়বার ভাবার অবকাশ দেবে। তবে আমার সেক্যুলারিজম-সংক্রান্ত আলোচনার মূল সুর ধরার জন্য এ লেখাটা জরুরী ছিল। এজন্যই লেখা।
এটি একাডেমিক লেখা নয়। আমি ইতিহাস কিংবা রেফারেন্স টেনে লেখাকে জটিল করতে যাচ্ছি না। শুধু সহজ ভাষায় সেক্যুলারিজমের প্রকৃতি ও পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করব। পাশাপাশি কুরআন-হাদীছের রেফারেন্স নিয়েও লেখা ভারী করতে চাচ্ছি না। সেসব আপনারা উলামায়ে কেরামের লেখা ও কথায় পেয়েই যাবেন। আমি শুধু ইসলামের অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টাই করে যাব ইনশাআল্লাহ।
[খ]
সেক্যুলারিজমের উৎপত্তি মূলত আঠারো শতকের ইউরোপে। খ্রিষ্টান চার্চের সাথে শাসকদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বই এর জন্য দায়ী। অবশ্য এর পেছনের অর্থনৈতিক কারণও অস্বীকার করার উপায় নেই। চার্চ তথা পোপদের ক্ষমতা থেকে শাসন ক্ষমতাকে পূর্ণরূপে রাজাদের হাতে হস্তান্তরের প্রয়োজনেই সেক্যুলারিজমের উদ্ভব। পরবর্তীতে পাশ্চাত্য সভ্যতার বস্তুবাদ ও ভোগবাদ এ মতবাদের পালে হাওয়া দেয় এবং সেক্যুলারিজমকেই ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে চর্চা করা শুরু করে।
মজার ব্যাপার হলো, সেক্যুলারিজম সব জায়গায় বা সব স্থানে একরূপ নয়। সময়-স্থান আর অবস্থার প্রেক্ষিতে এর রূপ ভিন্ন ভিন্ন। তবে উদ্দেশ্য একই— মানুষকে যথেচ্ছ স্বাধীনতা দেওয়া। প্রধানত তিনটি রূপে সেক্যুলারিজম আত্মপ্রকাশ করে। এগুলো সেক্যুলারিজমের পর্যায় হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে—
(১) কেবল রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি থেকে ধর্মের অপসারণ। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিতে কোনো ধর্মের প্রাধান্য থাকবে না, কোনো ধর্মের প্রভাবও থাকবে না। এ অবস্থায় সামজিক কার্যাবলিতে ধর্মের অনুশীলন নিষিদ্ধ নয়।
মুসলিম দেশসমূহ সাধারণত প্রথম প্রকারে সেক্যুলারিজমের অনুগামী। কেননা মুসলিমপ্রধান দেশে ধর্মকে একেবারে সামাজিক পর্যায় থেকে দূর করা খুবই কঠিন। ফলে সেসব স্থানে কেবল রাষ্ট্রীয় সব সিদ্ধান্তে ধর্মকে দূরে রাখা হয়।
(২) রাষ্ট্রীয় কার্যাবলির পাশাপাশি সামজিক ও পাবলিক কর্মকাণ্ডেও ধর্ম নিষিদ্ধকরণ। শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে ধর্ম অনুশীলন বৈধ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউকে এসব হচ্ছে এরূপ সেক্যুলারিজমের অনুসারী। বাস্তবতা হলো রাষ্ট্রপ্রধান ‘Protector of faith’ (Christian faith) শুধু নামমাত্র। ডলারে ‘In God we trust’ লেখা থাকলেও গডের দৌড় শুধু ওই পর্যন্তই। অন্য সব সিদ্ধান্ত মানুষের নিজের হাতে গড়া। হ্যাঁ, ব্যক্তি পর্যায়ে ধর্ম পালন করা যেতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের তাতে কোনো মাথাব্যথা নেই। হয়তো সকলে মিলে সামজিকভাবেও সম্ভব, তবে তা ধর্মের নামে নয়; কম্যুনিটির নামে।
(৩) ধর্মকে কোনো দেশ বা সমাজ হতে চিরতরে বিদূরিত করা। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায়েও ধর্ম মানার অনুমতি নেই। ধর্ম একেবারেই নিষিদ্ধ।
