আক্বীদায়ে খতমে নবুঅত তথা নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সর্বশেষ নবী ও রাসূল বলে মেনে নেওয়ার বিষয়টি কুরআন ও হাদীছের সুস্পষ্ট ভাষ্য দ্বারা প্রমাণিত। এ বিষয়ে প্রত্যেক যুগের মুসলিমগণ ঐক্যবদ্ধ ও অভিন্ন মত পোষণ করে আসছেন। সুতরাং এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণকারী নিঃসন্দেহে কাফের! পথভ্রষ্ট বাতিল সম্প্রদায় কাদিয়ানীরা নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সর্বশেষ নবী ও রাসূল বলে মানে না বলেই কাদিয়ানীরা অমুসলিম, কাফের।
আমরা জানি, কাদিয়ান পাকিস্তানের একটি গ্রামের নাম। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের একটি জেলার নাম গুরুদাসপুর। উক্ত জেলায় একটি গ্রামের নাম ‘কাদিয়ান’। ১৯০১ সালে ওই গ্রামেরই এক লোক নাম মির্জা গোলাম আহমাদ, সে নিজেকে নবী দাবি করেছিল।
লোকটি পরবর্তীতে তার গ্রামের নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। তার অনুসারীরা সারা বিশ্বে ‘কাদিয়ানী’ নামে পরিচিত। আর কথিত (ভণ্ড) নবীর দাবিদার গোলাম আহমাদের প্রচারিত বাতিল ধর্মমতকে কাদিয়ানী ধর্ম বলেই আখ্যায়িত করা হয়। যেহেতু কাদিয়ানী ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা গোলাম আহমাদ ছিল ‘কাদিয়ান’ নামক গ্রামের অধিবাসী। যদিও লোকটি ইতোপূর্বে নিজেকে কখনো ঈসা মাসীহ হবার, কখনো বা ইমাম মাহদী ইত্যাদি হবার দাবি করেছিল। সারা বিশ্বে মুসলিম ধর্ম বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মত ফতওয়ার ভিত্তিতে প্রায় সবগুলো মুসলিম শাসকবৃন্দ কাদিয়ানীদের মুরতাদ ও ধর্মচ্যুত বলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দিতে থাকে। সবার আগে পাকিস্তান এ ফরমান জারি করে। তারপর আরব-বিশ্বসহ অন্যরা কথিত কাদিয়ানী ধর্মমতের ধারকদের অমুসলিম কাফের আখ্যায়িত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফরমান জারি করে।
একথা আজ আর কারো অজানা নয় যে, বৃটিশ সরকারের বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীকে নবীরূপে দাঁড় করিয়ে দেয়। এ ব্যক্তি নানা উদ্ভট দাবি-দাওয়ার মাধ্যমে ইসলামের বহু স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কে অস্বীকার করতে থাকে। পরে তার স্বরূপ উন্মোচন করে দেন মুসলিম বিশেষজ্ঞগণ। পবিত্র কুরআন আর ছহীহ হাদীছের আলোকে তাকে ও তার অনুচরদের সুস্পষ্টভাবে কাফের হবার ফতওয়া জারি করেন।
নবুঅতের দাবিদার মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ১৯০৮ সালে আহলেহাদীছের কিংবদন্তী আলেম ‘শায়েখ সানাউল্লাহ অমৃতসরী’-এর সাথে মুবাহালা করে; মুবাহালার পরেই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পায়খানায় পড়ে লাঞ্ছনাকর ও ঘৃণিতভাবে মৃত্যুবরণ করে। তার মৃত্যুর পর তার নির্বোধ অনুচররা ইয়াহূদী-খ্রিষ্টান শক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ফেতনার এ দাবানল সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালায়। ইতোমধ্যে বহু মুসলিম রাষ্ট্র তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কাফের ঘোষণা করেছে এবং সেসব দেশে তাদের প্রকাশনা ও প্রবেশ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে। সঊদী আরব কাদিয়ানীদের কাফের আখ্যায়িত করার পরপরই তাদের হজ্জ ভিসা আজীবনের জন্য বাতিল করে দিয়েছে।
