কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কুরআনের আলোকে হাদীছের অপরিহার্যতা

post title will place here

উপস্থাপনা : মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য ছলনা, বাহানা ও কৌশল অবলম্বন করা শয়তানের চিরন্তন স্বভাব। মানুষের সামনে অতি খারাপ কাজকেও সে বিভিন্ন বাহানায় ভালো হিসেবে পেশ করতে পারে। যেমনটা পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘আর তারা যা করে, শয়তান তাদের সেই কর্মকে তাদের সামনে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে পেশ করে’ (আল-আনআম, ৬/৪)

তাই তো আমরা দেখি মেয়েদের অধিকারের নামে তাদেরকে নগ্নতার পথে উৎসাহিত করা হচ্ছে, যেটা স্বাভাবিকভাবে করা অসম্ভব ছিল। ঠিক তেমনি মানবাধিকারের বাহানায় সমকামিতার রাস্তাকে সহজ করা হচ্ছে, যেটা স্বাভাবিকভাবে করা অকল্পনীয় ছিল। ঠিক সেভাবেই সরাসরি হাদীছকে অস্বীকার করা বা হাদীছকে ছোট করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এবং সেটা মুসলিম সমাজকে গিলানো অনেক কঠিন। কিন্তু যখন কুরআনের শান-শওকত ও মান-মর্যাদার আড়ালে কুরআনের বিপরীতে হাদীছকে দাঁড় করানো হয়, তখন সেটা মুসলিমদেরকে বুঝানো অনেক সহজ হয়ে যায়। আজকের যুগের হাদীছ অস্বীকারকারীরা এই পদ্ধতিটাই অবলম্বন করেছে। তাদের একটাই চেষ্টা, কুরআনের বিপরীতে হাদীছকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হাদীছের উপর থেকে মুসলিমদের আস্থা ও বিশ্বাস উঠিয়ে দেওয়া। কিছুদিন পূর্বে হাদীছ অস্বীকারকারী এমন একজন ব্যক্তির সাথে আমার বিতর্ক হয়। সেখানে যে দলীল-প্রমাণাদি পেশ করা হয়, সেগুলো শ্রোতা কর্তৃক আল-হামদুলিল্লাহ অনেক বেশি পরিমাণে সমাদৃত হয়। তখন থেকেই শ্রোতাদের একটা বিরাট অংশ সেই দলীলগুলো লিখিত আকারে চাচ্ছিলেন। যদিও এই বাতিল ফেরক্বার রাদ্দ হিসেবে অতীতে আমার প্রকাশিত একটি গ্রন্থ রয়েছে ‘আমরা হাদীছ মানতে বাধ্য’ শিরোনামে; কিন্তু সেই গ্রন্থে এই দলীলগুলো সন্নিবেশিত করা হয়নি। আজকের এই প্রবন্ধে সেই বিতর্কের আলোকে শুধু কুরআন থেকে আমরা হাদীছের অপরিহার্যতা দেখব ইনশা-আল্লাহ।

(১) কুরআন ছাড়াও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অহী আসত, যা কুরআন থেকে প্রমাণিত : আমাদের দাবি অনুযায়ী, মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট দুই ধরনের অহী প্রেরণ করতেন। একটি হচ্ছে মহান আল্লাহর বাণী তথা পবিত্র কুরআন। আরেকটি হচ্ছে পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা, যা আমাদের নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ভাষায় তার ছাহাবীদের শিক্ষা দিতেন এবং বাস্তব জীবনে তা করে দেখিয়ে দিতেন। আমাদের এই দাবির পক্ষে অগণিত ও অসংখ্য হাদীছ রয়েছে যা আমরা হাদীছ মানতে বাধ্য বইয়ে আলোচনা করেছি। তবে আজকে আমরা এ দাবিটি কুরআন থেকে প্রমাণের চেষ্টা করব তথা আমরা কুরআন থেকেই প্রমাণ করব যে, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে কুরআনের বাইরেও অহী আসত।

