কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আহলে কুরআনের ফেতনা প্রতিরোধে ভারতীয় উপমহাদেশের আলেমগণের অবদান

post title will place here

ভূমিকা: ইসলামের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে যুগে যুগে ইসলামবিদ্বেষী মহল মুসলিম জাতিকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ করার হীন অপচেষ্টা চালিয়ে গেছে, যেটা আমাদের প্রায় সকল মুসলিম অবগত। অমুসলিম গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র আমরা সকলেই উপলব্ধি করি, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে চেষ্টা করি। বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রায় সকলেই ঐকমত্য পোষণ করি। কিন্তু এই ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি আমাদের মুসলিম নামধারী, লেবাসধারী, নেক ছুরতে আগমনকারী এমন অনেক মানুষ রয়েছে, যারা মুসলিমদের ঈমান হরণ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কুফরী আক্বীদা ও মতবাদের সবক দিয়ে দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বেদ্বীন, সংশয়বাদী মুসলিম এমনকি নাস্তিক পর্যন্ত বানাচ্ছে। যদিও তারা আদৌ কোনো ইসলামী দল কিংবা মুসলিম নয় তথাপি‌ও তারা ইসলামী দল দাবি করে এমন হীন অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এই পথভ্রষ্ট, বিভ্রান্ত কুফরী মতবাদ লালনকারী দলের মধ্যে অন্যতম একটি দল হলো ‘আহলে কুরআন’ (তাদের দাবি হলো কুরআন মানি; কিন্তু হাদীছ মানি না)। এরা নিজেদেরকে ‘আহলে কুরআন’ দাবী করলেও এরা মূলত: কুরআন ও হাদীছ বিদ্বেষী, এতদুভয়ের অপব্যাখ্যাকারী। এই হাদীছ অস্বীকারকারীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের এই ভুল বুঝ এবং অপব্যাখ্যা এমনকি কুফরী মতবাদকে প্রচার-প্রসার ছাড়াও তা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে নানামুখী অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই ইসলাম বিধ্বংসী মতবাদের দৌড় কতদূর এবং তা প্রতিরোধে বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের আলেমদের অবদান কেমন ছিল, তা জানা সময়ের দাবি বলেই আজকের বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের অবতারণা। 

ভারতীয় উপমহাদেশে আহলে কুরআন (তথা সুন্নাহ অস্বীকারকারীদের) অপতৎপরতার উৎপত্তি:

