কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

রিযিক্ব নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন?

post title will place here

‘রিযিক্ব’ বলতে আমরা এখানে কেবল মাল-সম্পদকে বুঝাচ্ছি- যদিও রিযিক্ব শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। রিযিক্ব এমন একটি শব্দ, যা নিয়ে খুব কম সংখ্যক মানুষই দুশ্চিন্তামুক্ত থাকে। আর অধিকাংশ মানুষই আজ এই রিযিক্ব নিয়ে নানা ধরনের দুশ্চিন্তায় ভোগে।

রিযিক্বের তাড়নায় ছুটে বেড়াতে হচ্ছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম। প্রতিনিয়ত তারা দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে ভিন্ন এক দেশে আর দীর্ঘদিন কাটছে তাদের প্রবাস জীবনে। দিতে হচ্ছে নিজের শরীরের অজস্র শ্রম। এই রিযিক্বের তাড়নায় অনেককে হয়তো দিতে হয়েছে তার নিজের অমূল্য জীবন। তবুও কেন জানি রিযিক্বের দুশ্চিন্তা একটুও কমে না।

আচ্ছা! কখনো কি ভেবেছেন যে মহান রব আপনাকে এই সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন আর সেই মহান রব কিনা আপনার রিযিক্বের দায়িত্ব নিবেন না? কখনো কি ভেবেছেন যে মহান রব দুনিয়াতে এত এত প্রাণী সৃষ্টি করেছেন সেই মহান প্রতিপালক কি সকল প্রাণীর রিযিক্বের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন না? অথচ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا ‘আর যমীনে বিচরণকারী প্রতিটি বিচরণশীল প্রাণীর রিযিক্বের দায়িত্ব আল্লাহরই’ (হূদ, ১১/৬)। এছাড়া আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আরও বলেন, اللَّهُ لَطِيفٌ بِعِبَادِهِ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْقَوِيُّ الْعَزِيزُ ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অতি দয়ালু। তিনি যাকে ইচ্ছা রিযিক্ব দান করেন। আর তিনি মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী’ (আশ-শূরা, ৪২/১৯)। অন্য এক আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَتَ رَبِّكَ نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مَعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّا وَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ ‘তারা কি তোমার প্রতিপালকের রহমত ভাগ-বণ্টন করে? আমরাই দুনিয়ার জীবনে তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করে দেই এবং তাদের একজনকে অপরজনের উপর মর্যাদায় উন্নীত করি, যাতে একে অপরকে অধীন হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। আর তারা যা সঞ্চয় করে আপনার প্রতিপালকের রহমত তা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট’ (আয-যুখরুফ, ৪৩/৩২)

তারপরও কি আপনি রিযিক্ব নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকবেন? যে মহান প্রতিপালক এই পৃথিবীর সকল প্রাণীর রিযিক্বের দায়িত্ব নিয়েছেন, তিনি কি আমাদের রিযিক্বের ব্যবস্থা করে দিবেন না? কিন্তু তারপরও আমাদের রিযিক্ব নিয়ে দুশ্চিন্তা কমে না। আর তার বড় একটি কারণ হচ্ছে তাওয়াক্কুলের অভাব। একটি হাদীছ থেকে তাওয়াক্কুলের বিবরণ পাওয়া যায়। উমার ইবনুল খাত্ত্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, (রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন) ‘যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি যথার্থ ভরসা করো, তাহলে তিনি তোমাদেরকে অনুরূপ রিযিক্ব দান করবেন, যেরূপ তিনি পাখিকে রিযিক্ব দিয়ে থাকেন। সে ভোরে খালি পেটে বের হয় এবং দিনের শেষে ভরা পেটে (বাসায়) ফিরে আসে’।[1]

সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ কত মহান, যিনি একটি পাখি যে কিনা সকাল বেলা বের হয় খালি পেটে, সেও আহার করে এবং তার বাচ্চাদেরকেও আহার করায়। সুতরাং আমি, আপনি যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার উপর তাওয়াক্কুল করি, তাহলে অবশ্যই তিনি রিযিক্বের ব্যবস্থা করে দিবেন। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا - وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন। আর তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযিক্ব দিবেন, যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট’ (আত-তালাক, ৬৫/২-৩)

সুতরাং আল্লাহ তাআলা আমার, আপনার জন্য যে রিযিক্ব বরাদ্দ রেখেছেন, তা না পেয়ে আমরা মৃত্যুবরণ করব না। কেননা একটি হাদীছে আছে, জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ করো। কেননা কোনো ব্যক্তিই তার জন্য নির্ধারিত রিযিক্ব পূর্ণরূপে না পাওয়া পর্যন্ত মরবে না, যদিও তার রিযিক্ব প্রাপ্তিতে কিছুটা বিলম্ব হয়। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ করো, যা হালাল তাই গ্রহণ করো এবং যা হারাম তা বর্জন করো’।[2]

