কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কুরআন-সুন্নাহর আলোকে রামাযান ও ঈদ


ভূমিকা : 

রামাযান মাস মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস। এ মাস কুরআন নাযিলের মাস। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ ‘রামাযান হলো এমন মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৫)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ ‘নিশ্চয় আমরা কুরআন একটি বরকতপূর্ণ রজনিতে অবতীর্ণ করেছি’ (আদ-দুখান, ৪৪/৩)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ ‘নিশ্চয় আমরা কুরআনকে ‘লায়লাতুল ক্বদর’ বা ভাগ্য রজনিতে অবতীর্ণ করেছি’ (আল-ক্বদর, ৯৭/১)। এ মাসেই রয়েছে মহিমান্বিত ও ফযীলতপূর্ণ রজনি ‘লায়লাতুল ক্বদর’ বা ভাগ্য রজনি। যে রজনিতে ইবাদত করাকে আল্লাহ হাজার মাস ইবাদত করা অপেক্ষা উত্তম বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে এরশাদ হয়েছে, لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ ‘লায়লাতুল ক্বদর বা ভাগ্য রজনি হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম’ (আল-ক্বদর, ৯৭/৩)। নিম্নে এই মাসের গুরুত্ব, ফযীলত, করণীয়-বর্জনীয়সমূহ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা পেশ করা হলো-

রামাযান মাসের বিশেষ ফযীলত : কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এ মাসের বিভিন্ন ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

(১) রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাযান মাসকে বরকতপূর্ণ মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন।

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ لَمَّا حَضَرَ رَمَضَانُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُبَشِّرُ اَصْحَابَهُ أَتَاكُمْ رَمَضَانُ شَهْرٌ مُبَارَكٌ فَرَضَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ

আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, (রামাযান মাস আসলে) রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবায়ে কেরামকে এ বলে সু-সংবাদ দিতেন যে, তোমাদের সামনে রামাযান মাস উপস্থিত, যা বরকতপূর্ণ মাস। আল্লাহ তোমাদের উপর রামাযানের ছিয়ামকে ফরয করেছেন’।[1]

(২) রামাযান মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ প্রসঙ্গে বলেছেন,إِذَا جَاءَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ وَصُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ ‘যখন রামাযান মাস আসে, তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়’।[2]

(৩) অপর এক হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِذَا كَانَ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ صُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ وَمَرَدَةُ الْجِنِّ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ فَلَمْ يُفْتَحْ مِنْهَا بَابٌ وَفُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ ‘যখন রামাযান মাসের প্রথম রজনি হয়, তখন আল্লাহ শয়তান এবং অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলিত করে রাখেন এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে রাখেন। তাই (রামাযান মাসে) জাহান্নামের কোনো দরজা খোলা হয় না। আর জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেন। তাই জান্নাতের কোনো দরজা বন্ধ করা হয় না’।[3]

(৪) রামাযান মাসে আসমানের দ্বারসমূহ বান্দার জন্য উন্মোচন করা হয়। এ মর্মে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِذَا دَخَلَ شَهْرُ رَمَضَانَ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ ‘যখন রামাযান মাস আসে, তখন আসমানের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয়’।[4]

(৫) রামাযান মাসে আল্লাহর রহমতের দ্বারসমূহকে উন্মুক্ত করে দেন। এ মর্মে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِذَا كَانَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ ‘যখন রামাযান মাস আসে, তখন রহমতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়’।[5]

(৬) রামাযানের ছিয়াম আদায়ের মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ مُكَفِّرَاتٌ مَا بَيْنَهُنَّ إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ ‘যদি ছায়েম কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকে, তাহলে এক রামাযান পরবর্তী রামাযান পর্যন্ত মধ্যবর্তী গুনাহসমূহের কাফফারা হয়ে যায়’।[6]

(৭) প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য মানুষকে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ প্রসঙ্গে বলেন,إِنَّ لِلهِ عِنْدَ كُلِّ فِطْرٍ عُتَقَاءَ وَذَلِكَ فِى كُلِّ لَيْلَةٍ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য মানুষকে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তি দেন’।[7]

(৮) রামাযান মাস ‘ছবর’ বা ধৈর্যধারণের মাস। ছবর করা মুমিনের অন্যতম গুণ। ধৈর্যধারণ করার অনেক ফযীলত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন। এর মাধ্যমে জান্নাত পাওয়া যায়। রামাযান মাসে সামনে খাদ্য-খাবার, লোভনীয় আইটেমের উপস্থিতি, প্রবৃত্তির তাড়না সত্ত্বেও মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। সত্যিই ধৈর্যের অনুশীলনের এটা উৎকৃষ্ট মাধ্যম।