প্রায় ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশ বাংলাদেশেও ভণ্ড নবী মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর অনুচরদের অমুসলিম ঘোষণা করার দাবি উঠেছে। তাদের খপ্পরে পড়ে কোনো মুসলিম যেন বেঈমান হয়ে না যায়, সেজন্য তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতিপত্রে এদেশের গণমানুষ স্বাক্ষরও করেছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ বৃটিশ ও তাদের মিত্র শক্তির রাক্ষসী ইশারায় এ দেশে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার গণদাবি বারংবার উপেক্ষিত হচ্ছে। যার ফলে কাদিয়ানীদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও বিভ্রান্তিমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। যা ক্রমান্বয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে।
কাদিয়ানীদের ফেতনার বিরূদ্ধে বাংলাদেশে ইতোপূর্বে জোরালোভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। নানা নামে অনেক সংগঠনও সক্রিয় ছিল। তন্মধ্যে তাহাফফূযে খতমে নবুঅত মুভমেন্ট, বাংলাদেশ খতমে নবুঅত আন্দোলন ইত্যাদি অন্যতম। আজও সে প্রতিরোধ আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। যদিও রাজনৈতিক বা অন্যান্য কারণে সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থায় চোখে পড়ার মতো কোনো কার্যক্রম নেই। এরই সুযোগে কাদিয়ানীরা নিজেদের ভ্রষ্ট মতাদর্শ সুকৌশলে এগিয়ে নিচ্ছে।
গত কয়েক বছরে তারা দেখতে পাচ্ছে যে, তাদের কর্মকাণ্ডে বাধা আসছে না। যেন বাধা দেওয়ার মতো কেউ নেই। যে কারণে তাদের আদি ও আসল ইসলামবিরোধী চেহারার দাম্ভিকতা প্রদর্শন সম্ভব হলো নাস্তিক ও এন্টি-ইসলাম ব্লগারদের জাগরণ মঞ্চে। গত ১০০ বছরের দীর্ঘ সময়ে এমন বাধাহীন অবস্থার কল্পনা করাও ছিল তাদের জন্য অসম্ভব ব্যাপার। সুতরাং বাংলাদেশের বর্তমান সময়টিকে বলা যেতে পারে ‘কাদিয়ানীদের স্বর্ণযুগ’।
কাদিয়ানী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ :
১৪০০ হিজরীর প্রথম দিকে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী নামক এক মিথ্যুকের মাধ্যমে মুসলিমদেরকে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ সম্প্রদায় জন্মলাভ করে। মিথ্যা নবুঅতের দাবিদার গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী প্রথমে নিজেকে মুজাদ্দিদ, এরপর ইমাম মাহদী, অতঃপর নিজেকে ঈসা আলাইহিস সালাম এবং সর্বশেষে নিজেকে শেষ নবী বলে দাবি করে।
নিম্নে তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহের মধ্য থেকে কিছু আক্বীদা তুলে ধরা হলো—
(১) তারা বিশ্বাস করে যে, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ছালাত পড়েন, ছিয়াম রাখেন, পানাহার করেন, যেমন সঠিক কর্ম করেন তেমনি ভুলও করেন আর স্ত্রীর সাথে মিলিত হন।[1]
(২) তারা বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে শেষ নবী বলে স্বীকার করে না।[2]
(৩) গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী নিজে আল্লাহর স্ত্রী হওয়ার মতো জঘন্য দাবি করেছে।[3]
(৪) গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী আরও বলেছে যে, গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর মাথা নবী-কন্যা ফাতেমা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর ঊরুদেশে রেখেছে।[4]
(৫) গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর লিখিত বই ‘আল-কিতাবুল মুবীন’-কে কাদিয়ানীরা কুরআনের ন্যায় মনে করে।[5]
(৬) কাদিয়ানীরা তাদের বার্ষিক সম্মেলনকে হজ্জ বলে মনে করে।[6]
(৭) তারা কাদিয়ান শহরকে মক্কা-মদীনার চেয়েও বেশি মর্যাদাপূর্ণ মনে করে।[7]
(৮) তারা বিশ্বাস করে, গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী নবী ও রাসূলগণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।[8] (নাঊযুবিল্লাহি মিন যালিকা)!