ভারতীয় উপমহাদেশে ‘আহলে কুরআন’ ফেতনার ধাবমান লাগামহীন অপচেষ্টার গোড়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রায় বিংশ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে এদের গোড়াপত্তন হয়। আহলে কুরআনের এই ফেতনার আন্দোলনে যে কয়েকজন নেতৃত্ব দেয়, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্যার সৈয়দ আহমাদ খান ও আব্দুল্লাহ আল-যাকরালভী। আব্দুল্লাহ আল-যাকরালভী, যিনি অস্বীকার বলেন, সুন্নাহ শরীআতের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুন্নাহ তথা হাদীছ শরীআতের হুজ্জাত (দলীল) নয় বলে চরমভাবে তারা অস্বীকার করেন এবং সে এই সুন্নাহ অস্বীকার মিশনে বিভিন্নভাবে খোঁড়া যুক্তি, বক্তব্য, লেখনীর মাধ্যমে সব ধরনের মুসলিমদের মধ্যে মারাত্মক সংশয়, সন্দেহের বীজ বপন করার পাঁয়তারা চালায়। মূলত হাদীছ অস্বীকার করার এই নিকৃষ্ট আন্দোলনের মূল নেতৃত্বদানকারী হলো প্রাচ্যবিদগণ (Oriআলাইহিস সালামnহাফিযাহুল্লাহছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামlisহাফিযাহুল্লাহ)। তাদের মদদ পেয়ে বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে এই ফেতনার সূত্রপাত ঘটে। এই প্রাচ্যবিদগণ মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে মুসলিম সমাজকে মারাত্মক সংশয়বাদী ও নাস্তিকতার বিষবাষ্পে আবৃত করার লক্ষ্যে নিজেদের বিসর্জন করে। ফলে তারা মুসলিম জাতিসত্তা, আক্বীদা, তাহযীব, তামাদ্দুনের উপর সন্দেহের বিষাক্ত তির ছুড়ে। যার ফলে সময়ের স্রোতে অধিকহারে মুসলিম পরিবার, তরুণ প্রজন্ম সংশয়বাদী হিসেবে গড়ে উঠঠে। মূলত সাম্রাজ্যবাদীরা এভাবেই তাদের মিশন সফল করার লক্ষ্যে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। বিশেষ করে প্রাচ্যবিদগণ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে। কারণ যখন কোনো মুসলিমের অন্তরে তার শরীআত তথা হাদীছের উপর সন্দেহ, ধারণা, মিথ্যাচার ঢোকানো সম্ভব হবে ঠিক তখনই তাকে সহজেই করায়ত্ত করা সহজ হবে। নচেৎ তাকে বশ করা সম্ভব নয়। তাই তারা বড় বড় নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে এবং এই উদ্যোগকে সফল করার লক্ষ্যে মুক্তবুদ্ধির চিন্তার পরিশীলিত রূপায়নের মতবাদকে তরুণদের কাছে গ্ৰহণীয় করে তোলে। সেইসাথে তারা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলিম সন্তানদের পড়ালেখা করার সুযোগ তথা স্কলারশিপ এর ব্যবস্থা করে। তাদের এই দীর্ঘমেয়াদি নগ্ন ষড়যন্ত্রকে সফল করার জন্য ‘হাদীছ অস্বীকার’ করার আন্দোলনকে জোরদার করতে নেতৃত্ব দেন প্রাচ্যের বড় বড় পণ্ডিত, লেখক, গবেষক ও সাহিত্যিক। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন গোল্ড যোহের, যোসেফ, আলফ্রেড হিউম, এম গ্ৰীন, ফিলিপ হিট্রি, আলফ্রেড জিওম প্রমুখ।

ভারতীয় উপমহাদেশে মুনকিরে হাদীছ তথা হাদীছ অস্বীকারকারী ‘আহলে কুরআন’ আন্দোলনের মূলে পর্যায়ক্রমে নেতৃত্ব দেন চেরাগ আলী, আহমাদ দ্বীন অমৃতসরী, আসলাম জয়রাজপুরী, গোলাম আহমাদ পারভেজ প্রমুখ। ভারতীয় উপমহাদেশে তারা তাদের এই নব্য ফেতনাকে বিকশিত ও সকলের নিকটে গ্ৰহণযোগ্য করার লক্ষ্যে হাতে কলম তুলে নেয় এবং লেখনী শক্তিতে তাদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চেষ্টা চালায়। যেমন—

() আব্দুল্লাহ যাকরালভী: যিনি সুন্নাহ তথা হাদীছকে শরীআতের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে একেবারে অস্বীকার করেন। হাদীছ শরীআতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয় বলে তিনি বিশ্বাস করতেন এবং দ্বীনের যেকোনো বিষয়ে হাদীছের দিকে প্রত্যাবর্তন করার কোনো প্রয়োজন নেই বলে তিনি মন্তব্য করতেন। তিনি কলম ধরেন এবং ‘ইশাআতুল কুরআন’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন।