(৯) এ মাস কল্যাণ সন্ধানের মাস। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, وَيُنَادِى مُنَادٍ يَا بَاغِىَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَيَا بَاغِىَ الشَّرِّ أَقْصِرْ ‘একজন (ফেরেশতা) ঘোষণা করতে থাকেন, হে সৎকাজে আগ্রহী, অগ্রসর হও। হে অন্যায় কাজে আগ্রহী, ক্ষান্ত হও’।[8]

এ ছাড়াও রামাযানের ফযীলতের ব্যাপারে অসংখ্য ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।

রামাযানের ছিয়াম :

ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয এবং ইসলামের পাঁচটি রুকন বা স্তম্ভের অন্যতম রুকন হলো ছিয়াম। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,بُنِىَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ ‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি জিনিসের উপর, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার রাসূল’ এই সাক্ষ্য প্রদান করা, ছালাত ক্বায়েম করা, যাকাত আদায় করা, হজ্জ করা ও রামাযানের ছিয়াম রাখা’।[9]

তাই এক দিকে রামাযানের ছিয়াম যেহেতু ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রুকন, অপরদিকে তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বান্দার উপর ফরয বা আবশ্যকীয় বিধান। আল্লাহ তাআলা সুস্থ, সবল, মুক্বীমের উপর ছিয়াম রাখা ফরয করেছেন। আল্লাহ বলেছেন, فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ‘তোমাদের মধ্যে যে রামাযান মাস পায়, সে যেন রামাযান মাসের ছিয়াম রাখে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৫)

ছিয়াম পালনকারীর মর্যাদা :

(১) ছিয়াম রাখার মাধ্যমে একজন ছায়েম আল্লাহ তাআলার নিকট পছন্দনীয় মানুষ ও মুত্তাক্বী হতে পারে : সূরা আল-বাক্বারার ২৮৩ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি ছিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাক্বওয়াবান হতে পারো’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৩)। অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাক্বী বা আল্লাহভীরুকে ভালোবাসেন’ (আত-তওবা, ৯/৭)

(২) ছিয়াম পালনকারীর জন্য রয়েছে বিশেষ দুটি খুশীর সময় : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ وَإِذَا لَقِىَ رَبَّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ ‘ছিয়াম পালনকারীর জন্য রয়েছে দুটি খুশীর সময়: ইফতারের সময় এবং তার প্রতিপালকের নিকট ছিয়ামের বিনিময় প্রাপ্তির সময়’।[10]

(৩) ছিয়াম পালনকারীর মুখের ঘ্রাণ আল্লাহ তাআলার নিকট অত্যন্ত প্রিয় : সারাদিন না খেয়ে থাকার কারণে ছিয়াম পালনকারীর মুখে যে গন্ধ সৃষ্টি হয়, তা আল্লাহ তাআলার নিকট অত্যন্ত প্রিয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ ‘শপথ ঐ সত্তার, যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, ছায়েমের মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার নিকট কস্তুরির সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুগন্ধিময়’।[11]

(৪) ছিয়াম পালনকারীর জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রাপ্তি ও বিরাট প্রতিদানের সুসংবাদ : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘ঈমানের সহিত আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে প্রতিদান প্রাপ্তির আশায় যে ছিয়াম রাখে, আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন’।[12] অন্য এক হাদীছে এসেছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ صَامَهُ وَقَامَهُ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا خَرَجَ مِنْ ذُنُوبِهِ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সহিত প্রতিদান প্রাপ্তির আশায় রামাযানের ছিয়াম রাখবে এবং (ইবাদতে) রাত্রি জাগরণ করবে, সে ভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় যাবতীয় গুনাহ থেকে নিষ্পাপ হয়ে যাবে’।[13] তাছাড়া অন্যান্য আমলের থেকে ছিয়াম পালনকারীর রয়েছে বিশেষ ফযীলত। ছিয়াম পালনকারীর প্রতিদান আল্লাহ তাআলা নিজেই দেওয়ার কথা বলেছেন,يَتْرُكُ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ وَشَهْوَتَهُ مِنْ أَجْلِى الصِّيَامُ لِى وَأَنَا أَجْزِى بِهِ ‘আমাকে রাযী-খুশী করার জন্য ছিয়াম পালনকারী পানাহার ও যৌন চাহিদা পরিহার করেছে। সুতরাং ছিয়াম আমারই জন্য। তাই এর প্রতিদানও আমিই দিব’।[14]

