কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

হজ্জের বিধান

post title will place here

হজ্জ (হাজ্জ/حج) আরবী শব্দ। এর অর্থ হলো ইচ্ছা করা বা সংকল্প করা। হজ্জের শারঈ অর্থ হলো ‘আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা’। এটা সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর জীবনে একবার আদায় করা ফরয।

হজ্জ ইসলামের পঞ্চম রুকন। হজ্জ হচ্ছে আর্থিক ও শারীরিক ইবাদত। হজ্জের শর্ত কারো মধ্যে পাওয়া গেলে এবং সে তা আদায় না করলে তার ইসলাম পূর্ণ হবে না। আর তার জন্য হজ্জ বিলম্ব করাও বৈধ নয়। কারণ সে জানে না, ভবিষ্যতে তার কী ঘটতে পারে। হতে পারে তার মাল শেষ হয়ে যাবে, অসুস্থ হতে পারে বা মৃত্যু হতে পারে। ফলে তার হজ্জ সম্পাদন করা হবে না।

ইসলামে হজ্জের গুরুত্ব ও ফযীলত অপরিসীম। হজ্জ জীবনে একবার ফরয।[1] কবুল হজ্জের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত।[2] হজ্জ থেকে সে প্রত্যাবর্তন করবে এমন অবস্থায়, যেমনভাবে মাতৃগর্ভ হতে শিশু জন্মের দিন নিষ্পাপ হয়ে বের হয়।[3] হজ্জ ও উমরা দরিদ্রতা ও পাপকে মুছে দেয়।[4] হজ্জ ও উমরা পালনকারীকে আল্লাহর মেহমান বলা হয়েছে।[5]

হজ্জ ফরয হওয়ার দলীল:

আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ ‘আর আল্লাহর উদ্দেশে এই গৃহের হজ্জ করা সেসব মানুষের উপর অপরিহার্য, যারা সফর করার (আর্থিক) সামর্থ্য রাখে। আর যে ব্যক্তি কুফরী করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সমগ্র বিশ্ববাসী হতে প্রত্যাশামুক্ত’ (আলে ইমরান, ৩/৯৬-৯৭)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘আর মানুষের কাছে হজ্জের ঘোষণা দিয়ে দিন, তারা আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রসমূহের পিঠে, তারা আসবে দূরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে। যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিযিক্ব হিসেবে দান করেছেন, তার উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে। অতএব, তোমরা ওটা হতে আহার করো এবং দুস্থ ও অভাবগ্রস্তকে আহার করাও’ (আল-হাজ্জ, ২২/২৬-২৮)

এখানে কল্যাণ বলতে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ। আখেরাতের কল্যাণ হলো সেখানে ছালাত, তওয়াফ, হজ্জ-উমরার কার্যাবলি দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। দুনিয়ার কল্যাণ হলো সেখানে হজ্জের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্থ উপার্জন করা। যেমন আল্লাহ বলেন,لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ ‘তোমরা স্বীয় রবের অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করলে তাতে তোমাদের পক্ষে কোনো অপরাধ নেই’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৮)

আল্লাহ তাআলা উমরা ও হজ্জের আদেশ দিয়ে বলেন,وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ্জ ও উমরাকে পূর্ণ করো’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৬)। এতে বুঝা গেল যে, উমরাও জীবনে একবার ফরয।

ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত— ১. এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো (প্রকৃত) মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল, ২. ছালাত প্রতিষ্ঠা করা, ৩. যাকাত প্রদান করা, ৪. হজ্জ করা এবং ৫. রামাযান মাসের ছিয়াম পালন করা’।[6]

হজ্জের বিবরণ:

মহান আল্লাহ বলেন,الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَعْلُومَاتٌ فَمَنْ فَرَضَ فِيهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ ‘হজ্জ হয় নির্দিষ্ট মাসসমূহে। অতএব, এ মাসগুলোতে যে কেউ হজ্জ করার মনস্থ করবে, তার জন্য হজ্জের মধ্যে (ইহরাম অবস্থায়) স্ত্রী সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৭)

হজ্জের মাস তিনটি: শাওয়াল, যিলক্বদ ও যিলহজ্জের প্রথম ১০ দিন। কাজেই শাওয়াল মাসের পূর্বে হজ্জের ইহরাম বাঁধা জায়েয নয়।[7]