সোভিয়েত, চীন ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অবস্থা। যেখানে ‘ধর্ম হচ্ছে আফিম’। বর্তমানের কিছু দেশ হিজাব-নিকাব ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে ধর্মকে ব্যক্তি জীবন থেকেও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা মূলত সেক্যুলারিজমের দ্বিতীয় পর্যায় থেকে তৃতীয় পর্যায়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র।
[গ]
এবার আসি, ইসলাম কী বলে? প্রিয় ভাই! এই তিন প্রকারের সেক্যুলারিজমের কোনোটাই ইসলাম সমর্থন করে না।
অন্য ধর্মের সাথে ইসলামের পার্থক্য এখানেই। অন্যগুলো যেখানে তৃতীয় পর্যায়ে, ধর্ম নিষিদ্ধ হলে কেবল প্রতিবাদী হয়। ইসলাম সেখানে প্রথম পর্যায়ের সূচনাতেই প্রতিবাদী। কেননা অন্য ধর্ম শুধুই ধর্ম। জীবনযাপনের সার্বিক পথনির্দেশনা তাদের নেই। যদি পরোক্ষভাবে থেকেও থাকে, তবে তার অনুশীলন নেই। ফলে একেবারে ঘর থেকে ক্রস বা মূর্তি বের করে না দিলে, তাদের কিছুই আসে যায় না; তাদের জীবনে কোনো পরিবর্তনই আসে না।
এ জায়গাতেই ইসলামের সাথে তাদের মৌলিক ব্যবধান। ইসলাম শুধু ধর্মই না, বরং জীবনব্যবস্থা। যাতে ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনের দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে এবং তা খুবই স্পষ্ট ভাষায়। আরো বিস্ময়কর হলো, এসব নির্দেশনা অনুশীলন করা হচ্ছে ইসলামের প্রথম দিন থেকেই।
সেজন্যই আমরা দেখি, যেখানেই মুসলিম, হোক তা মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.০০১%, সেখানেই ইসলামের উপস্থিতি। মুসলিমরা যেখানেই গিয়েছে, সাথে নিয়েছে তার সংস্কৃতি। হ্যাঁ, নিজ দেশের সংস্কৃতি এবং ইসলামের সংস্কৃতি। তা সে যত খারাপ মুসলিমই হোক না কেন। ছালাতের জন্য মসজিদ দরকার, দরকার ইসলাম শেখার মাদরাসা। তা না হলে অন্তত টুপি আর জায়নামাজ দরকার। হালাল খাবারের দরকার। তাও যদি না হয়, নামটা অন্তত মুসলিম থাকবে, অন্তত একটা অংশ হলেও।
অন্য ধর্মের অনুসারীদের এ সমস্যা নেই। তারা নির্দ্বিধায় মিশে যাচ্ছে প্রবাসের সংস্কৃতিতে। হয়তো ঘরে তাদের নিজের ধর্ম আর দেশের সংস্কৃতি আছে, কিন্তু প্রকাশ্যে তারা সে সংস্কৃতিরই অনুসারী।
এজন্য দেখা যায় পরিচিতি সংকটে (identity crisis) মুসলিমরাই বেশি ভোগে। এ নিয়ে একাডেমিক গবেষণাও কম হয়নি। আর তা শুধু পাশ্চাত্যে নয়; মুসলিম দেশেও। যেমন বাংলাদেশের মুসলিমদের সংকট তারা বাঙালি, না-কি মুসলিম। যদিও দুটোই একসাথে হওয়া দুষ্কর কিছু না, তবুও কিছু স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এ প্রশ্ন তুলে থাকেন। নিদেনপক্ষে কোনো পরিচয় আগে এ প্রশ্ন তো সাধারণ মুসলিমকে বিপাকে ফেলারই প্রয়াস। যাহোক, এ আলোচনায় আজ যাচ্ছি না।
এসব কারণে পাশ্চাত্যে হোক বা প্রতীচ্যে, মুসলিম দেশে হোক বা অমুসলিম দেশে, যখনই সেক্যুলারিজম দানা বেঁধে ওঠে তখন মুসলিমরাই প্রতিবাদী হন। কারণ একটাই। আমরা মানি বা না মানি, কম অনুশীলন করি বা বেশি, ইসলাম স্বয়ংই আমাদের life style. এছাড়া আমরা চলি কীভাবে? সেক্যুলারিজমের দোহাই দিয়ে তা বন্ধ করার পাঁয়তারা হলে প্রতিবাদ না করে কি কোনো উপায় আছে?
