মানুষের কর্মের কারণেই তার অধঃপতনের সূচনা হয়। পৃথিবীর সব জাতিই চায় উন্নতি। তারপরও অনেকে অধঃপতনের শিকার হয়। অপরাধ যখন ব্যক্তি পর্যায়ে থাকে, তখন অধঃপতন ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আবার যখনই ব্যাপকহারে কোনো দেশ বা জাতি অপরাধে লিপ্ত হয়, তখন সে অপরাধের দায় সকলকেই বহন করতে হয়। তখনই শুরু হয় দেশ ও জাতির অধঃপতন।
কোনো দেশে পাঁচ ধরনের অপরাধ চলমান থাকলে তারা কখনই উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারবে না, তাদের অধঃপতন সুনিশ্চিত।
(১) অশ্লীলতা: শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। তার কাজই হলো অন্যায় ও অশ্লীলতার আদেশ দেওয়া এবং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে সব রকমের অশান্তি নিশ্চিত করা। ইসলাম মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ চায়, পরকালীন শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহ্বান জানায় এবং সকল প্রকার অশ্লীলতাকে নিষেধ করে। একারণেই শয়তানকে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا النَّاسُ كُلُوْا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِيْنٌ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যমীনে যা হালাল ও পবিত্র, তা থেকে ভক্ষণ করো। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (আল-বাক্বারা, ২/১৬৮-১৬৯)।
ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট এসে বললেন, ‘…যখনই কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে (যেমন সূদ, ঘুষ, যেনা ইত্যাদি), তখন তাদের মধ্যে মহামারি আকারে প্লেগ ও এমন সব ব্যাধির জন্ম হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি…’।[1]
(২) ওযন ও পরিমাপে কারচুপি: সঠিকভাবে মেপে দেওয়া হচ্ছে লেনদেনের স্বচ্ছতা। বেচাকেনায় ওযন করার সময় সঠিকভাবে দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। ওযনে কারচুপি করার অপরাধে পূর্বে এক জাতি ধ্বংসও হয়েছে। আগত উম্মতকে সে বিষয়ে সতর্ক সংকেত দিয়ে কুরআনে কারীমে সেই ঘটনার বিশদ বিবরণ এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন,وَأَوْفُوا الْكَيْلَ إِذَا كِلْتُمْ وَزِنُوْا بِالْقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيْمِ ذٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيْلًا ‘মেপে দেওয়ার সময় পূর্ণরূপে মেপে দাও, সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওযন করে দাও। এটা পরিণামের দিকদিয়ে উত্তম ও উৎকৃষ্ট’ (বনী ইসরাঈল, ১৭/৩৫)। হাদীছের ভাষায়,وَلَمْ يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ إِلاَّ أُخِذُوا بِالسِّنِينَ وَشِدَّةِ الْمَؤُنَةِ وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْْ ‘যখন কোনো জাতি ওযন ও পরিমাপে কম দেয়, তখন তাদের ওপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ ও কঠিন বিপদ-মুছীবত আর তাদের ওপর শুরু হয় যালেম শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন’।[2]
(৩) যাকাত না দেওয়া: যাকাত মানে সম্পদ পরিশুদ্ধির বিধান। ধনীর সম্পদে গরীবের অধিকার হলো যাকাত। যাকাত না দিয়ে সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখা গরীব-দুঃখীর সম্পদ আত্মসাৎ করারই নামান্তর। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ ‘তাদের ধনসম্পদে রয়েছে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতের হক্ব’ (আয-যারিয়াত, ৫১/১৯)।
সম্পদের সুষম বণ্টন না থাকার কারণেই সমাজের সর্বত্র আমরা অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হই। যে রাষ্ট্রের অধিবাসীদের অধিকার সুনিশ্চিত নয়, তাতে সফলতা কামনা করা মানে বোকামি ছাড়া আর কী হতে পারে?
হাদীছের ভাষায়, وَلَمْ يَمْنَعُوا زَكَاةَ أَمْوَالِهِمْ إِلاَّ مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنَ السَّمَاءِ وَلَوْلاَ الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوا ‘কোনো জাতি যখন সম্পদের যাকাত আদায় করা থেকে বিরত থাকে, তখন তাদেরকে আসমানের পানি থেকে বঞ্চিত করা হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু-জানোয়ার (গরু, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, ঘোড়া ইত্যাদি) না থাকত, তাহলে তাদেরকে বৃষ্টির পানি দেওয়া হতো না’।[3]
(৪) অঙ্গীকার ভঙ্গ করা: অঙ্গীকার ভঙ্গ করা নিফাক্বের আলামত। কুরআন মাজীদের সূরা আল-মায়েদায় অঙ্গীকার পূরণের জোরালো তাগিদ এসেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এখানে অঙ্গীকার বলতে আল্লাহ তাআলা বান্দার কাছ থেকে ঈমান ও ইবাদত সম্পর্কিত যেসব অঙ্গীকার নিয়েছেন, সেটা অথবা তাঁর নাযিলকৃত বিধিবিধান, হালাল ও হারাম সম্পর্কিত যেসব অঙ্গীকার নিয়েছেন, আয়াতে সেগুলো উদ্দেশ্য’ (তাফসীরে মা‘রেফুল কুরআন, আল-মায়েদা, ৫/১-এর তাফসীর দ্রষ্টব্য)।
(৫) শরীআত বহির্ভূত বিচারব্যবস্থা: যমীন আল্লাহ তাআলার আর এখানে শাসনব্যবস্থা চলবে তাঁরই নির্দেশিত পন্থায়। নিজেদের মনগড়া সংবিধান মোতাবেক তাঁর যমীনে বিচারকার্য চলতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,قُلْ إِنِّي عَلَى بَيِّنَةٍ مِنْ رَبِّي وَكَذَّبْتُمْ بِهِ مَا عِنْدِي مَا تَسْتَعْجِلُونَ بِهِ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ يَقُصُّ الْحَقَّ وَهُوَ خَيْرُ الْفَاصِلِينَ ‘বলুন, আমি আমার প্রতিপালকের নিকট থেকে পাওয়া এক সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত; অথচ তোমরা তা মিথ্যা মনে করেছ, যা তোমরা খুব তাড়াতাড়ি পেতে চাও (অর্থাৎ আল্লাহর আযাব) তা আমার আয়ত্তে নেই। হুকুম বা ফয়সালার কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহর জন্যই। তিনিই সত্য কথা বর্ণনা করেন আর তিনিই সর্বোত্তম ফয়সালাকারী’ (আল-আনআম, ৬/৫৭)। আল্লাহর বিধান বহির্ভূত বিচারব্যবস্থার ব্যাপারে হাদীছে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের শাসকবর্গ যখন আল্লাহর কিতাব মোতাবেক ফয়সালা না করবে এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে বেছে না নিবে, তখন তিনি তাদের পরস্পরের মধ্যে কোন্দল (যুদ্ধ) বাঁধিয়ে দিবেন’ (ইবনু মাজাহ, হা/৪০১৯)।
একটি জাতির অধঃপতনের জন্য উপর্যুক্ত কারণগুলো বড় ভূমিকা পালন করে। আমাদের উচিত এসব বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে একমাত্র মহান আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!
মাহমুদ হাসান ফাহিম
শিক্ষক, বায়তুল আকরাম মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্স, সুরতরঙ্গ রোড, টঙ্গী, গাজীপুর।
[1]. ইবনু মাজাহ, হা/৪০১৯; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭৬৪।
[2]. ইবনু মাজাহ, হা/৪০১৯, হাসান।
[3]. ইবনু মাজাহ, হা/৪০১৯।