() আহমাদ দ্বীন অমৃতসরী: আহমাদ দ্বীন অমৃতসরী হলেন আব্দুল্লাহ যাকরালভী এর অনুসারী, সহযোগী এবং আহলে কুরআন মিশনের অন্যতম কর্ণধার। যখন আব্দুল্লাহ যাকরালভী মৃত্যুবরণ করে, তৎপরবর্তী সে এই হাদীছ অস্বীকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় এবং তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। মূলত সে ছিল অমৃতসরের অধিবাসী। সে ‘উম্মাতু মুসলিমা’ নামে একটি জামাআত প্রতিষ্ঠা করে এবং কুরআনের অপব্যাখ্যার চেষ্টা করে একটি তাফসীর লিখে ‘ইশাআতুল কুরআন’ নামে। তার দাবি ছিল কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন করা আর হাদীছকে বর্জন করা।

(৩) আসলাম জয়রাজপুরী: হাদীছ অস্বীকার আন্দোলনের পতাকাবাহীদের অন্যতম ব্যক্তি হলেন আসলাম জয়রাজপুরী। মূলত তিনি ছিলেন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। তিনি বিশ্বাস করতেন, বর্তমানে এই যুগে হাদীছের প্রয়োজন নেই।

() গোলাম আহমাদ পারভেজ: ভারতীয় উপমহাদেশে হাদীছ অস্বীকার আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা এবং শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন গোলাম আহমাদ পারভেজ। আসলাম জয়রাজপুরী ও গোলাম আহমাদ পারভেজ উভয়ে মিলে এই মিশনকে সফল করার জন্য ‘তুলূউল ইসলাম’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তারা এই পত্রিকা প্রচার-প্রসার করার মাধ্যমে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলাম এবং মুসলিমদের। তাদের এই পত্রিকার দাবি ছিল, এখন হাদীছের অনুসরণ প্রয়োজন নেই। আধুনিক যুগে সেই আগের তথা প্রাচীনকালের হাদীছ অনুসরণ নিষ্প্রয়োজন। এজন্য তারা ১৯৩৮ সালে এই পত্রিকা প্রকাশ করে।

(৫) মাওলানা মওদূদী: মাওলানা মওদূদী হলেন জামাআতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা। মূলত তিনি পুরোপুরি হাদীছকে অস্বীকার না করলেও হাদীছের উপর ছিল তার অগাধ সংশয়, সন্দেহ। তার দাবি ছিল হাদীছ সংকলন, ছহীহ-য‌ঈফ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে। এমনকি তিনি খবরে আহাদ হাদীছকে অগ্ৰহণযোগ্য বলে মন্তব্য করতেন। তিনি হাদীছের ব্যাপারে সংশয়বাদী ছিলেন এবং এর ব্যাপারে যথেষ্ট বিরূপ মন্তব্য লালন করতেন (দ্র. মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কোরায়শী রাহিমাহুল্লাহ-এর একটি পত্রের জবাব)।

আহলে কুরআনের ফেতনা প্রতিরোধে ভারতীয় উপমহাদেশের আলেমগণের অবদান:

হাদীছ অস্বীকার মিশন এবং হদীছের বিষয়ে সংশয়বাদী করে তোলার ফেতনাকে খুবই শক্তভাবে প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের আলেম সম্প্রদায় পৃথিবীর ইতিহাসে নযীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ইলমী অবস্থানে তাদের সে যুগোপযোগী প্রতিরোধের তীব্র স্রোতে আহলে কুরআনের নেতা, লেখনী, পত্রিকা মুখ থুবড়ে পড়ে। সুন্নাহ তথা হাদীছ ইসলামী শরীআতের হুজ্জাত তথা দলীল এবং দ্বীন ইসলামের অন্যতম অংশ। এটা সাব্যস্ত করার জন্য আহলুল হাদীছ ও হানাফী মাযহাবের আলেমগণ সমন্বিতভাবে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। তাদের সমন্বিত প্রতিরোধে তোপের মুখে পড়ে হাদীছ অস্বীকারকারীরা। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলবী রাহিমাহুল্লাহ-এর অন্যতম ছাত্র মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী রাহিমাহুল্লাহ, তিনি ‘আহলে কুরআন’-এর বিরুদ্ধে দাঁতভাঙা জবাবস্বরূপ পত্রিকা প্রকাশ করেন ‘ইশাআতুস সুন্নাহ’ নামে। যেটি প্রকাশিত হয় ১৯০২ বা ১৯০৩ সালে। মূলত এটি আহলে কুরআনের ‘ইশাআতুল কুরআন’-এর বিরুদ্ধে প্রকাশ করেন।‌

মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী রাহিমাহুল্লাহ বীর যোদ্ধার মতো তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ‘আহলে হাদীছ’ পত্রিকার মাধ্যমে। ‘কিতাবু ছিয়ানাতুল হাদীছ’ শিরোনামে ব‌ই লিখেন আব্দুর রঊফ ঝান্ডাগড়ী রাহিমাহুল্লাহ। এমনিভাবে ‘মানযিলাতুস সুন্নাহ ফিল ইসলাম’ শিরোনামে ব‌ই লিখেন মুহাম্মাদ ইসমাঈল আস-সালাফী রাহিমাহুল্লাহ। ঠিক তেমনি ‘নুছরাতুল হাদীছ’ নামে বই লিখেন শায়খ হাবীবুর রহমান আযমী রাহিমাহুল্লাহ। এমনিভাবে পরবর্তীতে মুহাম্মাদ ইসমাঈল আস-সালাফী রাহিমাহুল্লাহ প্রতিবাদ এবং প্রত্যুত্তর জানান ‘হুজ্জিয়াতুস সুন্নাহ আন-নাবাবিয়্যাহ’ বই লিখে এবং প্রখ্যাত বিতার্কিক শায়খ আহসান আল-কায়লানী রাহিমাহুল্লাহ লিখেন ‘তাদবীনুল হাদীছ’। এভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের আলেম সম্প্রদায় হাদীছ অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে সর্বদিক থেকে প্রতিবাদ করেন এবং তাদের বাতিল চিন্তা ও মতবাদকে নাস্তানাবুদ করার লক্ষ্যে বক্তব্য, লেখনী ছাড়াও জনসাধারণের মাঝে জনসচেতনতা সৃষ্টি করেন, যাতে কেউ যেন তাদের এই বাতিল আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করে। আধুনিক যুগেও অনেকেই লিখছেন ও বলে যাচ্ছেন।

পরিশেষে বলতে চাই, ভারতীয় উপমহাদেশে আহলে কুরআনের এই মিশন বেশি পুরনো ইতিহাস না হলেও তাদের এই আন্দোলন যে কত সূদূরপ্রসারী এবং আমাদের ইসলাম ও মুসলিম জীবনকে কত যে প্রশ্নবিদ্ধ করছে তা বর্তমান সময়ে সহজেই অনুমেয়। কেননা হাদীছের উপর সংশয় সৃষ্টি মানেই ইসলামী শরীআতের উপর সংশয় সৃষ্টি করা। ফলে খুব সহজেই ইসলামের মূল বৃত্ত থেকে যেকোনো মুসলিমকে সরিয়ে আনা সহজ আর এটাই করে যাচ্ছে হাদীছ অস্বীকারকারীরা। তাই আমাদেরকে এমন লেবাসধারী, নেক ছুরতে আগমনকারী আহলে কুরআন থেকে বেঁচে থাকতে হবে এবং তাদের কথিত যুক্তি, বক্তব্যকে এড়িয়ে চলে কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহর আলোকে জীবন গড়ার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। কেননা ফেতনা এভাবেই এসে আমাদের ঈমানকে চুরি করবে। তাই ফেতনার এই বীভৎস ঘনঘটায় কুরআন, সুন্নাহ আর সালাফদের পদাঙ্ক অনুসরণেই আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত। আল্লাহ আমাদের সঠিকটা বুঝার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

মাযহারুল ইসলাম

 দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা দারুস সুন্নাহ, মিরপুর, ঢাকা; শিক্ষক, হোসেনপুর দারুল হুদা সালাফিয়্যাহ মাদরাসা, খানসামা, দিনাজপুর।

Magazine