[ঘ]
আমাদের দেশে সুন্দর একটা ফাঁকি আছে, অনেকটা শুভংকরের ফাঁকির ন্যায়। সেক্যুলারিজমকে বাংলায় বলা হয়— ধর্মনিরপেক্ষতা। আর আলেমগণ বলেন— ধর্মহীনতা। পরিভাষা হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাই টিকে গেছে। কারণ ক্ষমতাশালী কর্তৃপক্ষের চাহিদা যে এমনই।
এই ধর্মনিরপেক্ষতার সুন্দর কিছু স্লোগান আছে। যে যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে, কেউ কাউকে বাধা দেবে না; সকল ধর্মই সমান, ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মাধ্যমে কিন্তু প্রথম পর্যায়ের সেক্যুলারিজমকে প্রমোট করা হয়।
আমাদের সাধারণ মুসলিমগণও ভাবেন, বাহ! সত্যিই তো, খুব সুন্দর কথা। অথচ এর প্রতিটি কথাই ইসলামের আলোকে ব্যাখ্যা করলে হয়তো আপনারা অন্য কিছু জানবেন। হ্যাঁ, ইসলাম নিজেও এমন বলেছে, তবে তার রূপ ভিন্ন ও সুস্পষ্ট। সেক্যুলারদের মতো অস্পষ্ট আর অসৎ উদ্দেশ্যে নয়।
এসব স্লোগানের ফল আপনারা কিছুটা এখন দেখছেন। বাংলাদেশের জন্মের সময়ের ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগান বদলে গিয়ে এখন হয়েছে— ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। এভাবেই ক্রমান্বয়েই সব হবে, একেবারে কিছুই হয় না। অন্তত মুসলিম দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা।
এবার বলি আলেমগণ কেন সেক্যুলারিজমকে ধর্মহীনতা বলেন। সুধী পাঠক! ধর্ম যদি শুধু আমাদের ব্যক্তিজীবনেই থেকে যায়; সামজিক আর রাষ্ট্রীয় জীবনে না থাকে, তাহলে ইসলামের অনেক কিছুই বাদ পড়ে যায়। এমনকি যাকাত, জিহাদ, আমর বিল মা‘রূফ, নাহী আনিল মুনকার- এসবের কোনোটাই পূর্ণতা পায় না।
এমতাবস্থায় ইসলাম শুধু হাড্ডিসার কঙ্কাল হয়েই বেঁচে থাকতে পারে। এরূপ সেক্যুলারিজমকে আপনি কি ধর্মহীনতা বলবেন, না-কি ধর্মনিরপেক্ষতার নাম দিয়ে সেক্যুলারিজমের চারাগাছে পানি দেবেন— তা আপনার হাতেই তোলা রইল।
এজন্যই সেক্যুলারিজমের ক্ষেত্রে অন্য ধর্মের যতটা উদারতা, ইসলামের ততই বিরোধিতা। এ সুযোগে অন্যরা সেক্যুলারিজমকে ইসলাম দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। আর আমরা বোকা মুসলিমরাও এ ফাঁদে পা দিয়ে ওদের সাথে গলা মিলাচ্ছি, সমালোচনা করছি আলেমদের।
সুধী পাঠক! এখনো সময় আছে। একদিন সে সময়ও শেষ হয়ে যাবে। সেদিন মহান রবের সামনে কাদের সাথে নিয়ে দাঁড়াব তা চিন্তার সময় সম্ভবত এখনই; আজই, এই মুহূর্তেই।
সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