(৫) ছিয়াম পালনকারীর জন্য রয়েছে জান্নাতের বিশেষ দরজা : আল্লাহ তাআলা তার অনেক প্রিয় বান্দার জন্য জান্নাত তৈরি করেছেন। আর আল্লাহ তাআলার তৈরিকৃত জান্নাতের একটি বিশেষ প্রবেশদ্বার ছিয়াম পালনকারীর জন্য নির্বাচন করেছেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ فِى الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ يَدْخُلُ مَعَهُمْ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ يُقَالُ أَيْنَ الصَّائِمُونَ فَيَدْخُلُونَ مِنْهُ فَإِذَا دَخَلَ آخِرُهُمْ أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ ‘নিশ্চয় জান্নাতে ‘রাইয়ান’ নামক একটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। কিয়ামতের দিন তা দিয়ে ছিয়াম পালনকারীগণ প্রবেশ করবেন। ছিয়াম পালনকারীদের সাথে ছিয়াম পালনকারী ব্যতীত অন্য কেউ উক্ত প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে, ছিয়াম পালনকারীগণ কোথায়? তখন ছিয়াম পালনকারীগণ উক্ত প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করবেন। অতঃপর যখন সর্বশেষ ছিয়াম পালনকারী প্রবেশ করবেন, তখন উক্ত প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেওয়া হবে। আর কেউ উক্ত প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না’।[15]

(৬) ছিয়াম পালনকারীর জন্য রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তির সুসংবাদ : দুনিয়াতে একজন মুমিনের প্রকৃত সফলতা হলো, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে যাওয়ার সংবাদপ্রাপ্ত হওয়া বা জান্নাতে প্রবেশের অধিকার লাভ করা। ছিয়াম এমন একটি ইবাদত, যে ইবাদতের মধ্যে যেমনভাবে জান্নাতপ্রাপ্তির সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে, তেমনভাবে ছিয়াম পালনকারীর জন্য ছিয়াম জাহান্নাম থেকে মুক্তির বর্ণনা এসেছে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الصِّيَامُ جُنَّةٌ مِنَ النَّارِ كَجُنَّةِ أَحَدِكُمْ مِنَ الْقِتَالِ ‘ঢাল তোমাদের যেমনভাবে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, তেমনভাবে ছিয়াম জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢালস্বরূপ’।[16] অপর এক হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الصِّيَامُ جُنَّةٌ وَحِصْنٌ حَصِينٌ مِنَ النَّارِ ‘ছিয়াম জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য ঢাল ও মযবূত দুর্গের সমতুল্য’।[17]

ছিয়াম অবস্থায় বর্জনীয় বিষয়সমূহ :

ছিয়ামের উক্ত ফযীলতসমূহ পেতে হলে ছিয়াম পালনকারীকে কতিপয় কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। অনেক বিষয় এমন আছে যা করলে ছিয়ামের প্রতিদান এবং ফযীলত শূন্য হয়ে যায় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,رُبَّ صَائِمٍ حَظُّهُ مِنْ صِيَامِهِ الْجُوعُ وَالْعَطَشُ وَرُبَّ قَائِمٍ حَظُّهُ مِنْ قِيَامِهِ السَّهَرُ ‘অনেক ছিয়াম পালনকারী এমন রয়েছে, ছিয়াম পালন করে যাদের ক্ষুধা ও পিপাসা ব্যতীত কিছুই হাছিল হয় না। অনেক ক্বিয়ামুল লাইলকারী এমন রয়েছে, যাদের রাত্রি জাগরণের কষ্ট ছাড়া আর কোনো প্রতিদান পায় না’।[18]

(১) যাবতীয় মন্দ কথা ও কাজ পরিহার করা : এ প্রসঙ্গে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِى أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ ‘যে ব্যক্তি ছিয়াম রেখে মিথ্যা কথা বলা এবং অন্যায় কাজ করা থেকে বিরত থাকবে না, তার সারা দিন পানাহার থেকে বিরত থাকার আল্লাহ তাআলার কোনো প্রয়োজন নেই’।[19]