দলীল : ১

আল্লাহ তাআলা বলেন,وَإِذْ أَسَرَّ النَّبِيُّ إِلَى بَعْضِ أَزْوَاجِهِ حَدِيثًا فَلَمَّا نَبَّأَتْ بِهِ وَأَظْهَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ عَرَّفَ بَعْضَهُ وَأَعْرَضَ عَنْ بَعْضٍ فَلَمَّا نَبَّأَهَا بِهِ قَالَتْ مَنْ أَنْبَأَكَ هَذَا قَالَ نَبَّأَنِيَ الْعَلِيمُ الْخَبِيرُ ‘আর যখন নবী তাঁর এক স্ত্রীকে গোপনে একটি কথা বলেছিলেন; অতঃপর যখন সে (স্ত্রী) অন্যকে তা জানিয়ে দিলো এবং আল্লাহ তার (নবীর) কাছে এটি প্রকাশ করে দিলেন, তখন নবী কিছুটা তাঁর স্ত্রীকে অবহিত করলেন আর কিছু এড়িয়ে গেলেন। যখন তিনি তাকে বিষয়টি জানালেন, তখন সে বলল, আপনাকে এ সংবাদ কে দিল? তিনি বললেন, মহাজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ আল্লাহ আমাকে জানিয়েছেন’ (আত-তাহরীম, ৬৬/৩)

ব্যাখ্যা : একদা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রী যায়নাব বিনতু জাহশ রযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকট আসার পর দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন। যা আয়েশা ও হাফছা রযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর মনে ঈর্ষা সৃষ্টি করে। ফলত, তারা উভয়ে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, তাদের যার নিকটেই আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসবেন তারা তাকে জিজ্ঞেস করবেন যে, আপনি মাগাফির খেয়েছেন নাকি? উল্লেখ্য, মাগাফির হচ্ছে দুর্গন্ধযুক্ত কোনো আঠাজাতীয় খাবার। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হাফছা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকটে আসলেন, তখন তিনি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রশ্নটি করেন। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাকে ঘটনা খুলে বলেন যে, তিনি যায়নাব রযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকট মধু পান করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, তিনি জীবনে আর কখনো মধু পান করবেন না এবং তাঁর এই সিদ্ধান্তটি কাউকে না জানানোর জন্য বলেন।

হাফছা রযিয়াল্লাহু আনহা যেহেতু বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর পূর্ব পরিকল্পনার অংশ ছিলেন, তাই তিনি আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা-কে সবকিছু খুলে বলে দেন। বিষয়টি মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানিয়ে দেন এবং তিনি তাকে কোনো হালাল বিষয়কে স্ত্রীদের সন্তুষ্টির জন্য নিজের উপর হারাম করতে থেকে নিষেধ করেন।

দলীলের যৌক্তিকতা : উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ তাআলা আমাদের রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অহীর মাধ্যমে সেই গোপন কথা জানিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, পবিত্র কুরআনে কোথাও মহান আল্লাহ সেই বিষয়টা খুলে বলেননি যে, তিনি তাঁর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কী গোপন কথা জানিয়েছেন। তথা এই গোপন কথাটি তিনি যে তাঁর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানিয়েছেন, তা তিনি কুরআনের বাইরে জানিয়েছেন। আর সেই জানানোর স্বীকৃতি তিনি পবিত্র কুরআনে দিচ্ছেন। তথা পবিত্র কুরআন স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট কুরআনের বাইরেও অহী আসত। যেমনটি মহান আল্লাহ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের গোপন কথা অহীর মাধ্যমে তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানিয়েছেন।

দলীল : ২

আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَا جَعَلْنَا الْقِبْلَةَ الَّتِي كُنْتَ عَلَيْهَا إِلَّا لِنَعْلَمَ مَنْ يَتَّبِعُ الرَّسُولَ مِمَّنْ يَنْقَلِبُ عَلَى عَقِبَيْهِ وَإِنْ كَانَتْ لَكَبِيرَةً إِلَّا عَلَى الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ إِنَّ اللَّهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ ‘আর যে ক্বিবলার উপর আপনি ছিলেন, তাকে কেবল এজন্যই নির্ধারণ করেছিলাম, যাতে আমি জেনে নেই যে, কে রাসূলকে অনুসরণ করে এবং কে তার পেছনে ফিরে যায়। যদিও তা অতি কঠিন (অন্যদের কাছে) তাদের ছাড়া, যাদেরকে আল্লাহ হেদায়াত করেছেন এবং আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদের ঈমানকে বিনষ্ট করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু’ (আল-বাক্বারা, ২/১৪৩)