হজ্জ ফরয হওয়ার শর্ত: ১. মুসলিম হওয়া, ২. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, ৩. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া, ৪. আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য থাকা এবং ৫. মহিলা হলে তার সাথে মাহরাম পুরুষ থাকা।

হজ্জের রুকন: হজ্জের রুকন ৪টি। যথা- ১. ইহরাম বাঁধা, ২. আরাফায় অবস্থান করা, ৩. তওয়াফ করা, ৪. ছাফা-মারওয়া সাঈ করা।

হজ্জের ওয়াজিব: হজ্জের ওয়াজিব ৭টি। সেগুলো হলো— ১. মীক্বাত বা নির্দিষ্ট স্থান থেকে ইহরাম বাঁধা, ২. সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করা, ৩. মুযদালিফায় ৯ তারিখে রাত যাপন করা, ৪. তাশরীকের দিনগুলোতে (কুরবানীর পরবর্তী তিন দিন) মিনায় রাত যাপন করা, ৫. তিন জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা, ৬. মাথা মুণ্ডন করা বা চুল ছাঁটা এবং ৭. বিদায় তাওয়াফ করা।

রুকন ছেড়ে দিলে হজ্জ হবে না। আর ওয়াজিব ছুটে গেলে একটি ছাগল যবেহ করে তা মক্কার দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করতে হবে এবং তা থেকে নিজে খাওয়া যাবে না।

হজ্জ তিন প্রকার: ইফরাদ, কিরান ও তামাত্তু। হজ্জে ইফরাদ হচ্ছে শুধু হজ্জ, এতে কুরবানী নেই। বাকী দুই প্রকার হজ্জে কুরবানী দেওয়া ওয়াজিব।

উমরা আদায়ের সঠিক নিয়ম:

(১) মীক্বাতে গিয়ে গোসল-ওযূ করে শরীরে সুগন্ধি ব্যবহার করে ইহরামের কাপড় পরিধান করা। অবশ্য, মদীনার হোটেল বা বাসাবাড়ি থেকে ইহরামের প্রস্তুতি নিয়ে গেলেও হয়ে যাবে। তবে কাপড়ে সুগন্ধি লাগানো যাবে না।

(২) মীক্বাত থেকে মনে মনে উমরার নিয়্যত করা এবং বলা— اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ عُمْرَةً ‘আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা উমরাতান’। তারপর এভাবে তালবিয়া পড়া— لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالمُلْكَ، لاَ شَرِيكَ لَكَ ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারীকা লাক’ পাঠ করা। এই তালবিয়া কা‘বাঘর পৌঁছা পর্যন্ত পাঠ করতে হবে। মাঝখানে ওযূ নষ্ট হলেও সমস্যা নেই। তবে তাওয়াফ শুরু করার আগে অবশ্যই ওযূ করতে হবে।

(৩) হাজারে আসওয়াদ তথা কালো পাথর থেকে তওয়াফ শুরু করে সাত চক্কর দিয়ে সেখানেই সমাপ্ত করা। প্রথম তিন চক্করে রমল তথা মৃদু দৌঁড়ে চলার চেষ্টা করা। তওয়াফ ও সাঈকালে নির্দিষ্ট কোনো দু‘আ নেই, তবে রুকনে ইয়ামানী ও কালো পাথরের মাঝখানে এই দু‘আ—رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ ‘রব্বানা আ-তিনা ফীদ দুনয়া হাসানাতাও ওয়া ফীল আখেরাতে হাসানাতাও ওয়া ক্বিনা আযাবান নার’ পড়ার কথা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত।

(৪) সম্ভব হলে মাক্বামে ইবরাহীমের পিছনে, অন্যথা যে-কোনো জায়গায় দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করা।

(৫) ছাফা পাহাড় থেকে শুরু করে মারওয়া পর্যন্ত সাত বার সাঈ করা (দৌঁড়ানো)।

(৬) মাথা মুণ্ডন করা বা চুল ছোট করা আর মেয়েদের চুলের অগ্রভাগ সামান্য পরিমাণ কাটা। উক্ত কাজ সম্পাদন করলেই উমরা আদায় হয়ে যাবে ইনশা-আল্লাহ! উমরা যে-কোনো মাসে ও যে-কোনো সময়ে করা যায়।

হজ্জ আদায়ের সঠিক নিয়ম:

(১) যিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখ সকালে নিজ অবস্থান থেকে গোসল-ওযূ করার পর শরীরে সুগন্ধি ব্যবহার করে ইহরামের কাপড় পরিধান করে মনে মনে হজ্জের নিয়্যত করা এবং বলা—اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ حَجًّا ‘আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা হাজ্জান’। তালবিয়া পাঠ করতে করতে মিনার দিকে রওনা দিতে হবে।

(২) মিনায় অবস্থান করতে হবে যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ সকাল পর্যন্ত। সেখানে অবস্থানকালে সকল ছালাত যথা সময়ে ক্বছর করে আদায় করতে হবে।

(৩) যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখে সূর্যোদয়ের পর আরাফার দিকে রওনা দিতে হবে। সেখানে গিয়ে যোহরের সময়ে যোহর ও আছর ছালাত একত্রে ক্বছর করে পড়তে হবে। এরপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার সীমানার মধ্যে অবস্থান করতে হবে। অবস্থানকালে ক্বিবলামুখী হয়ে দু‘হাত তুলে বারবার দু‘আ করতে হবে। সে দিনের সবচেয়ে প্রিয় দু‘আ হলো— لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারীকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর’।

(৪) সূর্যাস্তের পর মাগরিব ছালাত আদায় না করে সরাসরি মুযদালিফার দিকে রওনা দিতে হবে। সেখানে পৌঁছে মাগরিব ও এশার ছালাত একত্রে ক্বছর করে আদায় করে রাত যাপন করতে হবে। সেখানে পরের দিন ফজর ছালাত আদায় শেষে ক্বিবলামুখী হয়ে দু’হাত উত্তোলন করে দু‘আ ও যিকির করতে থাকতে হবে। পূর্ব আকাশ ফর্সা হওয়ার পর সূর্য উদয়ের পূর্বেই মুযদালিফা ত্যাগ করতে হবে।

(৫) ১০ তারিখে মুযদালিফা থেকে মিনায় আসতে হবে। মিনায় পৌঁছে কয়েকটি কাজ ধারাবাহিকভাবে সম্পাদন করতে হবে— (ক) বড় জামরায় ‘আল্লাহু আকবার’ বলে সাতটি কঙ্কর মারতে হবে, (খ) কুরবানী থাকলে কুরবানী করতে হবে, (গ) মাথা মুণ্ডন করতে হবে বা চুল ছাঁটতে হবে, (ঘ) কা‘বাঘর তওয়াফ করতে হবে এবং (ঙ) ছাফা-মারওয়া সাঈ করতে হবে।

(৬) ১১ ও ১২ তারিখে মিনায় রাত যাপন করতে হবে। এই দুই দিন কঙ্কর নিক্ষেপের সময় হলো, সূর্য ঢলার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। প্রত্যেকদিন তিনটি জামরায় সাতটি করে কঙ্কর মারতে হবে। তবে কেউ ১২ তারিখে চলে আসতে চাইলে সূর্যাস্তের পূর্বেই মিনা ত্যাগ করতে হবে। আবার কেউ ইচ্ছা করলে ১৩ তারিখে নিক্ষেপ করে আসতে পারে।

(৭) এরপর মক্কায় অবস্থানের শেষে বিদায়কালে শেষ তওয়াফ করে মক্কা ত্যাগ করতে হবে। উক্ত কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করলেই হজ্জে আদায় হয়ে যাবে ইনশা-আল্লাহ!

শেষকথা: হজ্জ ইসলামের মৌলিক স্তম্ভগুলোর অন্যতম স্তম্ভ। বিশুদ্ধ নিয়্যতে নববী পদ্ধতিতে হজ্জ সম্পাদন করতে পারলে কবুল হজ্জের ছওয়াব আমরা পাব ইনশা-আল্লাহ! মহান আল্লাহ আমাদেরকে হজ্জসহ সকল ইবাদত বিশুদ্ধ নিয়্যতে সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

মাহবূবুর রহমান মাদানী

 শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৩৭।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/১৭৭৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৪৯।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫২১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৫০।

[4]. আল-জামেউছ ছাগীর, হা/২৯০১।

[5]. ইবনু মাজাহ, হা/২৩৩৯।

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬।

[7]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, আল-বাক্বারা, ২/১৯৭-এর তাফসীর দ্রষ্টব্য।

Magazine