(২) যাবতীয় ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকা : ঝগড়া-বিবাদ শুধু মানুষের সম্পর্ক এবং পরিবেশকেই নষ্ট করে না, বরং তা আমলের প্রতিদানকেও নষ্ট করে দেয়। তাই প্রত্যেক ছিয়াম পালনকারীর জন্য অপরিহার্য যে, কখনোই সে উক্ত জঘন্য কাজে জড়িয়ে পড়বে না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّى امْرُؤٌ صَائِمٌ ‘যখন তোমাদের কোনো ব্যক্তি ছিয়াম রাখে, তখন সে যেন কোনো অশ্লীল কথাবার্তা বা ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি অন্য কোনো ব্যক্তি তাকে গালি দেয়, তাহলে সে (ছিয়াম পালনকারী) যেন (তার উত্তরে গালি না দেয় বরং সে বলে) আমি ছিয়াম পালনকারী’।[20]

ছাদাক্বাতুল ফিত্বর :

‘ছাদাক্বা’ অর্থ ‘দান’, ‘ফিত্বর’ মানে ‘ছিয়াম সমাপন’। ছাদাক্বাতুল ফিত্বর অর্থ হলো ‘ছিয়াম শেষে ঈদুল ফিত্বরের দিনে সকালে প্রদেয় নির্ধারিত ছাদাক্বা’। এর মাধ্যমে ছিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি মার্জনা হয়। গরীব মানুষ ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারে।[21] এই ছাদাক্বা ঈদের ছালাতের আগেই আদায় করতে হয়।[22] ফিত্বরা কোনো দেশের প্রধান খাদ্যসামগ্রী দ্বারাই আদায় করতে হবে। কেননা হাদীছে ‘খাদ্যদ্রব্য’ এর কথাই এসেছে।[23] এদেশে প্রচলিত টাকায় ছাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করা সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি নয়। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য যেহেতু চাল, তাই এদেশে চাল দ্বারাই ছাদাক্বাতুল ফিত্বরা আদায় করাই সুন্নাত।

কারা ছাদাক্বাতুল ফিত্বর দেবেন এবং কাদের দেবেন? ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, স্বাধীন-দাস সকলকে ফিত্বরা দিতে হবে।[24] অসহায় গরীব, ফক্বীর, মিসকীনরাই ছাদাক্বাতুল ফিত্বরের হক্বদার। যাকাতের আট খাতের অন্যান্যরা ছাদাক্বাতুল ফিত্বরের হক্বদার নয়।[25]

ঈদুল ফিত্বর প্রসঙ্গ :

ইসলামী শরীআতে মুসলিমদের জন্য আয়োজন বছরে দু’টি ঈদের। একটি হলো, শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে পালিত ঈদুল ফিত্বর।

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাক্কী জীবনে তেমন কোনো সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন ও উদযাপনের সুযোগ মোটেও ছিল না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় হিজরত করলেন, তখন মুসলিমদের সামাজিক স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রতিষ্ঠার সুযোগটি প্রথম এসেছিল। হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে মহান আল্লাহ স্বীয় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে মুসলিমদের জাতীয় উৎসব পালনের অনুমতি প্রদান করেন। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদীনায় এলেন, তখন সেখানকার অধিবাসীরা বছরে দু’টি আনন্দ উৎসব আয়োজন করত। তাতে তারা খেলাধুলা ও আনন্দ-ফূর্তি করতো। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ দু’টি দিনের বিশেষত্ব কী?’ তারা উত্তর দিলেন, ‘আমরা জাহেলী যুগে এই দুই দিনে খেলাধুলা ও আনন্দ-ফূর্তি করতাম। (আর সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে)’ তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের আনন্দ উদযাপনের জন্য এই দুই দিনের পরিবর্তে উত্তম অন্য দু’টি দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার একটি হলো ঈদুল ফিত্বর আর অপরটি ঈদুল আযহা।[26]

ঈদুল ফিত্বরের দিন ইসলামী শরীআত মুসলিমদের উপর ছিয়াম রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আবূ উবায়দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘একবার এক ঈদুল আযহার দিনে আমি উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি ছালাত দিয়ে ঈদের দিনের আমল শুরু করলেন। অতঃপর খুৎবা দিলেন। তিনি তাঁর খুৎবায় বললেন, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ দুই দিনের ছিয়াম নিষিদ্ধ করতে শুনেছি। ঈদুল ফিত্বরের দিন, সেটা তো তোমাদের ছিয়াম ভঙ্গ করার দিন। আর ঈদুল আযহার দিনে তোমরা তোমাদের কুরবানীর গোশত খাবে’।[27]

ছালাতুল ঈদ :

ঈদের আনন্দের আরো একটি বড় উপাদান হলো ছালাতুল ঈদ। ঈদের দিন প্রথম প্রহরে এলাকার সকল মানুষ উম্মুক্ত ময়দানে সমবেত হয়ে একই ইমামের পেছনে ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছোট-বড়, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে দাঁড়িয়ে দুই রাকআত ছালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে মানবিক ঐক্য আর সাম্য-মৈত্রীর যে মহিমা ফুটে উঠে, সত্যিই তা বড় আনন্দের!