এছাড়াও তাদের বহু নিকৃষ্ট আক্বীদা রয়েছে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী রচিত মনগড়া বিভ্রান্তিকর কাদিয়ানীদের বিভিন্ন বইয়ে!
খতমে নবুঅত সম্পর্কে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভাষ্য :
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন,﴿مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا﴾ ‘মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের মধ্যকার কোনো পুরুষের পিতা নন, কিন্তু (তিনি) আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞাতা’ (আল-আহযাব, ৩৩/৪০)। হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,وَإِنَّهُ سَيَكُونُ فِي أُمَّتِي كَذَّابُونَ ثَلَاثُونَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِيُّ اللَّهِ وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيين لَا نَبِيَّ بِعْدِي وَلَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللَّهِ ‘অদূর ভবিষ্যতে আমার উম্মতের মাঝে ৩০ জন মিথ্যাবাদীর আগমন ঘটবে এবং তারা প্রত্যেকেই আল্লাহর নবী হওয়ার দাবি করবে। অথচ সত্য কথা হলো, আমিই শেষ নবী, আমার পরে আর কোনো নবী নেই। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, আমার উম্মতের একটি দল সত্যের উপর অনড় থাকবে, যারা তাদের বিরোধিতা করবে, তারা ক্বিয়ামত আসা পর্যন্ত তাদের কোনোই ক্ষতিসাধন করতে পারবে না’।[9]
উক্ত আয়াত ও হাদীছ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, রিসালাত ও নবুঅতের ধারাবাহিকতা আমাদের প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমেই সমাপ্ত হয়েছে।
কিন্তু ভ্রান্ত-পথভ্রষ্ট কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মনগড়া বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা সুস্পষ্টভাবে কুফরীপূর্ণ। আর তারা তাদের বিভ্রান্তিকর নবুঅত-বিরোধী কথাবার্তার ফাঁদে মুসলিমদের পথভ্রষ্ট করছে। বিধায় তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করা সময়ের দাবি। আক্বীদায় কাদিয়ানীরা সুস্পষ্ট কাফের। আর তাদেরকে কাফের ঘোষণা করে সর্বপ্রথম কাদিনায়ীদের প্রতিষ্ঠাতা নিজেকে ঈসা আলাইহিস সালাম আবার মাহদী দাবিকারী পথভ্রষ্ট গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর সাথে মুবাহালায় বসেছিলেন বৃটিশ ভারতের বিখ্যাত আলেম আহলেহাদীছের অনুসারী সানাউল্লাহ অমৃতসরী রহিমাহুল্লাহ। মুবাহালার এক সপ্তাহের মধ্যেই গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে পায়খানায় পড়ে মারা যায়। আর মাওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরী আরও ৪০ বছরেরও অধিক সময় বেঁচে থেকে দ্বীনের খেদমত করেন; ভারতীয় উপমহাদেশে ছহীহ সুন্নাহর দাওয়াতে ভূমিকা রেখে ছহীহ সুন্নাহর প্রচার-প্রসার করেন। ঐ সময় ঐতিহাসিক সে মুবাহালায় প্রমাণিত হয়েছিল যে, গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী পথভ্রষ্ট, আর তার প্রচারিত আক্বীদা ও কথাবার্তাও ভ্রান্ত।
অধ্যাপক ওবায়দুল বারী বিন সিরাজউদ্দিন
পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. আল-কাদেয়ানিয়্যাহ, পৃ. ৯৭।
[2]. রূহানী খাযায়েন, ১৮/২২৩।
[3]. ইসলামী কুরবানী, পৃ. ১২।
[4]. রূহানী খাযায়েন, ১৮/২১৩।
[5]. আল-কাদেয়ানিয়্যাহ, পৃ. ১০৮।
[6]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১।
[7]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১১২।
[8]. রূহানী খাযায়েন, ২২/২৮৫।
[9]. আবূ দাঊদ, হা/৪২৫২, হাদীছ ছহীহ।