তাছাড়া আমাদের তাক্বদীরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যে রিযিক্বের ব্যবস্থা করে রেখেছেন, সেটি আমরা অবশ্যই পাব ইনশা-আল্লাহ। কেননা একটি হাদীছে রয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল ‘আছ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা সকল মাখলূকের তাক্বদীর আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর পূর্বে লিখে রেখেছেন’।[3]

রিযিক্ব নিয়ে দুশ্চিন্তার কী আছে! আপনার রিযিক্বই আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,الرِّزْقُ ‌أَشَدُّ ‌طَلَبًا لِلْعَبْدِ مِنْ أَجَلِهِ لَهُ ‘রিযিক্ব বান্দাকে অধিক অনুসন্ধানকারী তার মরণ তাকে অনুসন্ধান করার চেয়েও’।[4]

তবে এই রিযিক্বের তাড়নায় পড়ে আজ অনেক মানুষ হারাম উপার্জনের পথে পা বাড়াচ্ছে, যা ইসলামে নিষিদ্ধ এবং গর্হিত কাজ। যার ফলশ্রুতিতে দিন দিন মানুষের মাঝ থেকে বরকত উঠে যাচ্ছে। পরিবারে নেমে আসছে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ‘হে মানুষ! যমীনে যা রয়েছে, তা থেকে হালাল, পবিত্র বস্তু আহার করো এবং শয়তানের পদাঙ্কসমূহের অনুসরণ করো না’ (আল-বাক্বারা, ২/১৬৮)। অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,فَكُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ حَلَالًا طَيِّبًا وَاشْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ ‘অতএব, আল্লাহ তোমাদেরকে যে রিযিক্ব দিয়েছেন, তন্মধ্যে তোমরা হালাল পবিত্র রিযিক্ব আহার করো এবং আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করো, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত করে থাকো’ (আন-নাহল, ১৬/১১৪)

সুতরাং যতটুকু রিযিক্বের ব্যবস্থা হলে আপনার ও আপনার পরিবারের চলবে ততটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকুন; তবুও হারাম পথে উপার্জন করা বন্ধ করুন। বিলাসিতার নাম করে অধিক পরিমাণ উপার্জন থেকে বিরত থাকুন। আল্লাহ আপনাকে যা দিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকুন, এর মাঝেই রয়েছে বরকত। একটি হাদীছে আছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে লোক ইসলাম কবুল করেছে এবং তার নিকট ন্যূনতম রিযিক্ব রয়েছে এবং তাকে আল্লাহ তাআলা অল্পে তুষ্ট থাকার তাওফীক্ব দিয়েছেন, সেই সফলকাম হলো’।[5]

অনেককে দেখা যায় রিযিক্বের তাড়নায় আল্লাহ তাআলাকে ভুলে যায়, অথচ যে আল্লাহ আমাদেরই রিযিক্বের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন তাকে কীভাবে ভুলা সম্ভব? একটি হাদীছ থেকে জানা যায়, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কেউ যদি অভাব-অনটনে পড়ে তা মানুষের নিকট উপস্থাপন করে, তাহলে তার অভাব-অনটন দূর হবে না। আর যে ব্যক্তি অভাব-অনটনে পড়ে তা আল্লাহ তাআলার নিকট পেশ করে, তবে অবশ্যই আল্লাহ তাআলা তাকে দ্রুত অথবা বিলম্বে রিযিক্ব দান করেন’।[6]

অতএব, সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করুন। আপনার যা প্রয়োজন তা আল্লাহর নিকট পেশ করুন। অবশ্যই আল্লাহ আপনাকে হতাশ করবেন না। হয়তো সামান্য কিছুদিন রিযিক্বের তাড়নায় আপনাকে কষ্ট করতে হচ্ছে, তবে এর পেছনে নিশ্চয় আল্লাহ আপনার জন্য কল্যাণ রেখেছেন। আল্লাহ যেন আমাদের এ কথাগুলো বুঝার ও আমল করার তাওফীক্ব দান করেন- আমীন!

মুহাম্মাদ জাহিদ হাসান

শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা কলেজ।

[1]. তিরমিযী, হা/২৩৪৪, হাদীছ ছহীহ; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৬৪।

[2]. ইবনু মাজাহ, হা/২১৪৪, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/৫৩০০।

[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৫৩।

[4]. ছহীহুল জামে‘ আছ-ছগীর, হা/৩৫৫১, হাদীছ হাসান।

[5]. তিরমিযী, হা/২৩৪৮, হাদীছ ছহীহ।

[6]. তিরমিযী, হা/২৩২৬, হাদীছ ছহীহ।

Magazine