ব্যাখ্যা : মহান আল্লাহ ক্বিবলা করে দিয়েছিলেন বায়তুল মাক্বদিসের দিকে। কিন্তু আমাদের নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাইতেন কা‘বাকে ক্বিবলা করা হোক! এই আশায় তিনি আসমানের দিকে চেয়ে থাকতেন বারবার। পরবর্তীতে তার আশাকে পূরণ করে মহান আল্লাহ কা‘বার দিকে ক্বিবলা করে দেন।

দলীলের যৌক্তিকতা : উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ নিজেই বলেছেন যে, এতদিন আমি যে বায়তুল মাক্বদিসের দিকে ক্বিবলা করে রেখেছিলাম, এটার দ্বারা মানুষকে পরীক্ষা করা উদ্দেশ্য ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, মহান আল্লাহ কা‘বার দিকে ক্বিবলা করার আদেশ পবিত্র কুরআনেই দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম যখন বায়তুল মাক্বদিসের দিকে ক্বিবলা করা হয়, সেটার আদেশ পবিত্র কুরআনের কোথাও উল্লেখ নেই। আবার তিনিই পবিত্র কুরআনে তাঁর সেই অতীত আদেশের উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন, আমি সেই আদেশ দিয়েছিলাম তোমাদের পরীক্ষার জন্য। তথা আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মহান আল্লাহ বায়তুল মাক্বদিসের দিকে ক্বিবলা করার আদেশ পবিত্র কুরআনের বাইরে অহীর মাধ্যমে দিয়েছিলেন। আর সেই আদেশের স্বীকৃতি তিনি পবিত্র কুরআনে দিচ্ছেন। সুতরাং কুরআন থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট কুরআনের বাইরেও অহী আসত।

দলীল : ৩

আল্লাহ তাআলা বলেন,فَلَمَّا قَضَى زَيْدٌ مِنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَاكَهَا لِكَيْ لَا يَكُونَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِي أَزْوَاجِ أَدْعِيَائِهِمْ إِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًا وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ مَفْعُولًا ‘অতঃপর যায়েদ যখন তার স্ত্রীর সাথে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম, যাতে পালক পুত্রদের স্ত্রীদের ব্যাপারে মুমিনদের কোনো অসুবিধা না থাকে; যখন তারা তাদের স্ত্রীদের সাথে বিবাহসম্পর্ক ছিন্ন করে আর আল্লাহর নির্দেশ কার্যকর হয়ে থাকে’ (আল-আহযাব, ৩৩/৩৬)

ব্যাখ্যা : আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পালক পুত্র যায়েদ ইবনু হারেছা রযিয়াল্লাহু আনহু-এর স্ত্রী ছিলেন যায়নাব বিনতু জাহশ রযিয়াল্লাহু আনহা। বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে তালাক হয়ে যায়। তালাক হয়ে গেলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়নাব রযিয়াল্লাহু আনহা-কে বিবাহ করেন। তার এই বিবাহকে নিয়ে মানুষ এই মর্মে প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সন্তানের বউকে বিবাহ করেছেন?! এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন, যেখানে তিনি বলেছেন যে, এই বিবাহের সিদ্ধান্তটি মূলত আল্লাহ তাআলার ছিল, যাতে মানুষের মাঝে পালক পুত্রকে নিজের পুত্র মনে করার ভুল ভেঙে যায়।

দলীলের যৌক্তিকতা : প্রশ্ন হচ্ছে, উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে বিবাহ হয়ে যাওয়ার পরে। আর উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, তিনিই এই বিবাহের বিষয়ে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আদেশ প্রদান করেছিলেন। কিন্তু মহান আল্লাহর যে আদেশের কথা তিনি বলেছেন সেই আদেশ পবিত্র কুরআনে কোথাও নেই। তথা মহান আল্লাহ তাকে পবিত্র কুরআনের বাইরেও অহীর মাধ্যমে উক্ত বিবাহের আদেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে মানুষের ভুল ধারণা সংশোধনের জন্য তিনি নিজে কুরআনে স্বীকৃতি দিচ্ছেন যে, এই আদেশ তিনি দিয়েছিলেন। সুতরাং উক্ত ঘটনা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বাইরেও অহী প্রেরণ করতেন।


আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক

ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।

Magazine