জাতীয় উৎসবে সবকিছুর আগে সম্মিলিতভাবে খোলা মাঠে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ছালাত আদায়ের পবিত্র দৃশ্য মহান আল্লাহ খুবই ভালোবাসেন। তাইতো তিনি ঈদগাহে সমবেত মুছল্লীদের দেখিয়ে ফেরেশতাদের বলতে থাকেন, ‘দেখো আমার ফেরেশতারা! আমার বান্দাগণ তাদের উপর আমার বিধান (রামাযান মাসের ছিয়াম) পালন শেষে আমার বড়ত্ব বর্ণনা করতে করতে প্রার্থনার জন্য সমবেত হয়েছে। আমার বড়ত্ব আর মহত্বের শপথ! আমি তাদের সব প্রার্থনা মঞ্জুর করব’। অতঃপর মহান আল্লাহ সমবেত সকল মুছল্লীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তোমরা ফিরে যাও, আমি তোমাদের সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছি এবং তোমাদের পাপসমূহ পুণ্য দিয়ে বদলিয়ে দিয়েছি’।[28]

বছর ঘুরে আসা ঈদুল ফিত্বরের দিনটি হোক ধনী-গরীব সকল মুসলিমদের আনন্দ-উৎসবের দিন। বৈষয়িক আনন্দে পূর্ণ হোক আল্লাহর আনুগত্যের নির্মল ধারায় ঈদুল ফিত্বরের দিনটি। আর ঈদের দিনে ‘ঈদ মোবারক’ না বলে এক মুমিন আরেক মুমিনকে বলুন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’।

ওবায়দুল বারী

অধ্যাপক, নারায়ণগঞ্জ কলেজ।

[1]. সুনানে নাসাঈ, হা/২১০৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭১৪৮; মুছান্নাফে ইবনু আবী শায়বা, হা/৮৮৬৭, হাদীছ ছহীহ।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯।

[3]. সুনানে ইবনু মাজাহ, হা/১৬৪২, হাদীছ ছহীহ।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯৯।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯।

[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩৩।

[7]. সুনানে ইবনু মাজাহ, হা/১৬৪৩, হাদীছ ছহীহ।

[8]. সুনানে তিরমিযী, হা/৬৮২; সুনানে ইবনু মাজাহ, হা/১৬৪২।

[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৯-২২।

[10]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫৭।

[11]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫১।

[12]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯৪।

[13]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/২২০১; মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা, হা/৮৬৩।

[14]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯৪।

[15]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫২।

[16]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/১৮৯১, ২১২৫; ইবনু হিব্বান, হা/৩৬৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬২৭৩, ১৬২৭৮, ১৭৯০২, ১৭৯০৯; সুনানে নাসাঈ, হা/২২৩০,২২৩১; মুসান্নাফে ইবনু আবী শায়বা, হা/৮৮৯১; সুনানে ইবনু মাজাহ, হা/১৬৩৯।

[17]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৯২২৫।

[18]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/৬৫৫১; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩৪৮১; সুনানে ইবনু মাজাহ, হা/১৬৯০।

[19]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৪।

[20]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১১১৫।

[21]. আবূ দাঊদ, হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৮২৭, হাদীছ ছহীহ।

[22]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫০৩, ‘যাকাত’ অধ্যায়, ‘ছাদাক্বাতুল ফিত্বর’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৮৪; মিশকাত, হা/১৮১৫।

[23]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৯৮৫; মিশকাত, হা/১৮১৬।

[24]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫০৩, ‘যাকাত’ অধ্যায়, ‘ছাদাক্বাতুল ফিত্বর’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৮৪; মিশকাত, হা/১৮১৫।

[25]. আবূ দাঊদ, হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৮২৭, হাদীছ ছহীহ।

[26]. সুনানে আবূ দাঊদ, হা/১১৩৪; আল-মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাইন, হা/১০৯১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৬২২।

[27]. আবূ দাঊদ, হা/২৪১৬; ছহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/২৯৫৯; আস-সুনানুল কুবরা, হা/৮২৪৯।

[28]. বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান, হা/৩৪৪৪; ফাযায়েলুল আওক্বাত, হা/১৫৫; আহাদীছুল কুদসিয়্যা, হা/১৬৮।

Magazine